somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ সম্পর্ক

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শফিক সাহেবের মন-মেজাজ এই মুহূর্তে প্রচণ্ড বিলা হয়ে আছে । তিনি মেজাজ ঠাণ্ডা করার জন্য বসার ঘরে চলে গেলেন । সেখানে একুরিয়াম রাখা আছে । রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিন মেজাজ খারাপ হলে গাছে পানি দিতেন, আর শফিক সাহেব একুরিয়ামের গোল্ডফিশগুলোর দিকে তাকিয়ে মন শান্ত করেন । বড়ই বিচিত্র মানব মন !

উনার মেজাজ খারাপ হওয়ার মূল কারণ, কিছুক্ষণ আগে তার গাড়ির ড্রাইভারের কাছ থেকে আসা একটা ফোনকল । ড্রাইভার হাসিমুখে তাকে জানিয়েছে ‘ইনজিল ডাউন’, আজ তাই গাড়ি নিয়ে কোনোভাবেই বের হওয়া সম্ভব নয় । অথচ তিনি এক সপ্তাহ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন, আজকের দিনে নিজের গাড়িতে চড়ে গ্রামের বাড়ি যাবেন । পুরো গ্রামবাসীকে তো বটেই,তাঁর বড় ভাই রফিককেও তিনি ভেলকি লাগিয়ে দিতে চান । কিন্তু সেটা হচ্ছে না । মেজাজ খারাপ তো হবেই !

মাত্র দু’মাস আগেই ইঞ্জিন সারিয়ে এনেছেন ।নিজের অফিস আর বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে যাওয়া-ফিরিয়ে আনা ছাড়া গাড়ি গ্যারেজেই পরে থাকে । এতো তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাবার মত কিছুই ঘটেনি । তারমানে ড্রাইভার মজিদ নিজেই কিছু একটা করেছে গাড়িটার । এরকম অনিয়ম তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না ।
কিছুক্ষণ পর মোবাইল হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বললেন, “মজিদ, কালকে দুপুরে এসে আমাদের সাথে খেয়ে যেও । আর পুরো মাসের বেতনটাও নিয়ে যেও । তোমার চাকরী নট ।” কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিলেন তিনি । মজিদ তার পরিবার নিয়ে কি কি ঝামেলায় পরবে সেসব ফিরিস্তি শোনার সময় নেই তাঁর । তিনি নিজেও বেশ দুর্দশার মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে বর্তমানে এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন ।

শফিক সাহেবের এখন বেশ শান্তি-শান্তি লাগছে । একুরিয়ামের মাছগুলোর মত মনে হচ্ছে নিজেকে । যেন মনের সুখে পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন । ঠিক ছোটবেলার মত...

***
ড্রাইভার মজিদকে বরখাস্ত করতে পেরে মনে মনে খুশি হলেও, খুশির ভাবটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারলো না । কারণ,আজকে শফিক সাহেবকে গ্রামের বাড়িতে যেতে হবেই । সম্পত্তি ভাগাভাগির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে । এতোকাল ধরে তার বড় ভাই নিজেই জমি দেখেশুনে রাখার নামে জমি বর্গা দিয়ে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে গ্রামের অনেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে শফিক সাহেবকে জানিয়েছেন । অনিয়ম, প্রচণ্ড অনিয়ম । জমি নিশ্চয়ই রফিক ভাইয়ের একার নয় । তিনি যদি জমি থেকে টাকা আয় করতে পারেন, তাহলে নিয়মানুযায়ী সে টাকার অর্ধেক তাকে দিতেই হবে । কিন্তু এতোকাল ধরে রফিক ভাই পুরো ব্যাপারটা তার কাছ থেকে চেপে রেখেছিলেন । এতো শুধু অনিয়ম না, অন্যায়ও বটে !

শফিক সাহেব নিজে যতই রাশভারী স্বভাবের হন না কেন, বড় ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের সামনে একেবারেই ম্লান হয়ে যান । তাই এ জমি থেকে প্রাপ্ত টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কীভাবে কথা তুলবেন সেটা তার মাথায় ঠিক আসছিল না । এমন সময় তাকে চিন্তার মহাসাগর থেকে উদ্ধার করতেই যেন পরামর্শ দেন তার স্ত্রী, শাহানা । পরামর্শটা হল, সম্পত্তি ভাগাভাগি করে ফেলা । পরবর্তীতে শফিক সাহেবের কিছু বন্ধু-স্থানীয় লোকজনও একই পরামর্শ দিয়েছেন । আজকাল এরকম হরদম হচ্ছে । যার যার ভাগের সম্পত্তি নিয়ে নিজ নিজ পরিবারে মন দিচ্ছে । নিজের গ্রামীণ সত্ত্বাটুকু রূপকথা বানিয়ে, চরিত্র হচ্ছে শহুরে জীবন-যাপনের । আর তাছাড়া শফিক সাহেবের ছয় বছর বয়েসী একটা ছেলে আছে,স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা । তাদের সন্তানদের একটা ভবিষ্যৎ আছে, সেটা উজ্জ্বল করার ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে হবে । তাই সব ভেবে-চিন্তে সম্পত্তি ভাগাভাগির সিদ্ধান্তটাই সর্বোত্তম মনে করলেন তিনি । বিশেষ করে ‘তালুকের চর’ এর জমিটা যদি পাওয়া যায় তবে মাটি ফেলে এক বছরের মধ্যেই জমির দাম বেড়ে আশি-নব্বই লাখ টাকা হয়ে যেতে পারে । এ টাকায় শান্তিনগর-কাকরাইলের দিকে মোটামুটি ভালো মানের ফ্ল্যাট কেনা যেতেও পারে ।

কিন্তু সব ঠিক হলেও দিনের শুরুতেই যে ঝামেলা শুরু হয়েছে, তা আবার কপালে ভাঁজ ফেলছে শফিক সাহেবের । স্ত্রীকে দেখে-শুনে রাখার জন্য বিশ্বস্ত একজন আয়া রাখা হয়েছে, নার্সও রাখা হয়েছে । বাড়ির কাজগুলো রাহেলা বুয়া আর ফুট-ফরমাশ খাটা ছেলেটা দেখবে । অতএব, এখানে কোনো ঝামেলা থাকছে না । শফিক সাহেব ভেবে রেখেছিলেন, ছেলে সায়েমকে নিয়ে যাবেন এবার, গ্রামের বাড়িতে । ও আজ পর্যন্ত গ্রাম দেখেনি । কিন্তু যাবেন কি করে ? বাসে ? কিন্তু সায়েমের বাসে করে যেতে বমিভাব হয় বেশী । এবোমিনেও কাজ হয় না । তবে কি ট্রেনে যাবেন ? কিন্তু এই সময়ে ফার্স্টক্লাসে ট্রেনের শিডিউল আছে কি না বা থাকলেও তাতে সিট পাওয়া যাবে কিনা সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই । তবে এভাবে বাসায় বসে থাকলে কোনো ধারণাই পাওয়া যাবে না । তিনি স্ত্রীকে বলেন, সায়েমের ব্যাগ প্রস্তুত করে দিতে । আর দেরী করা যায় না । প্রথমে রিকশায় করে যাবেন কমলাপুর রেলস্টেশনে । ট্রেন পাওয়া না গেলে কমলাপুর থেকেই মাইক্রো-বাস ভাড়া করে যাবেন সোজা গ্রামের বাড়িতে ।

