হেসে খেলে-প্রথম পর্ব
মামুন খান
কাশেম আলী আমার বাল্য বন্ধু। অনেক দিন আগে, সেই ছোট বেলার কথা, আমাদের মফস্বঃল শহরে অগ্রনী ব্যাংকের একটা শাখা খোলা হল। কাশেমের বাবা এলেন সেই ব্যাংকের ম্যানেজার হয়ে। বলতে গেলে আমাদের গ্রাম তুল্য শহরে আগমনের প্রথম দিন থেকেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব। কাশেমের শহুরে পোশাক, আদপ-লেহাজ, কেতা-দুরস্ত চালচলন আমাকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করেছিল। ঐ বয়সের অন্যান্য ছেলেদের মত কাসেম ডানপিটে স্বভাবের ছিল না। আর দশ জন ছেলে পুলে মিলে আমরা যখন পাড়াটাকে অতিষ্ঠ করে রাখতাম, তখন কাশেম সে সব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখত। সেই বয়সেও ও প্রতিটি পদক্ষেপ হিসেব করে চলত। নামের সাথে মিল থাকার জন্য হোক অথবা ওর স্বভাব চরিত্রের কারণেই হোক, বন্ধু মহলে কাশেমের নাম হয়ে গেল কাছিম। ব্যাপারটা ঘোরতর অন্যায়। কারণ শুধু মাত্র স্বভাবের জন্য যদি জন্তুর নামে কাউকে নামকরন করতে হয়, তবে আমাদের একেক জনের নাম হওয়া উচিত ছিল- বান্দর- ১, ছাগল- ২, ভেড়া- ৩ ইত্যাদি ইত্যাদি; মেট্রিক-ইন্টারমিডিয়েটের রোল নাম্বার যেমনটা হয়। সে যাই হোক কাশেমের আরেক নাম যে কাছিম, তা এই মুহূর্ত থেকে চেপে যাব। কারণ কাশেম আমাদের এই টরন্টো শহরেই এক স্ত্রী আর এক সন্তান নিয়ে হেসে খেলে সংসার ধর্ম পালন করছে। মেইড ইন কানাডা সন্তানটি হয়ত বাবার সাবেক নাম কাছিম ছিল শুনে, শুধুমাত্র না বোঝার কারণে কোন মাইন্ড করবে না। কিন্তু কাশেমের বিদূষী স্ত্রী ব্যাপারটা কানাডিয়ায়নদের মত টেইক ইট ইজি কায়দায় নেবে বলে আমার মনে হয় না।
যাইহোক, হেসে খেলে সংসার ধর্ম পালন করছে, কথাটা এই জন্য বললাম যে, সুদূর শৈশবে খেলা ধুলার ফাঁকে কাশেম প্রায়ই আমাকে বলত, ‘ আমরা খুব শীগগিরই এই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে যাব। গ্রামে থাকা অনেক কষ্টের। শহরে অনেক আরাম। একবার আব্বু ঢাকায় বদলি হলে আমাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না। হেসে খেলে দিন গুলি কাটবে।’
কাশেম যে কথাটা বলত তা আমার কাছে মোটেই নতুন না। আমাদের গ্রামের সামসু পাগলাও(আসলে আধ-পাগলা) ঢাকা শহরের অনেক গুনকীর্তন করত। ঢাকা শহরে যে life ই life সে ব্যাপারটা বুঝলেও হেসে খেলে দিন কাটানোর ব্যাপারটা তখন মাথায় ঢুকত না কিছুতেই। কেন, আমরা কী এখন হেসে খেলে দিন কাটাচ্ছি না? অবশ্য হেসে খেলে দিন কাটানোর মর্মার্থ কিছুদিন বাদেই বুঝতে পেরেছি। সেই বুঝা আজ অবধি বোঝা হয়ে সিন্দবাদের ভূতের মত মাথায় চেপে আছে।
