somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ পার্থক্য

০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল রাসেলের । অন্যান্য দিনের মতই । পাখির ডাকটা আসল না অবশ্য । যান্ত্রিক এই নগরীর মতই একটা যন্ত্রের ফল । ঘড়ির এলার্ম


রাসেল উঠে বসে । শীতকাল আসি আসি করছে । এয়ারকুলারে ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস দেখাচ্ছে । বেশ আরামদায়ক তাপমাত্রা । প্রযুক্তির কল্যাণে কত কিছু বশে এনে ফেলা যাচ্ছে !

রাসেলের কলেজ বন্ধ । ঈদের ছুটি চলছে । ধীরে সুস্থে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে চলে যায় সে । ওর বাবা-মা সেখানে আছেন । দুটো কাজের মেয়ে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে । মাঝে মাঝে মা হাত লাগাচ্ছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন ।

রাসেলের বাবা আবিদ আহমেদ । পেশায় ব্যাংকার । সরকারী চাকুরীজীবী । এই চাকরিতে আছেন গত উনিশ বছর ধরে । যথেষ্ট পরিমাণে বিত্তবান তিনি । কোনোরকম পৈতৃক সম্পত্তির জোর ছাড়াই, শুধুমাত্র নিজের প্রচেষ্টায় ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে ,গাড়ি কিনে সহকর্মীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন । অবশ্য একজন সরকারী চাকুরীজীবী ব্যাংকার ঠিক কি রকম ‘প্রচেষ্টা’র জোরে এই অবস্থানে উঠে এসেছেন, তা তার স্ত্রী,পুত্র কেউ জানে না । জানতেও চায় না । যেমন আছে, সেটাকেই ঠিক বলে মেনে চলেছে । যুক্তিখণ্ডন করতে
চায় নি কখনো ।

রাসেলের মা রাজিয়া আহমেদ । উনিও চাকরি করেন । বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে ভালো অবস্থানে আছেন । তাদের একমাত্র ছেলে রাসেল । এবছরই কলেজে ভর্তি হয়েছে ।
- তুমি কি অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবে দুদিনের জন্য ?
- কি কারণ ?
- কি কারণ মানে ! রাসেলের কলেজ বন্ধ । ওকে একটু ঠিকমত দেখে রাখা কি উচিত না ? একা একা থাকে । এতোটা সময় কাটাতে বোর হয় নিশ্চয়ই !
- তাহলে তো আমাকে ছুটি নিতে না বলে তোমারই ছুটি নেয়া উচিত । তুমি মা । মা’রাই তো সন্তানদের বেশী দেখভাল করে রাখতে পারে । ...আর তাছাড়া, ক’দিন পরই ঈদের ছুটি আসছে । এসময় ছুটি দিবে না ।
- তোমাকে বলছি , কারণ তোমার ছেলে আমার চেয়ে তোমার সঙ্গই বেশী পছন্দ করে । আর মা হয়েছি বলে ছেলের সব কাজ শুধু আমিই করব, এ কেমন কথা !

রাসেল এতক্ষণে মুখ খুলল, “ওয়েল, ইটজ এনাফ । আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ । আমার জন্য তোমাদের মাথাব্যথা করা লাগবে না । ...সাড়ে দশটার দিকে আমার বন্ধুরা আসবে । আমি ওদের সাথে ঘুরতে যাবো । এট লিস্ট গাড়িটা লাগবে ।”
রাসেলের বাবা,মা দুজনেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন ওর কথায় । আবিদ সাহেব বলেন, “আমি অফিসে পৌঁছেই গাড়িটা পাঠিয়ে দিব ।”

রাসেল চুপ করে খেতে খেতে ভাবতে থাকে কি করা যায় । ইনডোর গেমসে বিরক্তি এসে গেছে । নেটে বসেও মজা নাই । সবাই খালি জ্ঞান দেয় । এইতো রোজার ঈদের কয়েকদিন আগে ফেসবুকে এক সিনিয়র ভাইকে রাসেল অনুরোধ করছিল যে, তাদের যে গ্রুপটা আছে সে গ্রুপের সব মেম্বাররা মিলে যাতে একটা গেট টুগেদার পার্টি এরেঞ্জ করে । একটা ‘ইফতার পার্টি’ দেয় । আর সেই ভাইটি তাকে ইচ্ছামত জ্ঞান দিয়ে গেল । বলে কি না, যে টাকা দিয়ে ওরা নিজেরা খাবে, সেই টাকা দিয়ে যদি গরিব বাচ্চা-কাচ্চাদের জামা-কাপড় কিনে দেয়া বা ওদের ইফতার খাওয়ানো যায়, সেটা নাকি বেশি ভাল হবে । হ্যাহ ! শখ কত ! ঐসব নোংরা নোংরা বাচ্চাকাচ্চাদের পয়সা খরচ করে খাওয়াতে যাবে । রাগের মাথায় প্রায় বলেই ফেলেছিল যে, নিজের মুরোদ থাকলে নিজেই খাওয়াক । অন্যদের এতো জ্ঞান দেয়া লাগবে না । রাসেল যেন কিছুই বুঝে না । সব বুঝে । এগুলো সব শো অফ করা । নাথিং মোর দ্যান দিস । শো অফ যদি করতেই হয়, তাহলে গার্ল ফ্রেন্ডের সামনে করলেই হয় । যতসব মিনিংলেস কাজকর্ম ।


ভেবেচিন্তে ফ্যন্টাসী কিংডম বা ওয়াটার কিংডমে যাবে বলে ভাবল ।
রাসেলের বাবা বেরিয়ে যাচ্ছেন ।
- ড্যাড । ...ক্যাশ লাগবে কিছু ।
- কত ?
- এবাউট টেন থাউজেন্ড ।
- ড্রয়ার থেকে নিয়ে নিও ।
- একটা ক্রেডিট কার্ড করিয়ে দিলে কি ক্ষতি হত ! বারবার টাকা খোঁজাটা বিরক্তিকর একটা কাজ ড্যাড ।
- ইউ আর স্টিল আন্ডার এইটিন । নেক্সট ইয়ারে পাবে । আর কিছু ?
- না...
আবিদ সাহেব বেরিয়ে গেলেন । রাজিয়া আহমেদও একটু পর বেরিয়ে গেলেন । দু’জনের দুই আলাদা গাড়ি নিয়ে ।
আইফোনটা হাতে নিয়ে ফ্রেন্ডদের ফোন করতে বসে গেল রাসেল ।


শুভ চোখ মেলেই প্রথম যে ব্যাপারটা লক্ষ করল, সেটা হল, ফ্যানটা থেমে আছে । লোডশেডিং । “শালার সরকার” বলতে বলতে নাকের ঘাম মুছে উঠে বসে সে । পাশে ভাইয়া এখনো ঘুমাচ্ছে । গায়ে কাঁথা । ভোরবেলার দিকে একটু ঠাণ্ডা পরে । তাতেই ওর কাঁথা গায়ে দিয়ে শুতে হয় । শুভ ভাবে, তার এরকম গরম সহ্য করার ক্ষমতার দরকার ছিল ।

এখন না হয় কলেজ বন্ধ । কয়েকদিন পর টার্ম পরীক্ষা । সেগুলোতে ভালো করতে হবে । আর পরীক্ষার সময় যদি লোডশেডিং থাকে এতো, তাহলে পড়বে কিভাবে, পরীক্ষায় ভালো করবে কিভাবে, সেটা সে বুঝতে পারে না । শুভ ওর আব্বাকে এই কারণে একবার বলেছিল, একটা আই পি এস কিনে দিতে । ওর আব্বা এই কথা শুনে খেঁকিয়ে উঠে বলেছিলেন, “সারা বছর বন্ধু-বান্ধব নিয়া ঘুরবা, মোবাইল টিপবা আর পরীক্ষার আগের রাত আসলে সব পড়া বাইর হয়, না ? আবার আই পি এস লাগব উনার ! এরপর বলিস গ্রামের ভিটা-বাড়ি বিক্রি কইরা আপনের জন্য রাজার হালে থাকার ব্যবস্থা করি । যা, পড়তে বস ।”

শুভ সে কথা মনে করে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে । রাসেল,সজীব,রোহানরা অনেক টাকা এমনি এমনি উড়ায় । ও তো অতটা চায় নি । যতটুকু দরকার, শুধু ততটুকুই । এটা কি খুব বেশী ? কেন ওর বাবা এতোটুকুও দিতে পারে না ?

