" স্টেরনোচিটাস "
.
লেখক: Hasan Tareque
.
আমি রাতুল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ছোট বেলায় আমার মা বাবা দুজনকেই হারালাম। বড় হলাম মামার বাড়িতে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে আমি চলে যায় মামার বাড়ি চট্টগ্রামে। সঠিক সময়ে রওনা দিলাম ঢাকা থেকে। পৌঁছালাম ঠিক পাঁচটায়। শীতের সকাল, কুয়াশা ঢাকা চারিদিক। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশন থেকে চলে এলাম মামার বাসায়। ভাড়া চুকিয়ে দিয়েই চক্ষুচড়ক গাছ। গেইটের সামনে পুলিশের গাড়ি। ঘঠনা কি? এত সকাল সকাল আবার কি হল?
.
"আপনি ঠিক বলছেন তো, মিস্টার সেন?" পুলিশ অফিসার রানা একটু ইতস্তত ভাবে জিজ্ঞেস করল।
এদিক ওদিক তাকিয়ে মামা জবাব দিল, "হ্যা আমি ঠিকই বলছি, আমার ঘরে কেউ ডুকেনি এবং কিছু চুরি হয়নি সব ঠিক আছে"।
"তাহলে যে মিস্টার সৌমিত্র বাবু বলছেন, আপনার দুতলার জানালা দিয়ে কাউকে ডুকতে দেখেছে।এবং জানালার কাঁচ ও ভাঙ্গা"। একটু চিন্তিত ভাব নিয়ে অফিসার রানা প্রশ্ন করল।
"দেখুন, হতে পারে ওনি ভুল দেখেছেন। আর কেউ ডুকলে তো তাকে আমি দেখতাম। এত কম সময়ে তো জানালা দিয়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব না।" মামা উত্তর দিল।
"তা ঠিক বলেছেন" অন্যমনস্কভাবে বলল অফিসার।
"আচ্ছা আপনার এখানে কি পালানোর অন্য কোন রাস্তা আছে নাকি?" অফিসার আবার প্রশ্ন করল।
"জ্বি, না। মামা বলল
"তাহলে কিছু চুরি হয়নি বলছেন তো?" অফিসার প্রশ্ন করল
"জ্বি, কিছু চুরি হয়নি। মামা জবাব দিল
"তারমানে রিপোর্টে লিখব, চোর ডুকেছে কিন্তু আপনার কোন জিনিসের পরিবর্তনও ঘঠেনি" অফিসার মুচকি হেসে বলল।
কপালে ভাজ বসিয়ে মামা বলল
"আমি তো তা বলিনি, কিছু চুরি হয়নি ঠিক, তবে একটা জিনিস বেশি আমার ল্যাবে"।
অফিসার রানার ভ্রু ঈষৎ কুচকে গেলো, "তাহলে এতক্ষণ বলেননি কেন?"
"অফিসার, আপনি বারবার জিজ্ঞেস করছেন কিছু চুরি হয়েছে কিনা। কিন্তু কিছু বার্তি আছে নাকি তা জিজ্ঞেস করেননি" মামা বলল
"তা জিনিসটা কি?"
"একটি কাটের বাক্সে স্টেরনোচিটাস" বলেই মামা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন।
অফিসার রানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "সেই বিষাক্ত পোঁকা?"
এই পোঁকার নাম এখানে অচেনা নয়। এখানের সবাই আমের চাষ করে। কাজেই বিষাক্ত পোঁকা নিয়ে ধারনা সবার আছে।
মামা জবাব দিল, "হ্যা"
অফিসারের উদ্রেক আরও বেড়ে গেলো। ঘরে কেউ একজন ডুকেছে। কিছু নেয়ার বদলে, দিয়ে গেছে।
ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমাল। অফিসার কোন সুরাহা করতে না পেরে চলে গেল। যাওয়ার সকাল সকাল বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলো, এবং দাড়োয়ান কাশেম মিয়াকে নিয়ো গেল জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।
.
অফিসার বের হয়ে যেতেই মামার প্রতিবেশী সৌমিত্র সেন ডুকল।
"সুব্রত বাবু আপনি ঠিক আছেন তো?" উদ্রেক নিয়ে সৌমিত্র বাবু প্রশ্ন করলেন।
'হ্যা আমি ঠিক আছি" মামা জবাব দিল।
সৌমিত্র বাবু চোখ মুখ কালো করে বললেন
"আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম, মধ্যরাত্রিতে দেখলাম আপনার দুতলার জানালা বেয়ে কেউ ঘরে ডুকছে, তাই পুলিশে খবর দিলাম"
"অনেক ধন্যবাদ সৌমিত্র বাবু আপনাকে। তা শুনলাম আপনি নাকি আমার বন্ধু আশরাফের আম বাগানগুলো কিনছেন?"
