আমার সাথে একমত হন আর নাই হন,আমাদের শরীরের সবচেয়ে অবহেলিত অঙ্গের মধ্যে পা হচ্ছে অন্যতম। প্রথমত আমরা যত্ন নিতে অবহেলা করি এর ওপর যদি ভুল জুতা পরে আরও অবহেলা করি তবে অবস্থাটা কেমন হয় একটু ভাবুন।
আজ আলোচনা করবো ভুল এবং দুর্বল ফিটিং এর জুতার কারনে সাধারণত আমাদের যে সমস্যাগুলো হয়ে থাকে, তার কারণ ও সমাধান (চিত্র সহ)।
১. অ্যাথলেট ফুটঃ নামটা শুনে ভাব্বেন না যে উসাইন বোল্ট বা অন্য যে কোন অ্যাথলেট এর পা নিয়ে কথা বলছি। এটা ত্বকের এক ধরনের ফাঙ্গাল ইনফেকশন। এটি সাধারণত পায়ের আঙ্গুল এর ফাঁকে বেশি দেখা যায় । যদিও এই ইনফেকশন টা পুরো পায়ে ছড়িয়ে পরতে পারে এবং অস্বস্থি, চুলকানি এবং কখনো কখনো ব্যাথার ও কারণ হতে পারে।
কারণঃ এই ফাঙ্গাস গুলো মূলত ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা গুলো থেকে ছড়ায়, তা ছাড়া জুতা এবং মোজা অপরিচ্ছন্ন ভাবে দীর্ঘ দিন ফেলে রেখে ব্যবহার করলে সেখান থেকেও ছড়ায়। এটি প্রচণ্ড আকারে সংক্রামিত হয়ে ত্বকের বিভিন্ন জায়গা যেমনঃ হাত, কুঁচকি এমন কি মাথার স্কাল্প এ পর্যন্ত ছড়াতে পারে।
সমাধানঃ জুতা, মোজা নিয়মিত পরিষ্কার করুন। পা গুলো পরিষ্কার ও শুকনা রাখুন। যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় দেরি না করে ডাক্তার এর পরামর্শ নিন।
২. বানিয়নঃ হ্যাঁ ভাই, আনিওন এর মত বানিওন ও লাল এবং চোখে পানি আনার জন্য যথেষ্ট। পায়ের বুড় আঙ্গুলের জয়েন্ট এর পার্শ্ববর্তী অংশ টা বেরে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হয় এবং ফুলে যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় এটাকে হ্যালাক্স ভ্যাল্গাস ও বলা হয়ে থাকে।
কারণঃ টাইট এবং সামনের দিকে সরু জুতা গুলো মূলত দায়ী। বিশেষ করে মহিলারা এই সমস্যাটায় বেশি ভোগেন, তাই বলে পুরুষরাও কিন্তু কম নয়। এছাড়া পারিবারিক ভাবেও এটা কেউ কেউ পেতে পারে।
সমাধানঃ সঠিক পরিচর্যা এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এর জন্য সঠিক ও উপযুক্ত জুতা নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরী। এ ছাড়াও এখন বানিওন প্যাড, স্প্লিন্ট পাওয়া যায় যা ব্যাথার জায়গাটিকে অতিরিক্ত চাপ থেকে রক্ষা করতে পারে।
ব্যাথা কমানোর জন্য বরফ লাগানো যেতে পারে, এ ছাড়াও ফুটকেয়ার বিশেষজ্ঞ যেমন পডিয়াট্রিস্ট অথবা পেডর্থিস্ট যারা কাস্টমাইজড জুতা, সঠিক অর্থটিক অথবা স্প্লিন্ট তৈরি বা পরামর্শ দিতে পারেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। অবস্থা বেশি খারাপ হলে অস্ত্রপচার করা লাগতে পারে।
৩. ইনগ্রোওন টো নেইল(অন্তবর্ধিত নখ)ঃ পায়ের নখ বড় হয়ে চামড়ার মধ্যে ঢুকে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যাথা ও অস্বস্থি হওয়াকেই ডাক্তারি পরিভাষায় অন্তবর্ধিত নখ বা ইনগ্রোওন টো নেইল বলা হয়।
কারণঃ এর প্রধান কারন হচ্ছে খারাপ ও অস্বাস্থ্যকর জুতা পরা, যারা চিকন মাথার টাইট জুতা পরেন তারা বেশি এই সমস্যায় ভোগেন। এছাড়াও অনিয়মিত নখ কাঁটাও এর অন্যতম কারণ। এছাড়া পারিবারিক ভাবেও এটা কেউ কেউ পেতে পারেন।
