somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুশোচনার কান্না।

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।
আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটির নাম ছিল ইসমাঈল। সদ্য এস,এস,সি পাশ করা ছেলেরা স্কুলের বাধা ধরা জীবন থেকে কলেজ লাইফের হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতায় কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ইসমাঈল ছিলো দিশেহারাদের সর্দার টাইপের কিছু একটা।

নিরস দুপুরে আমরা যখন ক্লাসে স্যারের লেকচার শোনায় মনোযোগী থাকতাম তখন তাকে পাওয়া যেত প্রশাসনিক ভবনের অদুরে গাছের নিচে হাফ ডজন মেয়েবন্ধুর সাথে আড্ডারত অবস্থায়।

পড়াশোনায় মোটেও তার মনোযোগ ছিলোনা, কখনও কলেজে অনুপস্থিত থেকেছে এমনটা ঘটে নি, তবে ক্লাসে উপস্থিত থেকেছে এমনটা কালে ভদ্রে ঘটতো।

দেখতে সুন্দর স্মার্ট বলে মেয়েদের মাঝে তাকে নিয়ে আলাদা আগ্রহ ছিলো। কোন আসর জমিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে সে সত্যিকার অর্থেই পারদর্শি ছিলো।


ইসমাঈলের সাথে আমার কখনও কথা হয় নি। সে তার মত ব্যাস্ত ছিলো আমি আমার মত। তবে মনে মনে আমি তাকে চরম হিংসা করতাম, কেন আমি তার মত না এমন কথা অসংখ্যবার ভেবে বিধাতাকে অভিষাপ দিয়েছি।

২।
ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষায় প্রথম হয়ে সবার সাথে সাথে ইসমাঈলের মনোযোগ আকর্ষন করতে সক্ষম হলাম (হলফ করে বলতে পারি এর পূর্বে সে আমাকে কোন দিন লক্ষ্যও করেনি)।

পরিক্ষার খারাপ ফলাফল তার ভেতরে একটা পরিবর্তন এনে দিল। বন্ধু আড্ডা কমিয়ে ক্লাসের দিকে মনোযোগী হতে আরম্ভ করলো। সাজেসন্স কিংবা পড়াশোনার বিষয়ে দু-একটা কথা বলতে বলতে আমরা একসময় ভালো বন্ধুতে পরিনত হলাম।

দিন গুলো এভাবেই কেটে যেতে পারতো যদি না ফাস্ট ইয়ারে সদ্য ভর্তি হওয়া একটি মেয়ে ইসমাঈলের আকর্ষেনর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হতো।

মেয়েটির নাম "বন্যা" অসাধারণ সুন্দর মেয়েটির রুপের বন্যায় ইসমাঈল প্রায় ভেসে যায় আর কি।

নিজের ক্লাস বাদ দিয়ে ফাস্ট ইয়ারে ক্লাস করে।
বন্যার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া, পড়াশোনা বন্ধ। সাহস করে ভালোলাগার কথাটা সে কোন ভাবেই বলতে পারছে না। যে ছেলের কাজ ছিলো ৪/৫ টা মেয়ে নিয়ে আড্ডা দেয়া সে আজ একটা মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে সাহস পাচ্ছে না ভাবা যায়!

বন্ধু হিসেবে বন্ধুর এহেন বিপদে পাশে দাড়ানো কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যা থাকে কপালে ওর হয়ে আমি কথা বললাম মেয়েটার সাথে।

প্রায় ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে কথা বলে অনেক অনুনয় বিনয় করেও বন্যাকে রাজি করাতে পারলাম না, কোন মতেই সে সেইম এজের একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করবে না। ব্যাপার টা আমার কাছেও যৌক্তিক মনে হলো। অল্প বয়সের এই আবেগ শেষ পর্যন্ত ভালো কিছু বয়ে আনেনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।

তবে বন্যার কথাগুলো আমি মেনে নিলেও ইসমাঈল সেটা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারলো না।

প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে সে নিজেই কথা বললো বন্যার সাথে, লাভ হলোনা তাতেও, মেয়েটা তার কথাতে অনড়।

আমাদের সমাজে এই বিষয়টি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে এবং এখনও বিদ্যমান " কোন মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে সে পরিনত হয় মহা শত্রুতে,কোন না কোন ভাবে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়"।