শফিক সাহেবের গাড়িটা এপার্টমেন্টের গ্যারেজে থাকে না । এখান থেকে গাড়ি-পথে মিনিট পাঁচেক দূরে তার শ্বশুরবাড়ীর দিককার এক আত্মীয়ের নিজস্ব বাড়ির গ্যারেজে রাখেন । তার জন্য কোনো আলাদা খরচ দিতে হয় না । তিনি এখনও এসব দিক দিয়ে বেশ হিসেব করেই চলেন । বাজারে গেলে দু’চারটা দোকান ঘুরে জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে ভালোমতো নিশ্চিত হয়ে তবেই কিনেন । এক ডজন কমলা কিনতে গেলেও বাছাবাছি করে মিনিট পনের কাটিয়ে দিতে পারেন । এসব ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি তার ।

বিলাসিতা এখনো তার কাছে সাময়িক, যেকোনো উপলক্ষের হেতু । সত্যিকারের বিলাসী হয়ে ওঠা হয়নি। কারণ হিসেবে অতীত জীবনকে দায়ী করা যেতে পারে ।

রেলস্টেশনে এসে যা সন্দেহ করেছিলেন তা-ই হলো । ফার্স্টক্লাসের কোনো ট্রেন নেই । তবে মিনিট পাঁচেক পরেই সেকেন্ড ক্লাসের একটা ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাবে । তিনি ভাড়া করা মাইক্রো-বাসে করেই যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও ছেলের আপত্তির মুখে তা আবার বদলালেন । সায়েম গো ধরে আছে, সে ট্রেনে করেই যাবে । সেটা ফার্স্ট ক্লাস না থার্ড ক্লাস তাতে কিছু যায় আসে না । এইটুকু ছেলের মুখ থেকে এমন পাকা পাকা কথা শুনে মনে মনে আত্মতৃপ্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠেন শফিক সাহেব । ছেলের কোনো সাধ পূরণ না করে ছাড়েন না তিনি । নিজে বাবা-মা’র আদর খুব একটা পাননি । ছেলেকে নিজের মত তা থেকে বঞ্চিত হতে দিতে চান না মোটেও ।

ছেলের জন্য হালকা খাবার আর পানি কিনে ট্রেনে উঠে গেলেন বাপ-বেটা দুজনে । সায়েম খুব খুশী হয়েছে । উত্তেজনায় এক একবার জানালা দিয়ে মাথা বাইরে রাখতে চাইছে । অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে ছেলেকে একাজে নিরস্ত করলেন শফিক সাহেব । বাচ্চা ছেলে, যুক্তি মানতে চায় না । তবে সায়েম বোধহয় কিছুটা বুঝল, মুখ গোমড়া করে বাবার কথা মেনে নিলো । অবশ্য মুখের গোমড়া-ভাবও বেশিক্ষণ থাকলো না । একটার পর একটা প্রশ্ন করে অস্থির করে দিতে লাগল বাবাকে । ট্রেন চলার সময় প্রচণ্ড ঘটাং ঘট শব্দ শুনে বাবাকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “বাবা ট্রেনটা এতো শব্দ করছে কেন ? এর কি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে ?”
স্মিতহাস্যে শফিক সাহেব একইভাবে উত্তর দিলেন, “না বাবা । ট্রেনে এরকম আওয়াজই হয় । তোমার কি বেশী খারাপ লাগছে ?”
সায়েম সবেগে ডানে-বায়ে মাথা দোলাতে লাগল । কিছুক্ষণের মধ্যেই লেভেল ক্রসিং এসে যাওয়ায় রাস্তার দুপাশে সিগন্যাল বার নামিয়ে দেয়ার ফলে গাড়ি আটকে থাকতে দেখে সায়েম আবারো চেঁচিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “বাবা, ট্রেনে কি কোনো ট্র্যাফিক জ্যাম নাই ? ট্রেনের রাস্তায় লাল বাতি,সবুজ বাতি নাই ?”
শফিক সাহেব আবারো হাসতে লাগলেন । তারপর হাসিমুখেই ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিলেন । সায়েম সন্তুষ্ট হয়ে চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো । শফিক সাহেব আপনমনে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন । মায়ের গায়ের রংটা পেয়েছে,তবে চেহারায় শফিক সাহেবের সাথে অনেক মিল । দিনদিন সুন্দর হচ্ছে ছেলেটা । মাশাল্লাহ ।
শফিক সাহেব ছেলের বয়েসের সময়কার নিজের কথা মনে করে নস্টালজিক হয়ে পরলেন । সায়েমের মত বয়সে তিনি কখনও গাড়ি বা ট্রেনে চড়া তো দূরের কথা, ঠেলাগাড়িতেও চড়েন নি । পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতেন,ফিরতেন । প্রায় আড়াই মাইল করে দিনে মোট পাঁচ মাইল হাঁটতে হত । সঙ্গী হতেন বড় ভাই, রফিক ।
খুব ছোটবেলাতেই শফিক সাহেবের মা মারা যান । মা’র চেহারাটাও মনে পড়ে না তার । মা’র মৃত্যুর পর তার বাবা খুব বেশী ধর্মকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন । গাঁয়ের মুনশি ছিলেন । সবাই একনামে চিনত । তবে ধর্মকর্মের দিকে তিনি এতোই বেশী মন দিয়ে ফেলেছিলেন যে, বিষয়-আশয়ের দিকে বা শিশুবয়েসী বাচ্চা দুটোর দিকেও নজর দিতে পারেন নি । রফিক,শফিক বড় হয়ে উঠেন একা একাই । তাদের কেউ রূপকথার গল্প শোনাত না, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত না, অসুখ হলে মাথায় জলপট্টি দিয়ে যেত না ।দুই ভাই নিজেরাই মিলেমিশে থাকতেন । কখনও-সখনও খুনসুটি বেঁধে গেলে নিজেরাই আবার মিটমাট করে ফেলতেন । শফিক সাহেবের মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার সময়ই একরকম হুট করেই তাদের বাবা মারা যান । বড় ভাই রফিক সাহেব তখন সবেমাত্র ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়েছেন । থাকতেন বহুদূরের এক গ্রামে, লজিং মাস্টার হিসেবে । তারপর......

