somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বলার আগে সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে জানুন। এরপর কথা বলুন।

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এবার পুরো লেখাটাই একসাথে দিলাম-

‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’-ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের অতি চর্বিত একটি শ্লোগান। প্রথম শ্রবণেই মন আকৃষ্ট হয়। মতভিন্নতার মাঝেও সবাই মিলে জুড়ে থাকার একটা যুৎসই পন্থা বলে মনে হয়। কিন্তু একটু গভীরে ডুব দিলেই বুঝে আসে, কথাটি নানা জটিলায়তনে বাঁধা। সুক্ষ্ম একটা কুটচাল কথাটিতে বিছিয়ে দেওয়া আছে। যা দিয়ে টার্গেটকে সহজেই বধ করা যায়। নৈতিকতার শ্লোগানে অনৈতিকতার হরিলুট সেরে ফেলা যায়। নিছক কল্পনার দাবি নয়, বাস্তবতার নিরিখেই বিষয়টি প্রমাণসিদ্ধ। সামনে বাড়ানোর আগে আমরা প্রমাণটা একটু ঘেঁটে নিতে চাই।
শুরুতেই আসা যাক-ধর্ম কাকে বলে? মত, পথ, নীতি, পন্থা, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি অর্থে ‘ধর্ম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যে কোন মত, পথ পদ্ধতি ও বৈশিষ্ট্যকেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুর ধর্ম হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘আলোর ধর্ম’ ‘বস্তুর ধর্ম’ ‘প্রাণের ধর্ম’ ‘চুম্বকের ধর্ম’ ইত্যাদি ব্যবহারগুলো এ অর্থেই আমাদের নিকট পরিচিত। এ হিসেবে বলা যায়- পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণী, এমনকি প্রতিটি বস্তুরও একটি করে ধর্ম আছে। এখন যদি বলা হয় ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’- এ কথার অর্থ আদৌ এটা নয়- প্রতিটি মানুষের নিজস্ব পালনীয় ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নেই। রাষ্ট্রের কোন নীতিপথ নেই। নিয়ম-নীতি, পথ-পদ্ধতি ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। বরং রাষ্ট্রেরও একটি ধর্ম আছে। প্রতিটি রাষ্ট্রই একটি ধর্ম মেনে চলে। নির্দিষ্ট ধর্ম, নির্দিষ্ট নীতিপথ, ও নিয়ম-পদ্ধতি মেনেই প্রতিটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এমন কি যারা শ্লোগানটির প্রবক্তা তাদের রাষ্ট্রও।
এবার আসা যাক রাষ্ট্রের ধর্ম ও নীতিপথ কোনটি হয় তা একটু তলিয়ে দেখি। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের ধর্ম হল- ঐ রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, বিশেষকরে রাষ্ট্রটি যারা পরিচালনা করেন, তাদের বোধ-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী একটি আদর্শ ও কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র যেভাবে পরিচালিত হওয়া উচিৎ বলে মনে হয়, সেটিই হয় ঐ রাষ্ট্রের ধর্ম। তাহলে ঐ বহুল চর্বিত শ্লোগন ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ বাক্যটি ব্যবহৃত হয় ঐ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র-ভাবনাকে নিধনের জন্য (কিংবা জনসংখ্যায় তারা বৃহৎ হলেও) রাষ্ট্র-ব্যবস্থা পরিচালনার ভার যাদের হাতে নেই। আরেকটু স্পষ্টভাবে বললে- পৃথিবীতে যত ধরণের ধর্ম বা মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে, তা দু’প্রকার :

এক. ঐসব ধর্ম বা মতবাদ যা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে পালনীয় কিছু আচার-অনুষ্ঠানের নির্দেশনা দেয়। আর কিছু ভাল ভাল উপদেশও প্রদান করে। মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন সম্পর্কে এসব ধর্ম বা মতবাদ থেকে তেমন কিছু পাওয়া যায় না।
দুই. ঐসব ধর্ম বা মতবাদ যা মানুষের সামাজিক জীবন, বিশেষকরে রাষ্ট্রীয় জীবন কেমন হবে এসব বিষয়ে পথ নির্দেশ করে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন পদ্ধতি নিয়ে এসব ধর্ম বা মতবাদে ‘সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা’ ছাড়া তেমন কোন পথনির্দেশনা থাকে না।
প্রথম প্রকারের ধর্ম বা মতবাদের অন্তর্ভুক্ত হল- ইহুদী ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় প্রকার ধর্মের অন্তর্ভুক্ত- পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, এই উভয় প্রকারের ধর্ম বা মতবাদ আপন আপন ক্ষেত্রেও পূর্ণাঙ্গ নয়, অসম্পূর্ণ। ফলে সবগুলোতেই নানা সংযোজন-বিয়োজন করা হয় বা করতে হয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে ইসলাম ধর্ম এই উভয়ক্ষেত্রেই নিজের শক্তিশালী অবস্থানের যেমন দাবি করে, তেমনি উভয়ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গতারও দাবিদার। ইসলাম মানুষকে তার ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে যেমন পথ-নির্দেশ দেয়, তেমনি মানুষকে তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও কিছু নীতিমালার আওতায় সমাজ ও রাষ্ট্র চালাতে বলে। এই অর্থেই প্রথম দিন থেকেই ইসলামের বাণী হল “ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থার নাম”।

