যখনই কোন ভ্রমণ পরিকল্পনা করা হয়; আমাদের লক্ষ্য থাকে যৌক্তিক খরচে ছুটির পুরো সময়টা যথাযথ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ভ্রমণস্পট কাভার করে একটা ট্যুর দেয়ার। আর আমাদের সেইবারের ১৬ দিনের ভারত ভ্রমণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নাই। কলকাতায় এক রাত থেকে বাই এয়ারে কেরালা-কণ্যাকুমারী’তে ৮ দিন, গোয়ায় ৩দিন এবং সবশেষে মুম্বাইতে ২দিন। আসলে মুম্বাই আমাদের এই প্ল্যানিং এ যুক্ত হয় শুধুমাত্র সময় ফ্যাক্টর বিবেচনা রেখে। আমাদের সেবারের ভ্রমণে একজন সরকারী কর্মজীবি থাকায় তার মোট ছুটির ১৬দিনের দিন আমাদের দেশে ফেরত আসাটা ছিল লক্ষ্য। আরে সেই লক্ষ্যেই আমরা টিকেট করেছিলাম এয়ার ইন্ডিয়ার মুম্বাই টু ঢাকা, মাঝে কলকাতায় ট্রানজিট ছিল প্রায় ৯/১০ ঘন্টার। আজকে সেই যাত্রা এবং তার পরের ঘটনাক্রম নিয়েই ১৬ দিনের সেবারের ভারত ভ্রমণের শেষ পোস্ট।
সারাদিন মুম্বাই এর টুরিস্ট বাসে করে মুম্বাই সিটি ডে ট্রিপ শেষে আমরা রাত আটটা নাগাদ আমাদের হোটেল হতে ব্যাগপত্তর নিয়ে রওনা হয়ে যাই মুম্বাই “ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর” এর উদ্দ্যেশ্যে। সেবারের সেই ভারত ভ্রমণ যাত্রার মাস খানেক আগে একদিন ডিসকভারি চ্যানেলে একটি অনুষ্ঠান দেখেছিলাম মুম্বাই এর এই নতুন নির্মিত বিমানবন্দরটিকে নিয়ে। সেই থেকে অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম সেই বিমানবন্দরটি দেখার। আমি ক্ষুদ্র আয়ের হিসাবরক্ষক মানুষ, ফলে আমার ভ্রমণ দৌড় ভারত-নেপাল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের বড়সড় বিমানবন্দরগুলো দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। আর তার কারনেই হয়তো ইচ্ছেটা আরো জোরালো হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল ২০২০ এর মার্চ এপ্রিল এ ভুটান এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এর দিকে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর এ একটা কম্বাইন্ড ট্যুর দেয়ার, করোনা বাবাজী এসে সেই “সাধ-সাধ্যের সমন্বয়” এর উদ্যোগে গুঁড়ে বালি ঢেলে দিয়ে গেছে।
যাই হোক যেখানে ছিলাম, সেই গল্পে ফিরে আসি। আমাদের হোটেলটি ছিল মুম্বাই এর গ্রান্ট রোড এ, সেই হোটেলের পাশেই এক মুসলিম রেস্টুরেন্ট রাতের ডিনার সেরে নিয়ে ট্যাক্সিযোগে চলে গেলাম মুম্বাই বিমানবন্দরে। রাত দশটা নাগাদ আমরা মুম্বাই বিমানবন্দরে; আমাদের ফ্লাইট সকাল ছয়টায়, খোঁজ নিয়ে জানলাম বোর্ডিং পাস দেয়া শুরু হবে রাত সাড়ে তিনটা থেকে। দীর্ঘ সময় কিভাবে কাটাবো তা নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না, কেননা আগে থেকেই প্ল্যান ছিল এই বিমানবন্দরটি ভালমত ঘুরে