দিন দুয়েক কলেজে অনুপস্থিত থেকে এক সকালে বেশ আগে ভাগে কলেজে এলো ইসমাঈল। মেস কলেজের পাশে হওয়াতে আমি প্রায়শই সবার আগে পৌছতাম।
ক্লাসরুমের অদুরে একটা টিনশেড ঘরছিলো যেটাতে আমরা টি টি খেলতাম সেখানে যেয়ে বসলাম দু'জন।

হাত থেকে ব্যাগটা রেখে চাপাস্বরে ইসমইল বলল " শালীকে আজ একটা উচিত শিক্ষা দেব, আজীবন আমার নাম মনে রাখবে"।
ওর কন্ঠস্বর এতটা ভয়ানক ছিলো যে ভয়ে কেপে উঠলাম।

প্রশ্ন করলাম-

"কি করতে চাস"?

ক্রুর হেসে সে ব্যাগের পকেট থেকে যা বর করলো তা দেখে আমার ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেল।

সে সময়ে গ্রাম অঞ্চলে এখনকার মত বিদ্যুত ছিলোনা, টিভি কিংবা ক্যাসেট চালাতে ব্যাটারি ছিলো ভরসা। হাটে, বাজারে যেখানে বিদ্যুত ছিলো সেখানেই ব্যাটারি চার্যের দোকান ছিলো, সেসব দোকানিরা সালফিউরিক এসিড ব্যাটারির কাচামাল হিসেবে রাখত। কোন এক দোকান থেকে এক বোতল এসিড যোগাড় করে ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে ভালোবাসার মানুষটার কাছে নিজের নাম চিরস্মরনিয় করে রাখতে। কি ভয়ংকর চিন্তা।

আমি তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক ওকে এই কাজ আমি করতে দিবো না। মেয়েটার ইসমাঈলের দু'জনের জীবনই নষ্ট হবে এটা ঘটলে। একজন থাকবে হাসপাতেলে অন্যজন হাজতে অথবা পলাতক।

আমাকে দেখানোর পরে ওর হাতেই ছিলো বোতলটা, ঘটনা কিভাবে ঘটাবে তার বর্ণনা দেয়ার যখন ব্যাস্ত এই ফাঁকে খপ করে বোতলটা ছিনিয়ে নিতে গেলাম।

হোমিওপ্যাথের শিশির থেকে একটু ব্ড় সাইজের বোতলটা আমার হাতে চলে এল কিন্তু সেখান থেকে সেটি নেবার জন্য চরম চরম জোরাজুরি আরম্ভ করলো ইসমাঈল। জোরাজুরি টা একজনের বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হতে পারতো কিন্ত এমনটা ঘটলো না। অব্যাহত বল প্রয়োগে এক পর্যায়ে বোতলের মুখ খুলে বেশ কিছু তরল আমার ডান হাতের কব্জির ইঞ্চিখানেক উপরে ছড়িয়ে পড়লো।

ইসমাঈলের মধ্যে মনুষত্য দ্রুতই ফিরে আসলো, ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে সাথে সাথেই আক্রান্ত অংশ ধুয়ে দিলো, কলপাড়ে গিয়ে অনেক সময় ধরে পানি ঢেলেও শেষ রক্ষা হলো না।

অবর্ণনীয় সেই যন্ত্রনার কথা লিখতে গেলে পোস্ট অনেক বড় হয়ে যাবে। এক যুগের ও বেশি সময় ধরে সেই চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। লং স্লিভ শার্ট ছাড়া বাইরে বের হতে পারি না আজ অবধি।


ইসমাঈলের সাথে আমার বন্ধুত্ব আগের মতই ছিলো, এখনও আছে, তবে ওই ঘটনার পরে তার মুখে আর কোনদিন বন্যার নাম শুনি নি। বউ, বাচ্চা নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে। প্রায়শই বাসায় আসে।



চিকিৎসা চলাকালিন সময়ে সে যেভাবে আমার সেবা করেছে ক্ষমা তার প্রাপ্য।

হাতটি ধরে অঝোরে কেদেছে কত দিন। আমি শুধু হাসতাম কারণ ওর এই কান্নার থেকে আমার এক বোনের কান্না অনেক বেশি কষ্ট দিত আমাকে, আমার কিছুটা কষ্টের বিনিময়ে তার সুন্দর জীবন তো আর কষ্ট ময় হয়ে যাই নি ।


আর জেলে বসে অনুশোচনার কান্না কাদতে দেখার চেয়ে প্রিয় বন্ধু হাত ধরে সামনে বসে কাদছে এই দৃশ্য খুব একটা খারাপ লাগতো না আমার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:৪৫
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×