গল্পঃ কল্পবিস্তার
১.
ছোটবেলায় ফিরে গেছে যেন ওরা। অভি আর রাজ। কানামাছি খেলছে ছাদের উপর। অভির চোখে কাপড় বাঁধা।
ছাদটায় রেলিং দেয়া নেই। রাজকে তাড়া করে ছুঁতে যেয়ে একেবারে কর্ণারে চলে এলো অভি। চোখ বাঁধা থাকায় কিছুই দেখতে পারছে না। হঠাৎ পেছন থেকে আস্তে করে একটা ধাক্কা দিলো রাজ। এক পা সামনে ফেলতে গিয়ে আর ঠাঁই পায় না অভি। তাড়াতাড়ি টানাটানি করে চোখে বাঁধা কাপড়টা খুলে ফেলে ও। আট তলার ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে সে। ওজনহীনতা অনুভব করছে। মুখ ঘুরিয়ে রাজের দিকে তাকালো। ওর দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি হাসছে। গা শিরশির অনুভূতি হচ্ছে অভির। পুরো দেহটা মাটিতে আঘাত করার পুর্বমূহুর্তেই একটা হার্টবিট মিস করে স্বপ্নটা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠলো অভি। এই শীতের মাঝেও ঘামছে। বুকটা দ্রিম দ্রিম করছে। এই খারাপ স্বপ্ন দেখবার কারণ কী? তাও আবার ওর সব থেকে ক্লোজ ফ্রেন্ডকে নিয়ে?
চারিদিকে অন্ধকার। ঘুম ভাঙার পরও কিছুক্ষণ মনে করতে পারলো না সে কোথায় আছে। এরপর মনে পড়লো, একটা গাড়ির ব্যাকসিটে বসে আছে সে। এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও। কিন্তু গাড়ি এখানে থামানো কেন? গাড়িটা চালাচ্ছিলো রাজ। কই ও? কোথাও ওর নিশানা দেখা যাচ্ছে না।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। মাটির রাস্তা। দুর থেকে আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে নির্জন গ্রামের দিকে গেছে রাস্তাটা। কোথাও আলো নেই। রাস্তার ওপারে তাকাতেই দু'তিনটে দোকান চোখে পড়লো। রাস্তাটা বেশী চওড়া না। বেশ সরু আর প্রচন্ড নির্জন।
"ধুর! কই গেলো শালা!" রাজের দেখা না পেয়ে অধৈর্য হয়ে উঠেছে অভি। সীটে একভাবে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যাথা করছে ওর। আঙুল দিয়ে ঘাড়টা ম্যাসাজ করতে করতে মাথাটা গাড়ির ভিতরে আনলো।
হঠাৎ ইগনিশনে নজর গেলো। চাবিটাতো ওখানেই ঝুলছে! দরজার দিকে চোখ পড়লো। ডানদিকের সামনের দরজাটা খোলা। কিছু হয় নি তো ওর? বুক ঢিপ ঢিপ করা শুরু করেছে। যদি রাজকে কেউ টেনেহিচড়ে নামিয়ে থাকে!
ওরা!
ব্যাগটা!
লাফ দিয়ে পিছন সিট থেকে সামনের সিটে চলে এলো। হাতড়াতে লাগলো। না নেই! ওটা নেই! নগদ ত্রিশ লাখ টাকার ব্যাগটা নেই!
সন্ধ্যার দিকেই ওরা খেয়াল করেছিলো আরেকটা গাড়ি ওদের ফলো করছে। প্রথমে ভেবেছিলো, চোখের ভুল।
মনের ভুল।
রাস্তায় এমন কত গাড়িই তো একটা আরেকটার পিছে ছোটে। ওদের পেরিয়ে নিরাপদ দূরত্বেও চলে এসেছিলো।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ওরাই। এটা ওদেরই কাজ। এমন একটা জায়গাতে সব ঘটা সম্ভব।
তাহলে অভি বেঁচে গেলো কিভাবে? পেছনের সীটে থাকায় হয়তো খেয়াল করে নি। তাছাড়া রাজ আর টাকাগুলো পেয়ে যাওয়ার পর ওরা হয়তো চিন্তাও করে নি অন্য কেউ থাকতে পারে।
"খোদা! ওকে রক্ষা কোরো!" গুঙিয়ে উঠলো অভি।
রাজকে কী করেছে ওরা? মেরেই ফেললো নাকি? মনের ভিতর ভয় জমাট বাধতে শুরু করেছে। কী করবে ও? রাজ মারা গেলে ওর এখনই পালানো উচিত। নাহলে নিজের জীবনও সংশয়ে পড়বে। পালাবে ও?
