।।বিবর্ন ক্যানভাস।।
==================
==>লেখা:- মোহাম্মদ হাসান তারেক
"তুমি তোমার মত থাক, আমাকে আমার মত থাকতে দাও। মুক্তি দাও আমায়।"
একথাটি এখনও নিলয়ের কানের এপাশ থেকে ওপাশে কম্পিত হয়। এখনও সে কন্ঠ লতাপাতার মত বেয়ে উঠে শরীরে এক করুন অনুভুতির সৃষ্টি করে, এখনও নিজেকে অসহায় মনে হয়।।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষে পড়া মনমরা চুপটি মেরে বসে থাকা নিলয় ছেলেটি কখনও কারো কাছে বন্ধুত্বের আবেদন নিয়ে যায়নি, এমনকি কেউ তার কাছে আসেওনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়াতে নিজেকে খুব ছোট ভাবে। ভাবে কারো বন্ধুত্বের যোগ্য সে নয়।।
অন্যপ্রান্তে তমা নামের হাসি মাখা থাকা মেয়েটি কখনও কারো সাথে কথা না বলে থাকতে পারত না। কেউ মনমরা হয়ে বসে থাকাটা সে অসহ্য মনে করে। কখনও কখনও কারো বার্থডেতে বিশাল এক সারপ্রাইজ নিয়ে চমকে দেয়, কখনও কখনও স্যারের কাছে অভিযোগ দেয় "স্যার দেখেন এ হতচ্ছাড়া কেমন করে মন মরা হয়ে বসে আছে, যেমন কি কেউ মারা গেছে"। বলেই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ত।।
নিলয়ের মন মরা মুখটি কারো এড়িয়ে যায়নি এমনকি তমারও। সবাই ব্যর্থ চেষ্টায় তার মুখে হাসির চাপটা দেখতে পারেনি। তমারও কম চেষ্টা হয়নি। তবু ছেলেটা মন মরা।।
একদিন ক্লাশ শেষে বাসায় ফিরছে। বাসায় ডুকতেই দেখে কেউ নেই। কিন্তু এ সময় তাকে না বলে রুমের কেউতো কোথাও যায় না? মনের মধ্যে কেমন যেন লাগল। লাইটের সুইচ টিপতে বুঝতে পারল কারেন্ট নেই। হঠাৎ আচমকা লাইট জ্বলে উঠল। "হ্যাপি বার্থডে নিলয়" লেখাটি প্রজেক্টরে ভেসে উঠল। সমস্বরে সবাই চিৎকার করতে করতে বলল "হ্যাপি বার্থডে" দোস্ত।।
ক্লাশের কম বেশী যারা তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল সবাই উপস্হিত। তমা দৌড়ে হাতে কেক নিয়ে এসে বসাল টেবিলে। নিলয়ের হাত কেক কাটার চুরি ধরিয়ে দিল। তখনই ঘঠল এক অবাক কান্ড যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।।
নিলয় হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সবাই চুপ হয়ে গেল। সেদিন তমা খুব কষ্ট পেল। বৃথা চেষ্টার ফল সবাই ভোগ করল। বিশেষ করে তমা। যত জনকেই সে বিমর্ষতার থেকে বাছাতে চেয়েছে ততজনই বেরিয়ে এসেছে আর সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলা শুরু করছে। কিন্তু নিলয়টা এমন কেন????
প্রতিদিনের মত সবাই আজও ক্লাশে উপস্হিত। কালকের ঘঠানাটা সবার মনেই দাগ কেটেছে। নিলয়কে আসতে দেখে সবাই ছিটকে যাচ্ছে। হঠাৎ তমা কোথা থেকে দৌড়ে এসে তার দুদিকের শার্টের কলার ধরে বলল "কেন কাল এমন করেছিলে? কি দোষ ছিল আমাদের? তুমি মন মরা হয়ে বসে থাক, সেটা আমাদের পছন্দ না। তোমার মুখে একটু হাসি ফোঁঠাতে ছেয়েছি। তোমার সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে ছেয়েছি। এটাই কি আমাদের দোষ???"।
"কি হল? চুপ করে অাছ কেন? উত্তর দাও"....
নিলয় পিছনের দিকে হাটতে লাগল, ক্লাশ থেকে বেরিয়ে বড় গাছ তলায় বসল। তমাও তার পিছুনেয়।
"আমার জীবনটা কখনই এমন ছিল না। তুমি যেমন কারো মন মরা হয়ে থাকা পছন্দ কর না, তেমনি আমিও। সেই সুবাদে পরিচয় হয় মিথিলা নামের এক ঝড়ের সাথে, যে ঝড় আমার জীবনকে তছনছ করে দেয়, যে ঝড় আমার ক্যানভাসের তুলির পালক ছিন্নবিন্ন করে দেয়, আমার সব কল্পনার রংকে ছিটিয়ে দেয় মাটিতে। খুব ভাল বেসেছি থাকে। মনের এক নীল ক্যানভাস জুড়ে তার ছবিই সারাদিন আঁখতাম। ভালবাসার স্বর্ণলতা বেয়ে তার নামটা মনের পুরোটা জুড়ে বেয়ে উঠত। কিন্তু হঠাৎ করে সে একদিন হারিয়ে যায়। যার খোজ আজও পায়নি। সে গেছে, সাথে আমার সব তুলি, রং, হাসি, সুখ নিয়ে গেছে। আমায় কিছুই দিয়ে যায়নি। তার শেষ কথাটি এখনও কানের এপাশ থেকে ওপাশ এক কম্পনের সৃষ্টি করে।।"
তমা কথাগুলো শুনছে আর ভাবছে। ভালবাসায় পরাজিত এক ব্যক্তি যে কিনা কিছু পাবার আশায় সব হারিয়েছে। সব বিবর্ণ ক্যানভাস জুড়ে দুঃখের রংগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হল নিলয়ের তমার মত একজনকে দরকার। তমা দেরী না করে নিলয়ের হাত ধরতে যাবে। এমন সময় দেখে নিলয়ের জায়গাটি শূন্য।।
দ্রুত গেল নিলয়ের রুমে। দরজা খোলা অবস্হায়। নিলয়ের জিনিসগুলো এলোমেলো। হঠাৎ একটি রংরঙ্গা ডাইরি দেখল। ডাইরি খুলতেই বড় করে একটি লেখা চোখে পড়ল।।
"যেদিন আমার জমানো সব কথা কেউ শুনবে সেদিন আমি সেই ব্যক্তির থেকে দূরে সরে যাব। কারন দুঃখের সময়ে সবাই ক্ষনিকের একটি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিবে। আমি সেই ক্ষনিকের সহায়তা চাই না।"