somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালিরা যেকোনো উপায়ে স্বাধীনতা অর্জনে প্রস্তুত

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩]
ঢাকায় ছাত্ররা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আর
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামবাসীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধে প্রস্তুত হচ্ছে

পল মার্টিন

অনুবাদ: আ-আল মামুন

সম্প্রতি ঢাকা থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে র‌্যাডিকাল ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক গ্রামে গণবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাদের কাজ হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা। ইতোমধ্যে গত সপ্তাহে ল্যাবরেটরিগুলো থেকে কেমিক্যাল চুরি করে পেট্রল বোমা এবং অন্যান্য হাতবোমা তৈরি করা হয়েছে। বাঙালিদের সাথে যেকোনো বিষয়ে আলোচনাই শেষ পর্যন্ত ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বিষয়ে গড়ায়। ছাত্ররা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্থ গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কথা বলছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানী। এদেরকে তারা দখলদার বাহিনী মনে করে। এমনকি নিরীহ প্রকৃতির মানুষগুলোও স্বাধীনতার চিন্তায় প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছে, তাদের বক্তব্য: যদি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা না আসে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে।

পাকিস্তানের গণআন্দোলন প্রতিবাদী ধর্মঘট থেকে রাতারাতি পূর্ণ বিকশিত ও সুনিয়ন্ত্রীত গণ-অসোহযোগ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে, যার একমাত্র দাবি- পূর্ণ স্বাধীনতা। অবশ্য গত তিন সপ্তাহ ধরে পূর্ব পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ (বাংলা রাষ্ট্র) এক ধরনের স্বাধীনতাই ভোগ করেছে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান উপদেষ্টাদের নিয়ে ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকায় তার ছোট ছিমছাম বাড়িটি থেকে প্রদেশটির প্রশাসনিক কার্যক্রম একপ্রকার নিজেই পরিচালনা করছেন।

বিচার বিভাগ পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছে, শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি অফিসগুলো বন্ধ রয়েছে, জরুরি সেবাখাতগুলো তার নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, ব্যাংকগুলো বিশেষ সময়সীমায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কাজ চালাচ্ছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আলোচনার জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে প্লেনে উঠবার পূর্বে শেখ মুজিবর রহমানের কাছে থেকে আশ্বস্ত হবার প্রয়োজন বোধ করেছেন যে তার অবস্থানকালে ঢাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। যদিও শেখ মুজিব জনসম্মুখে এবং ব্যক্তিক পর্যায়ে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি সতর্কভাবে এড়িয়ে গিয়ে ‘বাংলার মুক্তি’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করছেন, তবু সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, গত সপ্তাহের ঘটনাবলী প্রদেশটিকে সুনিশ্চিতভাবেই স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যদি শেখ মুজিবের আন্দোলনের লক্ষ্য হয় দুই শাখার মধ্যে অসমতা দূর করা, তবু শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল দাঁড়াবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।

একজন বাঙালি নেতা আমাকে জানালেন, “পাকিস্তান রাষ্ট্রসীমার মধ্যে থেকেই আমাদের প্রাপ্য আদায়ের একটা ফর্মূলা ছিল ছয় দফা কর্মসূচি।” কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান পরস্পরের সান্নিধ্য কীভাবে পরিহার করা যায় সেই সঙ্কটেরই সম্মুখীন হয়েছে। বাঙালিদের এ বিষয়ক চিন্তাভাবনা বুঝতে হলে কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিত্র অনুধাবন করা প্রয়োজন। যেমন, পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানির মাধ্যমে দেশের পঞ্চাশ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হলেও গত বিশ বছরের হিসাবে দেখা যায়, পাঁচ ভাগের চার ভাগ সামরিক ও প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে জনসংখ্যায় কম হলেও সিভিল সার্জেন্টদের ৮৫ শতাংশ এবং সেনা অফিসারদের ৯০ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানী।

দুই অঞ্চলের মধ্যে অসমতা এমনকি সাদা দৃষ্টিতেও চিহ্নিত করা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের নগরীগুলোতে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে সুদৃঢ় অবকাঠামো এবং নতুন নতুন সুদৃশ্য ভবন, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার গা থেকে প্রাদেশিক শহরের গন্ধটুকুও মোছা যায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে দারিদ্র খুবই প্রকটভাবে দৃশ্যমান, বস্তি সমস্যা যেন চিরকালীন এবং শিক্ষার সুযোগ পাওয়াদের সংখ্যা খুবই নগন্য। অন্যদিকে, শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বানিজ্যের সম্প্রসারণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের জীবন অনেক বেশি নিরাপদ। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদরা দাবি করেন যে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় দুই অঞ্চলে পণ্য উৎপাদন একই স্তারে থাকলেও বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তান ৬০ শতাংশ বেশি এগিয়ে রয়েছে। তারা এই বৈষম্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করেন। তাদের অভিযোগ, বৈষম্য বেড়েছে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানী থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মূদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবহার এবং পূর্ব পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের উদারভাবে ব্যাংক ঋণ দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। অবশ্য বৈষম্য কিছুটা কমিয়ে আনার একটা প্রচেষ্টাও দেখা যায়। সাম্প্রতিক ১৯৭০-৭৫ পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যায়ের ৫৩ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও, এর আগের দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বাজেটের ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হতো।

যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের পক্ষে তাদের অভিমত হলো যে, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে। স্বাধীন দেশের সূচনালগ্নে তারা পাট রপ্তানী থেকে প্রাপ্ত অর্থ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারবে। পাট শিল্প যে বর্তমানে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি- এধরনের ভাবনাকে তারা একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৩ মিলিয়ন যা আগামী ২৪ বছরে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা। ২০০০ সাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে একর প্রতি ১১.৫ জন। তদুপরি, জন্মনিয়ন্ত্রণের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম। যাহোক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন এবং অর্থনীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার শর্তে শেখ মুজিব যদি সমঝোতায় পৌঁছায়ও তবু গত তিন সপ্তাহ ধরে জনগণ স্বাধীনতার যে দাবি উঠিয়েছে নিশ্চিতভাবেই তা তৃপ্ত হবে না।

দ্যা টাইমস
২৫ মার্চ ১৯৭১

মুক্তযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×