অবশ্য ওর ঠিক কতটুকু দরকার সেটা সে নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না । মানুষের চাওয়ারও তো শেষ নেই । এসব কথা শুভ জানে ঠিকই । কিন্তু ওর নিজের ভেতরের যে লোভী মানুষটা, সে মানতে পারে না । সে আরও চায়...আরও চায় ।

শুভ হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আম্মার কাজকর্ম দেখে । এইটুকু রান্নাঘরের মধ্যেই কোনোমতে একটু জায়গা বের করে নিয়ে, সেখানে বসে রুটি বেলছেন । শুভকে দেখে বললেন,
- অভি উঠছে ঘুম থেকে ?
- নাহ ।
- ওকে ডাক । বেলা কত হইছে , সেইদিকে তো খেয়াল রাখে না । আর তুই তো আজকেও ফজরের নামাজটা পড়লি না ।
শুভ কিছু বলে না । মুচকি হাসে । আম্মার এই রাগ দেখানো ভঙ্গি দেখতে ওর খুব ভালো লাগে । আম্মা হঠাৎ গলা নামিয়ে বলেন, “তোর আব্বা এগুলা কি শুরু করছে বলতো...”
“আবার কি করলো !”
“অভি কে নাকি দুবাই বা কুয়েতে পাঠায়া দিবে । চিন্তা কর । ও এম্নিতেই এতো রোগা । ওকে ঐসব দেশে পাঠালে তো না খেয়ে মরবে ।”
“ভাইয়া না কি একটা দোকান দিবে বলছিল । বিদেশে যাওয়ার টাকাটা ওর ব্যবসার ক্যাপিটাল হিসেবে দিলেই তো হয় ।”
“আমিও তো সেটাই বলি । কিন্তু তোর বাপকে কে বুঝাবে ! তার সেই এক কথা, দোকানদারদের নাকি কোন সম্মান থাকে না । বিদেশে গিয়ে রাস্তায় ঝাড়ু দিবে, সেইটা খুব সম্মানের কাজ ।” মুখ ঝামটা দিলেন তিনি ।
শুভ হেসে ফেলল ওর আম্মার কথা বলার ভঙ্গি দেখে । “এই কথাগুলা আব্বাকে বললেই তো পার ।”
“তোর বাপ আমার কথায় কোন মূল্য দেয় ? উনার কাছে তো আমি একটা কাজের বেটি । সারাদিন কাজ কর, বেতন হিসেবে খাও,ঘুমাও । আমার কথার তো কোনই দাম নাই ।”
শুভ চুপ মেরে গেল । আম্মা খুব একটা ভুল বলেন নাই । ওর আব্বা সত্যিই পরিবারের কারো কথায় কোন দাম দেন না । নিজের কাছে যেটা ভালো মনে হয়, সেটাই করেন । এই পরিবারের একনায়ক যেন !

শুভ ওর অভি ভাইয়াকে ধাক্কা মেরে উঠাতে চাইল । কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাইয়ার । সহজে উঠতে চায় না । এমন সময়ই ফোন আসল শুভ’র মোবাইলে । রাসেল ফোন করেছে ।
- শুভ, সাড়ে দশটার মধ্যে চলে আসিস আমাদের বাসায় । ঘুরব আজকে । বাকিরাও আসবে ।
শুভ কিছুক্ষণ ভাবল, যাবে কি যাবে না । ওদের সাথে বেরুতে গেলে খাওয়া-দাওয়া করেই আসতে হবে । খাবার-দাবারের বিল অবশ্য ওকে দিতে হবে না । রাসেল
যেহেতু সবাইকে ফোন দিয়ে বলছে, তাহলে ও-ই সব খরচ দিবে । তবুও একটা অস্বস্তি মনের মধ্যে খচখচ করে শুভ’র । নিজেকে খুব নিচ,ছোট মনে হয় সে সময় । তবু বলল, “আচ্ছা দেখি, আসতে পারি কি না ।”
“দেখি-টেখি বুঝি না । ইউ মাস্ট হ্যাভ টু কাম । রাখলাম ।”


শুভ মোবাইল রেখে ভাবতে বসল, কি ঝামেলায় পড়া গেল !



ঈদ উপলক্ষে যাত্রীবাহী একটা ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়ে গেল এইমাত্র । প্রথমে আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর গতি বাড়িয়ে তুমুল বেগে যেতে থাকল । ট্রেনের ছাদে উঠা মানুষজন চিৎকার করে তাদের আনন্দোভাব প্রকাশ করছে । স্বজনদের সাথে একসাথে ঈদ করার আনন্দই আলাদা !

জাহাঙ্গীরের ঘুম ভাঙ্গে ট্রেনের শব্দে । ট্রেনটা যখন ওদের ছাপরা ঘরের পাশ দিয়ে যায়, পুরো ঘরটাই কেঁপে উঠে । জাহাঙ্গীর উঠে বসে হাই তুলতে থাকে । শীত শীত লাগছে । ভোরবেলাতেই উঠে পড়লো নাকি ?

ভালোমতো চোখ মুদে ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখে আলমগির মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে । মুখ দিয়ে লালা পড়ছে ওর । ছোট বোন বিন্তি গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে এক কোণে । বেশি শীত লাগছে নাকি বিন্তির ? জাহাঙ্গীর ওর ছেঁড়া চাদরটা বিন্তির গায়ের উপর দিয়ে দিল । মা নেই ঘরে । এতো সকালে কোথায় গেল ? ভাবতে ভাবতে হাই তুলে বাইরে বের হল জাহাঙ্গীর । ট্রেনটা মালিবাগ রেল গেইটের কাছাকাছি চলে গেছে । বিকট শব্দে সাইরেন বাজছে ।

জাহাঙ্গীর দাঁত মাজার কালি হাতে নিয়ে আঙুল দিয়ে কালি নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পানির কলের কাছে যেতে থাকল । গিয়ে দেখে ওর মা পানি ভরছেন কলসিতে । সাথে আরও তিনটা পাঁচ লিটারের প্লাস্টিকের বোতল । বেশী সকাল দেখে এখনও ভীড় শুরু হয় নাই পানি নেয়ার জন্য । মা হয়তো এই কারণেই এতো সকাল সকাল পানি নিতে উঠে এসেছেন । জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি দাঁত মেজে ওর মা’কে সাহায্য করে পানি ভরিয়ে সেগুলো নিয়ে আসতে ।

জাহাঙ্গীর বোতলগুলো নেয় আর ওর মা নেয় কলসিটা । লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের ঘরটার দিকে যেতে থাকে জাহাঙ্গীর । কিছু দূর গিয়ে পিছনে ফিরে দেখে ওর মা এখনো ছোট ছোট পা ফেলে আসছেন । ভর রাখতে পারছেন না ঠিকমত । জাহাঙ্গীর ওর হাতের প্লাস্টিকের বোতলগুলো রেখে দৌড়ে মায়ের কাছে যায় । তাঁকে দাঁড়াতে সাহায্য করে ।
- মাথাডা বিষ করতাছে ।
- কামে যাইয়ো না আইজকা ।
- কামে না গেলে বেতন কাইট্টা রাখব । খাবি কি ?