নাহ! যদি রাজকে কোথাও আটকে রাখে? নাহয় জখম করে ফেলে রেখে যায়? হয়তো ওর সাহায্যের অপেক্ষায় কোয়াথাও কাতরাচ্ছে রাজ। পালানোটা ঠিক হবে না। খুঁজতে হবে রাজকে। ওর জখম বেশি হলে হাসপাতালে নিতে হবে।
অভি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামলো। নামার আগে পকেটে একটা ছুরি নিয়ে নিলো। বাইরে এসে চারপাশের রাস্তাটা খুঁজে দেখতে লাগলো। রক্তের কোন ছোপ ছোপ দাগ আছে কি না। পাওয়া গেলে হয়তো আন্দাজ করা যাবে ও কে কোথায় নিয়ে গেছে। আবছা আলোয় খুঁজতে কষ্ট হচ্ছে ওর। কিন্তু কাজ চালিয়ে নিলো।
কয়েক মিনিট খোঁজাখুঁজির পর নিশ্চিত হলো, রাস্তায় কোন রক্তের দাগ নেই। ধস্তাধস্তিরও চিহ্ন নেই। তাহলে হয়তো ধরার আগেই রাজ পালিয়ে গেছে।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। রাজকে কল দিতে যাবে, এমন সময় খেয়াল করলো নেটওয়ার্ক নেই। খানিকক্ষণ সাবধানে এদিকওদিক হেঁটে নেটওয়ার্ক পাবার চেষ্টা করলো। নাহ। পাওয়া গেলো না। মনের ভিতর বিপদের আশংকা উঁকি মারছে।
দোকান! দোকানগুলোতে যেয়ে দেখা যায়। টাকা দিয়ে কথা বলার ব্যবস্থা থাকার কথা।
টাকা!
টাকার ব্যাগটার কথা এখন আর ভাবছে না অভি। টাকা যায় যাক। রাজকে সুস্থ ফিরে পেলেই হলো।
চারিদিকটা একটু বেশি অন্ধকার। নিঝঝুম। অমাবস্যা নাকি আজ? কাছে যেতেই বুঝতে পারলো ওখানে তিনটা দোকান। একটা মুদির দোকান। আর বাকি দু'টো রাস্তার পাশে থাকা হোটেলের মতো। হোটেলের বাইরে চার-পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আর গল্প করছে। কে জানে! হয়তো ওরাই রাজকে মেরে ব্যাগটা নিয়েছে।
মুদি দোকানের দিকেই এগোলো অভি। কারেন্ট নাই বোধহয়। মোমবাতি জ্বলছে।
অদ্ভুত ব্যাপার! দোকানে কেউ নেই! ফাঁকা! মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় ভালো করে দোকানের ভিতরটা দেখলো। নাহ কেউ নেই। তবে দোকানের এক কোণায় একটা টুলের ওপর টেলিফোন রাখা।
কী হবে না হবে, চিন্তা না করেই দোকানের ভিতর ঢুকে গেলো অভি। রিসিভারটা উঠিয়ে কানে ঠেকিয়েই রাজের নম্বর ডায়াল করা শুরু করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া নেই। কি যেন একটা মিসিং। ধরতে পারছে না অভি। হঠাৎ খেয়াল হলো, কোন ডায়াল টোন নেই। এই টেলিফোন ডেড!
ঘামতে শুরু করেছে আবার। এবার হাত-পাও কাঁপছে। কাঁপা হাতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছুরিটা চেপে ধরলো। এটা নিজের আত্মরক্ষার জন্যে। কিন্তু ভালোভাবেই জানে চার-পাঁচজনের সাথে একা পারবে না সে।
মুদি দোকান থেকে বেরিয়ে হোটেলের দিকে যাবার চিন্তা করলো। আর উপায় নেই। ওখানে হয়তো সাহায্য পাওয়া যাবে। এমন সময়েই ঘটনাটা ঘটলো।
মুদি দোকান আর হোটেল দু'টোর মাঝখানে একটা অন্ধকার গলি গেছে। ওটা পার হবার সময় খেয়াল করলো গলির ওমাথা থেকে একটা আওয়াজ আসছে। থেমে গেলো অভি। রাজ কি শব্দ করছে? ওখানে আটকে রেখেছে ওকে?
সাত-পাঁচ না ভেবে গলিপথটায় পা বাড়ালো। শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। চশমাটা না আনায় অন্ধকারে দেখতে কষ্ট হচ্ছে ওর। তারপরও মানিয়ে নিচ্ছে এটা। আগের আওয়াজটার সাথে অন্য আরেকটা শব্দ যোগ হয়েছে। কয়েক সেকেন্ড পর আরো একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে।
শব্দের উৎস না জেনে আন্দাজে এগোনোর আর সাহস পেলো না অভি।
ওখানে দাঁড়িয়েই একটু উঁচু গলায় ডাকলো, "রাজ! রাজ! আছিস ওখানে?"
