বাংলাদেশে মানুষ দুই প্রকার; এক প্রকার শাহবাগে এসেছে, আরেক প্রকার শাহবাগে আসেনি। শাহবাগে যারা এসেছে, তারাই তো উৎকৃষ্ট। নিকৃষ্টদের বিরুদ্ধে উৎকৃষ্টদের আন্দোলনই হচ্ছে শাহবাগের এই আন্দোলন।
নিকৃষ্ট কারা? যারা রাজাকার, তারাই তো নিকৃষ্ট, স্বাভাবিক! নিকৃষ্টদেরও প্রকারভেদ আছে; ১. যারা ৭১-এ সরাসরি যুদ্ধাপরাধ করেছে। ২. যারা এখনো যুদ্ধাপরাধের মানসিকতা লালন করে। ৩. যারা যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতিত্ব করে। তবে এই তিন শ্রেণীকেই আমি ঘৃণা করি। যারা সরাসরি যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের বিচার চাই। যারা এখনো যুদ্ধাপরাধের মানসিকতা লালন করে, তাদেরকে থামিয়ে দিতে চাই এবং তাদের প্রক্রিয়াগুলোকে নিষিদ্ধ করতে চাই। যারা যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতিত্ব করে, তাদেরকে শুধরে যেতে বলি, মানুষ হতে বলি, বলবোই। তবে তাদের পূর্বসূরীদের পরিণাম তাদের সামনে হাজির করে ‘অপরাধ’ বিষয়ে একটি ভীতি সঞ্চার করতে হবে, তাহলে তাদের জন্য শুধরে যাওয়াটা সহজ হবে, এটা বুঝি। কিন্তু এর প্রক্রিয়াটা কী হবে, সেটা ভেবে দেখার অবকাশ আছে, আপাতত শাহবাগ নিয়েই বলাবলি করা যাক।
ঐতিহাসিকভাবে এই দেশে আমরা যে সকল আন্দোলন শুনেছি, দেখেছি, সেসবের মধ্যে সবচে অপাপবিদ্ধ আন্দোলনের নামই হচ্ছে ‘বাংলা বসন্ত’। অপাপবিদ্ধ ও নিষ্পাপ আখ্যাটার পেছনে কারণ আছে- এখানে যারা এসেছেন সশরীরে অথবা মনে মনে, সবার ভেতরেই একটা নিষ্পাপ বোধ কাজ করেছে, অহিংস মগজ কাজ করেছে, গানে-কবিতায়-শ্লোগানে গগনবিদারী প্রতিরোধবিষয়ক ন্যায়বোধ কাজ করেছে। বোধগত উপলব্ধির জায়গায় থেকে যারা যথার্থই অরাজনৈতিক তারা শাহবাগে এসেছে। আবার যারা রাজনৈতিক, তারাও দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে এখানে হাজির হয়েছে। কিন্তু দল ও দলীয় স্বার্থের দাস যারা, দেশের চেয়েও দলকে যারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তারা শাহবাগে আসেনি। ব্যাপার না, শাহবাগের এই ‘বাংলা বসন্ত’ কোনো রাজনৈতিক দলের মুখাপেক্ষি নয়!
প্রশ্ন তো অবশ্যই, কেনো এই বাংলা বসন্ত, কেনোই বা শাহবাগ স্কয়ার? প্রাথমিক উত্তর এটা, ইতিহাসের সবচে নিকৃষ্টতম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ব্যাপারে যে রায় দেয়া হয়েছে, সেটা যথার্থ নয়। শাহবাগের এই আমরা তার মৃত্যুদণ্ডের রায় চাই এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর চাই। সাথে চাই বাকিসব যুদ্ধাপরাধীর যথার্থ রায় ও কার্যকরিতা। কিন্তু কথা হলো, এই দু’চার-দশ জনকে ফাঁসি দিলেই কি লাখো শহীদের রক্তের ঋণ শোধ হয়ে যাবে? যাবে না। কারণ ‘সেই রাজাকার’রা এমন একটি প্রক্রিয়া (জামায়াত) ও প্রজন্ম (শিবির) তৈরি করে ফেলেছে, যেটিকে কখনোই সহ্য করবে না শহীদের রক্ত, শহীদ পরিবার-প্রজন্ম এবং কখনো এটা মানবেই না ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশ।
এই ‘বাংলা বসন্ত’ যতোটা নির্দলীয়, তার চেয়ে বেশি সর্বদলীয় হলেও রাজনৈতিক তৎপরতামুক্ত। শাহবাগের আন্দোলনে রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য নেই, রাজনৈতিক কোনো ব্যানার নেই, শ্লোগান নেই; আছে শুধু দেশটাকে, এই বাংলাদেশটাকে নিষ্কলুষ করার প্রত্যয়ধ্বনি। থরে থরে ছড়িয়ে পড়েছে শব্দেরা। একার শব্দ নয়, দুইয়ের শব্দ নয়, তিনেরও নয়- সম্মিলিত উচ্চারণ সবখানে। মোম আর মশালের আগুনের সাথে মিলিয়ে গিয়ে ধ্বনিরা কুণ্ডুলি পাঁকিয়ে ছুয়ে যাচ্ছে আকাশ। কারো মাঝেই কোনো মোহ নেই, স্বার্থ নেই, স্বার্থবাজীও নেই, নেতাগিরি নেই। চূড়ান্তভাবে সবার ভেতরে একটিমাত্র চাওয়াই কাজ করছে- রাজাকারদের সমাপ্তি, রাজাকারির সমাপ্তি। সর্বোপরি রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ।