জাহাঙ্গীর কিছু বলে না । পৃথিবীর সব মানুষই তাদের কাজের জন্য সাপ্তাহিক ছুটি পায় । পায় না শুধু ওর মা এর মত মহিলারা, যারা বাসাবাড়িতে ঝি-গিরি করেন আর সে নিজে, যে বাসাবাড়িতে ঘুরে ঘুরে ময়লা-আবর্জনা নিয়ে দূরের বড় কোন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে ।

ছাপরা ঘরটাতে ঢুকে দেখে আলমগির ওর বোধশক্তিহীন শুকনো পা এর উপর দলাই মলাই করছে । জাহাঙ্গীর-আলমগীরের মা ঘরে ঢুকেই কষিয়ে থাপ্পড় বসান আলমগীরের গালে । বিশাল চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় আলমগির । জাহাঙ্গীর বিরক্তির সাথে ওর মা’কে বলে, “এই সক্কাল বেলা ওরে মারার কি এমন দরকারডা আসিলো ?”

“হারামজাদা পুলা... এইডারে আমি প্যাডে নিয়া পাপ করছিলাম । তুই জানস, অয় নাকি ভিক্ষা কইরা বেড়ায় । সুর কইরা কাইন্দা কয়,আমি দুই দিন ধইরা কিছু খাই না । ঐ...ঐ...হারামজাদা... এতো কষ্ট কইরা কাম করি কি তোগো ভিক্ষা করানের লাইগ্যা ? তোরে না খাওয়াইয়া রাখি আমি ? লেহাপড়া করস না ক্যান তুই ? ভিক্ষা কইরা কি মজা পাস ?” ওদের মা এসব কথা বলতে বলতে একনাগাড়ে আলমগীরের মুখে চড় মেরে যান ।

“আমার পা নষ্ট । আমার লাহান পুলাগোরে বেশী ভিক্ষা দেয় মাইনষে ।”

“তোর একডা পা নষ্ট হইলেই তোরে ভিক্ষা করা লাগব ? দুনিয়া ভইর্যাভ আল্লায় কি কোন এক পা ওয়ালা মানুষ পাডায় নাই ? হগলে কি তোর মত ভিক্ষা করে ?”

“হেগোর মায় মাইনষের বাসাত কাম কইরা বেড়ায় না ।”

এইবার আর সহ্য করতে পারলেন না জাহাঙ্গীরের মা । দমাদম কিল-ঘুষি-লাথি মেরে নিজেই কাঁদতে বসলেন ।

জাহাঙ্গীর চুপচাপ থেকে মা কে শান্ত হতে দিল । ওর মায়ের কষ্ট সে টের পায় । ওদের তিন ভাই,বোনকে রেখে ওদের বাবা পালিয়ে গিয়েছে । হয়তো এতদিনে আরেকটা বিয়েও করে ফেলেছে । সে সময় বিন্তির বয়স ছিল মাত্র চার মাস ।

সেই অবস্থা থেকে ওদের মা তাদের দেখাশোনা করে আসছেন । মানুষজনের গালি-গালাজ খেয়ে, লোভী দৃষ্টি এড়িয়ে তিনি ছেলেমেয়েকে লালনপালন করছেন । কখনও ভিক্ষার থলি হাতে নেন নি । টোকাই হয়েছেন, ইট ভেঙ্গেছেন, ময়লা পরিষ্কার করেছেন । এরপর গত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বাসা-বাড়িতে কাজ করে উপার্জন করছেন । জাহাঙ্গীরকে প্রাইমারী স্কুলে দিয়েছিলেন । টাকার অভাবে আর হাই স্কুলে পড়াতে পারেন নাই । পোলিওর কারণে আলমগীরের একটা পা নষ্ট হয়ে গেছে । কিন্তু তারপরও ওর মায়ের ইচ্ছা আলমগির পড়ুক, শিখুক, জানুক । কিন্তু সেসব না করে যখন মানুষজনের কাছ থেকে শুনতে হয় যে, ছেলে ভিক্ষা করছে তখন সেটা আর সহ্য হয় না তাঁর কাছে ।

জাহাঙ্গীর এসব বুঝে...খুব ভালোভাবেই বুঝে । তার বয়স ষোল ছেড়ে এখন সতেরতে পড়েছে । অনেক বয়স । পরিবারের দায়-দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে এখনই । জাহাঙ্গীর ময়লা নেয়ার কাজটা পেয়েছে মাত্র এক মাস আগে । এর আগে সে ছিল টোকাই । পুরানো প্লাস্টিকের বোতলসহ অন্যান্য জিনিস বিক্রি করে ভালোই চলত । কিন্তু খুব একটা আয় ছিল না । এখন যে কাজটা পেয়েছে, সেটা পৌরসভার । মাস শেষে নির্দিষ্ট অংকের টাকা সে পাবেই, এটা ভেবেই সে এ কাজ নিয়েছে । ময়লার গন্ধ প্রথমে বেশ অসহ্য লাগলেও, আস্তে আস্তে অভ্যাস করে নিয়েছে সে । পেট তো চালাতে হবে !

জাহাঙ্গীর এবার বেতন পেয়ে নতুন একটা ঘরের খোঁজ করবে । টাকা জমিয়ে ভালো কোন ব্যবসার ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখবে । সামনে ঈদ আসছে । বখশিশের টাকা দিয়ে ও এবার সেমাই কিনবে । বিন্তির জন্য নতুন জামা কিনবে । রোজার ঈদে বিন্তিকে কিছু দিতে পারেনি মা । ও সেটা পারবে...এসব ভেবেই মন খুশি হয়ে যায় জাহাঙ্গীরের । নতুন একটা দিন শুরু করার অনুপ্রেরণা পায় সে এভাবেই ।





রাসেলের প্রাইভেট কারে বসে যাচ্ছে ওরা পাঁচ বন্ধু । রাসেল,রোহান,সজীব,সৌরভ আর শুভ । সামনের সিটে সজীব আর সৌরভ চাপাচাপি করে বসেছে । শুভ চেয়েছিল ঐ সিটে বসতে । রাসেল,রোহানরা যদিও ওর বন্ধুই । তবুও ওদের সাথে ওর অনেক পার্থক্য । ওদের সাথে আড্ডা দেয়ার চেয়ে সামনের সিটে চাপাচাপি করে বসা অনেক ভালো । কিন্তু রাসেলই কেন যেন ওকে পিছনের সিটে ওদের সাথে বসতে বলেছে ।

