লাল কাঁকড়ার খোঁজে
বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ আমরা তিনজন চলে এলাম কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। সকালবেলা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে এর বামপাশ ধরে হেঁটেছিলাম; এবার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ডান পাশ ধরে হাঁটা শুরু করতেই কুয়াকাটার আলোচিত সমালোচিত মোটর সাইকেল চালক ভাইদের উৎপাত শুরু হয়ে গেল। বিকেলে প্যাকেজ অফার করতে লাগলো; ৪০০-৫০০ টাকায় বেশ কয়েকটি স্পট দেখাবে যার মধ্যে রয়েছে তিন নদীর মোহনায় সূর্যাস্ত, লেম্বুর বন, ঝাউ বন, লাল কাঁকড়া ইত্যাদি। আমার সাথের দুইজন মোটর সাইকেলের প্রতি কোন আগ্রহ না দেখিয়ে হাঁটতে লাগলে আমিও তাদের অনুসরণ করছিলাম।
প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর আমি সৈকত পারে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান দেখে এগিয়ে গেলাম; সেখানে বসা এক ষাটোর্ধ্ব বয়সের লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এখান হতে হেঁটে হেঁটে লাল কাঁকড়ার আবাস পর্যন্ত পৌঁছতেই সন্ধ্যা পেড়িয়ে যাবে, তিন নদীর মোহনায় সূর্যাস্ত বহু পরের কথা। আমি আমার সঙ্গী দুজন হতে বিদায় নিয়ে ইতিউতি এখন খোঁজ করতে লাগলাম মোটর সাইকেল এর। সাঁই সাঁই করে আরোহী নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল মোটর সাইকেল একের পর এক; যার সবগুলো সৈকত এলাকা থেকে রওনা হয়েছে।
আমরা প্রায় আধঘন্টার বেশী হেঁটে এগিয়ে এসেছি প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। কিছুক্ষণ পর একটা ফাঁকা মোটর সাইকেল আসতে দেখলাম সৈকত এর পথ ধরে। ইশারায় তাকে থামিয়ে দরদাম করে ৩৫০ টাকা চুক্তিতে উঠে বসলাম; হাতে সময় কম থাকায় তিন নদীর মোহনায় সূর্যাস্ত দেখাটা বাদ দিলাম। কুয়াকাটার মোটর সাইকেল ভাড়া প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলবো কুয়াকাটা ভ্রমণে এটা জরুরী। কেননা দুই দিকে সৈকতে ধরে প্রায় বিশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পর্যটন স্পটগুলো। তাই সহজে এইসব ভ্রমণে মোটর সাইকেল এর আপাতত কোন বিকল্প নেই; থুক্কু আছে, বিদ্যুৎ চালিত অটোরিকশা; যা আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে সৈকতের নানান এবড়োথেবড়ো পথে যাত্রা করে।
ও হ্যাঁ, একটি মোটর সাইকেলে দুইজন ভ্রমণ করতে পারবেন যদি স্থান সংকুলান হয়। আর আমার মত তিনমাত্রার ওজনধারীদের জন্য একজনই যথেষ্ট। ভাড়া সকালের প্রায় আটটি স্পট এর জন্য ৮০০ টাকা সর্বোচ্চ; দরদাম করে নিতে হবে। বিকেলের চারটি স্পট ভ্রমণে ৪০০ টাকা। এমনিতে মোটর সাইকেল চালকেরা বেশী চাইবে। সবচেয়ে ভালো হয় পরিচিত কোন সোর্স বা যে হোটেলে থাকবেন তাদের পরিচিত কোন চালককে ভাড়া করলে। তবে টাকাটা দরদাম করে ঠিক করে নিবেন। আমি যাত্রা করলাম আমার এদিনের বৈকালিক ভ্রমণে।
প্রথম গন্তব্য ছিল শুঁটকি পল্লী। কুয়াকাটা যদিও শুঁটকি’র জন্য বিখ্যাত নয়; তারপরও একদিকে সুন্দরবন এর লাগোয়া এবং অপরদিকে সৈকত এলাকা; তাই কক্সবাজার এবং সুন্দরবনের শুঁটকির কারনে এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের চাহিদার কারনে কুয়াকাটার সৈকত এলাকায়ও ছোট্ট পরিসরে গড়ে উঠেছে শুঁটকি পল্লী। সারি সারি শুঁটকি সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। কুয়াকাটার শুটকি’র বৈশিষ্ট্য হল এগুলোতে কোন কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না। প্রাকৃতিকভাবে সৈকতের রোদে শুকিয়ে সরাসরি বাজারজাত করা হয়; ফলে এখানকার শুটকি’র স্বাদে রয়েছে ভিন্নতা।
প্রায় শখানেক পরিবার প্রতি মৌসুমে শুটকি ব্যবসার সাথে জড়ায়; এখানকার সৈকতের পশ্চিম দিককার মাঝিবাড়ি, খাজুরা ছাড়াও খালগোড়া, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর ধুলাসারে রয়েছে শুটকি পল্লী। প্রতিটি পল্লী এলাকায় কার্তিক মাস থেকে শুরু করে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত শুটকি প্রক্রিয়াজাত করা হয়। মৌসুম নির্ভর এই শুটকির দিন দিন চাহিদা বাড়ছে পর্যটকদের নিকট। সাধারণত লইট্টা, ফাহা, ফালিসা, চাবল, কোরাল, হাঙ্গর, ছুরি, পোমা, চান্দাকাটা, চিংড়ি, লাক্ষ্মা, নোনা ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুটকি করা হয় কুয়াকাটা ও তার আশপাশের চরগুলোতে। আমি মোটর সাইকেল হতে নেমে একাকী ঘুরে দেখলাম, কিছু ছবি তুলে ফের উঠে বসলাম মোটর সাইকেল এ। এবারের গন্তব্য লেম্বুর বন।
লেম্বুর আর্তনাদ
শুটকি পল্লী হতে এগিয়ে গেলাম লেম্বুর বন এর দিকে। ঢাকা হতে যাওয়ার আগে তথ্য ঘাটাঘাটি করে কয়েকটি স্পট চিহ্নিত করে নিয়েছিলাম যার মধ্যে ছিল ফাতরার বন, গঙ্গামতির চর, লেম্বুর বন আর লাল কাঁকড়ার চর; অবশ্যই দেখবো বলে। এই লেম্বুর বন অনেকেই লেম্বুর চর আবার কেউ কেউ শুদ্ধ বাংলায় বলে লেবুর চর। আসলে এই লেম্বু খাবার লেবু নয়। লেম্বু এক রাখাইন কিশোরী, যে এই এলাকার বনে নিখোঁজ হয় এবং পরবর্তীতে তার মরদেহ পাওয়া যায়; অনেকে বলে সেই কিশোরী’র আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। আর সেই কিশোরীর নিখোঁজ হওয়ার পর শুরু হয় নানান গল্পকথা; প্রায় সময়ই নাকি সেই কিশোরীর আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায় এই বনে। আর এই রূপকথার পথ ধরে এই বনের নাম হয়েছে লেম্বুর বন।
১০০০ একর আয়তনের লেবুর চরে আছে কেওড়া, গেওয়া, গোরান, কড়ই, গোলপাতা হহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি। এক সময় এই লেম্বুর চর এলাকাটি সুন্দরবন এর অংশ ছিল; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা ফাতরার বন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে কুয়াকাটার ভূখণ্ডের সাথে মিশে গেছে। এই বনের এক পাশে বর্তমানে রয়েছে বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছ এবং অন্যান্য খাবারের দোকান। প্রতিদিন বিকেলে এখানে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটে; এখান হতে সামুদ্রিক খাবারের স্বাদ নিতে নিতে সূর্যাস্ত দেখে অনেকেই সন্ধ্যের মায়াময় সময়টুকু কাটিয়ে দেন। আমরা এই লেম্বুর বনে না থেমে সোজা চলে গেলাম লেম্বুর বন এবং ঝাউবন পাড়ি দিয়ে আরও অনেকটা পথ…
লাল কাঁকড়ার আস্তানায়
ফাতরার বনের বিপরীত পাশে ঝাউবনের শেষ অংশে গিয়ে দেখি বিপুল পরিমাণ পর্যটক এবং সেই সাথে সারি সারি, মোটর সাইকেল এবং তার সাথে কিছু ব্যাটারী চালিত রিকশা আর কিছু প্রাইভেট গাড়ী। টানা বাশের খুঁটি দিয়ে একটা সামনের পথ অবরোধ করে রাখা হয়েছে; আর সেখানে সকল পর্যটক দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে; সেই ব্যারিকেড এর অপর পাশে শয়ে শয়ে লাল কাঁকড়ায় জায়গাটা গিজগিজ করছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে পর্যটক এর দল, তুলছে ছবি।
আমি আমার আল্ট্রা জুম পাওয়ার শট ক্যামেরা নিয়ে বসে গেলাম ছবি তুলতে, চেষ্টা করলাম কিছু ভিডিও নেয়ার। ২০১৪ সালে টেকনাফ হতে কক্সবাজার হাঁটা ইভেন্ট যা আয়োজিত হয় ভ্রমণ বাংলাদেশ'এর ব্যানারে; শিলখালী থেকে ইনানী সৈকতে অংশে এরকম হাজারো লাল কাঁকড়ায় ছেয়ে থাকা সৈকত দেখেছিলাম। তা নিয়ে একটা পোস্ট রয়েছে, লাল কাঁকড়ার দেশে নামে, আগ্রহীরা ঢুঁ মারতে পারেন। আর এবারের করা ভিডিওটি দেখতে পারেন এই লিংকে গিয়েঃ
চল ফিরে ডেরায়…
লাল কাঁকড়ার দর্শন শেষে প্রফুল্ল চিত্তে এবার ফিরতি পথে থামলাম প্রথমে ঝাউবন এর কাছে। একপাশে ঝাউবন এবং তদসংলগ্ন সৈকত, মাঝে ক্যানেল আর অন্য পাশে ফাতরার বন; সম্মুখ পানে অবারিত জলরাশি আর তার বুকে ধীরে ধীরে লালিমা মাখিয়ে সূর্য হারানোর পায়তারা করছে। এখানে কিছু ছবি তুলে এগিয়ে গেলাম লেম্বুর বন এর দিকে। সেখানে সূর্যাস্ত দেখে ফিরে এলাম কুয়াকাটার মূল সৈকত এলাকায়। হোটেলের গেটে মোটর সাইকেল ছেড়ে দিলাম; ছেলেটির ব্যবহার ভাল ছিল, সে কিছু বকশিস চাইলে তাকে চারশত টাকাই দিয়ে দিলাম।
রুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে মনা’কে ফোন দিলাম। ওরা সৈকতের কাছে থাকা দোকানগুলোর মাঝে একটি দোকানে দুধ চা পেয়েছে, সেখানে আছে। আমিও গেলাম সেখানে; হালকা চা-নাস্তা করে সৈকত এর ডান পাশ ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম রাতের বলা সেখানে বসেছে সামুদ্রিক মাছের বাজার। পছন্দ মত মাছ কিনে অর্ডার করলে সাথে সাথে ডিপ ফ্রাই করে দিচ্ছে। জনে জনারণ্য সে জায়গায় বেশীক্ষণ না থেকে হোটেলে ফিরে এলাম।
এরপর রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ হোটেলের বিপরীতে থাকা অন্য আরেকটা খাবারের দোকানে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে ঘুরে দেখলাম অনেকটা সময় কুয়াকাটা সৈকত এলাকার জনপদ। পূর্বপ্রান্তের একটা মিষ্টির দোকানে আমার অন্য দুই সাথী মিষ্টি খেল, শেষে ফের আরেক কাপ চা পাণ করে ফিরে এলাম হোটেলে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মনা আর তার কলিগ আগামীকাল ফজরের পরপর প্রথম বাসে করে কুয়াকাটা হতে রওনা হয়ে যাবে বরিশাল হয়ে পিরোজপুর এর দিকে। আমার পরিকল্পনা, আরামে ঘুমিয়ে বেলা করে উঠবো, নাস্তা করে আশেপাশে বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরি করে বেলা সাড়ে এগারোটার বিআরটিসি বাসে করে কুয়াকাটা হতে বরিশাল, এরপর সেখান হতে মাইক্রোবাস সার্ভিস এ কেওড়াকান্দা হয়ে স্পীড বোট এ নদী পারাপার হয়ে মাওয়া থেকে সোজা গুলিস্তান হয়ে নিজের বাসায়। এই প্ল্যান রেখেই ঘুমাতে গেলাম, কিন্তু পরদিন আমার প্ল্যান গেল পুরো পাল্টে…
ভ্রমণকালঃ ডিসেম্বর, ২০২১
আগের পর্বঃ
অবশেষে কুয়াকাটা (কুয়াকাটা ভ্রমণ - প্রথমাংশ)