somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুম মনেস্ট্রি হয়ে রক গার্ডেন (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৬)

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্বঃ কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা টাইগার হিল হতে বাতাসিয়া লুপ (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৫)

টাইগার হিল হতে আমরা যখন রওনা হলাম বাতাসিয়া লুপ তখনো আকাশে কুয়াশা আর মেঘেদের বেশ রাজত্ব থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে কিছুটা কমা শুরু হলো তাদের দৌড়াত্ম। বাতাসিয়া লুপ থেকে যখন ঘুম মনেস্ট্রি রওনা হলাম তখন আকাশ বেশ কিছুটা পরিস্কার হলে পাহাড়ি পথে ধরে যাত্রাটা উপভোগ্য ছিলো। পাহাড়ের ঢালে ঢালে মাঝে মাঝেই দেখা পাচ্ছিলাম চা-বাগান এর। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত ঘুম ছোট্ট একটি পার্বত্য শহর। পাহাড়ের ভাঁজে দাঁড়িয়ে থাকা এই পাহাড়ি জনপদটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ টয়ট্রেন এর ষ্টেশন এর জন্য ভুবনখ্যাত। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত টয়ট্রেন এর রেল স্টেশন ঘুম, ভারতের সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত রেলস্টেশন। ভারতের নানান চলচ্চিত্র এবং ডকুমেন্টারি চিত্রায়িত হয়েছে এই ঘুম শহরেই। আমাদের সেবারের ট্যুরের পরের গন্তব্য ছিলো ঘুম মনেস্ট্রি।







ঘুম মনেস্ট্রি স্থানীয়দের কাছে ইগা চেওলিং মঠ বলে পরিচিতো। তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের একটি অন্যতম শাখা হলো ‘গেলুগ’; আর এই গেলুগ শাখার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের ধর্মীয় একটি পবিত্র স্থান হলো এই ঘুম মনেস্ট্রি। ১৮৫০ সালের দিকে মঙ্গোলিয়ান জ্যোতিষ এবং ধর্মীয় নেতা লামা শেরাব গ্যাতসো এই মঠের গোড়াপত্তন করেন এবং ১৯০৫ সাল পর্যন্ত এই মনেস্ট্রির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উনার দেহাবসানের পর লামা দোমো গেসে রিনপোচে ১৯০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তা পালন করেন। ১৯৫৯ সালে যখন চীন তিব্বত আক্রমন করে তখন বহু তিব্বতীয় ভারতে এসে এখানে রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় নেয়। ঘুম শহরে বর্তমানে তিনটি মঠ রয়েছে যার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত। এখানে ১০৮ খন্ডের তিব্বতীয় বৌদ্ধ শাস্ত্র ‘কাংগ্যুর’ নামক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলোর অন্যতম গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে। এখানে প্রার্থনায় রীতিনীতি তিব্বতীয় প্রথা পরিলক্ষিত হয়, এখানকার ধর্মীয় গুরুগণ তিব্বতীয় প্রথায় এখনো প্রার্থনা পতাকা উড়িয়ে থাকেন।









ঘুম মনেস্ট্রির ভেতরে ঢুঁকে সবাই দেখে এলে এর চত্বরে দাঁড়িয়ে চললো কিছু ছবি তোলার পালা। এখান থেকে পাহাড়ি ঢালে মেঘেদের দলের ছোটাছুটি দেখাটা ছিলো দারুন উপভোগ্য। এরপর এখান থেকে আমরা রওনা দিলাম রক গার্ডেন। ইতোমধ্যে পেটে ছুঁচো ডাকছে সবার, তাই রক গার্ডেন পৌঁছে সেখানে থাকা একটা ছাউনি দেয়া দোকানে আমরা গরম গরম মোমো খেয়ে নিলাম, কেউ কেউ ম্যাগি নুডুলস; সাথে নিলাম চা-কফি; আপাতত উদরখানা কিছুটা শান্ত থাকুক। এই ফাঁকে আমরা ঘুরে দেখি রক গার্ডেন।



১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা সিকিমের রাজা হতে দার্জিলিং অধিগ্রহণ করার পর থেকে এই অঞ্চলে তারা নগর পত্তন করে এবং এখানকার পর্যটন দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। চা-বাগানকে কেন্দ্র করে এখানে ধীরে ধীরে জনবসতি বাড়তে থাকে। গত শতকের আশির দশকে স্বাধীন ভারতে দার্জিলিং এর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠে এবং ১৯৮৮ সালের দিকে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ (ডিজিএএইচসি) প্রতিষ্ঠীত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসে। সেই দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ এর পর্যটন বিভাগ নির্মান করে এই রক গার্ডেন। দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ঘুম স্টেশনের পূর্বে ডানদিকে মোড় নিয়ে এই রক গার্ডেনের অবস্থান। এটি মূলত একটি পাহাড়ি প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পিকনিক স্পট। পাহাড়ের গা বেয়ে যে পথে জলধারা নেমে এসেছে সেখানে অনেক পাথুরে পথের চারিধারা বাগান এবং বসার জায়গা, ছোট্ট সেতু জুড়ে দিয়ে ঝর্ণার দুপাশে যাতায়াতের রাস্তা এবং কিছু কৃত্রিম সজ্জা এই জায়গাটিকে দিয়েছে অন্যরকম একটা ইমেজ যা খুব সহজেই এখানে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এই রক গার্ডেন হতে তিন কিলোমিটার দূরেই রয়েছে গঙ্গামায়া পার্ক, যদিও আমাদের সেবারের ভ্রমণ তালিকায় তা ছিলো না।











টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকতেই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তখনও চলা মেঘেদের টুকরোর ছুটে চলা আর তার মাঝে সবুজের বুক বেয়ে পাথুরে পথে নেমে আসা ঝর্ণার রূপে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। একেবারে ঝর্ণার পাদদেশে কৃত্রিম বিশাল এক পদ্মফুল এবং তাকে ঘিরে গোলাকারের চত্বর মত জায়গায় বেশ কিছু বসার জন্য ধাতব বেঞ্চ রাখা আছে। সেখানে থেকে দুপাশ দিয়ে ঝর্ণার চলার পথ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে; পর্যটকের দল সেই পথে উঠে চলেছে। আমি গিয়ে বেঞ্চিতে বসে পড়লাম, ঝর্ণার কলকল ধ্বনি এই নিশ্চুপ পাহাড়ি উপত্যকার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে অদ্ভুত এক সুরেলা ঝংকার তৈরী করে চলেছে; অনেকটা সময় বসে রইলাম একাকী, দলের সবাই তখন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে আমরা রওনা দিলাম হোটেল অভিমুখে। সকালের নাস্তার পর্ব হোটেলে সেরে নিয়ে বের হয়ে যাবো দিনব্যাপী দার্জিলিং ট্যুর এর বাকী অধ্যায় সমাপ্ত করার জন্য। আসুন দেখি রক গার্ডেন এর কিছু ছবিঃ





















ভ্রমণকালঃ জুলাই ২০১৬

এই ভ্রমণ সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
উদ্ভট যাত্রার আগের গল্প (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০১)
যাত্রা হল শুরু; রক্ষে করো গুরু (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০২)
দার্জিলিং মেইল এর যাত্রা শেষে মিরিকের পথে (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৩)
মিরিকের জলে কায়ার ছায়া (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৪)
কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা টাইগার হিল হতে বাতাসিয়া লুপ (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৫)

এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×