রাসেল, শুভর ভয় পাওয়া দৃষ্টি দেখে বেশ মজা পাচ্ছে । ওকে পরে খেলানো যাবে । রোহান আর রাসেল নিজেদের মধ্যে আলাপে মজে উঠল । রোহান নতুন হেয়ার-স্টাইল করিয়েছে । মাথার দুদিকে দুটো করে স্ট্রেট লাইন । এটা নাকি আজকাল খুব চলছে । শুধু এই হেয়ার-কাট দিতেই সাড়ে নয়শ টাকা লেগেছে ওর ।

শুভ গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হচ্ছে এই ভেবে যে, এই দেশে এতো ফ্যাশন,স্টাইলের পিছনে এত টাকা মানুষ খরচ করে কিভাবে ? সমাজের একদল লোক প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে কেবল নূন্যতম মৌলিক অধিকারটুকু পাওয়ার জন্য । আর আরেকদল লোক সেইসব মানুষদের ভোগ করে যাচ্ছে । গরিবরা আরও গরীব হচ্ছে , ধনীরা আরও ধনী । আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, এই এতো বড় বৈষম্যের ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা কেউ ভাবছে না । আর যদি কেউ ভাবা শুরু করে তাহলে তার আশেপাশের মানুষেরা এইসব ব্যাপার নিয়ে এতো বেশী বেশী হাসাহাসি,তিরস্কার করা শুরু করে যে, সেই মানুষটি তার সেই ভালো উদ্যোগটির কথা ভুলে যেতে বাধ্য হয় । নিজের মধ্যের পশুটা জেগে উঠে, ভালো মানুষটাকে দমিয়ে রাখে ।


গাড়ি এখন লম্বা জ্যামে পরেছে । জানালায় টুকটুক শব্দ শুনে শুভ কাঁচ নামিয়ে দেয় ।

- ভাইয়া গো, আমার একটা পা নাই । অনেক কষ্টে চলি ভাই । কিছু সাহায্য করেন ভাই ।

এসি গাড়িতে কাঁচ নামানোয় শুভকে কড়া গলায় কিছু একটা বলে ভেবেছিল রাসেল । কিন্তু হঠাৎ আরেকটা কথা মাথায় এসে যাওয়াতে সে মজা পেয়ে গেল । রোহানও বুঝতে পারল রাসেল কি করতে চাইছে ।

- ঐ ল্যাংড়া, নাম কি তোর ?
- জে, আলমগির ।
- কোন আলমগির ? বাদশাহ আলমগির ?
বলেই খিক খিক করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল সামনের সিটের দুজন সহ ওরা চারজনই । বাচ্চা ছেলেটা মুখ-চোখ মলিন করে তাকিয়েই থাকল ।

- তোরা কয় ভাই-বোন ?
- বড় ভাই আছে একজন । আর একডা ছোড বইন ।

শুভ এই সময় বাধা দিল ওদের কথায় ।

“তোরা কেউ কি বাচ্চাটাকে কোন টাকা দিবি নাকি সেইটা বল । ওর চৌদ্দ গুষ্টির খোঁজ নেয়ার কি দরকার !”

রাসেল বিরক্তিভরে উত্তর দিল, “এদেরকে টাকা দেয়া ঠিক না । ওরা এই টাকা দিয়ে গাঁজা কিনে খাবে ।” ওর সাথে রোহান যোগ করল,

“হাতে একটা বড় নোট ধরিয়ে দে । দেখবি, খোঁড়া পা ও ভালো হয়ে গেছে । দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি যাবে ।”
কথাটা বলেই রাসেল, রোহানরা হাসতে হাসতে হাই ফাইভ দিতে থাকল একে অন্যকে ।

শুভ বাচ্চাটার দিকে তাকাল আবার । “দুই দিন ধইরা কিছু খাই না ভাই ।” এই ছেলে টাকা নিয়ে নেশা করবে বলে বিশ্বাস হল না শুভর । ক্ষুধার জ্বালা, বড় জ্বালা । সে পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়ির জানালা তুলে দেয় ।
তবে ঝামেলা এড়াতে পারে না সে । সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে বলতে থাকে “ওরে হাজী মুহাম্মদ মহসীন রে ...”, “শুভ ভাই, দশটা টাকা দেন না ভাই”... “শুভ ভাই কত্তো বড়লোক রে...” এরপর সামনের থেকে সৌরভ বলে উঠে, “ওর পকেট চেক কর তো...দেখি ওর কত টাকা”

সবাই হই হই করে শুভর পকেটে হাত দিতে চায় । শুভ বাধা দিতে পারে না । ওর পকেট হাতড়ে বের করা হয় বিশ টাকার দুটো, দশ টাকার তিনটি আর দুই টাকার কয়েকটা নোট । এটা নিয়েও বাকিদের হাসাহাসি চলতেই থাকে । সবাই খোঁচা মেরে পচাতে চায় শুভকে । ও মুখ বুজে সব অপমান সহ্য করে । তাই একসময় বাকি সবাই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে ওর ব্যাপারে । নিজেদের মধ্যে আলাপে মশগুল হয় আবার । এমন করে এক সময় রোহান বলে উঠে আজকে শীশা লাউঞ্জে যাবে কি না । শুভ চমকে উঠে । একটু আগে বাচ্চা ছেলেটাকে টাকা দেয়ার ব্যাপারে ওদের আপত্তি ছিল যে বাচ্চাটা এই টাকা দিয়ে গাঁজা খাবে । আর এরা সবাই শিক্ষিত ঘরের ছেলে হয়েও, বাসায় প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও এরা শীশা খেতে যায় ! শীশা জিনিসটা ঠিক কি, সে সম্পর্কে শুভ তেমন কিছু না জানলেও ও জানে এটা যেকোনো মাদকদ্রব্যের চেয়ে কোন অংশে কম না । শুভ আপনমনে মাথা নাড়াতে থাকে ।

রাসেল বলে উঠে, “না থাক...আমাদের মধ্যে হাজী মুহম্মদ মহসীন,দি গুড বয় শুভ আছেন । উনি আবার এইসব পছন্দ নাও করতে পারেন । বাসায় গিয়ে বলবে, ম্যা ম্যা, রাসেলরা না অনেক পচা, ওরা শীশা খায় ।”

রাসেলের এরকম মিমিক্রি দেখে আবার হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই । মনে হচ্ছে যেন, এরা এর আগে কোনোদিন হাসে নাই ।
শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে । ও যে কেন ওদের মত বিত্তবান ঘরে জন্মাল না !

শুভদের মত ছেলেদের প্রতিনিয়ত এরকম আফসোস করতে হয় ।




জাহাঙ্গীর মন আজকে অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক ভালো । আগামীকাল ঈদ । ঈদ উপলক্ষে বেতনের সাথে বখশিশ পাবে আজকে সব বাসাবাড়ি থেকে । ওর প্রথম বড় ধরণের কোন উপার্জন ! এই টাকা দিয়ে ও কি কি করবে তা প্রায় সব ভেবে ফেলেছে সে । খুশিতে হাত-পা কাঁপাকাঁপি অবস্থা ওর । আল্লাহ যদি প্রতি মাসে এমন ঈদ দিত !


জাহাঙ্গীর আজকে ওর সবচেয়ে ভালো যে শার্ট আছে সেটা পরল, ওর প্যান্ট একটাই । আজকে সেটাই পরল । মোটামুটি একটা ভদ্র চেহারা নিয়ে সে আজকে ময়লা আনতে যাবে সব বাসাবাড়ি থেকে ।
-------------------------
শুভ ছাদে উঠে দেখে ওর ভাইয়া ছাদে উঠে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । শুভর মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ । ওর ভাইয়া সেটা লক্ষ করে বলল, “দেয় নি । তাই না ?”
“কি দেয় নি ?”
“আব্বা টাকা দিয়েছে তোকে ?”
“না... কিন্তু আমি টাকা চাইতে গিয়েছিলাম, সেটা তুমি জানো কিভাবে ?”

