somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জল জোছনার খোঁজে

০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :







সারাদিন বৃষ্টিকে সঙ্গী করে সন্ধ্যার আগে আগে যখন নৌকা টেকেরঘাটে ভিড়ল, তখন মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আকাশে তখনো মেঘেদের দৌড়ঝাঁপ সমানে চলছে। এবারো বুঝি হবে না মোর জলজোছনায় স্নাত হওয়ার সেই আকাঙ্ক্ষা। চাঁদের আলোয় মায়াবী আদিগন্ত বিস্তীর্ণ হাওড়ের জলরাশির পাণে চেয়ে গাওয়া হবে না,

এলোমেলো হয়ে যায়
এই জল জোছনায়
অগোছালো খুঁজে পাই
বৃষ্টি ভেজা তোমায়
এই জল জোছনায়
রূপসী তুমি
অকাতরে ভিজে যাই
অবাক এই আমি
শুধু যে তাই
এই জল জোছনায়

গত বৃহস্পতিবার রাতে কমলাপুর রেলষ্টেশন হতে চল্লিশজনের দল রওনা হয়েছিলাম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য বেশ কিছু হাওড় নৌভ্রমণ করে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওড় টাঙ্গুয়ার হাওড় পাড়ি দিয়ে মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে টেকেরঘাট। নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে এই কথা সত্য প্রমাণ করে রাত এগারোটা পঞ্চাশের ট্রেন ছাড়ল রাত দুইটার পরে। দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে সারা দেশ জুড়েই ছিল বৃষ্টি, ট্রেন ছাড়ার পরপরই বৃষ্টিও আমাদের সাথী হল। ফলে জানালার কপাট নামিয়ে দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে দেয়া ছাড়া আর করার কিছুই ছিল না।



আমি সবসময় একা নয়ত কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সাথে বেড়াতে অভ্যস্ত, আর গ্রুপের সাথে ট্যুরে গেলে সেটা হয় ভ্রমণ বাংলাদেশের সাথেই। এবার প্রথম ভ্রমণ বাংলাদেশের অন্যতম কার্যকরী সদস্য আবু বকর ভাইয়ের “ইকো ট্র্যাভেলার্স” এর সাথে ভ্রমণে বের হলাম। আগে থেকে দেয়া গেস্ট লিস্টে পরিচিত কাউকে দেখতে না পেয়ে তৈরি ছিলাম একা একা সময়গুলো উপভোগ করার। কিন্তু কমলাপুর পৌঁছে দেখলাম দশ বারো জন পূর্ব পরিচিত ভ্রমণ সঙ্গী রয়েছে যাদের সাথে আগে ভ্রমণ বাংলাদেশ হতে ট্যুর করেছি। ফলে সময়গুলো খুব খারাপ কাটবে বলে মনে হল না।



ভোর ছয়টার কাছাকাছি সময়ে ট্রেন পৌঁছলো ময়মনসিংহ ষ্টেশন, এখানে ট্রেন থেমে রইল বেশ কিছু সময়। ট্রেন হতে নেমে বৃষ্টির ছাঁট মাথায় নিয়ে চা পান করে নিলাম। এখান হতে দেখলাম মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্যে লোকাল ট্রেন ছাড়ে। হুমায়ূন আহমেদের সুবাদে এই এলাকার বেশ কিছু ষ্টেশনের নাম মনে গাঁথা ছিল। এক এক করে সেইসব ষ্টেশন পার হওয়ার সময় মনে পড়ছিল প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে। মোহনগঞ্জ, গৌরীপুর, শ্যামগঞ্জ, বারহাট্টা সহ কত নাম জানা না জানা ষ্টেশন পার হয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ। সেখানে ট্রেন থেকে নেমে চলে গেলাম জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে। সেখানে সকলে ফ্রেশ হয়ে লোকাল একটা রেস্টুরেন্টে সেরে নিলাম সকালের নাস্তা, সাথে চা আর লোকাল মিষ্টি। পেট পুজোর পর আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা ষ্টীল বডির ইঞ্জিন নৌকায় সবাই উঠে পড়লাম। কেউ কেউ নীচের ছাউনির ভেতরে, আর বাকীরা ছাঁদে চেয়ার বসে বসে, অথবা হাত-পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম। ইঞ্জিনের বিরক্তিকর শব্দের উৎপাত ঢাকা পড়ল বৃষ্টিভেজা চারিদিকের সবুজ প্রকৃতি। জলরাশি ভেদ করে এগিয়ে চলল আমাদের নৌযান।



