অধিকারের বিসর্জন
--------------------------
.
-----Hasan Tareque
.
টক টক কড়া নাড়ার শব্দে হঠাৎ জেগে উঠে গনি মিয়া। ইদানীং এরকম হচ্ছে প্রায়ই। ঘড়ির কাটার ঠিক ৩.২৫ মিনিটে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। একেকদিন এক এক কারনে ঘুম ভাঙ্গে। আজ ভেঙ্গেছে কড়া নাড়ার শব্দে। কখনও কখনও ঘড়ির কাটার ঠিক ঠিক শব্দেও জেগে উঠেন। আবার কখনও কখনও পানি পড়ার শব্দে। বাথরুমে গিয়ে কল নেড়েছেড়ে দেখেন, এবং আবিষ্কার করেন কল ঠিকই আছে, কোন শব্দ হয়নি।
৫৬ বছর বয়সী গনি মিয়ার এক রুমের ভাড়া ঘরে কেউ থাকে না। স্ত্রী গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। ছুলে পুলেও হয়নি। হিসাবরক্ষকের কাজ করে তার পেটে ভাতে চলে যায়।
.
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের পৃথিবী একদিকে আর ঘড়ির কাটা অন্যদিকে। নিজের স্ত্রী কিংবা ছেলে পুলে মারা গেলেও মানুষগুলো বলবে, "অফিসের টাইম শেষ করেই যাওয়া যাবে।"
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তাদেরই একজন। গোলগাল চেহেরা, সিথিকাটা চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমা পরা। ভদ্র বলতে যা বোঝায় সবই তার আছে। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়। যুদ্ধের সময়ই তার জন্ম। বাবা হোসাইন শরীফ তখন মুক্তিবাহিনীতে প্রানপনে দেশের জন্য লড়ছিলেন। পত্রমারফত খবর পেয়ে লুকিয়ে দেখতে আসে, আর তখন তাদের সেক্টর কমান্ডারের নামে নাম রাখে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। কথাগুলো শুনেছিল জাহাঙ্গীরের কাছেই। গনি মিয়াকে সে খুব ভালবাসে। নিজের কাজের ফাঁকে গনি মিয়ার হিসেবেও সাহায্য করে। তার হিসেবের হাত পাকা, তবুও তাকে কেরানি হয়ে থাকতে হচ্ছে। তার বাবা নাকি মুক্তিযুদ্ধের সনদ সরকারপক্ষ বাতিল করে দিয়েছে। আহা! একটা মানুষ নিজের জীবনের সবটি ত্যাগ করে, এই সবুজ দেশটাকে রক্ষা করেছে, আর তার ফল তার রক্তমাংসে গড়া ছেলেটা ভোগও করতে পারছে না।
গনি মিয়ার ভাবনার ছেদ পড়ে জাহাঙ্গীরের ডাকে,
__কি ভাবেন চাচা?
__কিছু ভাবছি না। কেমন আছ তুমি?
__জ্বি চাচা ভাল। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। আপনি খাবেন না?
__খাব একটু পর। তুমি খাবে না?
জিজ্ঞেস করেই গনি মিয়া হঠাৎ জাহাঙ্গীরের চেহারার দিকে তাকালেন। সেই সিথিকাটা চুল, গোলগাল চেহারার মাঝে যেন কিছু একটার শূন্যতা রয়েছে। তিনি ভাবনার অতল গহ্বরে সেই শূন্যতাটা খুঁজছেন। চোখ দুটো কেমন বসে গেছে। এই ছেলেকে ম্যানেজার চোরের দায়ে সেদিন প্রহার করেছিল। ছোটলোকের বাচ্ছা বলে গালি দিয়েছিল। আর ছেলেটা কাঁদতে বলছিল "স্যার আমি চুরি করিনি, স্যার আমি চুরি করিনি"।
ম্যানেজার তার হাতের পাঁচ আঙ্গুল দ্বিগুণ প্রসারিত করতে করতে বলছিল, তুই ছাড়া আর কে করবে? এখানে সবার রুমে তুই ডুকিস, ফাইল আনা নেয়া করিস। তুই চুরি করেছিস,আর বিলটাও তুই সরিয়েছিস, শালা ছোটলোকের বাচ্ছা।" তারপর তাকে আর চাকরিতে রাখা হবে না বলে দিয়েছে। আর মাত্র কটা দিন, কেউ জিজ্ঞেস করবে না "চাচা দুপুরের খাওয়া খেয়েছেন?"