থাক সেসব কথা । কষ্টের অতীতের দিকে এতো সময়ক্ষেপণ না করে বর্তমানকে আয়ত্ত্বে এনে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে । তবেই না সার্থক জীবন !

ট্রেন সবেগে রেললাইনের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে । চারপাশের দৃশ্যগুলো সমবেগে ছিটকে যাচ্ছে পিছনে । পুরো ব্যাপারটা যেন অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যতকে একই সমীকরণে সমাধান করে যাচ্ছে । বর্তমানের ফল শূন্য হলেও এটাই সর্বোচ্চ মান । অতীত,ভবিষ্যতের মান ঋণাত্মকে । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনের অজান্তেই আবারো নিজের ঋণাত্মক অতীতের বেশ কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায় শফিক সাহেবের ।

বাবার উদাসীনতার কারণে ছোটবেলায় পড়ালেখা নিয়ে অত ধমক শুনতে হয়নি । তাছাড়া ছিলেন একেবারেই অজ-পাড়াগাঁয়ের ছেলে । লেখাপড়া শিখে বড় কিছু হয়ে যাবেন, সেতো তিনি নিজেও কখনও ভাবেননি । ছেলেবেলায় কখনো কখনো এমনও দিন গেছে যে দুপুরে কিছু খেলে রাতে খাবার থাকবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না । মাটির চুলোয় দুটো মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে নিয়ে দু’ভাইয়ে খেয়ে নিতেন । দরকার হলে বেশী করে পানি খেয়ে ক্ষিধে মেটাতেন । সেরকম অবস্থা থেকে খানিকটা নিজের গরজে, বেশ খানিকটা বড় ভাইজানের চাপাচাপিতে লেখাপড়া শিখেছেন । রফিক ভাই যখন ক্লাস ফোরে পড়তেন তখনই চলে যান এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে লজিং এ থেকে অন্য এক স্কুলে পড়তে । মাঝে মাঝে এসে ছোটভাইয়ের খোঁজ নিয়ে যেতেন । সত্যি বলতে কি,তাদের জীবনে তাদের বাবার ভূমিকা বলতে গেলে কিছুই ছিল না । তবুও যখন বাবার চেহারাটা হঠাৎ করে মনে পড়ে যায়, একসঙ্গে অনেকগুলো স্মৃতি যেন ঝাঁপ মেরে জাগিয়ে দিয়ে যেতে চায় মনের মধ্যে অতি সযত্নে লুকোনো পুরনো কোনো কোণের হাজার অভিমানকে । এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে নিতে চায় । নেই, নেই, বাবা নেই, মা নেই, কিচ্ছু নেই । তবে শফিক সাহেব নিজের আবেগে বাঁধ দিতে শিখেছেন বেশ । আধুনিক মনোভাবের এ যেন এক অনন্য কীর্তি । রক্ত-মাংসেই গড়ে তুলছে একেকটি অনুভূতিহীন যন্ত্রদানব ।

ট্রেন সাইরেন বাজাতে বাজাতে এক স্টেশনে এসে থামল । এখানে মিনিট পনের ট্রেনটা থাকতে পারে, শুনলেন সামনের সিটের একজন যাত্রীর মুখে । শফিক সাহেবের সিগারেটের নেশা না থাকলেও চায়ের নেশা আছে । তিনি সায়েমকে নিয়ে নেমে স্টেশন ক্যান্টিনের দিকে যান । নিজের জন্য চা আর ছেলের জন্য আরো কিছু হালকা খাবারের ব্যবস্থা করলেন ।

দশ মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে গেলেন ট্রেনে,নিজেদের সিটে । ট্রেন ছাড়ার মিনিট পাঁচেক পরে সায়েম জানালো সে ‘হিসি’ করবে । শফিক সাহেব বহুকাল ট্রেনে চড়েননি । এবারে বুঝলেন আসল সমস্যা । ট্রেনের বগি থেকে বগির মাঝে যে টয়লেট, সেখানে দুর্গন্ধের চোটে কাছে ঘেরা যায় না । সায়েম হিসি করবে কিভাবে ? কিন্তু উপায়ন্তর না দেখে, সায়েমের নাক চেপে নিয়ে গেলেন সেসব টয়লেটেই । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, এই-ই প্রথম এবং শেষবারের মত ছেলেকে নিয়ে সেকেন্ড ক্লাসে ট্রেনে চড়া । আর কক্ষনো এ ভুল করা চলবে না ।
সায়েমকে নিয়ে সিটে ফিরে আসার সময় নরম কিছু একটাতে ধাক্কা খেলেন তিনি । নিচে তাকাতেই দেখেন একটা পা! চমকে উঠেন তিনি । ভালোমতো দেখার পর অবশ্য ভয় কেটে গেল । দুটো বাচ্চা ছেলে জড়োসড়ো হয়ে সিটের পিছনে অল্প ফাঁকা যা জায়গা পেয়েছে তাতেই শুয়ে ঘুমিয়ে আছে । এই জায়গাটা বেছে নেয়ার কারণ খুব সম্ভবত টিকেট-চেকারের ভয়ে । টিকেট-চেকাররা এরকম গরীব বাচ্চা-কাচ্চা, যারা বিনা পয়সায় ট্রেনে চড়ে বেড়ায় তাদের দেখলেই চাবকাতে চায় । শফিক সাহেব একটু মাথা উঁচু করে দেখতে গিয়ে বুঝলেন বাচ্চা দুটোর মধ্যে যেটি বেশী ছোট, ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে । এই বাচ্চাটার পায়ের সাথেই ধাক্কা লেগেছে শফিক সাহেবের । সে ভয়ে ভয়ে শফিক সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে আর পাশে শুয়ে থাকা অগ্রজকে ঠেলতে লাগল, “ভাইজান, উডেন, উডেন না । দেহেন না এক ব্যাডা কি জানি চাইতাছে আমাগো দিকে তাকাইয়্যা ।” বাচ্চাটার বড় ভাই চোখ মেলে তাকালো শফিক সাহেবের দিকে । আর তার পরপরই খেঁকিয়ে উঠলো, “কিতা ? কি হইছে ? তাকায়া আছেন কিল্লাইগ্যা ? গরম লোহার মধ্যে হুইয়া আছি, এদ্দুরও সইহ্য অয় না ?”
শফিক সাহেব বিরক্ত-মুখে সরে এলেন । তবে মনে মনে অবাক হলেন এটা ভেবে যে, সত্যিই ...ট্রেনের বডি,মেঝে এতো গরম হয়ে আছে যে ভারী জুতা পরেও তার আঁচ তিনি ঠিকই টের পাচ্ছেন । আর এই কমবয়সী বাচ্চা দুটি এরমধ্যে শুয়ে আছে কেমন করে ! শফিক সাহেব সাধারণত এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না খুব একটা । তবে আজ যেন তাকে নিয়মভাঙ্গার নিয়মে পেয়েছে । আর তাছাড়া বাচ্চা ছেলে দুটির ছোটটি বয়সে সায়েমের প্রায় সমান হবে বলেই মনে হয়, সায়েমের মতই লাগছে । মানুষ তার পছন্দের মানুষের চেহারায় অতি প্রিয় মানুষের মুখের ছায়া দেখতে পছন্দ করে । হয়তো সেকারণেই শফিক সাহেবের এতো আগ্রহ জেগে উঠেছে ।