দেখার। বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করে ওয়েটিং লাউঞ্চে পছন্দমত একটি জায়গা আগে খুঁজে নিয়ে ডেরা ফেললাম আমাদের দলের। আসলেই মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলাম বিমানবন্দরটি দেখে। ভেতর চমৎকার আয়োজন। সারিসারি আসন সাজানো; কিছু দূর দূর বিশাল টিভি চলছে, নির্দিষ্ট ডেস্কে ডেস্কে ছয়টি করে কম্পিউটার, নিজের ইচ্ছে মত ইন্টারনেট ব্যবহার করা গেল; চার্জিং পয়েন্ট এ আমাদের সকল ডিভাইস চার্জে দিয়ে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম যার যার মত করে; বিমানবন্দর এর ভেতরটা দেখার জন্য।
মজার ব্যাপার প্রায় দুইঘন্টা পর আমি আমাদের ডেরায় এসে দেখি; দলের কেউ নেই সেখানে। লাগেজগুলো জায়গামতই আছে; মোবাইল-ক্যামেরা যেভাবে চার্জিং পয়েন্ট এ ছিল সেভাবেই আছে। তখন মনে পড়লো ঢাকা এয়ারপোর্ট এর কথা। যদি এই মালামাল সেখানে এভাবে পড়ে থাকতো… যেখানে চেকইন লাগেজ কেটে জিনিসপত্র হাওয়া হয়ে যায়…
দিল্লির পরে মোট এবং আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিবহনের দিক থেকে এটি দেশের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর, এবং এশিয়ায় ১৪ তম ব্যস্ততম বিমানবন্দর এবং বিশ্বের ২৮ তম ব্যস্ততম বিমানবন্দর ছিল ২০১৭ সালে। ২০১৫ সালে বিমানবন্দরটি ৪৯.৮ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহন করে। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও বিমানবন্দরটি দেশের দ্বিতীয় ব্যস্ততম স্থানে রয়েছে। বিমানবন্দরে মোট ৭৫০ হেক্টর জমিতে (১,৮৫০ একর) বিস্তৃত তিনটি সক্রিয় টার্মিনাল রয়েছে এবং প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক উড়ানের চলাচল পরিচালিত হয়। নতুন করে এই মুম্বাই এয়ারপোর্ট নির্মান ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ এর ব্যাপার। কেননা পুরাতন বিমানবন্দর কার্যক্রম অব্যহত রেখে নতুন টার্মিনাল নির্মান, সমুদ্র তীরবর্তী স্থাপনা, তলদেশ দিয়ে প্রবাহমানতা সহ নানান জটিলতর এবং চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রম এর বিবরণ শুনে এবং এর ভেতরের চমৎকার নান্দনিক এবং শৈল্পিক সজ্জা দেখে সত্যি অভিভূত হতে হয়। সেই গল্পে না গিয়ে দুটি ইউটিউব ভিডিও লিংক শেয়ার করলাম; দেখে নিতে পারেন আগ্রহীরা।
এখন শুরু করা যাক, মূল গল্প তথা আলোচনা। এম্নিতেই মুম্বাই এ বোমা হামলার পর বাংলাদেশী নাগরিকদের সেখানে গমন অনেক ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাই এয়ারপোর্টে প্রবেশ করে যখন ঘুরে দেখতে বের হলাম পুরোটা; কোথা থেকে শুরু করবো; কি কি দেখবো; ছবি তোলা নিয়ে নিরাপত্তাকর্মী’রা কোন ঝামেলা করবে কি না; নানান প্রশ্ন ছিল মনে। কিছুদূর এগুতোই সশস্ত্র এক পাঞ্জাবী নিরাপত্তা রক্ষীকে দেখালাম দাঁড়িয়ে। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পুরো এয়ারপোর্ট কম্পাউন্ডে কোথাও ছবি তোলা নিয়ে বিধিনিষেধ আছে কি না। আমাকে অবাক করে দিয়ে, সে একগাদা কথা বলল। কোথা হতে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি এসব জেনে পুরো এয়ারপোর্ট এর কোনদিক এ কি আছে, সব সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলো। আমি সত্যি অবাক হয়েছিলাম। যাই হোক পুরোটা শুনে উৎফুল্ল মনে ঘুরে বেড়ালাম চারিদিকে। রাত তিনটার পর বোর্ডিং পাস নিতে কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম আগেই দিয়ে দেয়া শুরু করেছে। বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশন করার সময় জানলাম, এক্সিট সিল মুম্বাই হতে দেয়া হবে না, কলকাতায় ইমিগ্রেশন এক্সিট হবে। শুনে ভালো লাগলো; তাহলে কলকাতা গিয়ে সকাল থেকে বিকেল অবধি বসে থাকতে হবে না বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে; ঘুরে বেড়ানো যাবে কলকাতা শহরে; সাথে শপিং করার কিছু বাকী ছিল দলের কয়েকজনের; তারা সেই সুযোগও পেয়ে যাবে।
যাই হোক সকাল ছয়টার ফ্লাইটে রওনা হয়ে সাড়ে নয়টা নাগাদ মুম্বাই থেকে কলকাতা চলে এলাম। লাগেজ সব আগেই চেকইন করা ছিল; দলবেধে এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার আগে ভাবলাম, একটু খোঁজ নিয়ে যাই, আমাদের ঠিক কয়টার সময় বিমানবন্দরে হাজির থাকতে হবে। কেননা, অনেক সময় কলকাতা নিউমার্কেট এলাকা থেকে দমদম এয়ারপোর্ট পৌঁছতে দেড়-দুই ঘন্টারও বেশী সময় লেগে যায়। যেহেতু এক্সিট কম্পাউন্ডে ছিলাম; চারিদিকে খোঁজ করে আশেপাশে এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ইন্ডিগো, স্পাইসজেট সহ অন্য মোট চারটি এয়ারলাইন্সের কাউন্টার দেখে এগিয়ে গেলাম। সব কাউন্টারেরি বাংলা ভাষাভাষী লোক বসে ছিল। তাদের রেসপন্স এটিচিউড লিখে বোঝাতে পারবো না, উত্তর প্রায় একই রকম, “জানি না কোথায়, খুঁজে দেখো”। প্রায় মিনিট দশেক ঘুরে একসময় দেখি এক পাঞ্জাবী আর্মড সিকিউরিটি ফোর্স মেম্বার; গত রাতের কথা মনে করে তার কাছে গেলাম। সে ইশারা করে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ঐখানে গিয়ে বামে কিছু দূর গেলেই এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টার খুঁজে পাবো। যেখানে ঐ চারটি কাউন্টার ছিল, তার বামপাশ দিয়ে যে করিডোর গেছে সেখানে কিছুদূর এগুতোই কাউন্টারটি পেলাম; ভিউ এঙ্গেল একটু বিপরীত এ থাকায় প্রথমে খুঁজে পাই নাই। কিন্তু কথা হল, ঐ কাউন্টারগুলোতে বসা আমাদের বাঙ্গালী ভাইবোনেরা কি জানতো না কাউন্টারটি কোথায়? এতটুকু ভদ্রতা বা সভ্য আচরণ করতে কার্পণ্য কেন রে ভাই?