বছর খানেক পর কাশেমদের পুরো পরিবার ঢাকায় বদলি হয়ে গেল। সামনের দিন গুলি হেসে খেলে কাটানোর কথা থাকলেও, ঢাকায় রওয়ানা দেবার আগে কাশেমের চোখ দুটো আমি ছলছল দেখেছিলাম। তারপর অনেকগুলো দিন, অনেক গুলো মাস আর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেল। কাশেমের স্মৃতি ডায়নোসরের মতই তখন প্রায় ফসিলের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মেট্রিক পাশ করলাম, ইন্টার পাশ করলাম পর্যায়ক্রমে গ্রামের স্কুল আর কলেজ থেকে- হেসে খেলে। রেজালট মন্দ না। তবে ভাল কোথাও ভর্তি না হতে পারলে বাকী জীবনটা হেসে খেলে কাটানোর কোন সম্ভাবনা নাই। অতএব ঢাকায় এক আত্মিয়ের বাসায় এসে আস্তানা গাড়লাম; উদ্দেশ্য ঢাকায় ভাল কোথাও ভর্তি হওয়া। আত্মিয়র গৃহকে নিজ গৃহ মনে করে- থাকাটা এবং তিন বেলা খাওয়াটা মুফতে সারতে পারলেও, আত্মিয়ের পকেটকে নিজ পকেট মনে করে পকেট খরচাটাও মুফতে সারা সম্ভব ছিল না। অবশ্য সেই আত্মিয়টির সুপারিশে ধানমন্ডি এলাকায় একটা টিউশনি জুটে যাওয়ায় পকেট খরচের দুঃশ্চিন্তা থেকে তখনকার মত মুক্তি মেলে। এক বিকেলে কলাবাগান লেকের সামনে দিয়ে, বগল তলায় সদ্য কেনা বুয়েট ভর্তি গাইড নিয়ে হনহনিয়ে হেটে টিউশনিতে যাচ্ছি। হঠাৎ দূর থেকে দেখি আমেরিকান কালচারাল সেন্টার থেকে একটা ছেলে বের হয়ে, আমার চেয়েও বেশি হনহনিয়ে হেটে আমার দিকে আসছে। ছেলেটার চোখে চশমা, বগল তলায় একটা বই। স্মৃতির আংগিনায় অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া একটা মুখ হঠাৎ উঁকি মারে। দূর থেকে কাশেমরও হয়ত আমাকে দেখে চেনা চেনা লেগেছিল। কাছে আসতেই দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াই।
‘আরে তুই মামুন না?’
‘আরে তুই কাশেম না?’
‘তাই তো বলি কোথায় যেন দেখেছি!’ ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কথা চলে আমাদের মধ্যে।
একসময় জিজ্ঞেস করি, ‘তোর বগল তলায় কী বই?’
কাশেম উত্তর দেয়, ‘এটা বই না, বই না। এটা হচ্ছে TOEFL পরীক্ষা দেওয়ার ফর্ম সহ বুকলেট। USIS থেকে নিয়ে এলাম।’
TOEFL সম্পর্কে স্বল্প বিস্তর আমি ইতিমধ্যে জেনেছি। তাই দীর্ঘ দিন পর দেখা পাওয়া শহুরে বন্ধুর সামনে একেবারে অপ্রস্তুত হতে হয় না।
আমি বলি, ‘তার মানে তুই আমেরিকায় যাচ্ছিস?’
‘আলবৎ! এই দেশে কোন পাঠায় থাকে? কোনরকমে পাঁচশ পঞ্চাশ TOEFL স্কোর উঠাতে পারলে, হেসে খেলে আমেরিকায় পারি জমাব। তারপর - - -’ কাশেম তার বক্তব্য অসম্পূর্ণ রেখে আমার দিকে যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারে। আমি অবশ্য খুব একটা অপ্রস্তুত হই না। কারণ আমাদের গ্রামের সামসু পাগলাও (ইতমধ্যে তার পাগলামীর মাত্রাটা বেশ ভাল রকমের বেড়েছে)এখন সৌদী আরব আর জাপানের কথা তোতা পাখীর মত মুখস্ত আওরায়।
সেদিনের মত কাশেমের কাছ থেকে বিদায় নিলেও পরবর্তিতে ওর সঙ্গে আমার মোলাকাত হতে থাকে। শৈশবের বন্ধু বলে কথা। প্রথম সাক্ষাতের মাস তিনেক পর কাশেম হাস্যবদনে এসে আমাকে জানালো যে সে TOEFL- এ পাঁচশ সত্তর স্কোর করেছে। এবারে হেসে খেলে ভিসা পাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। স্কোর হাতে পেতে দেরী হয়েছিল কিঞ্চিৎ, কিন্তু আমেরিকার নামী দামী ইউনিভার্সিটি থেকে I-২০ আনতে মোটেই দেরি হয় না কাশেমের। খুশিতে নাচতে নাচতে সে বারিধারার মার্কিন দুর্গে কাক ডাকা ভোরে হাজির। সংগতি না থাকলেও শুধুমাত্র সংগ দেয়ার খায়েশ থাকায়, কশেমের বিশেষ অনুরোধে আমিও সাথে গেলাম। অবশ্য সঙ্গতিহীন সংগ দেয়ার খেসারত হিসেবে, কাক ডাকা ভোর থেকে পেট চোঁ চোঁ করা দ্বীপ্রহর পর্যন্ত আমাকে ঠায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। অনেক প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক সময় কাসেম লাল দুর্গ থেকে বাইরে আসে। তবে হেসে খেলে না- বিসন্ন বদনে। আমি বলি, ‘কিরে দোস্ত ঘটনা কী?’ কাশেম কোন উত্তর দেয় না। বুঝতে পারি ভাগ্যের শিকে ছেড়েনি। আমি তাকে সান্ত্বনা দিই, প্রবাদ বাক্য বর্ষণ করি, ইতিহাস থেকে সম্রাট রবার্ট ব্রুসের ঘটনা তর্জমা করে শোনাই।
রবার্ট ব্রুস তার হারানো রাজ্য ফিরে পেয়েছিল সাতবারের মাথায়। আর আমাদের কাশেম তার সবুজ পাসপোর্টে কাংখিত স্টিকার পায় পাঁচ বারের মাথায়। দুর্ভাগ্য কাসেমের- ইতিহাসের কোথাও তার কথা লেখা নেই। যাইহোক ভিসা পাওয়ার পর কাশেমের চিকনাই দেখে কে? বাল্যবন্ধুর চিকনাই আমার হৃৎপিণ্ডে আলট্রাভায়োলেট রশ্মির মত বেঁধে এবং তাৎক্ষণিক জ্বালা অনুভব করি আমি। এই প্রথম বারের মত অনুধাবন করলাম- জ্বলুনি বিশেষনটা শুধু রমণীকুলের একার সম্পদ না।
দেখতে দেখতে কাসেমের বিদায় ক্ষণ উপস্থিত। হেসে খেলে আমেরিকায় গমনের কথা থাকলেও, এয়ারপোর্টের ডিপার্টার লাউঞ্জে দেখি কাশেমের অন্য চেহারা। একবার মা’কে ধরে কাঁদে, তো পরের বার কাঁদে বাবাকে জড়িয়ে, পর মুহূর্তে হয়ত ঘনিষ্ঠ কোন বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে শুরু করে দেয় মাতম। আমরা কেউ কেউ বিজ্ঞের মত মুখ টিপে হাসি। ভাবখানা এমন, ‘শালা আমেরিকা যাওয়ার জন্য একেকজন কোমড়ে কাচা মেরে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে। একবার মার্কীন মুল্লুকে পা রাখতে পারলে স্বর্গে যাওয়া ঠ্যাকায় কে? আর পাঠায় কী-না - - -’
প্রথম দিকে, উইচিটা শহর থেকে কাশেম বেশ ঘন ঘন আমাকে চিঠি লিখত। মাঝে মাঝে ফোনেও কথা বলার সুযোগ হত। আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘কিরে দোস্তস্বর্গ রাজ্যে আছিস! সুখ ই সুখ। জীবনটা তো- - -।’
সে বলত, ‘নারে দোস্ত, কেবল মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম। বছর চারেক লাগবে ব্যাচেলর ডিগ্রীটা শেষ করতে। তারপর- - -।’
বছর চারেক না, প্রায় বছর ছয়েক পর শুনতে পেলাম কাশেমের ব্যাচেলর ডিগ্রী কমপ্লিট। এখন সে, পুরো দস্তুর একজন Chemical ইঞ্জিনিয়ার; তাও আবার আমেরিকার নামকরা ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট প্রাপ্ত। কথা প্রসংগে আমি বন্ধুকে বলি, ‘ফ্রেন্ড তোমার তো এখন সু-দিন।’
কাশেম বলে, ‘না মানে, আমেরিকায় একটা গ্রীন কার্ড না থাকলে সব কিছুই বেকার। কোন রকমে একটা গ্রীন কার্ড পেলে, হে হে হে, বুঝলি না?’