বাচ্চা দুটোকে সায়েমও লক্ষ্য করেছে । আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বলল না । স্কুলে যাওয়ার সময় এরকম বাচ্চাদের প্রায়ই সে দেখে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভিক্ষা করতে । ট্রেনে তারচেয়ে ভিন্ন কিছু হবে বলে মনে হয় না । অবশ্য সায়েমের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে বাচ্চা দুটি কিছুক্ষণ পর আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে কোত্থেকে যেন গোলাপি রঙের দুটো ক্যান্ডির বড় প্যাকেট নিয়ে এসে হাঁকডাক শুরু করে দিল, “এই যে ভাইজান, লাপ ক্যান্ডি খান । মজার লাপ ক্যান্ডি । একটা দুই টাকা, তিনটা পাঁচ টাকা, ছয়টা দশ টাকা । কার কার লাগবো বলেন । এই যে লাপ ক্যান্ডি...”
সায়েমের ‘লাপ ক্যান্ডি’র প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকলেও ট্রেনের অন্য অনেকের মধ্যে আগ্রহ দেখা গেল । অনেকেই কিনল । বাচ্চা দুটো সব মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ টাকার ক্যান্ডি বিক্রি করে ফেলল ।
শফিক সাহেব আবারো একটা স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করে বসলেন । হাতের ইশারায় ডাকলেন, ক্যান্ডি বিক্রেতা বাচ্চা দুটোকে । বড় ছেলেটা এসেই পাকা ব্যবসায়ীর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “কয়ডা দিমু ?”
“একটাও না । তোদের সাথে এমনি কথা বলতে ডাকলাম।”
“বেহুদা কথা কওয়ার সময় নাই । আর আপ্নে আমগোরে তুই-তোকারী করেন ক্যান ? কামের পোলা লাগি আপ্নের ?”
শফিক সাহেব মনে মনে চমৎকৃত হলেও, বাইরে তা প্রকাশ করলেন না । “তোমাদের কাছে সব মিলিয়ে কয়টা ক্যান্ডি আছে ?”
“ক্যান ?”
“আমি সবগুলো কিনবো ।”
ছেলেটার চোখ যেন অক্ষিকোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো । আগে হয়তো একদিনে এতো বেশী ক্যান্ডি বিক্রি হয়নি । বাচ্চাটা ব্যতিব্যস্ত হতেই শফিক সাহেব বললেন, “এখন বল, তোমার নাম কি ?”
“রশিদ ।”
“আর এ...তোমার ছোট ভাই ? ওর নাম কি ?”
‘হ...অর নাম হামিদ ।”
“তোমরা কোথায় থাকো ?”
“ঠিক নাই । ইশটিশনে ইশটিশনে ঘুইর্যান বেড়াই ।”
“বাবা-মা ?”
“বাপে ভিক্ষা করে । মায় গেছে হারাইয়া......আইচ্ছা আপ্নে সত্য সত্য সবডি লাপ ক্যান্ডি কিনবেন ?” রশিদের গলায় এবারে ঘোর সন্দেহের সুর ।
শফিক সাহেবের গম্ভীর মুখে মুহূর্তের জন্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটেই আবার মিলিয়ে গেল । তবে মুখভঙ্গির ইঙ্গিতটা ছিল অর্থবহ । রশিদের মত বাচ্চা ছেলেও তা বুঝতে পারে । সে একদম মিনিয়ে গেল ।
“যদি কিনি তাহলে ভালো হবে ?”
‘জি ছার । খুব ভালো হয় ।দুই দিন ধইরা ভাত না খাইয়া আছি ।” নির্দোষ মুখে কথাগুলো বলল রশিদ । ওর বলার ভঙ্গি দেখে সত্য না মিথ্যা বলছে তা বোঝার উপায় নেই । শফিক সাহেব কৌতুকবোধ করলেন। এরা সবসময় না খেয়ে থাকা দিনের সংখ্যার বেলায় স্পেসিফিক্যালী “দুই দিন” বলে কেন ? তিন বা চার দিন নয় কেন ? তিনি এবারে নজর দিলেন ছোট বাচ্চাটির দিকে, হামিদ নাম যার । শফিক সাহেব ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছেন, হামিদ, ক্যান্ডি বিক্রির সময় যতটা উৎসাহী, অপরিচিত মানুষজনের সাথে কথা বলার সময় ঠিক ততটাই অপ্রতিভ ।
“কিরে ? গত দুই দিন ধরে নাকি ভাত খাস নাই ? তোর ভাই সত্য কথা বলছে ?”
হামিদ কিছুটা দ্বিধাভরে উত্তর দিল, “গতকালে এক ব্যাডায় এক প্যাকেট বিরানি খাইতে না পাইরা দিয়া দিছিল, ভাইজানের মনে অয় ওই কথা মনে নাই...” পুরো কথা শেষ করার আগেই মাথায় গাট্টা খেল রশিদের হাতের । হামিদ সাথে সাথেই আবার বলল, “তয় ভাইজানে খায় নাই। আমারে দিয়া দিছিল, আমি একাই খাইছি ।” শফিক সাহেব একটু অবাক হলেন যেন । এইটুকু বাচ্চা ছেলেও নিজে না খেয়ে থেকে ছোটভাইকে খাওয়ায় ! “রশীদ তুই খাস নাই কেন ?”
“খুব বেশী ছিল না ছার ।তারউপরে হামিদ হইলো ছুডু মানুষ ।ক্ষুধা সহ্য করা শিখে নাই । আমি পারি ।”
শফিক সাহেবের কিছুক্ষণের জন্য মনে হল নিজের ছোটবেলার কথা । তাঁর বড় ভাই রফিকও প্রায় সময়ই নিজে না খেয়ে থেকে ছোট ভাইকে খাইয়েছিলেন, অথচ, এই বাচ্চাগুলোকে না দেখলে বা এদের কথা না শুনলে বোধহয় একথাটা কখনও তার মনে পড়ত না । তিনি কেমন যেন একটু আচ্ছন্ন হয়ে পরলেন । চুপ হয়ে গেলেন ।
কিছুক্ষণ পর রশীদ তার হাতে তিন প্যাকেট ক্যান্ডি ধরিয়ে দিল । শফিক সাহেব মানিব্যাগ থেকে দাম মিটানোর সময় ডাবল টাকা দিলেন । বাকিটা বখশিশ । রশিদ,হামিদ চলে গেল অন্য বগিতে ।

