somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অধিকারের বিসর্জন

২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




অধিকারের বিসর্জন
--------------------------
.
-----Hasan Tareque
.
টক টক কড়া নাড়ার শব্দে হঠাৎ জেগে উঠে গনি মিয়া। ইদানীং এরকম হচ্ছে প্রায়ই। ঘড়ির কাটার ঠিক ৩.২৫ মিনিটে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। একেকদিন এক এক কারনে ঘুম ভাঙ্গে। আজ ভেঙ্গেছে কড়া নাড়ার শব্দে। কখনও কখনও ঘড়ির কাটার ঠিক ঠিক শব্দেও জেগে উঠেন। আবার কখনও কখনও পানি পড়ার শব্দে। বাথরুমে গিয়ে কল নেড়েছেড়ে দেখেন, এবং আবিষ্কার করেন কল ঠিকই আছে, কোন শব্দ হয়নি।
৫৬ বছর বয়সী গনি মিয়ার এক রুমের ভাড়া ঘরে কেউ থাকে না। স্ত্রী গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। ছুলে পুলেও হয়নি। হিসাবরক্ষকের কাজ করে তার পেটে ভাতে চলে যায়।
.
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের পৃথিবী একদিকে আর ঘড়ির কাটা অন্যদিকে। নিজের স্ত্রী কিংবা ছেলে পুলে মারা গেলেও মানুষগুলো বলবে, "অফিসের টাইম শেষ করেই যাওয়া যাবে।"
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তাদেরই একজন। গোলগাল চেহেরা, সিথিকাটা চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমা পরা। ভদ্র বলতে যা বোঝায় সবই তার আছে। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়। যুদ্ধের সময়ই তার জন্ম। বাবা হোসাইন শরীফ তখন মুক্তিবাহিনীতে প্রানপনে দেশের জন্য লড়ছিলেন। পত্রমারফত খবর পেয়ে লুকিয়ে দেখতে আসে, আর তখন তাদের সেক্টর কমান্ডারের নামে নাম রাখে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। কথাগুলো শুনেছিল জাহাঙ্গীরের কাছেই। গনি মিয়াকে সে খুব ভালবাসে। নিজের কাজের ফাঁকে গনি মিয়ার হিসেবেও সাহায্য করে। তার হিসেবের হাত পাকা, তবুও তাকে কেরানি হয়ে থাকতে হচ্ছে। তার বাবা নাকি মুক্তিযুদ্ধের সনদ সরকারপক্ষ বাতিল করে দিয়েছে। আহা! একটা মানুষ নিজের জীবনের সবটি ত্যাগ করে, এই সবুজ দেশটাকে রক্ষা করেছে, আর তার ফল তার রক্তমাংসে গড়া ছেলেটা ভোগও করতে পারছে না।
গনি মিয়ার ভাবনার ছেদ পড়ে জাহাঙ্গীরের ডাকে,
__কি ভাবেন চাচা?
__কিছু ভাবছি না। কেমন আছ তুমি?
__জ্বি চাচা ভাল। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। আপনি খাবেন না?
__খাব একটু পর। তুমি খাবে না?
জিজ্ঞেস করেই গনি মিয়া হঠাৎ জাহাঙ্গীরের চেহারার দিকে তাকালেন। সেই সিথিকাটা চুল, গোলগাল চেহারার মাঝে যেন কিছু একটার শূন্যতা রয়েছে। তিনি ভাবনার অতল গহ্বরে সেই শূন্যতাটা খুঁজছেন। চোখ দুটো কেমন বসে গেছে। এই ছেলেকে ম্যানেজার চোরের দায়ে সেদিন প্রহার করেছিল। ছোটলোকের বাচ্ছা বলে গালি দিয়েছিল। আর ছেলেটা কাঁদতে বলছিল "স্যার আমি চুরি করিনি, স্যার আমি চুরি করিনি"।
ম্যানেজার তার হাতের পাঁচ আঙ্গুল দ্বিগুণ প্রসারিত করতে করতে বলছিল, তুই ছাড়া আর কে করবে? এখানে সবার রুমে তুই ডুকিস, ফাইল আনা নেয়া করিস। তুই চুরি করেছিস,আর বিলটাও তুই সরিয়েছিস, শালা ছোটলোকের বাচ্ছা।" তারপর তাকে আর চাকরিতে রাখা হবে না বলে দিয়েছে। আর মাত্র কটা দিন, কেউ জিজ্ঞেস করবে না "চাচা দুপুরের খাওয়া খেয়েছেন?"