অভি কোন উত্তর দেয় না । হাসতে হাসতে বলে, “হবে না ...হবে না । কোন লাভ হবে না ।” শুভ এবারো কিছু বুঝতে পারে না । বোকার মত জিজ্ঞেস করে, “কি হবে না ?”
“তুই তো পথ শিশুদের খাওয়াবি বলে টাকাটা চাইছিলি। তাই না ?”
“হ্যাঁ...”
“তুই যখন বড় হবি...আব্বার মত বয়সের হবি, তখন তুইও সেরকম হয়ে যাবি । তোর ছেলে তোর কাছে টাকা চাইবে, তুই দিতে চাইবি না । তুইও হয়ে যাবি আব্বার মত মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্টাল পারসন...। আই হেইট দিস ক্লাস ।” অভি একদলা থুথু ফেলে নিচে ।


শুভ মনে মনে কল্পনা করতে চায় নিজেকে । তার বাবার মত অবস্থায় । পারে না । সে কল্পনাও করতে পারে না । শুভর চোখমুখ শক্ত হয়ে যায় । সে হারবে না । অনেকে অনেক গালাগাল করবে, হাসাহাসি করবে ওকে নিয়ে...কিন্তু তারপরও সে এইসব সুবিধা বঞ্চিত বাচ্চাদের জন্য কাজ করে যাবে । সে একা হয়তো তেমন কিছুই দিতে পারবে না, কিন্তু সে তার বন্ধুদের বুঝিয়ে বলতে পারে । সবাই না হোক, অন্তত দু’চারজনকে যদি ও ওর মত করে ভাবাতে পারে, এসব কাজে উৎসাহিত করতে পারে, তাতেই সে সফল হবে । শুভ মোবাইল হাতে নিয়ে সজীবকে ফোন দেয় । ওর কাছে জমানো একশ টাকাই আছে । বাকিদের বলে যদি কিছু টাকা নিয়ে সেসব বাচ্চাদের সাহায্য করা যায়, সেটাই সই ।

--------------------------


জাহাঙ্গীরের মন মেজাজ খারাপ হচ্ছে ক্রমশ । এ পর্যন্ত তিন বাসায় গিয়েছে সে । কেউ বখশিশ দেয় নি কিছু । এক বাসা থেকে বলে পরে নিতে, আরেক বাসা থেকে বলে অভিভাবক কেউ বাসায় নাই, আরেক বাসা থেকে বলে সে নাকি ময়লাই নেয় না সবসময়, কিন্তু বখশিশের বেলায় ঠিকই গলা উঁচু । জাহাঙ্গীরের ইচ্ছা করে ভয়ংকর কোন গালি দিতে এসব মানুষদের । পারে না । সেরকম আচরণ করলে ওর চাকরী থাকবে না ।

এখন সে চতুর্থ বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । কে জানে এরা কোন বখশিশ দেয় কি না !

--------------------------------------

শুভ বাসায় আসলে ওর মা ওর হাতে পঞ্চাশ টাকার দুটো নোট দিয়ে বলেন, ময়লার বিল নিতে আসলে যাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দেয় । আর বখশিশ চাইলে বাকি পঞ্চাশ দিতে । শুভ বিরক্ত বোধ করে । এরকম একটা উৎসবের দিনে ওদেরকেও তো ওদের প্রাপ্য টাকা দেয়া উচিত । বখশিশটা তো ওদের প্রাপ্যই । এটা আবার চাইলে দাও, না চাইলে দিও না বলার মানে কি ! শুভর মতে, ওরা চাওয়ার আগেই টাকাটা দিয়ে দেয়া উচিত ।

কলিং বেল বেজে উঠলে শুভ গিয়ে দরজা খুলে । ওর সমবয়সী একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে । হাতে-পায়ে ময়লা মাখা । একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “ময়লার বিলডা নিতে আইছিলাম ।”
শুভ নোট দুইটা বাড়িয়ে দেয় । ছেলেটা সাবধানে নোট দুটো হাত বাড়িয়ে নেয় । খেয়াল রাখে যাতে ওর হাতের ময়লা শুভর হাতে না লাগে । শুভ তারপরও ইচ্ছা করে ছেলেটার হাতের সাথে হাত লাগিয়ে দেয় । ছেলেটা ভয় পাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । শুভ অভয় মাখা হাসি হাসে । ছেলেটা নিশ্চিন্ত হয় ।

শুভ জানে, এই শহরে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকা অনেক মানুষের মনের ময়লার চেয়ে পেটের দায়ে একাজে নামা সাধারণ এই ছেলেটার হাতের ময়লা অনেক ভালো ।





আজ ঈদ । সকাল থেকেই জাহাঙ্গীরের মায়ের মাথা ব্যথাটা তীব্র হতে থাকে । কিন্তু জাহাঙ্গীর,আলমগির,বিন্তি...ওরা আশায় আছে ওদের মা কখন বাসাবাড়িতে গিয়ে মাংস চেয়ে আনবে , সেই মাংস রান্না করা হবে, আর ওরা খাবে, সেই আশায় । তাই শরীর খারাপ থাকলেও সেটা চেপে গিয়ে প্রতিদিনের মত পানি আনতে গেলেন পানির ট্যাপটার কাছে । জাহাঙ্গীর আজকেও সাহায্য করছে ওর মাকে । কিন্তু ওদের ঘরটার কাছাকাছি আসার পরই হুড়মুড় করে পরে গেলেন । জাহাঙ্গীর ওর মাকে ওঠাতে গিয়ে খেয়াল করল, ওর মায়ের অনেক জ্বর । সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “আম্মা চুপচাপ শুইয়া একটু জিরাও । কোন কাজ কাম করা লাগব না । আমি ঔষধ নিয়া আহি ।”

“বদপোলা কয় কি ! আইজকাও কয় কাজ না করতে । কাজ না করলে খাবি কি ? আমার মাথা ?”

“আইজ তো ঈদ । এম্নেও তোমার ছুডি । মাংস আনা ছাড়া তো ঐহানে কোন কাম নাই । আমারে বুঝায়া দিয়ো, আমি নিয়া আসুম ।”

জাহাঙ্গীরের মা চোখ বুজেন । ঘুমাতে পারলে মন্দ হয় না । শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেয়া দরকার ।