সায়েম এতক্ষণ ধরে তার বাবার কর্মকাণ্ড দেখছিল । ওর বাবাকে কখনোই কোনো অপরিচিত মানুষের সাথে এতো কথা আগে বলতে দেখেনি সে । সায়েম ভাবত, বাবা ওর ব্যাপারে ছাড়া দুনিয়ার বাকি সবার প্রতি বদমেজাজি,রগচটা আর গম্ভীর । এতোটা আন্তরিকভাবে গরীব বাচ্চা দুটোর সাথে কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে । এমনকি বাবা যেভাবে কৌশলে বাচ্চা দুটোকে তুই-টোকারই করেই ছাড়লেন, সেটাও সে লক্ষ্য করেছে । কিন্তু এখন আবার হঠাৎ করে চুপ করেই বা আছেন কেন সেটাও সে বুঝতে পারে না । আজ বাবাকে কেন যেন খুব অচেনা লাগছে ছোট্ট সায়েমের ।

অনেকক্ষণ পর, সায়েমের বাবা মুখ তুলে বাইরে তাকিয়ে সায়েমকে বললেন, “রেডি হয়ে নাও । এসে গেছি । নামতে হবে ।”

***
স্টেশনে নেমেই এই রোদের মধ্যেও বেশ কোমলতা টের পেলেন শফিক সাহেব । ঠাণ্ডা লাগছে বেশ । শহুরে কার্বনের বিষাক্ততা এখানে নেই । চোখ বন্ধ করেও বলে দেয়া যায় তারা এখন গ্রামের কাছাকাছি এসে গেছেন ।
সায়েমকে একহাতে ধরে রেখে টেম্পোতে চড়ে আসলেন গাঁয়ের নিকটবর্তী সবচেয়ে বড় বাজারটার টেম্পো স্ট্যান্ডে । এখান থেকে বেশ কিছু কেনাকাটা করা দরকার । রশীদ,হামিদের কাছ থেকে কেনা ক্যান্ডিগুলো বাড়ির উঠানে পুরো গ্রামের বাচ্চাদের ডেকে তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিবেন । প্রতিবারই করেন । এতে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও একটা কর্তৃত্ব-ভাব বজায় থাকে । মানুষের একটা অদ্ভুত স্বভাব হল, সারাজীবন ধরে সে যার সাহায্য পায়, তার চেয়ে অল্প সময়ের জন্য অযাচিতভাবে যার কাছ থেকে বেশী সাহায্য পায় তার প্রতিই বেশী কৃতজ্ঞ থাকে । গ্রামের মানুষদের মধ্যে এই মনোভাবটা আরো বেশী । শফিক সাহেব সেটা জেনে-বুঝেই কাজে লাগান । ভাই-ভাবীর জন্য, তার ভাস্তির জন্য কিছু না কিছু কিনে নিলেন । বাজারে থাকা অনেকেই শফিক সাহেবকে চিনেন । গ্রাম থেকে লেখাপড়া করে এখন অনেক বড় অফিসার হয়ে যাওয়া এই মানুষকে প্রায় সবাইই সমীহ করে চলে । তাছাড়া মাঝে মাঝে শফিক সাহেব নিজের মর্জি মত অনেক মানুষকেই সাহায্য করেন, তার সুনজরে থাকা ভালো ।
গ্রামে যেতে এখনো প্রায় দু’মাইল পথ হাঁটা লাগবে । সরাসরি যাওয়ার মত যানবাহনের রাস্তা বা ব্যবস্থা কোনোটাই নেই । সায়েমকে এতদূর নিয়ে যাবেন কীভাবে ? বাজারের টং দোকানে বসে চা খেতে খেতে তিনি একবার কথাটা তুলতেই অনেকে আগ্রহ দেখালো, সায়েমকে কোলে করে গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিতে । শফিক সাহেব তাদের মধ্য থেকে সুজনকে বেছে নিলেন । পশ্চিম-বাড়ির মোস্তাক ভাইয়ের ছেলে । সুজনকে ছোটবেলায় অনেকবার কোলে করে ঘুরেছেন, আর আজ এই ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেছে !
বাজারের পাশ থেকে একটা শাখা নদীর উপশাখা ঢুকে গেছে জমির মধ্য দিয়ে । এই নদীর উপশাখার পাড় ধরে যেতে হবে, জমির আইলের উপর দিয়ে । তিনি হাঁটতে হাঁটতে সুজনের কাছ থেকে গ্রামের অবস্থা সম্পর্কে টুকিটাকি জিজ্ঞেস করে নিলেন । শফিক সাহেব বুঝতে পারছেন যে, তিনি বেশ অন্যমনস্ক হয়ে আছেন । সুজনকে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের উত্তর সে দিচ্ছে কি না বা কি বলছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না । ট্রেনের বাচ্চা দুটো তার ভাবনায় বেশ বড় ধরণের একটা দাগ ফেলে গেছে । সেটা কাটিয়ে উঠতেও পারছেন না ।

শফিক সাহেব মাথা তুলে চারদিকে তাকিয়ে একবার বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন । নদীটার পানি কমে আছে । কাছেই অল্প পানিতে ধানের চারা লাগিয়ে রাখা হয়েছে । এই জায়গাটা বেশ উর্বর, চারাগুলো তাড়াতাড়ি বড় হবে । শফিক সাহেব সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছেন, এই নদীটার পানি এরকম অল্পই । মরা নদী,মরা নদী বলে আসলেও নদীটা এখনো মরে যায়নি । বর্ষাকালে তা ভালোভাবেই টের পাওয়া যায় । দু’কূল উপচে পানি পরে তখন । ছোটবেলায় এই নদীতে ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে দুভাই মিলে চলে যেতেন অনেকটা দূর । মাঝে মাঝে মাছও ধরতেন। বহুবার বড় ভাইয়ের কথা না শুনে পানিতে বিপজ্জনকভাবে পা ভিজিয়ে বসে থাকার কারণে মারও খেয়েছেন । কখনো, নদী পাড়ের কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে মারামারি করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক-মাখন সহোদরের মত । স্কুল শেষে বন্ধুদের সাথে ফসল উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া জমিতে ছাল-চামড়া উঠে যাওয়া ফুটবল নিয়ে খেলতে নেমে যেতেন । কাটা ধানগাছের গোঁড়াগুলো পায়ের পাতায় সূক্ষ্মভাবে ব্যথা দিলেও তা উপেক্ষা করে মহাসুখে খেলে বেরিয়েছেন। খেলা শেষে নদীর পানিতে গোসল শেষে বাড়ি ফিরেছেন । এ-ই সেই নদী । আজ সম্পত্তি ভাগাভাগির পর আর কি কখনো আসবেন এখানে ? যেভাবে অনুভব করতেন এই প্রকৃতিকে,তা কি আর সম্ভব হবে ? চির আপন এ জায়গাকে পর করে দিতে কি পারবেন তিনি ?
কিছুক্ষণ পর তালুকের চরের জমিটা সামনে পরে যাওয়ায় তার আবার মনে পড়ে গেল, ঢাকায় নিজেদের একটা ফ্ল্যাটের সেই ইচ্ছেটা । দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব মন থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন । এ জমিটা বিক্রি করে তাকে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনতে হবেই । কিন্তু পুরোপুরি মনের মধ্যে খুঁতখুতিটা দূর করতে পারলেন না । চাইলেই কি এসব সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় ? মুছে ফেলা যায় স্মৃতি ?

সুজন আর সায়েম কি যেন বলাবলি করছে, সায়েম হাসছে খুব । এই নোংরা পৃথিবীর মাঝেও যে নির্মলতা এইসব গ্রামীণ পরিবেশে রয়ে গেছে, সেটার কিছুটা হলেও যদি সায়েম বুঝতে পারে, তবেই শফিক সাহেব সার্থক । কিন্তু গ্রাম-বাংলা থেকে তিনি নিজেই আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাইছেন । তার ছেলে কি শিখবে তাহলে ?

শফিক সাহেবের বাবা মারা যাওয়ার পর সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ বিপদে পরেন তারা দুই ভাই । বাবা তাদের খোঁজখবর তেমন একটা না রাখলেও তিনি ছিলেন, একটা আশ্রয়ের মত । সেই আশ্রয় হারিয়ে যাবার পরই দুই ভাই টের পান বাবার গুরুত্ব । বিষয়-সম্পত্তি খুব একটা কম ছিল না তাদের । কিন্তু দেখাশোনার অভাবে বেদখল হয়ে যায় বেশ কিছু জমি । এতোসব জেনে বড় ভাই রফিক আর দূরের কলেজে ফিরে যেতে চাইলেন না । গ্রামে থেকে শক্ত হাতে ধরেন সংসারের হাল । কিন্তু তবুও উনিশ বছর বয়েসী তরুণ রফিক আর কতোটাই বা পারতেন ? এরমধ্যে জমি বেদখল হওয়া থামালেন, নিজের লেখাপড়া আর না আগালেও ছোট ভাইকে পাঠিয়ে দেন স্থায়ী জেলা শহরের নামকরা কলেজে । নিজেদের জমিতে চাষবাস করতেন তখন । কি খেতেন, কি পরতেন তা জানার উপায় ছিল না । শফিক সাহেব নিজেও অনেক কষ্টে মেসে থেকে লেখাপড়া করতেন । ইউনিফর্ম ছিঁড়ে গেলে নিজেই সেলাই করে নিয়েছেন । মাসিক আড়াই হাজার টাকার মত প্রয়োজন হত । বড় ভাই কষ্টে-সৃষ্টে বাইশশ’,তেইশশ’ এরকম অংকের টাকা পাঠাতেন । তা দিয়ে টায়ে টায়ে দিনাতিপাত করতে হত শফিক সাহেবের । অবশ্য বড় ভাই যে কীভাবে এই টাকা যোগাড় করে দিতেন, তাও অজানা ছিল শফিক সাহেবের কাছে । যতই গ্রামের দিকে এগুচ্ছেন ততই সেসব কথা মনে পড়ে এক ধরণের অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেন তিনি ।

হাঁটতে হাঁটতে এক সময় গ্রামে পৌঁছে গেলেন তারা । মজার ব্যাপার হল, মৌচাক থেকে শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত হাঁটতেও শফিক সাহেব হাঁপিয়ে পরেন, অথচ আজ এতদূর হেঁটেও খুব একটা ক্লান্তি লাগছে না । গ্রামের আবহাওয়াটাই অন্যরকম!

এই গ্রামটির নাম পাঁচদোনা । গ্রামের ঠিক মাঝ বরাবর সবচেয়ে বড় বাড়িটাই রফিক সাহেব-শফিক সাহেবদের । বাড়ির সামনে বিশাল উঠান আর তারপরই সর্বদক্ষিণে পারিবারিক কবরস্থান । দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে গ্রামের মসজিদ । উঠানের পশ্চিমে তাদের নিজস্ব পুকুর । পুকুরে নিজের হাতে মাছ চাষ করেন রফিক সাহেব । শফিক সাহেব যখন বাড়িতে এসে পৌঁছলেন, তখন রফিক সাহেব পুকুর-ঘাট থেকে ওযু করে উঠেছেন মাত্র । শফিক সাহেব অনেকদিন পর মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলেন বড় ভাইকে । মুখ-ভর্তি দাঁড়ি নেমে এসেছে অনেকখানি । রোদেপোড়া মুখ ঢেকে আছে অনেকটা ।কিন্তু রফিক সাহেবের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এখনো আগের মতই রয়ে গেছে ।
“কখন আসছস ? সময় জানায়া আসতে পারতি, লোক পাঠাইয়া দিতাম ।”
শফিক সাহেব ঝুঁকে বসে বড় ভাইজানকে কদমবুসি করে উত্তর দিলেন, “বাজারে পশ্চিম-বাড়ির সুজনরে পাইছিলাম । সমস্যা হয় নাই ।”
রফিক সাহেব বেশ অবাক হলেন । শফিক গত দশ বছরে কখনো পায়ে ধরে সালাম করেছে বলে তার মনে পড়ে না । তিনি বললেন, “পায়ে ধরে সালাম করা ঠিক না । নবীজীর নিষেধ আছে । উঠানে চেয়ার পাতা আছে । তুই গিয়া বস । আমি তোর ভাবীরে বইলা আসি কিছু খাবার দিতে ।”
রফিক সাহেব খবর পেয়েছেন, প্রায় চার বছর পর শফিকের বাড়িতে আসার কারণ একটাই, সম্পত্তি ভাগাভাগি করা । সেই উনিশ বছর বয়স থেকে তিনি এ বাড়িসহ সব সম্পত্তি দেখেশুনে আসছেন। জমির বেদখল রোধ করার জন্য আদালতে দৌড়াদৌড়ি করেছেন । যতদিন সম্ভব হয়েছে,নিজের হাতেই জমি চাষ করে এসেছেন । আজ বয়স এসে পৌঁছেছে প্রায় চল্লিশে । ছোট ভাই নিজের সম্পত্তির ভাগ চাইছে, চাইতেই পারে । তাতে রফিক সাহেবের আপত্তি নেই। শুধু বহু পুরনো, চেপে রাখা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায় ।