"না সুব্রত বাবু, ওই দিকের আম বাগান গুলো যা পোঁকা ধরেছে। তাতে আমার বাগান নিয়ে আমি সঙ্কিত।"
"ও আচ্ছা।"
"কিছু মনে করবেন না, আপনার বন্ধুকে আমি কিনব না বলে দিয়েছি।" সৌমিত্র বাবু মামার চেহারার দিকে তাকিয়ে একটুু হেসে আবার বলল, "একবার আসুন না ওদিকে, আমি নতুন বাংলো বানিয়েছি, দেখে যাবেন।"
মামা জবাব দিল, "যাব, কালই যাব। ভাগনে এসেছে। ওকে নিয়ে আপনাদের ওখানে ঘুরে আসব, তাছাড়া আমার বন্ধুর সাথেও দেখা করে আসব।"
কথোপকথন শেষে সৌমিত্র বাবু চলে গেলেন। আমার মনে আনন্দের সীমা রইল না। মামার সাথে ঘুরতে যাওয়া মানে অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। তাছাড়া রাজশাহী যাওয়া হয়নি এখনও। কাজেই সুযোগ মিস করা চলবে না। তাছাড়া মামা একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রফেসর। এসেই লাভে পড়ে গেলাম।
.
আমি ভেবেছিলাম রাজশাহী যাবে যখন বলেছে, তখন হাতে একটু সময় পাব। এক সপ্তাহ তো লাগবেই। কিন্তু তিনদিন পেরুতেই মামা তাগাদা দিল। পরের দিন রওনা হতে হবে। গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম। একটা কাটের বাক্স আর কিছু কাগজ পত্র নিল মামা। বুঝতে বাকি রইল না মামা বিশেষ কোন কাজে যাবে। আমিও আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো নিলাম। চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী পৌঁছালাম পরের দিন দুপুরে। দুপুরের খাওয়া সেরে মামার বন্ধুর বাড়িতে ঘুমিয়ে বিকালটা পার করলাম। সন্ধ্যে হতেই মামা তাগাদা দিল, এখন বের হতে হবে। মামার বন্ধুর জিপটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম দুজনেই। মামা কাটের বক্সটা সঙ্গে নিলেন।
বিশাল গেইটের সামনে মামা গাড়ি দাড় করালেন। হেড় লাইট চালু রেখেই নেমে পড়লেন জিপ থেকে। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম "মামা লাইট বন্ধ করে দাও"
মামা ঠোঁট জোড়া বাকা করে বললেন, "জ্বলুক। একটু পরেই বুঝবি।" আমি আর কিছু বললাম না।
.
বাড়িটার চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের উপর দিয়ে আম গাছ উঁকি দিচ্ছে। বুঝলাম এখানে আমের চাষ হয়। গেইটের কাছে গিয়ে মামা বেল টিপলেন। অনেক্ষন কোন সাড়া শব্দ নেই। গেইট খোলারও নাম নেই। আমার বিরক্ত লাগছে, এই সন্ধ্যেতে এসব এলাকার মানুষজন হয়ত খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেন শুধু তাদের বিরক্ত করছেন মামা, কে জানে। মামার মধ্যে বিরক্তের কোন চাপ নেই। হাতে কাটের বাক্সটা নিয়ে দাড়িয়েই আছেন।
একটু পর গেইটে লাগানো স্পীকার থেকে ভেসে এল "কে?"
আমি এতক্ষণ স্পীকারটা খেয়াল করিনি। মামা জবাব দিল "আমি সুব্রত। চট্টগ্রাম থেকে।"
অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এল "চলে আসুন ভিতরে"।
ঘর ঘর শব্দে গেইটটা খুলে গেলাম। তার মানে গেইটা রিমোট কন্ট্রোল। আমি অবাক হলাম এইভেবে, এই নির্জন এলাকায় এসব কেনো? এমন কি আছে যে এত নিরাপত্তা লাগবে?