আলমগির আজকে খুব সকালে উঠেই ঈদগাহের দিকে চলে গেছে । আজকে নাকি অনেক ইনকাম হবে ওর । ছেলেটার মাথা থেকে ভিক্ষাবৃত্তি সরাতে পারেন নি তিনি । বিন্তি নতুন জামা পেয়ে মনের সুখে অন্য ছাপরা ঘরগুলোতে থাকা বাচ্চাদের সাথে খেলতে চলে গেছে । জাহাঙ্গীর ঠিক কত টাকা পেয়েছে তা তিনি জানেন না । তবে তার এই ছেলেটা অনেক কিছু কিনে এনেছে । চিকন চাল কিনেছে, চিনি কিনেছে, লবণ কিনেছে, সস্তার ডাল পেয়ে সেগুলোও নিয়ে এসেছে কিছু । বশীর মিয়ার দোকান থেকে পনের টাকা কেজি দরে লাল সেমাই কিনে এনেছে । ওদের তিন ভাই-বোনেরই খুব সেমাইয়ের শখ । বিন্তির জন্য নতুন জামা কিনেছে । আর এতো কিছুর পরও নগদ তিনশ টাকা তুলে দিয়েছে জাহাঙ্গীর, ওর মায়ের হাতে । মাংস খেতে হলে তেল লাগবে, মশলা লাগবে । এগুলো এখনো কেনা হয় নাই । জাহাঙ্গীরের মা নিজেই এসব কিনে নিতে পারবেন । তবে আগে মাংস আনতে যাওয়া লাগবে । জাহাঙ্গীর আনতে পারবে না । ওকে দিবে না । উনার নিজেকেই যেতে হবে ।
জাহাঙ্গীর বেরিয়ে যাবার পর জাহাঙ্গীরের মা ছেলের কথা মনে করে কাঁদতে থাকলেন । ছেলেটা সারাদিন এতো কষ্ট করে, এতো কাজ করে, তারপরও ওকে প্রচুর গালাগাল করেন তিনি । ছেলেটা একটাবারও তর্ক করে না, মুখের উপর কথা বলে না । কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি ।


ঘুম থেকে উঠে দেখেন দুপুর হয়ে গেছে । জাহাঙ্গীর,আলমগির,বিন্তি ওরা কে কি খেয়েছে কে জানে ! উনার নিজের পেটেও কিছু পড়ে নি । তার উপর বেলা এতো বেশী হয়ে গেছে যে, তিনি ভয় পেয়ে গেলেন, হয়তো তারা মাংস দিতে চাইবে না ।
তিনি তড়িঘড়ি করে উঠে একটা প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগ নিয়ে চলে গেলেন মাংসের খোঁজে ।


জাহাঙ্গীরের মা যেসব বাড়িতে কাজ করেন সেগুলোতে একে একে খোঁজ নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোন বাড়ি থেকে এক টুকরো মাংসও পেলেন না । সব বাসা থেকে আগেই মাংস দেয়া হয়ে গেছে । এখন নাকি আর দেয়া সম্ভব না । তারপরও এখনও অনেক মানুষ ভীর করে আছে বেশ কিছু বাড়ির সামনে । জাহাঙ্গীরের মা দিশেহারার মত হয়ে পড়লেন । বাসায় তার তিন তিনটা ছেলেমেয়ে । তারা আশা করে আছে, মা নিশ্চয়ই মাংস নিয়ে আসবে । জাহাঙ্গীরের মা দ্বিধায় পড়ে যান । তবে তিনি জানেন, তাকে মাংস নিয়ে যেতেই হবে । তিনি একটা বুদ্ধি বার করেন । এলাকার সবচেয়ে বিত্তবান লোকটির বাড়িতেও তিনি কাজ করতেন । সেখানে গিয়েও দেখেন তার মত অনেকেই ভীর করে আছে । তিনি ভীর ঠেলে এগিয়ে যান গেটের দিকে । দারোয়ানকে বলেন,

“বাই...গেটটা একটু খুলেন । বাড়িত কাম আছে ।”

দারোয়ান একটু সন্দেহের চোখে তাকালেও গেট খুলে দিল । বাইরে থাকা মানুষজনদের কেউ কেউ হই হই করে ঢুকতে চাইলেও দারোয়ানটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে তাদেরকে ঠেলে বের করে দিল ।
জাহাঙ্গীরের মা দ্রুত ভেবে নিলেন কি করা যায় । এই বাড়ির পেছন দিয়ে একটা দরজা আছে, ঐটা দিয়ে সরাসরি রান্নাঘরে যাওয়া যায় । তিনি ভেবে নিলেন ঐখান দিয়েই বাসাটাতে ঢুকবেন । এরা লাখ টাকার উপরে গরু কিনে কুরবানি দেয় । সেখান থেকে অল্প একটু নিলে নিশ্চয়ই কোন পাপ হবে না , এটা তো তার প্রাপ্যই ।
তিনি গেলেন । ডিপ ফ্রিজটা খুলে তার মাথা ঘুরে যাওয়ার মত অবস্থা হল । কানায় কানায় মাংস ভর্তি । অন্য ফ্রিজটারও নিশ্চয়ই একই অবস্থা হবে । তিনি ছোট্ট একটা মাংসের প্যাকেট নিলেন । মনে মনে আলমগীরের মুখের চেহারাটা কল্পনা করলেন । ছেলেটার মাংস খাওয়ার খুব শখ । যতই মারেন তিনি ওকে, ছেলের হাসিমুখের দৃশ্যটা কল্পনা করে মন খুশিতে ভরে উঠল তার ।
মাংসের প্যাকেটটা নিয়ে পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখে এগার-বার বছর বয়সী মোটাসোটা একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে । ছেলেটাকে আগে কখনও দেখেন নি তিনি । বেড়াতে এসেছে হয়তো আজ । কিন্তু আর সাত পাঁচ কিছু ভাবার আগেই ছেলেটা চিৎকার করা শুরু করল,

“চোর...চোর...চোর...মাংস চুরি করতে এসেছে । চোওওওর...”


জাহাঙ্গীরের মা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেলেন । তিনি কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগেই দেখলেন দুদ্দাড় শব্দে পুরো বাড়ির মানুষজন দৌড়ে আসছে । কিল,ঘুষি গায়ে এসে পড়তেও সময় লাগলো না ।