এখন দ্বিতীয় প্রকার ধর্মের মতাবলম্বীরা ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ বলে প্রথম প্রকারের ধর্মমত উদ্দেশ্য নেয়। কিন্তু প্রথম প্রকারের কোন ধর্মমতই যখন রাষ্ট্রচিন্তায় সরব কিংবা শক্ত কোন অবস্থানে নেই, তখন শ্লোগানটি দ্বারা প্রকারান্তরে ইসলাম ধর্মের রাষ্ট্রচিন্তাকেই নির্মূল করা উদ্দেশ্য হয়। ইসলাম যদি সত্যিই মানুষকে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য কিছু নীতিমালা দিয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য অন্যান্য মতাদর্শের ন্যায় এটিও একটি মতাদর্শ। হ্যাঁ, পার্থক্য এতটুকু অন্যগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়, এটি পূর্ণাঙ্গ। অন্যগুলো মনুষ্যত্ব ও মানবতার শ্লোগান দেয়, আর এটি মনুষ্যত্ব ও মানবতা প্রতিষ্ঠা করে। অন্যগুলোয় শুভঙ্করের ফাঁকি আছে, এখানে কোন ফাঁকি নেই। অন্য মতবাদগুলো বিভেদ-বৈষম্যহীন শান্তি ও সমৃদ্ধির একটি রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করে, মতবাদগুলোর যথার্থতা আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি; আর ‘ইসলামই যে বিভেদ-বৈষম্যের সকল দেওয়াল ভেঙে দিতে সক্ষম, সক্ষম শান্তি ও সমৃদ্ধি দিতে’- একথা ইসলাম ইতিহাসে একাধিকবার প্রমাণ করেছে।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার অন্যসব মতাদর্শের মত সাধারণ একটি মতাদর্শও যদি ধরা হয় তবুও তো তা পৃথিবীতে টিকে থাকার এবং মানুষ চাইলে তা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু সাধারণ একটি মতাদর্শ হিসেবেও এটিকে মূল্যায়ন না-করে, কেউ এটিকে ভালবাসলে তার প্রতি অতিমাত্রায় বিরূপ ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠা কি সাম্প্রদায়িকতা নয়?

ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা রাষ্ট্রে মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সুষম বণ্টনে যখন চরম বৈষম্য ও অব্যবস্থাপনা দেখে, এমনকি রাষ্ট্রকে প্রাণের নিরাপত্তাটুকুও দিতে ব্যর্থ হতে দেখে; তখন যদি তারা দাবি করে- রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামের কালজয়ী নীতিমালাগুলো চালু করা হোক, তখনই আওয়াজ ওঠে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’। অথচ চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থা পদ্ধতিও যে একটি ধর্ম- একথা আওয়াজধারীরা বুঝতে চান না, কিংবা বুঝেও না বুঝার ভান করেন। শুধু তাই নয় নিজেদের এই সাম্প্রদায়িক আচরণকে উল্টো প্রতিপক্ষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার নসীহত করেন। এভাবেই চলে সাম্প্রদায়িক শব্দটির বহুল অথচ ভুল ব্যবহার। তাই আমরা একটু বিস্তারিত বিশ্লেষণ দিয়েই দেখে নিতে চাই 'সাম্প্রদায়িক' শব্দটার গতি-প্রকৃতিটা কী?