একটু থেমে কানপেতে শোনার চেষ্টা করলো। নাহ। কোন সাড়াশব্দ নেই। আবার বললো, "কথা বল, ভাই। "
তাও রেসপনস নেই কোন।
নাহ। এখানে হয়তো নেই। গলিটা থেকে বের হওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। একটু এগোতেই অন্ধকারে দেখলো কে যেন হেঁটে আসছি গলিটা ধরেই।
ওর দিকেই।
একটা কালো মূর্তির মতো মনে হচ্ছে।
জ্যাকেট পরা। ওর থেকে একটা দূরে এসে থেমে দাঁড়ালো সে।
অভির টেনশন আরো বেড়ে গেছে। এ লোকটা হয়তো রাজের কিডন্যাপারদেরই কেউ। অভির কথা টের পেয়ে হয়তো এখন তাকেই ধরতে আসছে।
পকেটে হাত দিয়ে ছুরিটা শক্ত করে ধরলো। কিছুতেই নিজেকে ধরা দিবে না সে। মূর্তিটাও ডান পকেটে হাত ঢুকালো। আরেকটা হার্টবিট মিস করে গেলো অভির। যা করার দ্রুত করে এখান থেকে বের হতে হবে।
হঠাৎ কী হলো, সে নিজেও বুঝতে পারলো না। নিয়ন্ত্রণের রশিটা যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে গেলো ওর হাত থেকে।
ছুরিটা চকিতে পকেট থেকে বের করে তড়িত গতিতে লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো অভি। মূহুর্তের মাঝে পাকস্থলি বরাবর ঢুকিয়ে দিলো ওটা।
গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। সেই রক্তে হাতটা ভিজে গেছে। অস্ফুট স্বরে গোঙাচ্ছে মানুষটা।
লোকটার উপর থেকে উঠে যেতেই তার ডান পকেট থেকে একটা লাইটার বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। মূহুর্তেই বুঝতে পারলো, কী ভুলটা করেছে সে! নিরীহ একটা মানুষকে বিনা কারণে ছুরি মেরেছে। এখন কী হবে?
পালাতে হবে।
গলির মাথায় দাঁড় করানো একটা মোটর সাইকেল স্টার্ট নিলো। আহত মানুষটার গোঙানি আর মোটর সাইকেলের হেডলাইটের আলোয় লোকগুলো বুঝে গেছে কী ঘটেছে। অভি লাফিয়ে উঠে কাঁপা পায়ে এলোমেলোভাবে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। ধরে ফেলে ওকে।
২.
দুই দিন পর।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রাজ। ওর মাথার কাছে বসে আছে অভি।
সেদিনের দেখা স্বপ্নটা এভাবে সত্যি হবে, ভাবে নি অভি। স্বপ্নে রাজ ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। আর বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটছিলো প্রায়।
ছুরির আঘাতটা বেশ গুরুতরই ছিল। পাকস্থলিটা অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। কোমায় চলে গেছিলো রাজ। আজ মোটামুটি আশংকামুক্ত। আর এই দু'দিন পুলিশি হেফাজতে থাকতে হয় অভিকে। রাজের অবস্থা একটু উন্নতি হবার পর, ওকে সব খুলে বলেছে অভি। সেদিনের সব ঘটনা। কিভাবে উল্টোপাল্টা ভেবে একা একা ভয় পেয়েছিলো। চশমা সাথে না থাকায় ঐ ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাজকে চিনতে পারে নি ও। সব বুঝতে পেরে আর মামলা করে নি রাজ।
রাজ নিজেও ভূল স্বীকার করেছে। অভি ঘুমিয়ে থাকায়, কিছু না জানিয়েই ওকে একা ফেলে হোটেলে রাতের খাবার খেতে গেছিলো। খাওয়া শেষে সিগারেটে দু'টো টান দিতেই গলির মাথায় দাঁড়িয়েছিলো সেদিন।
আর টাকার ব্যাগটা?
গাড়ি থেকে বের হবার আগে ওটা অভির সীটের নিচে রেখে গেছিলো রাজ। অভি ঘুমিয়ে থাকায় টের পায় নি। আর ঘুম ভাঙার পর, অতি উত্তেজনায় নিজের সিটটাই খুঁজতে ভুল গেছিলো অভি।
অনেকটা চিলে কান নেওয়ার মতো ব্যাপার।
হাসানুল ফেরদৌস সাদিদ
২৯ শে মে, ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:১৩