.
গনি মিয়া বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। আর ভাবতে লাগলেন সেদিন কার চেহারায় যেন অস্পষ্ট হাসি দেখেছিলেন। কে সে? হ্যা মনে পড়েছে। ওসমান সাহেব সেদিন.....
আর দেরি না করে গনি মিয়া ওসমান সাহেবের ডেক্সে চলে গেলেন। এখন রাত দশটা অফিসে কেউ নেই। গনি মিয়া কাজের অতিরিক্ত চাপ দেখিয়ে দেরী করেছিলেন।
কিছু ফাইল হাতড়ালেন, টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। না কিছু নেই। এখন কি করবেন তিনি? কিভাবে প্রমান করবেন?
হঠাৎই তার চোখ গেল টেবিলের পাশে রাখা ময়লা ফেলার জারটাতে। কিছু ধুমড়ানো মুছড়ানো কাগজ, সিগারেটের শেষ অংশ, আর ম্যাচের কাটি। তার ভিতর আরও একটা ধুমড়ানো মুছড়ানো রঙ্গিন কাগজ। হ্যা এটাই সেই বিল, যে বিলের কারনে জাহাঙ্গীরের চোর বনতে হয়েছে। বিলটাতে ওসমান সাহেবের স্বাক্ষরের বিষাক্ত বর্ণগুলো জ্বলছে।
.....
পরের দিন
____
আজ গনি মিয়ার অন্যরকম একটা দিন। নিষ্পাপ ছেলেটার জন্য সে কিছু করতে পেরেছে। তাকে আর কেউ চাকরি থেকে বিদায় করতে পারবে না। একটু আগে ওসমান মিয়ার ডিসচার্জ লেটার দিয়া হয়েছিল। মানুষটা বের হতে হতে গনি মিয়াকে চোখ লাল লাল করে দেখছিল আর বলছিল "কাজটা ভাল করলেন না"।
গনি মিয়া একটা চিকন হাসি হেসে নিজের কাজে আবার মন দিলেন। কিন্তু মন বসছে না। যে ছেলেটা সকাল সকাল চলে আসে, সে দুপুর হয়ে গেল এল না কেন? আজ তো তার খুশির দিন। তাছাড়া তাকে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। ওসমার মিয়ার চেয়ারটা এখন তার।
না, আর অপেক্ষা করা যাবে না। গনি মিয়া ছুটি নিয়ে নিলেন অফিস থেকে। রিক্সা নিয়ে চলে এলেন জাহাঙ্গীরের বাসার সামনে।
হ্যা, এটাইতো জাহাঙ্গীরের মেস। ভুল হওয়ার কোন উপক্রম নেই। বয়স হইত ভুল করে বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু মন এখন পাকাপুক্ত আছে।
__এই যে ভাই শুনন
__জ্বি বলুন
__এখানে জাহাঙ্গীর থাকতো না?
__জ্বি, এইত এই জায়গায়, কিন্তু সে তো চলে গেছে আজ ভোরেই। বলছিল চাকরিতে নাকি বাদ দিয়ে দিয়েছে। তাই চলে যাচ্ছে। কোথায় যাবে বলে যাইনি।
গনি মিয়া সেই জরাজীর্ণ জায়গাটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কিছু ভাঙ্গা আর টুকরো জিনিস, আর আষ্টেপৃষ্ঠে। কি আশ্চর্য জাহাঙ্গীরের রেখে যাওয়া ভাঙ্গা টুকরো জিনিস গুলোকে তিনি ছুঁয়ে যেন জাহাঙ্গীরের স্পর্শতা অনুভব করছেন। জিনিস গুলো বলছে, এই দেশ আমাদের নয়, এই দেশ তাদের যারা রক্ত না দিয়েও এইদেশ চুষে খাচ্ছে তাদের। তোমরা আমাদের রক্ত খেয়ে সুখে থাক।
অভিমানী মানুষগুলো দেশের জন্য এত কিছু করেও কিছু পায় না। দেশের প্রতি অভিমান তাদের, সবুজ দেশটার প্রতি আক্ষেপ। মানুষগুলো বহুরুপি হয়ে গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে অন্যের অধিকার। তবু সে মানুষগুলো অভিমান করেই থাকে। দূরে চলে যায়, আপন মনে দেশটাকে ভালবাসে।।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৩৪
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×