আমরা এখানে সাম্প্রদায়িকতার সম্ভাব্য সকল অর্থ একে একে উল্লেখ করব এবং প্রত্যেকটির বাস্তবতাটাও একটু পরখ করে নেবো।

+ সাম্প্রদায়িকতার প্রথম অর্থ: মানুষ ও মনুষ্যত্বের উপর পশুত্বের মহড়া দেওয়া।
পৃথিবীর সবচে’ বড় সত্য হল আমরা সকলেই মানুষ। মত-পথের হাজারো বিভেদের পরও এই একটি সত্যে আমরা সকলেই এক। আর পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই ‘মানুষ’ হিসেবে কমবেশি কিছু মানবিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, ন্যায়-নীতি, ইনসাফ ও মহানুভবতার মত মানবিক গুণগুলো কমবেশি সকলেই ধারণ করে। এবার কখনো সম্প্রদায়গত বিভেদ যখন মানুষের এই মনুষ্যত্বকেও ছাপিয়ে ওঠে তখনই তা হয় ‘সাম্প্রদায়িকতা’। তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, মানুষের কাতার থেকে বেড়িয়ে যায়।
পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িকতার অতীত সকল রেকর্ড একত্রিত করলে এই একটি সত্য বের হয় যে, যে-সম্প্রদায়ের নৈতিক বাধ্যবাধকতা যত দুর্বল, এ অর্থে (মনুষ্যত্ব ও মানবতাকে দলন) সে-সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক আচরণ তত বেশি এবং ভয়াবহ। কথাটিকে আরো সুস্পষ্ট করতে নিম্নোক্ত শ্রেণীভেদে আমরা বিষয়টাকে বিন্যাস করতে পারি।

এক. যে সাম্প্রদায়ের ধর্মীয় কোন বাধ্যবাধকতাই নেই। যেমন- প্রকৃত সেক্যুলারিজমে যারা বিশ্বাসী। অর্থাৎ কোন ধর্মেই যাদের আস্থা নেই; নিজেদের খেয়াল-খুশীই যাদের ধর্ম। কমিউনিজম যাদের প্রধান আশ্রয়। এ সম্প্রদায়টি বয়সে সবচে’ নবীন হলেও এদের সাম্প্রদায়িক ভয়াবহতার রেকর্ড অতীতের যেকোন ভয়াবহতাকেই চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ভীন্ন মতাদর্শীদের নির্মম উপায়ে নির্মূল করতে কোন নীতিবোধই যাদের বাধা দিতে পারে না। প্রমাণ আমরা সামনে দিচ্ছি।

দুই. ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আছে কিন্তু তা না-মেনে চলার সংস্কৃতিটাই যাদের জন্য স্বাভাবিক। যেমন- ইহুদী ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়। অবশ্য তাদের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা না-মানার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। যেমন- ধর্ম তার আসল স্বরূপ হারিয়ে ফেলা। নানা বিকৃতি-বিবর্তনের ফলে এমন অযৌক্তিক বিষয়-ব্যাকরণ ধর্মে স্থান পেয়ে যাওয়া, যার ফলে এই আধুনিক যুগে ধর্মকে গির্জাবদ্ধ করে রাখাই জীবন স্বাচ্ছন্দে চালানো ও আধুনিক উৎকর্ষকে এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র পন্থা।
এ শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক ভয়াবহতাও পূর্বোক্ত শ্রেণীর কাছাকাছি। কেননা বাধ্যবাধকতা না থাকা আর থাকলেও তা না-মানা প্রায় একই কথা। এ কারণেই মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করলেও তারা খ্রীষ্টান অধিবাসীদের মধ্য থেকে যাদের ইচ্ছা নিরাপত্তা নিয়ে থাকার, আর যাদের ইচ্ছা নিরাপদে চলে যাওয়ার পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিল; কিন্তু পরবর্তীকালে খ্রীষ্টানরা আবারো তা দখল করলে ৭০ হাজার মুসলমানকে নির্মমভাবে শহীদ করে। অবশ্যই তাদের ধর্ম তাদেরকে এমন কোন নির্দেশনা দেয় না। অনুরূপভাবে স্পেনে মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ শান্তি-সমৃদ্ধি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের পয়গাম নিয়ে হাযির হলেও খ্রীষ্টানরা ৭ লক্ষ মুসলমানকে পুড়িয়ে,পানিতে ডুবিয়ে, দেশান্তর ও হত্যা করে সেখান থেকে মুসলমানদের বিদায় দেয়। আমার বিশ্বাস এমন নির্দেশনাও তাদের কিতাবে নেই। নিকট অতীতে এমন আরো অনেক বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত আছে। আর ইহুদী রাষ্ট্র ‘ইসরাইল’ তো বর্তমান পৃথিবীর এক বিভীষিকার নাম।

