somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেখ মুজিব: শহীদ হবার পথে

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭]
যে সংকটের আশঙ্কা করেছিলেন এখন তারই মুখোমুখি শেখ মুজিবুর রহমান


পল মার্টিন
অনুবাদ: আ-আল মামুন

পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জনগণকে একতাবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন, নিজেই এখন প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। গত বিশ বছরে তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে। বর্তমানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার সংগ্রামের সবচেয়ে সংকটময় সময়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং পূর্ব বাংলার যে ৯৬ শতাংশ ভোট তাকে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতায় পরিণত করেছিল, এখন যেন তার চেয়েও বেশি জনসমর্থন রয়েছে তার পিছনে। সম্প্রতি নিজ বাসভবনে আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সেনাবাহিনী আসুক এবং আমাকে জেলে নিক্ষেপ করুক। নিজে থেকেই দেখ, আমাকে পাহারা দেয়ার জন্য কেউ নেই। তাদের হাতেই সব সমরাস্ত্র রয়েছে। তারা আমাকে হত্যা করতে পারে। এমনকি তারা আমার পরিবারের সব সদস্যকেই হত্যা করতে পারে। কিন্তু তাদেরকে জানাও যে তারা ৭৬ মিলিয়ন বাঙালির চেতনাকে হত্যা করতে পারবে না। জনগণ আমার ওপর আস্থাশীল এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তারা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। তারা সেটা প্রমাণও করেছে। অস্ত্র দিয়ে বাংলার মানুষের কণ্ঠস্বর কখনোই রুদ্ধ করা যাবে না।”

গত তিন সপ্তাহ ধরে শেখ মুজিবের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। দুই দিক থেকে তাকে এই চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সাধারণ নির্বাচনের ফলে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের সমাধান করা যাবে- এরকম তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে বিরামহীনভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। অন্যদিকে বাঙালির মুক্তির যে আভা গতমাস থেকে জনতার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে তা প্রদেশব্যাপী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে পূর্ণ গণ-অসহযোগ রূপে প্রকাশ পাচ্ছে এবং তার রাজনৈতিক মর্যাদাকে চাপের মুখে ফেলেছে। একইসাথে তাকে দলের ভিতরের কট্টর স্বাধীনতাবাদীদেরও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তবে, পাকিস্তানের সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানে সামরিক বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের সুবিধা নিশ্চিত করে বাঙালিদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটাই হয়তো যুক্ত পাকিস্তানের সমাপ্তি টানবে। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন তবু বলা যায়, সামরিক জান্তার যুদ্ধাংদেহী অবস্থানের পক্ষে যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ রয়েছেন তাদের চেয়ে নিশ্চিতভাবেই তিনি অনেক বেশি দেশপ্রেমিক।

দীর্ঘদেহী সুদর্শন ৫১ বছর বয়সী শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেকটা সফল ব্যবসায়ীর মতো দেখায়। মুসলিম সমাজের গোত্রপতিদের মতো তিনি তাঁর রাজনৈতক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বাতিলের মাধ্যমে এ মাসের শুরুতে যে সংকটের শুরু হয়েছে তখন থেকেই তিনি অসামান্য ধৈয্যের পরিচয় দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সাথে তাকে ঘন ঘন বসতে হচ্ছে, নীতি নির্ধারণ করতে হচ্ছে এবং প্রদেশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করতে হচ্ছে। তদুপরি, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংকট সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে আসছেন, তাদের সাথেও বসতে হচ্ছে। সব কিছুর ওপরে তার বাড়ি বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

স্বাধীনতার উল্লেখ না করার যে কৌশল তিনি আগে থেকেই নিয়েছেন সেটা অক্ষুন্ন রেখে বললেন, ‘আমি যা চাই তা হলো আমার জনগণের মুক্তি।’ তিনি আরও বললেন, “আসুন সত্যের মুখোমুখি হই। বৃটিশরা যখন ভারত শাসন করেছে তখনও আমাদের ওপর এতো ট্যাক্স আরোপ করা হয়নি। তারা এই প্রদেশের সম্পদ ভোগ করেছে, কোনো ট্যাক্স আরোপ করেনি। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদেরকে কেবল কলোনি ও বাজার হিসেবে ব্যবহার করে। আমাদের অধিকার আছে এবং গত নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমেই সেটা প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মিসেস ইন্দিরা গান্ধি প্রধান মন্ত্রী হিসবে শপথ গ্রহণ করেছেন। আর, আমি নির্বাচনে জয়ী হয়েছি গত বছর অথচ এখনও শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছি।”

মিশনারী স্কুল শেষ করে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পূর্বেই তিনি কোলকাতা ইসলামীয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন ও পরে মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে চল্লিশের দশকের শুরুতেই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। যাহোক, দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় ক্ষমতায় আসে। তিনি মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে মুসলিম লীগ শাসনামলেই প্রথমবারের মতো তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। পরবর্তী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীগুলোর শাসনামলে তাকে আরও চারবার কারাবরণ করতে হয়েছে।

১৯৬৬ সালে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের আওতায় সামরিক সরকার প্রধান আইয়ুব খান তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। এই ঘটনাই তাঁকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার সূচনা করে এবং তিনি ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করার পরই তাঁকে আবার কারারুদ্ধ করা হয়। ২১ মাস সাধারণ কারাগারে আটক থাকার পর তাঁকে সামরিক তত্ত্ববধানে সরিয়ে নেয়া হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগ আনা হয় যে তিনি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তাঁর গ্রেপ্তারের পর থেকে গত বছর বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট ও স্বতস্ফূর্ত গণআন্দোলন চলতে থাকে। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। কোনো সন্দেহ নেই যে, সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং মামলা অমিমাংসিত ভাবে শেষ হয়ে যায়। আর এর ফলে দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় সেটাই আইয়ুব খানের পতন ঘটায়। তার পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক সরকার গঠন করেন।

গত তিন সপ্তাহ যারা শেখ মুজিবকে কাছে থেকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন তারা বুঝেছেন যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুর বছরগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে দৈন্যতা চাপিয়ে দিয়েছিল তিনি তা ভুলে যাননি। দীর্ঘদিন থেকে যারা শেখ মুজিবের সাথে রয়েছেন তারা জানেন তিনি সব সময় কারাভোগের দিনগুলোর কথা এবং যেকোনো সময় তাকে হত্যা করা হতে পারে- এমন বলতেন। অবশ্য, সবসময় যে ভয় পেতেন তার মুখোমুখি হয়তো তাকে হতে হবে না, এমনটাই তাঁর বিশ্বাস ছিল। এ বিষয়ে তিনি নিজেই সবসময় বলতেন, “আমি আশাবাদী। সবচেয়ে ভালোটার জন্য আমি চেষ্টা করে যাই কিন্তু সব সময় মন্দটার জন্যও প্রস্তুত থাকি।”

দ্য টাইমস

২৭ মার্চ ১৯৭১


মুক্তযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×