কিন্তু যে সময়টাতে এই বাংলা বসন্তের অভ্যুদয় সূচিত হয়েছে, সেই সময়টাকে কোনোভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনো ‘মখমল-রঙিন দিন’ বলা যায় না। অনেক সঙ্কটের ভেতর দিয়ে একটি বিস্ফোরণের মতো সময় বলা যেতে পারে। ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীরা পরস্পরে প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে নেই। অপ্রীতিকর এই রেশ সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে, জনগণ ভীতিকর অবস্থায় দিনাতিপাত করছে, আছে ভয়-সংঘাত অত্যাসন্ন। জনগণের দায় পাশ কাটিয়ে একে অপরকে দোষারুপ করছে, কথায় কথকতায় আক্রমণ করছে। ক্রমশই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। ঠিক এই সময়টাতেই বাংলা বসন্তের সূচনাটা যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়কে অতিক্রম করে অনেকগুলো সিদ্ধান্তকে সামনে নিয়ে এসেছে। সর্বতোভাবে, রাজনৈতিক সংস্কারকে স্বাগত জানানোর বীজ ফলিত হচ্ছে।
তবে শাহবাগের এই আন্দোলন সেই বীজটাকে আপাতত প্রশ্রয় দিতে চাইছে না। রাজাকার ও রাজাকারি তৎপরতার সমাপ্তি ঘটানোর পরিপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের আশ্বাস পেলেই হয়তো আমাদের ঘরে ফেরা সম্ভব। কিন্তু ঘরে ফেরাই মানে শাহবাগ ছেড়ে দেয়া নয়, ভুলে যাওয়া নয়, যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেই আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠবে শাহবাগ, উত্তাপ ছড়িয়ে পরবে সর্বত্র। বেশ কয়েকদিন তো হলো, কবে সরকার ব্যবস্থা নেবে? অচিরেই হয়তো নেবে! তবে এটাও আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে- সকল যুদ্ধাপরাধীর সমাপ্তির রায়-পরবর্তী জামায়াত-শিবিরের হিংস্রতাকে কতোটা সামাল দেয়া যাবে, সেই প্রচ্ছন্ন শক্তিধর অবস্থান কি ক্ষমতাসীনদের আছে! যদি থেকে থাকে, তবে ভালো। আর যদি এমন সৎ-সাহস, সামর্থ ও শক্তিমত্তা সরকারের না থাকে, সে ক্ষেত্রে সরকারকেই পথ খুঁজে বের করতে হবে অথবা নতুন পথ নির্মাণ করে অগ্রসর হতে হবে। সরকারের তৎপরতার নেতি-ইতি বিবেচনা করেই বাংলা বসন্তের গতিপ্রকৃতি-বিষয়ে ভাববে অ্যাক্টিভিস্টরা এবং সেটা শাহবাগে বসেই।
জন্মগতাভাবেই জামায়াত-শিবির জঙ্গিবাদী দল। খুন-খারাবি ও রগ কাটাকাটি তাদের স্বাভাবিক ভাষা। কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের দিন ঘোষণা হওয়ামাত্রই টানা দুইদিন হরতাল ডেকে বসে তারা। আর সকল যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হলে তাদের পদক্ষেপ কী হবে, কেমন হিংস্র ও ভয়ঙ্কর হবে, সহজেই অনুমেয়। এখন এই বিষয়ে অনুমান ও বাস্তবতার নিরিখে রাষ্ট্রপক্ষের উচিৎ নিজেদের শক্তিমত্তার জায়গাগুলো পরখ করে নেয়া। তবে তাদেরকে হিসাব মিলাতে হবে এ কথা মাথায় রেখে যে ‘সকল যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের কার্যকর প্রতিশ্রুতি না পেলে কিন্তু আমরা শাহবাগ ছাড়ছি না’। আবার এটাও মনে করিয়ে দেই- আমরা যে শাহবাগে আছি সেটাই একমাত্র শাহবাগ নয়, শাহবাগ গড়ে উঠেছে ঘরে ঘরে, শহরে-অন্তরে। শাহবাগ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে, পৃথিবীময়।
অবধারিত ও অলঙ্ঘণীয় আশ্বাসে আমরা ফিরে গেলেও আমাদের বিশ্বাস, এই শাহবাগ আন্দোলন সকল রাজনৈতিক দলবদ্ধতার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে দলীয় কঠোরপন্থা, হেয়ালিপনায় ও অসৎ রাজনৈতিক অভিলাসে। সকল রাজনৈতিক দলই দীর্ঘকাল এর দ্বারা ভীতি ও সাবধানতা অনুভব করবে। জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসরেরাও ঘরকুণো হয়ে যাবে, তাদের সামাজিক মুখোশ খসে পড়বে। সকল মতের এমন অ-রাজনৈতিক নিস্বার্থ সম্মিলন এ দেশের গণতান্ত্রিক পথচলায় আর দেখা যায়নি। কারণ, নষ্টদের অধিকারটাই যেন আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল, দেশমাতৃকতার ব্যাপারে কেমন এক উদাসীনতা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমাদের। কিন্তু এখন সব কেটে গেছে, প্রতিরোধের অহিংস দীক্ষাটা আমরা রপ্ত করে ফেলেছি। এবং আরও অনেক অনেক, আমাদের জন্য যেন অনেক বরাভয় ও বারতা নিয়ে এসেছে এই ‘বাংলা বসন্ত’।
বাংলামেইলটোয়েন্টিফোর-এ প্রকাশিত

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