তিন. ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আছে, তবে তা ন্যায়-নীতির নয়, বৈষম্যের। সেই সাথে না-মানার সংস্কৃতিতো আছেই। যেমন- হিন্দুধর্মের অনুসারীদের শ্রেণী-বিভেদ, বৈষম্য-বিন্যাস। মনু শাস্ত্রে মানব-বৈষম্যের যে ভয়াবহ চিত্র আছে তার কিয়দাংশ এখানে তুলে ধরছি। উল্লেখ্য, মনুশাস্ত্র অনুযায়ী হিন্দু ধর্মের শ্রেণীভেদটা হল এরকম- ব্রা‏‏হ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হল ব্রা‏‏হ্মণ, যারা ভগবানের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি আর সর্বনিম্নশ্রেণী হল শূদ্র যাদের আপাদমস্তক ব্রা‏‏হ্মণদের পদসেবার জন্যই তৈরি।
মনুশাস্ত্রে ব্রা‏হ্মণ ও শূদ্রদের মাঝে যে আচরণবিধি উল্লেখ আছে তা নিম্নরূপ :

“ব্রা‏হ্মণ ইচ্ছা করলে শূদ্র থেকে জোরপূর্বক মাল নিতে পারে এবং তাতে কোন পাপ হবে না’।
‘শূদ্ররা সম্পদ জমা করার যোগ্য নয়। কেননা তারা তা জমা করলে ব্রা‏হ্মণ কষ্ট পায়’।
‘কোন শূদ্র যদি কোন ব্রা‏হ্মণের দিকে লাঠি বা শুধু হস্ত সম্প্রসারিত করে তাহলে হাত কেটে দেওয়া হবে। অনুরূপভাবে পা দ্বারা যদি লাথি মারে তাহলে পা কেটে দেওয়া হবে’।
‘কোন শূদ্র যদি কোন ব্রা‏হ্মণের সাথে একই জায়গায় বসতে চায় তাহলে শাসকদের কর্তব্য যে, সে শুদ্রের নিতম্বে গরম ছ্যাক দিবে। অথবা তার নিতম্বে মেরে আহত করার পর দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে’।
‘যদি কোন শূদ্র কোন ব্রা‏‏‏হ্মণকে স্পর্শ করে বা গালি দেয় তাহলে তার জিহ্বা গোড়া থেকে টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে। আর যদি দাবি করে আমি তার শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তাহলে তাকে উত্তপ্ত তৈল পান করাতে হবে।’
‘কুকুর, বিড়াল, ব্যাঙ, টিকটিকি, কাক, পেঁচা ইত্যাদির রক্তপণ ও একজন শূদ্রের রক্তপণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।”

এভাবেই এখানে পদদলিত হয়েছে মানুষ ও মানবতার ধর্ম। আর ধর্মে ভাল যেসব নির্দেশনা আছে তা না-মানার দৃষ্টান্ত হিসেবে গুজরাটের দাঙ্গা, বাবরী মসজিদ ধ্বংস এবং বিশেষভাবে ভারত বিভাগকালীন সময়ের ভয়াবহ দাঙ্গাসমূহ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রতিপক্ষদের দাঙ্গা দিয়ে নির্মমভাবে শেষ করার নির্দেশ হিন্দু ধর্ম-ও মনে হয় দেয় না। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, মানুষ না মানলে তার সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা সবকিছুকেই ছাপিয়ে যেতে পারে। আর হিন্দু ধর্ম এমন কিছু অদ্ভুত বিশ্বাস ও নির্দেশনার নাম যে, এখানে না-মানার সংস্কৃতি গড়ে উঠতে বাধ্য। ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের থেকেও অনেক প্রবলভাবে।

চার. ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আছে। এ বাধ্যবাধকতা নীতি-নৈতিকতায় সমৃদ্ধ এবং তা মানার সংস্কৃতিও চালু আছে। তথাপি সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা। হ্যাঁ, এমনও হতে পারে যখন এ ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা বিরাজ করে কিংবা এ ধর্ম সম্পর্কে যাদের জানাশোনা কম থাকে। যেমন- ইসলাম ধর্ম। বহু অমুসলমানও একথা স্বীকার করেছেন এবং করেন- নীতি- নৈতিকতার এতটা সমৃদ্ধ নির্দেশনা অন্য কোন ধর্মে নেই। আবার এসব নির্দেশনা এতটাই যৌক্তিক, সুস্পষ্ট, সুসংহত ও জীবনোপযোগী যে, এধর্ম সম্পর্কে জানাশোনা রাখলে না-মানার সংস্কৃতি গড়ে উঠার সুযোগ নিতান্তই কম। এ কারণেই সাদা-কালো, ধনী-নির্ধন অঞ্চল বা শ্রেণীগত বিভেদ-বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস মুসলিম সমাজে নিতান্তই গৌণ। ভারত বিভাগকালে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে এমন কিছু সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটলেও কখনোই তা জোড়ালো হয়ে উঠতে পারেনি।