বুঝি, আমি কাশেমের সুখটা বুঝি। আবার এও বুঝি যে জ্বলুনি ব্যমোটা ইতিমধ্যে আমার হৃৎপিণ্ডে পার্মানেন্টলি বাসা বেঁধে ফেলেছে। আজকাল অন্য কারো ভাল শুনলে বা দেখলে রোগটা গলা খাকারী দিয়ে জানানি দেয়।
নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে একসময় কাশেমের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ইত্যবসরে আমি বিএ, এমএ পাশ করে এবং বিয়ে করে, একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে মোটামুটি মোটা বেতনের চাকুরীতে যোগ দিয়েছি। মোটামুটি মোটা বেতনের চাকুরে হলেও সংসার জীবনে স্ত্রীর সংগে আকছার খিট-খিটি লেগেই থাকে। সেই সাথে আছে কর্ম ক্ষেত্রের ঝুট ঝামেলা।
আমার স্ত্রী, আমাকে প্রায়শই বিশেষ এক প্রাণীর নাম করে গালি বর্ষন করে। আর বর্ষণ করবেই বা না কেন? আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের অনেকেই, এমন কি আমার জুনিয়রদের কেউ কেউ অনেক আগেই কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এদেশ থেকে ফুটেছে। আর আমি কী-না - - -
বলতে লজ্জা করছে, তবুও বলছি- সে সময় আমি প্রায় রাতে একটা স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম, আমি আর আমি নেই। আমার মুখ মন্ডল বাদে শরীরের বাকী অংশ টুকু পাঠার মত হয়ে গেছে। নিশীর স্বপ্ন আস্তে আস্তে দিনে দুপুরেও দেখতে থাকি। হাটে-মাঠে, রাস্তা-ঘাটে যত লোক দেখতাম, সবাইকে আমার পাঠার মত মনে হত। চেহারাটা মানুষের কিন্তু শরীর পাঠার। দেশ ভর্তি যেন শুধু পাঠা আর পাঠা। মানব জন্ম সার্থক করতে পারি আর না পারি, অন্তত পাঠা হয়ে কবরে যেতে আমি নারাজ। কাজেই সেই ভয়ংকর স্বপ্নের হাত থেকে নাজাত পেতে আমি ছোটাছুটি শুরু করি এবং একসময় স্বপ্নের পাঠা বলি দিয়ে পাঠা-দেশকে পিঠ প্রদর্শন করে সপরিবারে টরন্টোর পাক জমিনে পদার্পন করি।
টরন্টো শহরে প্রথমে এক বন্ধুর আশ্রয়ে থাকলেও পরবর্তিতে বাঙ্গালী অধ্যুসিত ভিক্টোরিয়া পার্ক, ড্যানফোর্থ এলাকায় ছয়শত পঞ্চাশ ডলারে একখানা বেইজমেন্ট ভাড়া করার পর বাসস্থান সমস্যার আপাদত সমাধান ঘটে। কনকনে ঠান্ডার মাস। আপাদমস্তক গরম কাপড়ের (বংগ থেকে কেনা) প্যাকেটে ঢুকিয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করি কাজের আশায়। কাজ একটা না পেলেই নয়। দেশ থেকে আনা সামান্য টাকা শেষ প্রায়। দেশে হলে আক্ষরিক অর্থেই গাছতলায় থাকা যেত। কিন্তু টরন্টো শহরে এই ঠান্ডার মধ্যে? আমার পরিচিত যারা আমার বছর খানেক আগে এ দেশে এসেছে তাদের এখনও অনেকে লাইন মত কাজ পায় নি। গাঁটের কড়ি খরচ করেও দিব্যি আছে তারা। দেশ থেকে কত টাকা আনলে টরন্টোর মত শহরে এক বছর বিনা রোজগারে থাকা সম্ভব এবং সেই টাকার উৎস কী- তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষনার বিষয় আছে। আমার এই প্রশ্ন শুনে কেউ কেউ আমাকে অতি সজ্জন ভাবতে পারেন। যারা ভেবেছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। জগৎ সংসারে এমন অনেক মানুষ আছে যারা পরিস্থিতির কারণে অসৎ হতে বাধ্য হয়। আবার কেউ কেউ পরিস্থিতির কারণে বা মওকা না থাকার দরুণ সৎ থাকতে বাধ্য হয়। আমি দ্বিতীয় দলের লোক। যাই হোক পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কল্যানে রেস্টুরেন্টে থালা বাসন ধোয়ার একটা কাজ জুটে যায়। তখনকার মত গাছ তলায় থাকা বা আধ পেটা খেয়ে বাঁচার গ্লানি থেকে পরিত্রান মেলে।
বাতাসের ঝাপটা সহ বাইরের তাপমাত্রা তখন হিমাংকের পয়ত্রিশ ডিগ্রী নীচে। বাসা থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়ের দিকে হেটে যাচ্ছি, হাতে লাঞ্চের আইসোথার্মাল ব্যাগ। হঠাৎ দেখি উলটো দিক থেকে হনহনিয়ে এক যুবক আমার দিকেই আসছে। যুবকটির চোখে পুরু লেন্সের চশমা, পিঠে কলেজ পড়ুয়া ছেলে ছোকরার মত একটা ব্যাগ। দূর থেকেও চিনতে অসুবিধা হয়না কাশেমকে। আমাকে চিনতে অবশ্য ওর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। দীর্ঘ দিন পর বাল্যবন্ধুকে কাছে পেয়ে আবেগে জড়িয়ে ধরি, পরষ্পর পরষ্পরেরে পিঠে চাপড় দিই।
আমি বলি, ‘কিরে দোস্ত তুই এখানে? ঘুরতে এসেছিস না-কী?’
কাসেম বলে, ‘না দোস্ত, আমি এখন টরন্টোর বাসিন্দা। গুষ্টি কিলাই আমেরিকার।’
‘বলিস কী?’
‘অনেক ভাবে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তাই শেষ পর্যন্ত এখানে।’ আফসোসের স্বরে বলে সে।
‘তাতে কী? যাহা বিক্রমপুর, তাহাই শরিয়তপুর। শত হলেও আমেরিকার গ্রাজুয়েট।’
‘নাহ। শালার কপালটা খারাপ। বাংলাদেশে ভারতীয় পন্যের মত টরন্টো শহরেও এঞ্জিনিয়ারে এঞ্জিনিয়ারে সয়লাব। কোথাও চাকরী নাই। যাক বাদ দে, তোর খবর বল।’
কফি টাইমে বসে, ধুমায়িত কলম্বিয়ান কফির কাপে ঠোঁট রেখে আমি আমার কথা বলি; দুঃখের কথা, সুখের কথা, সাবেক আর বর্তমান দশার কথা, দারা- পুত্র-পরিবারের কথা। কাসেমও তার নিজের অনেক কথা বলে। সে বলে- এঞ্জিনিয়ারিং প্রফেশনে চাকুরীর বাজার ঠান্ডা হলেও ফার্মাসিউটিক্যাল লাইনে বাজার গরম। কাজেই সে TIP নামের এক ইনস্টিটিউট থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল লাইনের ওপর নয় মাসের একটা কোর্স করেছে। বর্তমানে একটা কোম্পানীতে তিন মাসের জন্য কো-ওপ (co-op) করছে। ওরা যদি তিন মাস পর হায়ার করে তবে বছরে ফিফটি কে-র নীচে বেতন নাই। যত মুশকিল, তত আছান।