রফিক সাহেব তার স্ত্রীর হাতে বানানো মিষ্টান্ন,মোয়া আর বাজার থেকে কেনা বিস্কুট দিয়ে প্লেট সাজিয়ে নিতে লাগলেন । তাকে সাহায্য করল, মেয়ে আমিনা । খাবার নিয়ে উঠানে গিয়ে রফিক সাহেব অবাক চোখে তাকালেন সায়েমের দিকে । সায়েমকে তিনি আগে কখনো দেখেননি, তাকে কেউ বলেও দেয়নি, তবু তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন এ ফুটফুটে দেব-শিশুর মত বাচ্চাটাই শফিকের ছেলে । তিনি খাবারগুলো প্লাস্টিকের টেবিলে রেখে সায়েমকে কোলে তুলে নিলেন । বাচ্চা-কাচ্চা তার খুবই প্রিয় ।

শফিক সাহেব নিজের ভাস্তির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি নাম তোমার ?”
“আমিনা ”
“কোন ক্লাসে পড় ?”
“ক্লাস ফোরে ।”
“বলতো, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কে লিখেছেন ?”
“কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।”
“বাহ, সাবাস ! ক্যান্ডি খাও ?”
আমিনা বাবার দিকে তাকিয়ে লজ্জা-মাখা মুখে আস্তে করে হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলালো । শফিক সাহেব ব্যাগ থেকে পুরো এক প্যাকেট ক্যান্ডি আমিনার হাতে ধরিয়ে দিতেই সে দৌড়ে পালালো । আমিনা সেই ছোটবেলা থেকেই তার এ চাচার কথা শুনে আসছে বাবা-মা সহ গ্রামের আরো অনেকের মুখে । বছর কয়েক আগে দেখেছিলও একবার । সেবার কোনো কথা বলেননি । হয়তো চিনতেনও না যে, এই আমিনাই তার আপন ভাইয়ের মেয়ে । আজকে যখন তার এই অতি মেধাবী চাচাটি তার সাথে কথা বলছিল, আমিনার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না । আগের গম্ভীর চাচা আর এই চাচার মধ্যের বিস্তর পার্থক্য তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলছে ।

রফিক সাহেব কিছুক্ষণ পর কনিষ্ঠ ভাইটিকে বললেন, “সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়া কিছু একটা করবি শুনছিলাম...”
শফিক সাহেব অপরাধীর মত মাথা নামিয়ে উত্তরে বললেন, “ঐসব কথা থাক ভাইজান । পরে কোনো একসময় দেখা যাইবো...”
রফিক সাহেব কিছু বললেন না । জুম্মার নামাজের জন্য প্রস্তুত হতে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন ।
জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে এসে শফিক সাহেব দক্ষিণ দিকে দূরে তাকিয়ে রইলেন ।একটা নাগরদোলার মাথা দেখা যাচ্ছে । বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “দক্ষিণগাঁওয়ের মেলাটা কি এখনো হয় ভাইজান ?”
“হ...ঐটাই । বিকালের দিকে সায়েমরে নিয়া যাইস । শহরে বড় হইছে, গ্রামের মেলা-টেলা দেখুক কিছু ।”
শফিক সাহেব নীরবে সম্মত হলেন । খাওয়া-দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে তিনি নিজেই হাঁক-ডাক করে ‘পূবের বাড়ি’, ‘পশ্চিম বাড়ি’ থেকে বাচ্চা-কাচ্চাদের
জড়ো করেন নিজেদের বাড়ির উঠানে । সবার মধ্যে একটা উৎসব-উৎসব অনুভূতি । ‘বড় বাড়ি’র ছোটজন আজকে সবার বাড়িতে গিয়েছে, এতো অভূতপূর্ব ঘটনা ! তবে এরমধ্যেও গ্রামবাসীর অনেকে অনেক সন্দেহ শুরু করে দিয়েছে । বড় বাড়িতে আজ সম্পত্তি ভাগাভাগি হবে, একথা প্রায় সবাই জেনে গেছে । এখন আবার ছোটজন কোন নাটক শুরু করতে চাইছে !
রফিক সাহেবও শফিকের কাণ্ড দেখে আবারো বেশ অবাক হয়ে গেলেন । হলো কি, আজ ওর! শফিক সাহেব বিনীতভাবে বড় ভাই রফিককে বললেন, “ভাইজান, দক্ষিণগাঁওয়ের মেলায় যাইতাছি সবাইরে নিয়া । আপ্নেও আসেন ।”
“আমি ক্যান ?”
“এম্নেই । চলেন যাই”

রফিক সাহেব গায়ে পাঞ্জাবী চড়ালেন । একসময় দক্ষিণগাঁওয়ের মেলাতে যাওয়ার উপলক্ষে দুই ভাই হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিতেন । বাবাকে এই একটা দিনই নিজেদের মত করে পেতেন তারা । অনেক খেলনা কিনে দিতেন, নাগরদোলায় চড়াতেন । শফিকের হয়তো সেসব কথাই মনে পড়ে থাকতে পারে ।

কিছু জমিতে দুই আইলের মধ্য দিয়ে সেঁচের পানি যাওয়ার জন্য বড় জায়গা রাখা হয় । সে জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় । আইলের উপর দিয়ে হাঁটা লাগে না । বড় ভাইকে সামনে রেখে শফিক সাহেব পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন । বাতাস বয়ে যাচ্ছে বেশ । বাচ্চা-কাচ্চারা সামনে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে । আমিনা,সায়েমকে দেখে রাখার মত মানুষেরও অভাব নেই । গ্রামবাসীর অনেকেই দূর থেকে এই গাঁয়ের মাথা, দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে । কি হতে যাচ্ছে আজকে ?