.
গনি মিয়া বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। আর ভাবতে লাগলেন সেদিন কার চেহারায় যেন অস্পষ্ট হাসি দেখেছিলেন। কে সে? হ্যা মনে পড়েছে। ওসমান সাহেব সেদিন.....
আর দেরি না করে গনি মিয়া ওসমান সাহেবের ডেক্সে চলে গেলেন। এখন রাত দশটা অফিসে কেউ নেই। গনি মিয়া কাজের অতিরিক্ত চাপ দেখিয়ে দেরী করেছিলেন।
কিছু ফাইল হাতড়ালেন, টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। না কিছু নেই। এখন কি করবেন তিনি? কিভাবে প্রমান করবেন?
হঠাৎই তার চোখ গেল টেবিলের পাশে রাখা ময়লা ফেলার জারটাতে। কিছু ধুমড়ানো মুছড়ানো কাগজ, সিগারেটের শেষ অংশ, আর ম্যাচের কাটি। তার ভিতর আরও একটা ধুমড়ানো মুছড়ানো রঙ্গিন কাগজ। হ্যা এটাই সেই বিল, যে বিলের কারনে জাহাঙ্গীরের চোর বনতে হয়েছে। বিলটাতে ওসমান সাহেবের স্বাক্ষরের বিষাক্ত বর্ণগুলো জ্বলছে।
.....
পরের দিন
____
আজ গনি মিয়ার অন্যরকম একটা দিন। নিষ্পাপ ছেলেটার জন্য সে কিছু করতে পেরেছে। তাকে আর কেউ চাকরি থেকে বিদায় করতে পারবে না। একটু আগে ওসমান মিয়ার ডিসচার্জ লেটার দিয়া হয়েছিল। মানুষটা বের হতে হতে গনি মিয়াকে চোখ লাল লাল করে দেখছিল আর বলছিল "কাজটা ভাল করলেন না"।
গনি মিয়া একটা চিকন হাসি হেসে নিজের কাজে আবার মন দিলেন। কিন্তু মন বসছে না। যে ছেলেটা সকাল সকাল চলে আসে, সে দুপুর হয়ে গেল এল না কেন? আজ তো তার খুশির দিন। তাছাড়া তাকে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। ওসমার মিয়ার চেয়ারটা এখন তার।
না, আর অপেক্ষা করা যাবে না। গনি মিয়া ছুটি নিয়ে নিলেন অফিস থেকে। রিক্সা নিয়ে চলে এলেন জাহাঙ্গীরের বাসার সামনে।
হ্যা, এটাইতো জাহাঙ্গীরের মেস। ভুল হওয়ার কোন উপক্রম নেই। বয়স হইত ভুল করে বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু মন এখন পাকাপুক্ত আছে।
__এই যে ভাই শুনন
__জ্বি বলুন
__এখানে জাহাঙ্গীর থাকতো না?
__জ্বি, এইত এই জায়গায়, কিন্তু সে তো চলে গেছে আজ ভোরেই। বলছিল চাকরিতে নাকি বাদ দিয়ে দিয়েছে। তাই চলে যাচ্ছে। কোথায় যাবে বলে যাইনি।
গনি মিয়া সেই জরাজীর্ণ জায়গাটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কিছু ভাঙ্গা আর টুকরো জিনিস, আর আষ্টেপৃষ্ঠে। কি আশ্চর্য জাহাঙ্গীরের রেখে যাওয়া ভাঙ্গা টুকরো জিনিস গুলোকে তিনি ছুঁয়ে যেন জাহাঙ্গীরের স্পর্শতা অনুভব করছেন। জিনিস গুলো বলছে, এই দেশ আমাদের নয়, এই দেশ তাদের যারা রক্ত না দিয়েও এইদেশ চুষে খাচ্ছে তাদের। তোমরা আমাদের রক্ত খেয়ে সুখে থাক।
অভিমানী মানুষগুলো দেশের জন্য এত কিছু করেও কিছু পায় না। দেশের প্রতি অভিমান তাদের, সবুজ দেশটার প্রতি আক্ষেপ। মানুষগুলো বহুরুপি হয়ে গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে অন্যের অধিকার। তবু সে মানুষগুলো অভিমান করেই থাকে। দূরে চলে যায়, আপন মনে দেশটাকে ভালবাসে।।