কো-ওপ, বা ফিফটি কে ( ৫০ কে) শব্দ গুলো আমি ঠিক বুঝি না। তাই লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে শব্দ দুটোর মাহাত্য শুধাই। আমার অজ্ঞতায় কাশেম কিঞ্চিত বিরক্ত হলেও, বাল্য বন্ধু হওয়ার সুবাদে মূর্খ, খ্যাত বা এই জাতীয় বিশেষণে বিশেষিত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে যাই। কৃত্রিম বিরক্তি প্রকাশ করে সে বলে, ‘আরে ছাগল কো-ওপ মানে হচ্ছে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য কোন কোম্পানীতে নিজ প্রফেশন বিনা পয়সায় কাজ করা। কারণ কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স ছাড়া কোথাও কেউ তোকে হায়ার করবে না। ফিফটি কে মানে পঞ্চাশ হাজার , কে অর্থাৎ কিলো।’
কাশেমের কাছ থেকে সেদিন এবং পরবর্তিত দিন গুলিতে অনেক কিছু শিখেছিলাম এবং বলতে দ্বিধা নেই- এখন পর্যন্ত শিখছি।
দুর্ভাগ্য বশতঃ কাশেমের ফিফটি কে’র কাজটা কানের কাছ দিয়ে গুলি লাগার মত বাতাসে শিশ কেটে বেরিয়ে যায়। তবে এই কো-ওপের জোরে কোন এক এজেনসীর মাধ্যমে পনের ডলার ঘন্টার একটা চাকরী জুটে যায়। যদিও এজেনসী বেতনের বড় একটা অংশ হাপিস করে দিচ্ছে, তবুও নিজ প্রফেশনে কাজ বলে কথা। এক্সপেরিয়েন্স টকস।
সেদিনের পর থেকে আমার গৃহে কাশেমের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমার সুখের সংসারে যাতায়াত করে হিংসা বশতই হোক আর নিজের জৈবিক চাহিদার জন্যই হোক, বন্ধুটি এবার বিয়ে করবে বলে মনস্থির করল। বিয়ের ব্যাপারে তার যুক্তি হল- লাড্ডু যখন খেতেই হবে তাহলে দেরী কেন? শুভশ্য শীঘ্রম (!) তাছাড়া বিয়ে’থা না করা পর্যন্ত কেউ কোনদিন প্রতিষ্ঠা পায়নি। কাজেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে, জীবনটা হেসে খেলে কাটাতে হলে চাই বিবাহ থেরাপী।
আমার কোমল মতী, সেই সাথে বুদ্ধিমতী জীবন সঙ্গিনী, পতি-বন্ধু’র পীড়ায় কাতর হয়ে পাত্রী দেখানোর মহৎ কর্মটি মহোৎসাহে নিজ স্কন্ধে তুলে নিল। গিন্নী তার আপন, পর, কাছের, দূরের হাতা-বাছা যত মেয়ের ছবি আছে তার সব, পাত্রের সামনে তাসের মত মেলে ধরে। ডজন দুই ছবি থেকে একটাও পছন্দ না করতে পেরে হতাশ কাশেম শেষ-তক দেশে গিয়ে চিরাচরিত পন্থায় পাত্রী দেখার সিদ্ধান্তনেয়। যে কথা, সেই কাজ। পকেটে হাজার দশেক কড়কড়ে ইউ,এস ডলার আর দুই লাগেজ বোঝাই মাল সামান নিয়ে কাশেম নাচতে নাচতে শাদীর লাড্ডু খেতে রওয়ানা করল।
মাস চারেক পর যখন সে দেশ থেকে ফিরল, তখন দেখি কাশেমের মধ্যে সেই হাসি খুশি ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। আগে কালে-ভদ্রে সিগারেটের ফিলটারে ঠোঁট ছোঁয়াত। আর আজকাল তার পকেটে সিগারেটের প্যাকেট থাকে সব সময়। ঘটনাটা কী? আমি কৌতূহলী হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করি, ‘কি ফ্রেন্ড, তোমার চেহারার এমন যায় যায় দিন দশা কেন? এনিথং রং?’
‘আর বলিস না দোস্ত। বড় বিপদে আছি। বিয়ে করার সময় যে টাকা নিয়ে গেছিলাম তাতে কুলায় নাই। অনেক টাকা ধার করে এসেছি। এখন এই টাকা শোধ দিব কী করে ভেবে কিনার পাই না। তার মধ্যে আবার নতুন যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।’
আমি বলি, ‘সেটা আবার কী?’