রেইন কোট পড়ে, মাথায় ছাতা দিয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়। একসময় সব কিছু বাদ দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাওড়ের রূপসুধা পান করতে করতে এগিয়ে চললাম সম্মুখ পাণে। সাথে করে ঢাকা থেকে আমাদের টুলু বাবুর্চিকে নিয়ে যাওয়ায় খাবারের সকল আয়োজন নৌকাতেই হয়েছিল। হাওড়ের বেশ কয়েক পদের মাছ দিয়ে আয়োজন ছিল লাঞ্চের। লঞ্চের ছাঁদে বসে খোলা আকাশের নীচে জলের দুলুনিতে খাওয়ার মজাই অন্যরকম। কিন্তু বিকেল হতেই শুরু হল ঝড়ো হাওয়া, উত্তাল হল হাওড়। ২০১৩ সালের হাওড় ট্যুরের সময় বন্ধু মনার মুখে শুনেছিলাম হাওড়ের ঢেউ নাকি ভয়ংকর হয়। এবার তার রূপ দেখলাম, অবিশ্বাস্য। আমাদের গন্তব্যের সাথে ঢেউয়ের অভিমুখ ছিল প্রায় নব্বই ডিগ্রী, ফলে ঢেউ সরাসরি নৌকার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছিল, ক্ষণে ক্ষণে নৌকা কাত হয়ে যাচ্ছিল। ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে গেল, মাঝিকে বারবার বলছিলাম নৌকার দিক একটু ঘুরিয়ে দিতে, যাতে করে ঢেউয়ের আঘাত সরাসরি নৌকার বডিতে না পড়ে। কিন্তু মাঝিটা বড়ই বেয়ারা ছিল, সে একটু পরপরই নৌকাকে ঢেউয়ের সাথে নব্বই ডিগ্রী এঙ্গেলে নিয়ে যাচ্ছিল। শেষে বাধ্য হয়ে সবাই লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিলাম, আসন্ন যে কোন বিপদের জন্য। আবহাওয়া বেশী খারাপ হলে, একটা দ্বীপ গ্রামে নৌকা ভেড়ানো হল। দুপুরের নামাজ ছিল জুম্মা নামাজ, মূল হাওড়ে ঢোকার আগে একটা গ্রামের মসজিদে সেটা সেরে নিয়েছিলাম। এবার এই গ্রামে আসরের নামাজ সেরে নিলাম এই ফাঁকে। নামাজ শেষে নৌকায় ফিরে দেখি পরিস্থিতি একটু ভাল, ঢেউয়ের উত্তালতা একটু কমেছে। আবার নৌকা ছাড়ল, রওনা হলাম টেকেরঘাটের দিকে। চোখের সামনে মেঘালয় পাহাড়ের মেঘের খেলা, তার নীচে সাজানো গ্রাম, নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সেই মায়ার ভুবনে।











সন্ধ্যার লগ্নে নৌকা ভিড়ল ঘাটে, সাথে শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। টেকেরঘাটে একটিমাত্র আবাসিক হোটেল, স্থানীয় চেয়ারম্যানের মালিকানার “খন্দকার আবাসিক” যেখানে রুম মাত্র চারটি। তাই প্রতিবার টেকেরঘাটে ভ্রমণসাথী বেশীরভাগ ছেলের দল নৌকায় কাটাই সারা রাত। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ২০১৩ সালেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, এবারো হবে। বৃষ্টি দেখে মেজাজ খারাপ আমার, ঢাকা থেকে আসার আগে ভেবেছিলাম নিম্নচাপ তো দক্ষিণে, এই উত্তরে নিশ্চয়ই তার প্রভাব থাকবে না। কিন্তু কোথায় কি? নৌকা হতে নেমে স্থানীয় মসজিদ যা ঐ ঘাটের একেবারে লাগোয়া, সেখানে চলে গেলাম মাগরিবের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে কি মনে হল, মসজিদ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আট-দশজন মসজিদের লাগোয়া ছাউনি ঘেরা বারান্দায় রাত কাটানোর অনুমতি পেয়ে গেলাম।



বৃষ্টি একটু কমে আসলে নৌকায় ফিরে এসে আবার ছাঁদে উঠে পড়লাম, নাহ মেঘের কমতি নেই আকাশে। আহা আমার জল জোছনায় স্নানের সাধ! কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, রাতের খাবার খাওয়া শেষে যখন সবাই ছাঁদে উঠে এলাম, তার কিছুক্ষণ পর মেঘ সরে গিয়ে মুখ দেখালো পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলোয় পুরো হাওড় যেন এক রহস্যময় অপার্থিব জগতে পরিণত হয়ে গেল। মুগ্ধতার সাথে আমরা সাত আটজনের দল চেয়ে রইলাম সেই ঘোর লাগা সৌন্দর্যের দিকে। গেয়ে উঠলাম, এই জল জোছনায়....



















সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৩৬
৪২টি মন্তব্য ৪২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×