+সাম্প্রদায়িকতার দ্বিতীয় অর্থ: পরমত সহিষ্ণু না-হওয়া।
এখানে দু’টি বিষয় বিশেষভাবে শুরুতে বলা প্রয়োজন-

এক. একজনের নিকট যে মত ও পথটাকে সবচেয়ে যৌক্তিক, ভাল, কল্যাণকর ও পালনীয় মনে হবে, অন্য একজনের নিকট সে মতাদর্শটি এমন মনে নাও হতে পারে।
দুই. প্রত্যেকেই নিজের মতটিকে মানুষ ও মানবতার জন্য উপকারী, সবচেয়ে শুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে। আর শুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ মনে না করলেও তা ‘আপন-আদর্শ’ হিসেবে ধরে রাখার নানা যৌক্তিকতা খুঁজে পায়। যেমন- বাপ-দাদার ধর্ম, অথবা কোন ধর্মই সত্য নয়, অথবা সকল ধর্মই আংশিক সত্য ইত্যাদি।

এজন্য সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে-শ্রেণীর লোকদের প্রাবল্য হবে, তাদের চিন্তাধারা অনুযায়ীই একটি আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। আরেকটু সহজভাবে বললে- প্রতিটি মানুষ তার প্রভাবাধীন বলয়ে নিজস্ব চিন্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে এটাই পৃথিবীর নিয়ম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেউ যখন অপরের কাঁধে ‘আপন-সত্য’ জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, অন্যথায় নির্মম নিধন উৎসবে মেতে ওঠে, তখনই তা জঘন্য সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয়। এ জন্যই ইসলামের নীতি হল- ‘ইসলাম’ নিজেকে স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত একমাত্র সত্য-ধর্ম, মনুষ্যত্ব ও মানবতা নির্মাণের শ্রেষ্ঠতম পন্থা সাব্যস্ত করলেও- বলে ‘দ্বীন গ্রহণে কারো উপর জবরদস্তি নেই।’ হ্যাঁ, রাষ্ট্রব্যবস্থায় মুসলমানরা অধিষ্ঠিত হলে নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ীই মানব-কল্যাণে আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা করবে; তবে ভিন্ন মতাদর্শীরাও সে রাষ্ট্রে নিজ নিজ মতাদর্শ নিয়ে পাবে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার।

এই ক্ষেত্রটিতে এসে কমিউনিজমের অনুসারীরা সবচেয়ে বেশি অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেয়। তারা মনে করে- তারা যে থিওরিতে মানুষ ও মানবতার মুক্তি বলে ভাবে সে থিওরিতেই অন্যদেরকেও ভাবতে হবে, নয়তো হারাতে হবে বেঁচে থাকার অধিকার। ভিন্ন মতাবলম্বীদের সমূলে নির্মূলের মত জঘন্য মনোবৃত্তি ও সাম্প্রদায়িকতা কমিউনিজমের অনুসারীদের মত পৃথিবীর আর কোন সম্প্রদায়ের লোকেরা হয়ত দেখাতে পারেনি। শুধু অভিযোগ না করে পরিসংখ্যানে আসি। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখলের কিছু দিনের মধ্যেই ২৬ হাজার মসজিদে আজান বন্ধ করে দেয়। সেই সাথে বন্ধ করে ২৪ হাজার মাদরাসা, আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ আলেমকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ-কমিউনিস্টরা যে থিওরিতে মানব-মুক্তির কথা ভাবত, তারা সেভাবে ভাবতে পারেনি। কমিউনিস্ট বিপ্লবের ছয়-সাত বছরের মধ্যেই ক্ষমতায় আসেন জোসেফ স্টালিন। যিনি একটানা ২৭ বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসন করেছেন। তিনি তার শাসনামলে লাখ লাখ মানুষকে কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি করে করে রাখতেন শুধুমাত্র মতভীন্নতার অপরাধে। বলা হয় তার দীর্ঘ ২৭ বছরের শাসনামলে তার বিরোধিতা করতে পারে এ ধরণের কাণ্ডজ্ঞানহীন সন্দেহে তিনি তিন কোটি বা তারও দ্বিগুণ পরিমাণ সোভিয়েতবাসীকে গুলি করে মেরেছেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, বুভুক্ষু অবস্থায় মেরেছেন, প্রহার করেছেন কিংবা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। অথচ এই কমিউনিস্টদের দাবি হল- তারা অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ, পরমত সহিষ্ণু?!