‘আমার এক মামা শ্বশুড় আছে। শালায় একটা গিট্টু, বহুত গিরিঙ্গী। গিট্টুটায় আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকজনকে বুঝিয়েছে যে আমি নাকি ইহকালে কানাডায় বৌ আনতে পারব না। আজকাল শ্বশুড় বাড়িতে ফোন করলে বার বছরের ছোট শ্যালিকা থেকে শুরু করে কাজের বুয়া পর্যন্ত, ফোন ধরে হ্যালো বলার আগে বলে- দুলা ভাই, আফারে কবে নিবেন? অবস্থাটা বোঝ একবার।’ কাশেমের কথা শুনে আমার স্ত্রী সহানুভূতি প্রকাশ করে (যদিও ভেতরে ভেতরে সে মহাখুশী)।
বন্ধুটির ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। বছর খানেকের বেশী তাকে এই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়নি। গিট্টু মামা শ্বশুরের মুখে চুন কালি মাখিয়ে, আট বছরের শ্যালিকা (তত দিনে অবশ্য শ্যালিকার বয়স তেরোতে পরেছে) থেকে শুরু করে কাজের বুয়া পর্যন্ত, শ্বশুড়ালয়ের প্রতিটি সদস্যের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ডিসেম্বরের কোন এক সন্ধ্যায় টরন্টো শহরে নাজেল হলেন বন্ধু পত্নি। বন্ধু পত্নি আসার পরেও আমাদের মধ্যে সম্পর্কের এতটুকু ভাটা পরেনি। আগের চাকুরী টা ছেড়ে এখন সে অন্য একটাতে জয়েন করেছে- কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ার হিসেবে, বেতন নিঃসন্দেহে অনেক বেশী। কাশেমের সাথে আমার সখ্যতা পূর্ববৎ থাকলেও- বৌ-বাচ্চা নিয়ে এখন তার দিন হেসে খেলে যাচ্ছে কী-না তা আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুহয়ে এধরনের প্রশ্ন করা উচিৎ না- ক্রিমিনালী হয়ে যায়। তবে আপনারা যে কেউ করতে পারেন। কাশেমকে আপনারা অনেকেই হয়ত চেনেন না। কিন্তুএকটু বর্ণনা দিলেই ওকে চিনতে পারবেন। ভিক্টোরিয়া পার্ক, ড্যানফোর্থ এলাকায় বাংলাদেশী গ্রোসারীর সামনে যদি কোন বাঙ্গালী ভাইকে দেখেন যার হাতে পলিথিন ভর্তি কাঁচা বাজার, পেছন পেছন সুন্দরী মত এক যুবতি স্ট্রলারে বাচ্চা বসিয়ে স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেঁটে চলছে পার্কিং লটের দিকে। ওয়ালমার্ট বা অন্য কোন শপিং মলে প্রায়ই দেখবেন এক বাঙ্গালী যুবক সপিং কার্টে বাচ্চাকে বসিয়ে রাম ভক্ত হনুমানের মত স্ত্রীর পিছে পিছে হাটছে আর মনে মনে কী যেন হিসেব করছে। গোধূলী বেলায়, অথবা খুব ভোরে, সাবওয়ে বা তার ধারে কাছে দেখবেন এক বাঙ্গালী যুবক কাঁধে লাঞ্চ ব্যাগ আর হাতে একটা মেট্রো পত্রিকা নিয়ে ধেই ধেই করে ছুটছে। কোনদিকে তাকানোর সময় নাই বেচারার। পরিচিত কেউ হয়ত লম্বা একটা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর ভাই জান?
সে উত্তর দিবে, ‘আর বলবেন না রে ভাই পেরেশানীর মধ্যে আছি। হঠাৎ গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছে না।’
‘বলেন কী, আপনি না সেদিন গাড়ি কিনলেন, নতুন।’
‘নতুন হলে কি হবে আমেরিকান গাড়ি! আমি শালার একটা গাধা, জাপানী গাড়ি কিনলে হেসে খেলে দশটা বছর পার করে দেয়া যেত?’
পাঠক, এই যুবকটিই আমার বাল্য বন্ধু কাশেম।
কাশেমের সাথে আমার সর্বশেষ যখন দেখা হয়েছিল তখন খুব আত্মপ্রত্যয়ের সাথে সে তার ভবিষ্যৎ আদ্যিকাল থেকে দুই ধরনের ব্যবসার কোন লস নাই। এক চামরার ব্যবসা, দুই খাদ্যের ব্যবসা। আর হালে যোগ হয়েছে প্যাকেজ নাটকের ব্যবসা। দেশ থেকে শিল্পী এনে টরন্টোতে শুটিং করব। একটা নাটক হিট হলে হেসে খেলে ------।
পাঠক, কাশেম তার জীবনটা হেসে খেলে কাটাতে পারবে কী-না, তা একবার ভেবে দেখবেন। আকেল মান পাঠক কে লিয়ে ইশারাই যথেষ্ট হ্যায়। পরিশেষে বলি- আমি নিজে, কাশেমের মত বিভিন্ন কায়দায় (আল-কায়দা ছাড়া), হেসে খেলে দিন কাটানোর চেষ্টা করেছি। এখনও চেষ্টা করছি।
টরন্টো