মার খেতে খেতে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন, তা হয়তো তিনি টেরও পান নি । তাঁর হাতে তখনও মাংসের প্যাকেটটা ধরা ছিল । জাহাঙ্গীর-আলমগির-বিন্তিদের খাওয়ানোর জন্য মাংস ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
- নাম কি আপনার ?
- জাহাঙ্গীর ।
- কেমন আছেন ?
- আল্লায় যেমন রাখছে, আলহামদুলিল্লাহ ।
- কতদিন ধরে আছেন এই জায়গায় ?
- এই ধরেন গিয়া আপনের... ছয়-সাত বছর ।
- কি করেন আপনি ? মানে লেখাপড়া করছেন নাকি অন্য কিছু ?
- লেহাপড়া করছিলাম ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত । এরপর ইশকুল পাল্টাইতে হয় । ঐ সময় আর পড়তে যাইতে পারি নাই ।
- কেন ? সরকারী স্কুলগুলোতে তো ফ্রিতেই পড়ায় ।
- ওইসব ইশকুলে নতুন,ভালা জামা কাপড় পিন্দা যাইতে হয় । আমাগোর তো ওইগুলা কিনার মত ট্যাকা নাই ভাই । দুইবেলা মুখে খাওন জুটাই, এম্নেই চলতাছি ।
আমি কিছুক্ষণের জন্যে হলেও চমকাই । স্কুল ড্রেস কেনার সামর্থ্য নেই বলে স্কুলে যেতে পারছে না, এমন ছেলেমেয়েও এই ঢাকাতেই আছে !
- এখন কি করছেন ?
- বাসাবাড়ি থিকা ময়লা নেই । পৌরসভার কাম । খারাপ না । ইঙ্কাম ভালাই । ...ভাই, আপনে কি সাংবাদিক ?
- না... আসলে আমি একটা শর্ট ফিল্ম বানাবো । এইসব জায়গাতে আপনাদের মত যারা থাকে তাদের জীবনযাত্রাটা অন্যান্যদের সামনে তুলে ধরার জন্য ।
জাহাঙ্গীর মৃদু হেসে বলে, “অ...”
“আপনি যদি একটু সাহায্য করেন, তাহলে ভালো হয় । আপনাকে আমরা পারিশ্রমিকও দিব ।”
জাহাঙ্গীর এখনও আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে আছে যেন আমি কোন রসিকতা করছি ওর সাথে । মেজাজ চড়ে যাচ্ছে আমার । ফিল্মের কথা বললে সবাই লাফায়, আর এই ব্যাটা এতো ভাব নিচ্ছে কেন ?!
“ভাই দুইডা কথা কই ? কিছু মনে নিয়েন না ।”
“বলেন...সমস্যা নাই ।”
“আপনে যে ফিলিম বানাইবেন, এতে আমাগোর ফায়দা কি ভাই ? আমরা কি কেউ কিছু পামু ?”
আমি কোন উত্তর দিলাম না ওর কথায় । কি বোঝাতে চাইছে,সেটা ঠিক স্পষ্ট না ।
জাহাঙ্গীর স্মিত হেসে বলে যেতে থাকল, “আপনে ফিলিম বানাইবেন । সেই ফিলিম মাইনষে দেখব । কাইন্দা কাইন্দা কইব আহারে আমরা কত কষ্টে থাকি । আপনের কাজের সবাই প্রশংসা করব । আপনি বিখ্যাত হইয়া যাইবেন । কিন্তু আমাগোর কি কিছু অইব ? আমরা যা আছিলাম, তেমনই থাকুম । আমাগোর দিকে কেউ ফিরাও চাইবো না ।”
জাহাঙ্গীরের কথাগুলো একটু একটু বুঝতে পারছিলাম আমি । আমি চুপ থেকে ওকে বলে যেতে দিলাম ।
“আপনে আমাগোরে নিয়া ফিলিম বানাইবেন । কেউ লেখব গল্প, কেউ লেখব কবিতা, কেউ কেউ আমাগোরে নিয়া নাটকও বানায় । কিন্তুক হেরফর ? আপনেরা যে যার বাড়িত যাইয়া আনন্দ-ফুর্তি কইরা বেড়াইবেন । কেউ ফিরাও চাইবেন না । কেন গো বাই ? আমরা কি মানুষ না ? আমাগোরে মানুষ ভাবা যায় না ?”
আমি জাহাঙ্গীরের কষ্টটা টের পাচ্ছিলাম । শান্তভাবেই জিজ্ঞেস করি, “আপনার বাবা কি করেন ?”
জাহাঙ্গীর এবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে যেন । কয়েক দলা থুথু ফেলে উত্তেজিত হয়ে বলে, “বাপ না...বাপ না । কন ঐ কুত্তাডা কি করে । ঐ কুত্তা মারে ছাইড়া দিয়া হাঙ্গা বইছে । গাড়ি চালায় । হালায় একটা ... ... ”
আমি ওকে ঠাণ্ডা করার জন্যেই দ্রুত জিজ্ঞেস করলাম, “আর আপনার মা ?”
জাহাঙ্গীরের মুখে বিদ্রূপের হাসি ফিরে আসে আবার ।
“আমার মাও আপ্নাগো সুবিধা দেয়ার লাইগ্যা মরতাছে...”
আমি মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, “মানে ?”
জাহাঙ্গীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে । বসে থেকে পা প্রসারিত করে নিয়ে ভাঁজ করে আবার সেই পায়ের উপর ভর করে বসে । তারপর আস্তে আস্তে বলা শুরু করে কয়েকদিন আগে হয়ে যাওয়া ঈদের দিনে ওর মায়ের ঘটনাগুলো । যেদিন অমানুষিক মার খেয়েছিলেন তিনি, শুধুমাত্র তার সন্তানদের জন্য কয়েক টুকরো মাংস আনার ‘অপরাধে’। জাহাঙ্গীর বলতে থাকে, “ভাই...আমার মায় কি দোষ করছিল এট্টু বুঝায়া কইবেন ? আমি তো ভাই বুজি না । আপনের মায় যদি আপনার ন্যায্য খাওন আনতে যায়, আর হেরপর যদি মাইনষে ধইরা পিডায়, আপনের ক্যামন লাগব ? চিন্তা কইরা দেহেন তো...”
আমি জাহাঙ্গীরের কথা মত সেই দৃশ্যটা কল্পনা করতে চাইলাম । পারলাম না । তবুও শিউরে উঠলাম । জাহাঙ্গীর এখনো বলে যাচ্ছে, “হেই ছুডুবেলা থেইক্যা দেইখ্যা আইতাছি, বাপে যখন আমাগোরে ছাইড়া গেলোগা...আমাগো মায় এক দিনের লাইগ্যাও আমাগোরে ছাইড়া কোনোহানে যায় নাই । সবসময় চোখে চোখে রাখছে । মাইনষের লাথি,উষ্ঠা খাইছে...হেরপরও আমাগোর লাইগ্যা খাবার আনছে...কোনোদিন ভিক্ষা করতে বয় নাই...আমার এই মারে যহন ...” জাহাঙ্গীরের কণ্ঠরোধ হয়ে আসে । চেপে রাখা কান্না বের হয়ে আসতে চায় । সে তবুও সে বলা চেষ্টা করে, “আমার মায়...আমার মায়...এতো কষ্ট করছে জীবনে...গাইল্যায়,ধমকায়...আবার এই আমাগো জড়ায়া ধইরা কান্দে...মায় তো আমাগো লাইগ্যাই কদ্দুর মাংস আনতে গেছিল । এর লাইগ্যা কেউ এম্নে মারতে পারে ? হাসপাতালে নিয়া গেছিল ঐখানেরই কিছু লোকজন । হাত-পা ব্যান্ডিজ করায়া দিছে । মায় এহন কথাও কইতে পারে না ...। চোউখ খুইল্যা খালি উপ্রের দিকে তাকায়া থাকে । চোউখ দিয়া পানি পড়ে...। ভাই গো...আপ্নেই কন...কোন পোলার কি তার মার এই অবস্থা সহ্য হয় ?”
আমি এবারও চুপ হয়ে থাকি । সত্যি বলতে, আমি বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না । ময়লা নেয়ার সাধারণ এই ছেলেটার কাছে নিজেকে কেমন যেন নিচ বলে মনে হচ্ছে । সুশীল সমাজের সদস্য হয়ে এরকম ঘটনা শুনে নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে ।
“ভাই...আপনারা কুরবানি দেন না ? দেড় লাখ,দুই লাখ ট্যাকা দিয়া গরু কিনেন । ঐ গরুরে সাজান । দামী সাবান কিন্যা গোছল করান । ঐ গরুটা যাতে না খাইয়া না থাকে, সেইটার খেয়াল করেন । পাহারা বসান গরুর লাইগ্যা । কিন্তু ...আমাগো দিকে দেখেন । আমাগোর দিকে কেউ ফিরাও চায় না । ঐসব গরুরও একটা দাম আছে...কিন্তুক আমাগোর ঐ দামডাও নাই । এইডা ক্যামন বিচার ভাই ? আপনাগো এতো কিছু দিছে আল্লায়... তারপরও আমাগো হকটুকু দিতেও বাঁধে ক্যান ?”
আমি জাহাঙ্গীরের শতচ্ছিন্ন ফতুয়াটার কাঁধে হাত রাখলাম । মাথার মধ্যে বয়ে যাওয়া চিন্তার ঝড়টা যতটা সম্ভব দমিয়ে বলি, “আমি এসবের কোনটারই কোন উত্তর জানি না জাহাঙ্গীর । কিচ্ছু জানি না । আমাকে মাফ করবেন ।”
আমি ধীরপায়ে রেললাইন ধরে হেঁটে চলে আসছি । পিছনে বসে আছে খুব সাধারণ একটা ছেলে, মনে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে । চোখ ভর্তি অশ্রু, যার প্রতিটি ফোঁটায় ওর মায়ের প্রতি আবেগ, টইটম্বুর ।
আমি সামনে তাকাই । জাহাঙ্গীরদের ঘরটার মত আরও অনেক ছাপরা ঘর রয়েছে আশেপাশে । ছোট্ট একটা বাচ্চাকে ওর বাবা কোলে নিয়ে রোদের দিকে ধরে রেখেছে । আদরসূচক কথাবার্তা বলছেন । বেশ মায়া লাগে এই দৃশ্যটা দেখতে ।
আচ্ছা...এই বাচ্চাটা একদিন বড় হবে । সেও কি তখন জাহাঙ্গীরদের মতই একজন হবে ? সেও কি বড় হয়ে অভিশাপ দিবে এই জীবনকে...এই সমাজকে...তথাকথিত সুশীল মানুষজনকে ?
জাহাঙ্গীরের কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রমাগত ।
“আপনে আমাগোরে নিয়া ফিলিম বানাইবেন । কেউ লেখব গল্প, কেউ লেখব কবিতা, কেউ কেউ আমাগোরে নিয়া নাটকও বানায় । কিন্তুক হেরফর ? আপনেরা যে যার বাড়িত যাইয়া আনন্দ-ফুর্তি কইরা বেড়াইবেন । কেউ ফিরাও চাইবেন না । কেন গো বাই ? আমরা কি মানুষ না ? আমাগোরে মানুষ ভাবা যায় না ?”
......আমি মনে মনে হিসাব কষতে থাকি, এই শর্ট-ফিল্মের পিছনে আমার বাজেট কত... অথবা এথেকে কত টাকা আসতে পারে । স্পন্সরশীপের জন্য হয়তো বলে কয়ে কাউকে পাওয়া যাবে । ...আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, পরবর্তী ফিল্ম থেকে যা আয় হয়...তার মধ্যে আসল টাকাটা রেখে লাভের টাকার পুরোটা আমি জাহাঙ্গীরদের পিছনে খরচ করব । আমি একা হয়তো এদের সবার জন্য কিছুই পারবো না । কিন্তু অন্তত এক, দুইজনের জন্য কোন একটা ব্যবসার ক্যাপিটাল যোগাড় করে দিতে পারি । যে অবস্থায় ওদের দুবেলা খাবার যোগাড় করতেই সব টাকা চলে যায়, ছোটখাটো কিছু একটা ব্যবসা করে যে স্বাবলম্বী হবে, সে সুযোগটাও থাকে না । সে জায়গায় আমি বা আমার বন্ধুরা একটু করে হলেও তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি । তাছাড়া সিনেমা লাইনে কাজ করে এরকম অনেক লোকজনের সাথে উঠতে-বসতে গিয়ে টের পেয়েছি এরা সবাই বেশ অবস্থা সম্পন্ন । হাজার দুই-তিনেক টাকা এরা চোখের পলকে খরচ করে ফেলতে পারে । তাদের কাছে যদি বলে-কয়ে কিছু টাকা যোগাড় করে একটা ফান্ড যোগাড় করতে পারি, সাধ্যমত জাহাঙ্গীরদের সাহায্য করে ওদেরকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমি নিশ্চিত একদিন না একদিন এরকম কোন ষোল-সতের বা তার চেয়েও কমবয়সী বাচ্চারা নিজেদের জীবনকে ধিক্কার দিবে না, এই সমাজকে ধিক্কার দিবে না ।...এসব ভেবে ভেবে আমার মনটা হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক রকমের ভালো হয়ে গেল ।