এই কমিউনিস্টরা তথাকথিত সাম্যবাদের নামে নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর যে পরিমাণ মানুষ হত্যা করেছে পৃথিবীর আর সকল আদর্শ মিলিয়েও মনে হয় এত মানুষ হত্যার রেকর্ড নেই।

সমাজতন্ত্রের এ দেশীয় অনুসারীরাও একইরকম অসহিষ্ণু। পরমত বিশেষকরে ইসলামের ক্ষেত্রে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ব্যক্তি জীবনের সাথে সাথে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনাচার সম্পর্কেও নির্দেশনা দেয় বলে ইসলামের নাম-ধাম, স্বাভাবিক আচার-অনুষ্ঠানও তাদের সহ্য হয় না। অন্যান্য ধর্মের মত ইসলামের ঘাড়েও তাদের তথাকথিত সাম্যবাদ চাপিয়ে দিতে না পারার আক্রোশে ইসলামে সবকিছুকেই সাম্প্রদায়িকতা বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। বামদের দখলে থাকা বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে এ কারণেই ফররুখের মত প্রতিভা, ইসলামের প্রতি অনুরাগী হওয়ার অপরাধে, যথার্থ মূল্যায়ন পাননি। আল মাহমুদও একই পথের পথিক।

+সাম্প্রদায়িকতার তৃতীয় অর্থ : নিজ ধর্মকেই একমাত্র মুক্তির পথ বলে ভাবা।
হ্যাঁ, সাম্প্রদায়িকতার এমনও একটি অর্থ টানার চেষ্টা করা হয়। নিজ ধর্মটাকেই ইহলৌকিক, বিশেষত পারলৌকিক একমাত্র মুক্তির পথ বললে অনেকেই এতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পান। এক অযৌক্তিক অস্থিরতায় অস্থির হয়ে ওঠেন। বিষয়টা যেমন অযৌক্তিক তেমিন অনেকটা হাস্যকরও বটে। নিজ ধর্ম বা মতাদর্শের উপর আস্থা সংকটের কারণেই এমনটা হয়ে থাকে। তা না-হলে আমার ধর্মটা যদি সত্য হয় তাহলে সে ধর্মের পক্ষ থেকে স্বর্গ-প্রাপ্তির আশ্বাসই আমার জন্য যথেষ্ট। অন্য ধর্ম আমাকে স্বর্গ-না-নরক দিল তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তাহলে সব ধর্ম থেকেই স্বর্গপ্রাপ্তির আশ্বাস পেতে অযৌক্তিক এই চেষ্টা কেন?

হ্যাঁ, আমার ধর্ম গ্রহণ না করার কারণে, কেউ নরকে যাবে বলে মনে হলে, তার জন্য দুনিয়াতেই আমার পক্ষ থেকে আমি নরক তৈরি করতে পারি না। এমন কোন আচরণও আমার জন্য সঙ্গত নয়। এটা সাম্প্রদায়িকতা। নরক দান স্রষ্টার কাজ। মৃত্যুর পর স্রষ্টাই যার ব্যবস্থা নিবেন। এ কারণে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হল- প্রতিটি অমুসলমানও তার মানবিক প্রাপ্যগুলো মুসলমানদের থেকেও পাওয়ার অধিকার রাখে, এবং সে অধিকার পূরণের নির্দেশ ইসলাম মুসলমানদেরকে দেয়। তাছাড়া ইসলামের কাছে একজন অমুসলমানের মৃত্যু পর্যন্ত ঈমান আনার সম্ভাব্যতাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

সবধর্ম থেকে স্বর্গলাভের আশ্বাস পাওয়ার চেষ্টা যেমন অযৌক্তিক, অদ্ভুত; এরচে’ আরও অদ্ভুত হল, সব ধর্মকে এক সঙ্গে মিলিয়ে একীভূত করে নতুন আরেকটি ধর্ম চালু করার চেষ্টা করা। বড় অদ্ভুত ও অযৌক্তিক বলেই এমন প্রচেষ্টা একাধিকবার হলেও, কখনোই তা খুব একটা পানি পায়নি। অনেকে এটাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বলে চালানোর চেষ্টা করেন। ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িক বানাতে গিয়ে নিজেরাই সাম্প্রদায়িক আচরণ শুরু করে দেন।