হাঁটতে হাঁটতে একটা গাব গাছের কাছে এসে গেলেন তারা । ছোটবেলা থেকে তারা শুনে এসেছেন এই গাছে ভূত থাকে । সেই ভূত দেখার জন্যও বাজি ধরে রাত জেগে এই গাছের আসতে গিয়ে ভয়ে কাঁপছিল সেই সময়ের ছোট্ট শফিক । কিসব দুরন্ত দিন যে গেছে ! মেলা নিয়েও একবার এরকম ঘটনা ঘটিয়েছিলেন । তিনি রফিক সাহেবকে ডাকেন, “ভাইজান...”
“হুমম ?”
“ছোটবেলায় একবার মেলায় হারায়া গেছিলাম, মনে আছে আপনার ?”
“মনে থাকবো না আবার ! কি কান্নাকাটিই না করছিলি ঐদিন !”
“একবার বলবেন পুরা ঘটনাটা ? শুনতে ইচ্ছা করতাছে ।”
“তোর মনে নাই সব ? সেইবার আমি তোরে নাগরদোলায় চড়ার লাইগা লাইনে দাঁড় করাইয়া গেছিলাম পানি খাইতে ।আইস্যা দেখি তুই নাই ! নাই তো নাই-ই। খুঁইজা পাওয়া যায় না এই অবস্থা । তখন অনেক ঘুরতে ঘুরতে তোরে পাইলাম যাত্রার দলের লোকজনেগো লগে । তুই আমারে দেইখা হাত ধইরা সেই কি কান্দন! তোর কান্না থামানো যায় না । হাতও ছাড়স না !” রফিক সাহেব, শফিক সাহেব সেদিনকার কথা মনে করে দুজনেই প্রাণ খুলে হাসতে থাকেন । বহুদিন এমনভাবে হাসেননি দুই ভাই । গ্রামে থেকে দূর হতে যারা এই দুই ভাইকে লক্ষ্য করছিলেন, তাদেরও বিস্ময়ে ফেটে পড়ার মত অবস্থা! শেষ কবে, এই দুই ভাইকে একসঙ্গে কথা বলে এরকম হাসতে দেখেছিলেন,তা কারোরই মনে পড়ে না ।

রফিক সাহেব আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলেন । বাতাসের বেগটা বেড়েছে । সরিষা ক্ষেত থেকে কিছু কিছু হলুদ ফুল উড়ে আসছে । অত্যন্ত মনোরম একটা দৃশ্য । শফিক সাহেব হঠাৎ করে থেমে গেলেন । তার আশেপাশের দৃশ্যপট যেন পালটে যেতে থাকলো । সামনে হেঁটে যেতে থাকা ভাইজানের ছায়াটুকুও আস্তে আস্তে পালটে যেতে থাকে ।
এই গ্রামে, এই গ্রামের আলো-বাতাসে তিনি বড় হয়েছেন । এ গ্রামের প্রতিটি বালুকণা তার অস্তিত্বের পরিচয় দেয় ক্ষণে ক্ষণে । সামনে থাকা কাচা-পাকা চুল-দাঁড়ি মাথায় এই মানুষটা তার ভাই । মায়ের পেটের আপন ভাই । একই রক্তের মানুষ তারা দুজন । এই মানুষটা নিজের ছোট ভাইয়ের জন্য ত্যাগ করেছেন প্রচুর । ছোট ভাইটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজে রোদে-পুড়ে খেটেছেন,কষ্ট করেছেন । দুই ভাই ছোটবেলায় একসাথে মিলেমিশে ছিলেন । নিজেদের মধ্যে খাবার ভাগাভাগি করেছেন । ছোট ভাইয়ের যাতে না খেয়ে থাকতে না হয়,সেজন্য বড় ভাই নিজে অভুক্ত থেকেছেন । রাগ-অভিমান-ভালোবাসা-স্নেহে বড় হয়ে আজ সেই ছোট্ট ভাইটি অস্বীকার করতে চাচ্ছেন নিজের আপন বড় ভাইকে ! এটাও কি সম্ভব!
সম্পর্কের বন্ধন প্রায় সময়েই তুচ্ছ মনে হতে থাকে । এই শফিক সাহেব যখন ছোটবেলা থেকে নিজের মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত থেকেছেন, তখন থেকে তার মনে হয়েছে মায়ের স্নেহ ছাড়াও বেঁচে থাকা অসম্ভব নয় । বাবা ছিলেন ‘থেকেও নেই’ মত । তাঁর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে । সেরকম করে তিনি নিজ ভাইকে ছাড়াও হয়তো ভালোভাবেই জীবন পার করে দিতে পারবেন ; সব সম্পত্তি ভাগাভাগি করে আলাদা হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে । কিন্তু তার ঠিক বিপরীত যুক্তিও তো খাটতে পারে! মানুষ যেমন চাইলেই পরস্পর সম্পর্কের বন্ধন থেকে আলাদা হয়ে জীবন কাটাতে পারে, ঠিক একইরকম একসাথে মিলেমিশে থাকাও তো নিশ্চয়ই অসম্ভব কিছু না । কি দরকার এই সম্পর্ক ছিন্ন করার ? কি দরকার এই আলাদা হয়ে গিয়ে স্বার্থপরতায় মনোযোগী হওয়ার ? যেই ছোট্ট ভাইটি একসময় ভয় পেয়ে অগ্রজকে জড়িয়ে ধরে আশ্রয় পেতে চাইতো,সেই সহোদরের এমন কি দরকার পরবর্তীতে নিজ পরিবারের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অজুহাতে ছোটবেলায় আঁকড়ে ধরা হাত নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেবার ? একী নিজের সাথেই প্রতারণাই নয় ? শফিক সাহেব বাবা-মা’কে ছাড়া জীবন অতিবাহিত করার সময় এক মুহূর্তের জন্যেও কি তাদের কথা মনে করে নিঃসঙ্গ বোধ করেননি ? তাহলে কি দরকার আজ সেই নিঃসঙ্গতার পাল্লাকে ভারী করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে জীবন কাটাবার ? তিনি চাইলেই একাকীত্বের শেকলে পা জড়াতে পারেন আবার সে শেকল থেকে মুক্তিলাভও করতে পারেন । পুরো ব্যাপারটাই নিজের একটা ছোট্ট সিদ্ধান্তের ।

“ভাইজান, আপনার হাতটা একটু ধরি ?”
রফিক সাহেব মুখে কিছু বললেন না । তবে একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন শফিক সাহেবের দিকে । পোড়-খাওয়া,বহু অভিজ্ঞতায় পূর্ণ খসখসে চামড়ার হাতটি গভীর মায়ায় স্পর্শ করে শফিক সাহেব আত্মতুষ্ট হন ।
রফিক সাহেব পিছনে তাকাননি। তাকালে দেখতে পেতেন তার ছোট ভাইটি ছোটবেলায় মেলা থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর তার দেখা পেয়ে যেভাবে হাপুস নয়নে কেঁদে শার্ট ভেজাচ্ছিলেন, আজ ঠিক একই রকমভাবে সে কেঁদে চলেছে ।

শফিক সাহেব শক্ত করে ধরে রেখেছেন বড় ভাই রফিকের হাত, এ হাত আর কোনোদিন তিনি ছাড়বেন না ।

- সমাপ্ত -
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×