হাঁটতে হাঁটতে রেলওয়ে ক্রসিং এর কাছে এসে গেছি । দূর থেকে ধোঁয়া উড়িয়ে একটা ট্রেন আসছে, দেখা যাচ্ছে । সূর্যটা নিচে নেমে এসেছে । একটু পরেই ডুবে যাবে । আঁধার ঘনিয়ে আসবে । তারপর আরেকটা দিন আসবে । নতুন একটা দিন । নতুন করে স্বপ্ন দেখার দিন ।

পরিবর্তন আসবেই । আর সে পরিবর্তনের সূচনা কারো না কারো হাত ধরে আসবে । তবে সেটা আসতে হবেই । আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি...রূপকথা নয়, একদিন সত্যিই সত্যতে পরিণত হবে এই দেশের স্বনির্ভরতা ।

সমাপ্ত

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: পুরো লেখাটাই আসলে জয়দা(জয় আচার্যী)’র লেখা একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং জিকো ভাই ( রাসায়াত রহমান জিকো/ব্লগার জিকসেস ) এর “মাংস চোর” গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা । তাঁদের দুজনকেই বিশাআআআল ধন্যবাদ যে তাঁরা আমাকে লেখাটি লিখতে অনুমতি দিয়েছেন ।

কিছু কথা: সাহিত্য মানের দিক থেকে আমার লেখাটা হয়তো একটা জগাখিচুড়ি, জানি । কিন্তু আমার এই লেখা পড়ে যদি একজন মানুষও সেইসব সুবিধা বঞ্চিতদের দুঃখ-কষ্টটা টের পেয়ে, তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন তাতেই আমি খুশী । আর কিছুদিনের মধ্যেই শীতকাল আসছে । আমরা নিজেদের জন্য প্রতিবারের মতই হয়তো নতুন গরম জামা-কাপড় কিনব । পুরনোগুলো চাইলেই জাহাঙ্গীরদের মত ছেলে-মেয়েদের বা তাদের পরিবারের জন্য দিয়ে দিতে পারি । এপার্টমেন্টে বসে ফুটপাথে তাদের যে অকল্পনীয় কষ্টের মধ্যে দিনগুলো কাটাতে হয়, তা আমরা টের পাইনা ঠিকই । তবে তাদের কষ্টের কথা বুঝতে পেরে হলেও আমাদের এগিয়ে আসা উচিত । আপনি সরাসরিভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারলেও যেসব সংগঠন এসকল কাজের সাথে যুক্ত,তাদের সাথে যোগাযোগ করুন । পুরনো জামা-কাপড় দিতে না পারলে আর্থিকভাবে সাহায্য করুন । সেটা নিদেনপক্ষে একশ’ টাকা হলেও যথেষ্ট । তারপরও আমার একটাই আকুতি...আপনারা দয়া করে এগিয়ে আসুন...সক্রিয় হোন ।
মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হতে পারে না । গরীব একটা বাচ্চার মুখে ফুটিয়ে তোলা হাসির দৃশ্য অথবা বয়স্কা কোন বৃদ্ধার অশ্রুসিক্ত নয়নে আশীর্বাদ করার দৃশ্য অনেক বেশী পবিত্র...।

উৎসর্গ: সেইসব মানুষদের......যারা হাজারো তিরস্কার, উপেক্ষা,কটূক্তি সহ্য করেও নিঃস্বার্থভাবে এই ‘পার্থক্য’ কমিয়ে আনার চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন ।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×