এই কাজটা সর্বপ্রথম বাদশাহ আকবর ব্যাপকভাবে করতে চেয়েছেন। এর পেছনে যতটা-না-ছিল মানবিকতা, তারচে বেশি ছিল অজ্ঞতা, আর যতটা-না-ছিল অজ্ঞতা, তারচে বেশি ছিল রাজনৈতিক চাল। এরপর অনেক ভাববাদীরাই ভাবোন্দলন ইত্যাদি নামে কাজটি করার চেষ্টা করেন। সর্বশেষের ‘লালন-হাছন’ এ ধারারই অন্তর্ভুক্ত। দেশের বাম ও নাস্তিকরা এ চিন্তাটিকে বড় সমাদর করে, আর এর বিরোধিতাকে মনে করে সাম্প্রদায়িকতা।

এই চিন্তাধারাটির পেছনেও কার্যকর নিজ ধর্মের প্রতি আস্থাহীনতা। তাই ধর্মহীন নাস্তিক-কমিউনিস্টদের নিকট বাদশাহ আকবরের এত কদর। লালন-হাছনের এত সমাদর। হ্যাঁ, কিছু কিছু ধর্মের উপর আস্থা রাখা বড়ই কঠিন। তাই শিক্ষিত হিন্দুরাও এ চিন্তাটিকে গ্রহণ করে এবং হিন্দু সাধু স্বামী বিবেকানন্দ এ চিন্তাটিকেই আরেকটু অগ্রসর করে বলেন- ‘সকল ধর্মই সত্য, একই সাগরে গিয়ে মিলিত হওয়ার একাধিক নদীপথ।’

এ অর্থেই হয়তো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবীদ অমর্ত্য সেন কিছুদিন আগে বলেছিলেন- ‘হিন্দুধর্ম অসাম্প্রদায়িকতার ধর্ম। অসাম্প্রদায়িক তথা ধর্মনিরপেক্ষ হতে হলে মুসলমানদেরকেও হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করা উচিৎ!’

আমাদের দেশে সংস্কৃতির নামে কিংবা বাঙালির নিত্য নতুন ঐতিহ্যের নামে নানা ধর্মের নানা কিছু নিয়ে উৎসব-আয়োজন যা কিছুই হয়, সবই রাম-বাম আর ধর্মহীনদের এ ধারারই অসাম্প্রদায়িক হওয়ার নানামাত্রিক চেষ্টা মাত্র। এ কারণেই তাদের এসবে কোন বিরোধিতা দেখলে তারা সরাসরি ‘সাম্প্রদায়িক’ ‘গোঁড়া’ ‘ধর্মান্ধ’ ইত্যাদি শব্দগুলো বলে দেয়।

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের নামে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার যে তোড়জোড়, সেটা এ অর্থেই চলে। এ জন্যই দেশের আলেম সমাজ এর বিরোধিতা করেন। বলেন- ‘ধর্ম বিসর্জন কিংবা নিজ ধর্মকে পর ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলার যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়’। দেশের প্রধানমন্ত্রী অসাম্প্রদায়িকতার তৃতীয় এই অর্থটি চালু করার প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় অর্থটি টেনে তাঁদের বুঝ দেন-‘ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। বরং প্রত্যেককে আপন আপন ধর্ম নিরাপদে পালনের সুযোগ দেওয়া।’

আসল কথা হল- নিজ ধর্মের উপর আস্থাশীল থাকা, নিজ ধর্মকেই একমাত্র সত্য মনে করা সাম্প্রদায়িকতা নয়। বরং সাম্প্রদায়িকতা হল সেই ‘সত্য মনে করাটাকে অপরের কাঁধে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া। কিংবা সম্প্রদায়গত অন্ধত্বের শিকার হয়ে মনুষ্যত্ব ও মানবতার সীমা লঙ্ঘন করা। এ সূত্রে অসাম্প্রদায়িকতার নামে ‘সকল ধর্মই সত্য’ নিজেদের এই ‘সত্য মনে করা’টাকে অপরের ঘাড়ে চাপানোর জন্য রাম-বামদের অতিমাত্রায় বাড়াবাড়িটাই উল্টো সাম্প্রদায়িকতার পরিণত হয়।

+যে কারণে বে-শরা পীর-ফকির বিশেষকরে কাদিয়ানীদের মুসলমানরা গ্রহণ করতে পারে না।

পূর্বেই বলেছি পরমত-সহিষ্ণু হওয়াই মুসলমানদের ধর্ম। যে কারণে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে যে কোন ধর্মের লোক নিজ নিজ ধর্ম পালনের অবাধ সুযোগ লাভ করে। তথাপি কেন কাদিয়ানী বা বে-শরা পীর ফকিরদের মুসলমানরা গ্রহণ করতে চায় না? নিশ্চয় এখানে ভিন্ন একটি কারণও বর্তমান।

ধরুন- আপনি নির্দিষ্ট একটি নামে একটি পণ্য বাজারজাত করেছেন। সারাদেশে এর বিপুল কাটতি এবং এ নামেই আপনার পণ্যের বিশ্বব্যাপী সুনাম ও পরিচিতি। তখন কেউ যদি আপনার পণ্যের নাম ও লোগো ব্যবহার করে তার থেকে আরেকটি পণ্য বাজারজাত শুরু করে তাহলে আপনি কি বলবেন- এটা তার ব্যবসায়িক স্বাধীনতা? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোন আইনেই এটি কি অপরাধ নয়?
আসুন আরেকটি উদাহরণে- আপনি দেশের শীর্ষ সারির একজন ব্যক্তি। আপনি ‘একটি কথা’ বলেননি। যে কথার সাথে আপনার কিংবা দেশের বিশালাকারের লাভ-ক্ষতি সম্পৃক্ত। এমন একটি কথা অন্য কেউ আপনার নামে চালিয়ে দিল। আপনি কি বলবেন, এটা তার বাক স্বাধীনতা? এটা তার মৌলিক বা মানবিক কোন অধিকার?

কাদিয়ানী বা বে-শরা পীর-ফকিরদের ব্যাপারটাও মুসলমানদের নিকট এরকম। তারা যদি ভিন্ন লেভেলে, ভিন্ন নামে তাদের মতাদর্শ প্রচার করত তাহলে হয়তো মুসলমানদের এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ছিল না। কিন্তু তারা তাদের কাজ পুরোটাই করে ইসলামের লেভেলে। এতে বিভ্রান্ত হয় ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ। পণ্য নকলের বিষয়টি সকলেরই জানা থাকলে যেমন ক্ষতি হয় না তেমনি মুসলমানরা সকলেই আলেম হলে কিংবা ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জানাশোনা রাখলেও এখানে ক্ষতির কিছু ছিল না। কিন্তু কোন একটি বিষয়ে সকলেরই ভাল জানাশোনা থাকা তো কঠিন বিষয়। তথাপি মুসলমানরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়; চায় একটি সমাধান। কাদিয়ানীরা তাদের মতাদর্শের যৌক্তিকতা প্রমাণ করুক। (অর্থাৎ খতমে নবুওয়াতের ব্যাপারে কোন সন্দেহ সৃষ্টি করেও যে ‘মুসলমান’ থাকা যায় তা তারা প্রমাণ করুক) আর বে-শরা পীর-ফকিররা কুরআন-হাদীসে আছে বলে যেসব কথা বলে বেড়ায়, তা তারা কুরআন হাদীসে দেখাক।

শেষকথা-
এক. মানুষে মানুষে মতভিন্নতা থাকবেই। মতভিন্নতা আছে বলেই এ দুনিয়া ‘বৈচিত্র্যময়’। সেই ভিন্নতার কারণে ‘নানা দল ও সম্প্রদায়ে’ নানা বিভক্তিও আসতে পারে। সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অন্যায় নয়; অন্যায় ‘সাম্প্রদায়িকতা’। যে সাম্প্রদায়িকতা ভিন্ন মতাদর্শীদের। নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় দমনে উৎসাহ যোগায়। মানুষ ও মানবতার নির্মম দলনে কখনো কুণ্ঠিত করে না।

দুই. ধর্মনিরপেক্ষতা নামে কথিত যে মতাদর্শ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় সেটা ধর্ম নিরপেক্ষতা নয় বরং সেটিও একটি ধর্ম। এ ধর্মের রূপ- কখনো হয় ধর্মহীনতা, কখনো হয় ধর্ম-বিকৃতি, আবার কখনো হয় নিজ ধর্মকে পরধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলা। এ ধর্ম না-মানলে প্রতিপক্ষের উপর সাম্প্রদায়িকতার যে লেবেল এঁটে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, সেটা ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটির ভুল প্রয়োগের পথ ধরেই। শব্দটিকে যথার্থরূপে প্রয়োগ করে নয়।

তিন. সাম্প্রদায়িকতা যেমন অন্যায়, তারচে’ বড় অন্যায় সাম্প্রদায়িক শব্দটির ভুল ব্যবহার। কারণ, তখন তা আরো জঘন্য রূপ পরিগ্রহ করে। তখন মানুষের সামনে আর কোন বাধা-নিষেধই থাকে না। কেননা পিঠে তখন সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের মত এক মানবিক কর্মের মহৎ লেবেল। এজন্যে আমাদের উচিৎ যেমন সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না-দেওয়া, তেমনি সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের নামে তারচে’ বড় সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির সুযোগও কাউকে না দেওয়া।

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৬
৯টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×