যাই হোক, সারাদিন ঘোরাঘুরি করে, যথাসময়ে বিমানবন্দর ফিরে এসে ঢাকার বিমানে চেপে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ নামলাম ঢাকায়। লাগেজ বেল্টে এসে সবাই নিজ নিজ লাগেজ খুঁজে পেলেও আমার লাগেজ লাপাত্তা। একে একে দলের সবাই চলে গেলে রাত এগারোটা পর্যন্ত আমি এদিক সেদিক খোঁজ করে অবশেষে এয়ার ইন্ডিয়ার ঢাকা বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্ট এ তদারকি করার অফিসারকে খুঁজে পেলাম। তাকে বললাম আমার সমস্যা, তার কথাবার্তা আর এরোগেন্ট আচরণ আরও ভয়াবহ। আমাকে বলে যে, “তুমি তোমার দলের সাথে তোমার লাগেজ দিয়ে দিয়েছো; এখন আসছো মিথ্যা অভিযোগ করতে…” সিরিয়াসলি ম্যান? রাগে মন চাচ্ছিল কষে একটা চড় দিতে। আমার এই হেনস্থা অনেকক্ষণ ধরে এক পরিচ্ছন্নতা কর্মী দেখছিলো। অবশেষে সে আমার পাশে এসে চাপা স্বরে বলল, আপনি লস্ট এন্ড ফাউন্ড কাউন্টারে গিয়ে যোগাযোগ করুন। সেখানে যাওয়ার পর তারা সেই এয়ারলাইন্স এর তদারকি অফিসারকে ডেকে আমার লাগেজ মিসিং কমপ্লেইন ইস্যু করিয়ে দিল। আমি রাত একটার পর ফিরলাম বাসায়। পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্স এর ভারতীয় অফিস হতে ফোন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো আমার লাগেজ মিসিং এর জন্য। মুম্বাই এয়ারপোর্ট এ এয়ারলাইন্স অফিসার ভুলক্রমে আমার লাগেজ এ ডেস্টিনেশন এয়ারপোর্ট ঢাকার বদলে কলকাতা'র স্টিকার লাগিয়ে দেয়ায়, আমার লাগেজটি কলকাতায় থেকে যায়। সে জানালো আজ রাতের ফ্লাইটে তারা লাগেজটি ঢাকায় পাঠিয়ে দিবে। এরপর রাত নয়টা নাগাদ আবার ফোন করে জানালো, ঢাকায় পৌঁছে গেছে লাগেজটি। আমি যেন কালেক্ট করে নেই। আমি জানালাম, আজ নয়, আমি আগামীকাল সুবিধামত সময়ে লাগেজটি নিয়ে নিবো। আমাকে অবাক করে দিয়ে পরের দিন রাতে আবার ফোন দিয়ে তারা কনফার্ম হল আমি আমার লাগেজটি বুঝে পেয়েছি কি না।
এখানে মুখ্য বিষয় যা চোখে পড়েছে; আমরা বাঙ্গালী স্বভাবই কি এমন। ঢাকা বিমানবন্দরে বাংলাদেশী যে ছেলে এয়ার ইন্ডিয়া হতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিল লাগেজ বেল্টে কোন লাগেজ থেকে গেলে বা কারো লাগেজ না আসলে সেই অভিযোগ লিখিত নেয়ার; সে কেন এবং কিভাবে এত বাজে ব্যবহার করে। কলকাতা এয়ারপোর্ট এর সেই কাউন্টারগুলোতে থাকা বাঙ্গালী ছেলেমেয়েগুলো “কোথায় এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টার” একটু কষ্ট করে বলে দিলে কি ক্ষতি হতো? আমি সত্যি জানি না। এই বাঙ্গালী আচরণ এর হেনস্থা হতে বাঁচার জন্য আমি বাই রোড এ ভারতে যাই না। সত্যি বলতে, ভারত ভ্রমণের সময় আমি কলকাতার গণ্ডী পেরিয়া গেলে মনে মনে খুব স্বস্তি ফিল করি। ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত বাঙ্গালী অফিসারগুলোর আচরণ খুব মর্মাহত করে। তা স্থল বা বিমান যে পথেই হোক না কেন।
যাই হোক সুন্দর একটি দীর্ঘ ভ্রমণের সমাপ্তিটা খুব জঘন্যভাবে হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে আমাকে আরও সতর্ক এবং ঘটনা পরম্পরা হজম করতে শিখিয়েছিলো। যাই হোক তিক্ত অভিজ্ঞতার বকবকানি শেষে আসুন আমার তোলা মুম্বাই এয়ারপোর্ট এর কিছু ছবি দেখে শেষ করা যাকঃ
ভারত ভ্রমণের গল্প সকলঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা