মেয়েটা আমাদের বাসার গৃহকর্মী ছিল।হালকা গড়নের গোছানো মানুষ টুনটুনি।বয়স জিজ্ঞেস করলে মুখটা ভারী করে বলতো “ কতো আর অইবো , এই বিশ-বাইশ।” তাঁর চেহারা দেখে বয়স ওরকমই মনে হলেও আচরণ কখনোই বিশ বাইশ বয়সী ছিল না, অনেক পরে জেনেছিলাম তাঁর বয়স প্রায় তিরিশ। আমার কর্মজীবি স্ত্রী তাঁর সংসার ও সন্তানের পুরোটা দ্বায়িত্ব দিয়ে রেখেছিল টুনটুনির উপর।পড়ালেখায় ব-কলম টুনটুনি দায়িত্বে অবহেলা করতো না।কম কথা বলতো এবং সচারাচর হাসতো না।
পড়ালেখা না জানায় তাঁর মধ্যে সচেতনতার অভাব ছিল যা মাঝে মাঝে আমাদের ছোটখাটো ঝামেলায় ফেলে দিতো। কিন্তু তাঁর আনুগত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতার কথা চিন্তা করে আমরা তাঁর প্রতি বিরক্ত হতাম না।তাঁর মধ্যে একটা মহৎ গুণ ছিল সরলতা।সে যাই গোলমাল পাকাতো , অকপটে স্বীকার করে নিতো।যে বুঝেই না তাঁর ভুলটা কোথায় , তাঁকে ভুলের জন্য দায়ী করা যায় না বরং ভুলটা ধরিয়ে দিয়েই শান্ত থাকতে হয়।
টুনটুনি কাজে জয়েন করার মাসখানেকের মাথায় বউ আমার কাছে সুপারিশ নিয়ে আসলো। “দেখো মেয়েটা খুব গরিব আর কাজ কামেও ভালো। ওর বেতনটা একটু বাড়ায়ে দাও।” আমিও রাজি হয়ে গেলাম।ভেবে দেখলাম মেয়েটার সার্ভিসের তুলনায় আমরা খুব সামান্যই দেই।বাজার দরের কথা চিন্তা করলেও ওকে আরো অন্তত হাজার দুয়েক টাকা বেশি দিতে হয়।তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে নয় মাসে তিন বার তাঁর বেতন বাড়ানোর জন্য বউয়ের সুপারিশ মেনে নিয়েছিলাম।
ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন টুনটুনি আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। “স্যার, এইটাই কি ভিসা?”।আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি টুনটুনির ভিসার ফটোকপি। টুনটুনি সৌদি আরব যাবে।গৃহকর্মী হিসেবে।বিষয়টা আমাদেরকে অনেক গুলো সংকটে ফেলে দিলো।নতুন কাজের মানুষ কাম ছেলের দেখাশোনা করার মানুষ কোথায় পাবো? বউ খানিকটা ক্ষেপে গেছে।এদিক ওদিক হাটছে আর গজ গজ করছে “নয় মাসে তিন বার বেতন বাড়ায়ে দিলাম। আমরা যা খাই তাই খাওয়াই, আমার বেবি হওয়ার আগের সবগুলো জামা কাপড় ওকে দিলাম। নতুন দুইটা ড্রেস কিনে দিলাম তোমাকে না জানায়ে তাও মেয়েটা চলে যাবে? সৌদিতে কতো বেতন দিবে ওকে? ............
টুনটুনির সাথে এর আগে আমার কখনো আলাপ হয় নি।তাই ওকে তেমন জানি না। টাকার লোভে মেয়েটা একা একা সৌদি চলে যাবে?মেয়েটা কি এমনই লোভী? ওর সাথে কথা বলা দরকার।আমার সামনে কথা বলতে সংকোচবোধ করতে পারে তাই বউকে দিয়ে রহস্য উৎঘাটনের চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। বউ এসে রিপোর্ট দিলো “মেয়েটা লোভী, ও যেসব কথা বলতেছে একটাও যৌক্তিক না।ও সৌদিতে বিশ হাজার টাকা বেতন পাবে, আমরা তো এর অর্ধেকও দিতে পারি না। তাই চলে যাবে।”
শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি তাঁকে ডেকে পাঠালাম।আমার সামনে এসে টুনটুনির চেহারা পালটে গেলো।আমি তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলা শুরু করলো। শান্ত গলায়, ধীরে ধীরে তাঁর ভারী শব্দ ও নিঃশ্বাস আমাকে বিচলিত করে তোলছিল। আমি শুধু তাঁর কথা শোনে যাচ্ছিলাম। স্বান্তনা দেওয়ার ভাষাও আমার ছিল না।
স্যার আমার দাদী একটা কথা খেয়ালি কইরা কইতো। আমি অভাগী, আমার জন্মের সময় দেশে বড় বন্যা হইছিলো।কইতো তুই দুনিয়াত আইছস বন্যা লইয়া, তর জীবন কানতে কানতে যাইবো।কথাডা আমার জীবনে সত্যি হইয়া গেলো।চার বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে আমি মাঝারো। বন্যায় ঘর বাড়ি সব নদীতে নিছে।তখন আমরা দুই বইন আর দাদীরে নিয়া বাবায় বরিশালের উজিরপুর ছাইড়া এইখানে চইলা আইছে।এইখানেই আমরা বড় হইছি। অভাবের সংসারে বাবায় আমাগোরে পড়ালেখা করাইতে পারে নাই। সারাজীবন রিক্সা চালায়ে আমাগোরে মানুষ করছে, বিয়া শাদী দিছে।কিন্তু কপালে সুখ না থাকলে কি হইবো। আমার বিয়া হইছে আজকে সাত বছর হয়।একটা পুরুষ মানুষ কেমন আমরা মাইয়ারা সেইটা দুরেত্তেই বুঝবার পারি। আমার মানুষটা ভালো ছিলো না। হের লোভ ছিল বেশি। বনি বনা হয় নাই।তিন মাসের মাথায় আমি বাপের বাড়ি চলে আসি।হেয়ও আমারে আর নিতে আসে নাই। বাপের বাড়ি আসার দুই দিন বাদে জানলাম আমি পোয়াতি।আপনার ছেলের মতো লাল টুকটুকে একটা বাবু হইছিল আমার। নাম রাখছিলাম ইলিয়াস কাঞ্চন।আমার নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন হাঁটা শিখতে শিখতেই গেলো গা।আমার কোলের থাইকা জানটা গেছে। ঠাণ্ডা লাগছিল, শ্বাস টান নিয়া জন্মাইছিল আমার পোলাডা।আমি পাগলের মতো দুই বছর পোলাডার লাইগা কানছি। বইনেরা সবাই বিয়া শাদি কইরা জামাই বাড়ি। ভাইডা ছোট। বুড়া বাপের উপরে বইয়া খামু কয়দিন।শুরু করলাম মাইনষের বাড়িতে কাম করা।ভালোই চলতেছিল, মায় বাপে বিয়ার কথা কতো কইছে, আমি রাজি না।পুরুষ মানুষ আমার সহ্য হয় না।এই বাসায় কাম নেওয়ার মাসখানেক আগে বাজানো গেলো গা। ঘুম থুনে উইঠা দেখি বাপের গতর ঠাণ্ডা। বাপ চলে যাওয়ার পর আমি দুনিয়াডারে আবার নতুন কইরা চিনলাম।ভাইডা থাকে কামে কাইজে বাইরে।আশেপাশের বুড়া জোয়ান ব্যবাক পুরুষ মানুষের নজর খালি আমার দিকে।কিন্তু বিয়ার কথা কইলে লুইর পারে।এখন এই জ্বালা আরো বেশি।ম্যাডাম অফিস থাইকা ফিরতে দেরি করলে আমি গোসা করি কেন জানেন? খেতের মধ্যে দিয়া হাইটা বাড়িতে যাইতে হয়। সাপ না, ভূত না, আমার পুরুষ মানুষে ডর লাগে।সন্ধ্যা হইলে এই রাস্তায় গ্রামের ব্যাবাক পুরুষের মজমা বসে।গায়ে গতরে হাত দিবার চেষ্টা করছে দুই একবার। আল্লাহ্ আমার ইজ্জত বাচাইয়া রাখছে।আমার দুলাভাইয়ের বন্ধু সৌদি থাকে, হেয় আমারে এই ভিসা কইরা দিছে। আপনাদের বাসায় আমি যা কামাইছি সব দিয়া এই ভিসা পাইছি। আমি এই দেশ ছাইড়া চইলা যামু।আমারে যেখানে কেউ চিনে না, জানে না, জানবার চেষ্টাও করবো না, আন্ধার হইলে কেউ শরীরে হাত দিবার চাইবো না। আপনেরা আমারে আটকাইয়েন না। আমি জাইগা। আপনেগো কথা আমার মনে থাকবে। আপনেরা দুইজনেই খুব ভালো মানুষ স্যার। ম্যাডাম একটু অবুঝ আছে। আপনে হেরে বুঝাইয়া রাইখেন। আপনের ছেলেডাও মাশাল্লাহ রাজার মতো হইছে।যাই স্যার। সন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে।
টুনটুনি আমার সামন থেকে কখন চলে গেছে বুঝলাম না। বউয়ের গলা শোনে নিজেকে ফিরে পেলাম।“আচ্ছা বলতো, লেখা পড়া জানে না, বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষা জানে না,ঠিকমতো মোবাইলটা চালাতে জানে না, এই মেয়ে সৌদিতে যেয়ে একা একা কীভাবে চলবে?” বউকে একটা ভাবুক মার্কা উত্তর দিলাম। “জীবন মানুষকে সব কিছু শিখিয়ে নেয়।”
পরদিন আবার টুনটূনির সাথে আমার অনেকক্ষণ এই বিষয় নিয়ে কথা হয়।কিন্তু আমি বেশি জোড় দিয়ে তাঁকে না বলতে পারি না।টুনটূনিকে বিদেশ যেতে বারণ করার পেছনে আমার স্বার্থ জড়িত আছে।এই বিষয়টা ভিসার দালাল টুনটুনির মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
সৌদিতে বাঙ্গালী গৃহকর্মীদের কি হাল হয়? তাঁরা কেমন দিনাতিপাত করে এই বিষয়ে একদিন আমি টুনটূনিকে বলতে গেলাম, কিন্তু তাঁতে হিতে বিপরীত হয়ে গেলো।অনেকটা কঠিন গলায় টুনটুনি আমাকে বলে বসলো-
“স্যার, আপনে কি ভাবতেছেন আপনারা যা বেতন দেন তাঁতে আমি সন্তুষ্ট না? এই টাকায় আমার সুন্দর চলে যায় স্যার।আর এই টাকা বেতন দিলে আপনারো কাজের মানুষের অভাব হবে না।আমার মতো আপনের সংসার কেউ আপন কইরা নিবো না। কিন্তু ভালোই চলবো। আপনি আমারে যাইতে দিবেন না বইলা নবীর দেশ, রাসুলের দেশ, সৌদি আরবের নামে খারাপ কথা কইতেছেন। আল্লাহ্, রসূলের দেশ নিয়া খারপ কইয়েন না, গুনা হইবো।”
এইবার আমি বুঝে গেলাম।আর যুক্তি বুদ্ধি খাটবে না।জ্ঞান দিয়ে, বুঝিয়ে অন্ধকেও আলোর পথ দেখানো যায়, কিন্তু চোখ বুঝে থাকা মানুষকে আলো দেখানো যায় না।
টুনটুনি চলে গেল। আমরাও নতুন কাজের মানুষ পেয়ে গেলাম।প্রায় দেড় বছর হয়ে গেলো নতুন কাজের মানুষটা দিব্যি সংসার চালিয়ে নিচ্ছে।বউয়ের সাথে টুনটুনি বিষয়ে কখনো কথা উঠলেই বউ ক্ষেপে যায় “ বেইমান একটা, এতো ভালোবাসা দিলাম তবু টাকার লোভে চলে গেলো।”
গত দু-তিন দিন আগের ঘটনা।সন্ধ্যার দিকে বাজার করছি এমন সময় বউ ফোন দিয়ে বললো “টুনটূনি ফোন দিয়েছিল, সৌদি থেকে।তোমার সাথে কথা বলতে চায়।বললো আর্জেন্ট। তোমার নাম্বার দিয়ে দিছি।কিন্তু বুঝলাম না তোমার সাথে ওর আর্জেন্ট কি কথা আছে?”
আচ্ছা, আগে কথা হোক, বাসায় এসে সব বলবো। বউয়ের ফোন কাটার আগেই বিদেশি নাম্বারের কল ওয়েটিং দেখলাম।ফোন ধরে হেলো বলতেই ওইপাশে কান্নার শব্দ।ভরা বাজারে তেমন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। ফোন কানে ধরেই একটু খোলা জায়গায় গেলাম।
টুনটুনি কান্না করো না। আগে বলো তুমি কেমন আছো ?
স্যার আমি আপনার কথা না শোনে ভুল করছি।দেশে সন্ধ্যা অইলে ডর করতো, এইখানে দিনে রাইতে সব সময় ডর করে, স্যার। এইখানে মানুষ নাই,এই দেশে আল্লাহ্ রাসূল কেউই নাই।
লাইনটা কেটে গেলো কি না বুঝতে পারলাম না। মনে হয় কেটেই দিছে।এক হাতে বাজার নিয়ে অনেক ক্ষণ খালি মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর কল আসে নি।অনেকক্ষণ ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম “আল্লাহ্ তুমি টুনিটুনিরে বাচায়ে রাইখো”।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৫০