সমাধানঃ সঠিক জুতা পরতে হবে, টাইট বা আনফিট জুতা পরা যাবেনা। পায়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত নখ কাটতে হবে।
৪. প্ল্যান্টার ফ্যাশাইটিসঃ এটা আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বের একটা কমন সমস্যা। সকাল বেলা উঠে পা দিয়ে পারা দিলে পায়ের গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হতে পারে যা আপনার স্বাভাবিক হাঁটা চলায় বড় প্রভাব এবং অস্বস্থিতে ফেলে। এতে দৈনন্দিন জীবনের কাজ করাটা কঠিন হয়ে যায়।
কারণঃ ভুল জুতায় মূলত এই সমস্যাটা বেশি হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন, পায়ের গাঠনিক সমস্যা(ফ্ল্যাট ফিট, হাই আর্চ) ছাড়াও যারা দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে কাজ করেন তাদের ও এই সমস্যা হতে পারে।
সমাধানঃ এই সমস্যার বেশীরভাগ সময় বাড়ীতেই চিকিৎসা সম্ভব নির্দিষ্ট কিছু শরীরচর্চার মাধ্যমে। তাছাড়া পায়ের আর্চ সাপোর্টযুক্ত সঠিক ও নরম ইনসোল দিয়ে জুতার মাধ্যমে এই সমস্যার আমূল সমাধান সম্ভব। শরীরের ওজনের দিকেও খেয়াল রাখা দরকার। এর জন্য সঠিক জুতা একমাত্র পডিয়াট্রিস্ট অথবা পেডর্থিস্টরাই সবচেয়ে ভাল জানেন। কখনও ৬-১২ মাস ও লাগতে পারে পা স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে। জুতা সংস্করণ এর মাধ্যমেও এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।
৫. ব্লিস্টারঃ এই সমস্যায় পরেনি এমন মানুষ পাওয়া খুব এ কঠিন। বিশেষ করে নতুন, খারাপ ফিনিশিং এর জুতায় গোড়ালির উপরে এখিলিস টেন্ডন বরাবর চামড়া উঠে পানি বের হয়।
কারণঃ খারাপ ফিনিশিং এর জুতা পরলে এই সমস্যাটা বেশি হয়। এ ছাড়া যারা অনেক্ষন ধরে হাঁটা চলা করেন, পা ঘামানোর ফলে এবং জুতা ঠিক মত ফিট না হলে এই সমস্যাটা বেশি হয়। অনেকে মোজা ছাড়া জুতা পরেন তাদের এটা হতে পারে।
সমাধানঃ ব্লিস্টার হলে প্রথমত জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনক্রমেই এটা যেন বারতে না পারে এবং একে সময়ের সাথে নিজে নিজে সারতে দিতে হবে। সঠিক এবং ফিট জুতা পরতে হবে। যদি মাঝে মাঝে এই সমস্যা হয় তবে অবশ্যই চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে।
৬. কর্ণ ও ক্যালাসঃ কর্ণ এর কথা শুনে অনেকেই হয়ত ভাবছেন কর্ণ স্যুপ বা পপ কর্ণ এর কথা। আসলে এই গুলো ও পায়ের এক ধরনের সমস্যা। পায়ের চামড়ার ওপর মোটা, শক্ত এক ধরনের আস্তর পরে যখন আমাদের পায়ের ত্বক চাপ এবং ঘর্ষণ এর বিপরীতে কাজ করে নিজেকে রক্ষা করতে চায় তখনি কর্ণ ও ক্যালাস হয়ে থাকে। কর্ণ মূলত ক্যালাস এর চেয়ে ছোট হয়ে থাকে এবং পায়ের যেসব জায়গায় ওজন বহন করেনা সেসব জায়গায় হয়ে থাকে। ক্যালাস মূলত পায়ের নিচে বা যেসব জায়গায় ওজন বহন করে সে জায়গায় হয়ে থাকে।