মামা কাটের বক্সটা গেইটের ভিতর ডুকেই বাক্সের মুখ খুলে দিলেন, এবং রেখে ভিতরে চলে গেলাম। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ঘঠনা কি। সে যাই হোক, মামা আমার কাছে কিছু লুকান না। ভিতরে ডুকেই দেখলাম মামার প্রতিবেশী সৌমিত্র বাবু। ওনি এখানে আম চাষ করেন জানি। কিন্তু এত নিরাপত্তা কেন বুঝলাম না।
"এই যে সুব্রত বাবু এসেছেন তাহলে? ধন্যবাদ আপনাকে। রাতে কিন্তু আমার এখানে খেয়ে যেতে হবে" সৌমিত্র বাবু কোলাকুলি করতে করতে বললেন।
মামা ও জবাব দিল, "না সৌমিত্র বাবু। আমাদের কাল সকালেই চিটাগাং রওনা দিতে হবে। আপনার জন্য একটা গিফট এনেছি"।
"আরে আগে বসুন তো আপনি। বিয়ার হবে নাকি একটু?" সৌমিত্র বাবু লাজুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন।
"না না। এখন ওসব না। আচ্ছা আপনি তো আমার বন্ধুদের বাগানটা কিনছেন না, তাই না?" মামা বলল।
"জ্বি, দেখছেন তো বাগানগুলো পোঁকার আক্রমনে মরমর অবস্হা" সৌমিত্র বাবু জবাব দিল।
"তা আপনার বাগানগুলো তো দিব্বি সুস্হ আছে, ব্যাপারটা কি বলুন তো? " মামা রহস্যের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল।
"আমি আমার বাগানগুলোর যত্ন নেয়। তাই" মুখ কুচকে জবাব দিল সৌমিত্র বাবু।
"হ্যা ঠিক তাই। আপনি বিদেশ থেকে এনে নিজের বাগানে কাঁচামাল দিয়েছেন। অন্যদের বাগানে বিষাক্ত পোঁকা স্টেরনোচিটাস লাগিয়ে দিয়ে ওদের বাগান নষ্ট করে দিয়েছেন। যাতে ওরা কেউ আমের চাষ না করে।" মামা রাগান্বিত স্বরে বলে গেলেন।
সৌমিত্র বাবু পকেট থেকে পিস্তল বের করে উচিয়ে ধরল, "দেখুন সুব্রত বাবু, আমি যদি এখানে আপনাকে খুন রেখে দেই কেউ জানবে না।
"শুনন মিস্টার সৌমিত্র আমিও আপনার জন্য এক বাক্স স্টেরনোচিটাস আপনার বাগানে ছেড়ে দিয়েছি"। মামা জবাব দিল।
"এটা কি করেছেন আপনি? আপনাকে আমি খুন করে ফেলব"।
মামা সৈমিত্র বাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আপনি কি ভেবেছেন আমি একা আসব? বাইরে পুলিশের গাড়ি আছে। চুপচাপ গেইট খুলে দিন। আমি পুলিশকে কিছু বলব না। হাজার হোক আপনি আমার প্রতিবেশী। "
সৌমিত্র বাবু বাইরে থাকাতেই জিপের হেড লাইট জ্বলানো অবস্হায় দেখতে পেল। ততক্ষণে আমরা গেইট খোলা পেয়ে বাইরে এসে জিপ স্টার্ট দিয়ে রওনা দিলাম।
আমি এতক্ষণ কোন কথায় বলিনি। শুধু হতবম্বের মত চেয়েছিলাম। মামা ড্রাইবিং সিটে বসে ঈষৎ হেসে জিজ্ঞেস করলেন "কিরে কিছু বুঝলি?"
আমি মাথা নাড়লাম। তখনও বুঝতে পারিনি ঘঠনা কি? মামা স্টিয়ারিং ঘোড়াতে ঘোড়াতে বলল, "সৌমিত্র বাবু এতদিন এখানকার আম চাষিদের হেনস্তা করছিল। নিজে ওদের বাগানে স্টেরনোচিটাস নামের বিষাক্ত পোঁকাকে উপকারী পোঁকা হিসেবে বলে তাদের বাগানে দেয়ার উপদেশ দিত। দিন দিন বাগান গুলো খারাপ হবে, আর তিনি কম দাম দিয়ে বাগানগুলো হাতিয়ে নিয়ে একাই ব্যাবসা করবেন, এটাই ছিল তার ভাবনা। এমনকি আমার বন্ধুর বাগানটাও নষ্ট করল। তাই শিক্ষা দিলাম একটা"
আমি মামাকে আবার বললাম "সবই বুঝলাম। কিন্তু সেদিন রাতের ঘঠনাটা কি হল? কে ডুকেছিল তোমার বাসায়?"
মামা একপ্রকার রহস্যের হাসি হেসে জবাব দিল, " ওটা আমি নিজেই ছিলাম। আমি উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করি। কাজেই আমাকে টার্গেট করেছিল সে। আর ওই বিষাক্ত পোঁকা স্টেরনোচিটাস আমি সেদিন তার বাগান থেকে চুরি করেছিলাম। আমার দাড়োয়ানকে সে কৌশলে বিদায় করে তার একজন দাড়োয়ান কাশেমকে আমার দাড়োয়ান হিসেবে দিল। আমিও না করিনি। কারন আমি আগে থেকেই জানতাম যে সেরকম কিছু সে করবে। তাই চুরের মত চুরি করে এনেছিলম ওই বিষাক্ত পোঁকাগুলো। পোঁকাগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয়। আমি যদি গেইট খুলে যেতাম, কাশেম সৌমিত্রকে বলে দিত। এবার বুঝলি?"
আমি আনন্দে মাথা নাচাতে লাগলাম। আর মনে মনে বললাম, যে অন্যের যে ক্ষতি করে, তার পরিনাম হয় ভয়াবহ। সে কখনও ঠিকে থাকে না।।