কারণঃ দুর্বল উপাদান দিয়ে তৈরি এবং ঠিক মত ফিট না হওয়া জুতা গুলো এর মূল কারণ। এ ছাড়া মোজা ছাড়া জুতা পরাও এগুলোর কারণ হতে পারে।
সমাধানঃ যদি ডায়াবেটিস না হয়ে থাকে তবে আপনি ব্যাথার জন্য চিকিৎসক এর কাছে যেতে পারেন, তা ছাড়া জুতা পরিবর্তন করে উপযুক্ত জুতা(পায়ে কোন চাপ যেন না পরে) বাছাই করে পরতে পারেন।
কিন্তু যদি ডায়াবেটিস বা দুর্বল রক্ত সঞ্চালনের রোগী হয়ে থাকে কোন ভাবেই নিজে কিছু করতে যাবেন না। অতি দ্রুত চিকিৎসক এর পাশাপাশি পডিয়াট্রিস্ট অথবা পেডর্থিস্ট এর পরামর্শ নিন তা না হলে মনে রাখবেন ছোট একটা সংক্রমণ আপনার পা কে আলসার এর দিকে নিয়ে যেতে পারে, ঠিক মত চিকিৎসা না হলে এর পরিণাম পঙ্গুত্ব এবং ধিরে ধিরে মৃত্যু।
৭. ক্ল, হ্যামার, ম্যালেট টোঃ পায়ের আঙ্গুল এর বিকৃতি অনুসারে এই তিনটি সমস্যার নাম রাখা হয়েছে। এগুলো পায়ের ছোট আঙ্গুল গুলতে বেশি হতে দেখা যায়। আঙ্গুল গুলো ভাজ হয়ে উপরে উঠে থাকে, এর ফলে ব্যাথা অনুভূত হয়, ধীরে ধীরে কর্ণ ও ক্যালাস হওয়া শুরু হয়,পায়ের জন্য কোন ধরনের জুতাই ফিট হয়না।
কারণঃ আনফিট এবং অতিরিক্ত টাইট জুতা এর মূল কারণ। আবার বেশি বড় জুতাও এর র একটা কারণ তখন পায়ের মাসেল গুলকে কাজ করতে হয় জুতা টিকে আঁকড়িয়ে ধরতে। আমাদের দেশে কিছু স্যান্ডেল পাওয়া যায় বিশেষ করে তরুণ রা পরে সামনের দিকে একটা মোটা স্ট্রিপ বিশিষ্ট। এতে স্যান্ডেলটি আঁকড়িয়ে ধরতে পায়ের আঙ্গুল গুলোর একটু বেশি কাজ করতে হয় এবং চাপ পরে।
সমাধানঃ আঙুল এর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা আছে এমন জুতা পরতে হবে। আঙুল গুলতে নরম সাপোর্ট এবং পা যেন আরামদায়ক অবস্থায় থাকে সেরকম ব্যবস্থা বিশিষ্ট জুতা পরতে হবে। এছাড়া টো ক্যাপ, টেপিং , স্প্লিন্ট এর মাধ্যমে সাময়িক ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিয়মিত আঙুল এর ব্যায়াম এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
৮.স্টোন ব্রুজঃ এর আর এক নাম মেটাটারসালজিয়া।এটা মূলত পায়ের আঙুল এবং মাঝ পায়ের আর্চ এর মাঝা মাঝি হয়ে থাকে।ফলে এই অংশটিতে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হয়,মনে হয় যেন একটা পাথর পায়ের নিচে রাখা আছে।
কারণঃ ভুল জুতা এর মূল কারণ। যারা পায়ের সামনের অংশ দিয়ে বেশি কাজ করেন বা চলাফেরা করেন তাদের বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে হাই হিল পরা মেয়েদের, খারাপ ফিটিং এর জুতা পরে যারা শারীরচর্চা করে থাকেন অনেক্ষন ধরে।
সমাধানঃ সঠিক জুতা নির্বাচন করতে হবে। ইনসোল ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়াও জুতায় কিছু সংস্করণ এর মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এছাড়াও জুতার কারনে গোড়ালি, হাঁটু ব্যাথা সহ আরও অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। এর থেকে পরিত্রানের উপায় হচ্ছে সচেতনতা সমস্যা গুলোকে অবহেলা না করা এবং সঠিক জুতার ব্যবহার।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:০৭