"রিফাত " ছেলেটা ক্লাস ৯ এ পড়ে । লিখাপড়ায় খুব ভাল তাই বাবা-মা তাকে কোন কাজেই বাধা দেয় না । বড়লোক বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান । ঢাকায় ৪ টা ফ্ল্যাট আছে তাদের ।
সে যা চায় তাই পায় । তাই বন্ধু মহলে তার অনেক সুনাম আছে । সব ছেলেরা তাকে খুব মেনে চলে । কারন ছেলেগুলা রিফাত থেকে হাত খরচ পেয়ে থাকে ...।
গান ও খেলাধুলায় সে প্রথম হয় । মেয়েরাও তার অনেক ভক্ত । অনেক গার্লফ্রেন্ড আছে তার । সবাই তার টাকা ও মেধার পিছে ছুটে কিন্তু মন থেকে কেউ তাকে ভালবাসে না । এই কথাটা "রিফাত" জানতে পারে তার খুব কাছের এক ভাল ছেলে বন্ধু থেকে ...।।
ধীরে ধীরে ভাল বন্ধুগুলো সরে যায় আর খারাপ বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে ।রিফাতের সিগারেট ও বিয়ারের পার্টীতে যাতায়াত শুরু হয় । ছেলের এই অবস্থা তার বাবা-মাকে চিন্তায় ফেলে দেয় । বাবা-মা জেমসকে একটু বুঝানোর চেস্টা করে । তাকে ডেকে বাসায় একটি ফ্যামিলি মিটিং করে ।
মিটিং এ বাবা-মা বলেন " -
দেখ বাবা জেমস । তুমি আজ পর্যন্ত যা চেয়েছ তাই আমরা দিয়েছি । সামনে রমজানের মাস । আমরা চাই তুমি বন্ধুদের থেকে দূরে থাকবে আর বাসায় এক আলেম হুজুরের কাছে "নামায ও কুরআন " সহীসও শুদ্ধভাবে পড়া শিখবে । বাসার ভিতরে থেকে যা ইচ্ছে করতে পার । রোজার ছুটি। তাই বাইরে স্কুলের ঝামেলাও নেই । প্রাইভেট স্যারের বাসাও নেই। হাউজ টিচার বাসায় এসেই পড়াবেন । আশা করি বা্বা-মায়ের কথা মেনে চলবে । তমার সব কথা শুনেছি । আমাদের একটা কথা রাখ । মাত্র ১ টা মাসই তো " ।
রিফাত বাবা-মায়ের কথা ফেলতে পারে না । মাত্র একটা মাস দেখতে দেখতেই চলে যাবে । সে রোজার ১ম দিন থেকে হুজুরের কাছে "কুরআন ও হাদীশ " পড়ার নিয়ত করে ...।
যথা সময়ে রোজার ১ম দিনে হুজুর বাসায় চলে আসেন । হুজুরের লম্বা লম্বা দাড়ি ও বড় জুব্বা থাকার কথা । কিন্তু রিফাত যেমন টা ভেবেছিল, হুজুর তেমন টি নন ।
একদম সাদা সিদে মানুষ । বয়স মাত্র ২৪-২৫ হবে । একটা শর্ট পাঞ্জাবী পড়েছেন । আর মুখে কোন দাড়ি নেই । জিজ্ঞেস করে জানাগেল , উনি ঢাকা বিশ্যবিদ্যালয়ে "দর্শন" এর উপর পড়াশূনা করছেন । ফাইনাল ইয়ারে আছেন ...।
রিফাত তো অবাক !!! হুজুর মানুষ এতো সুন্দর ও স্মার্ট হয় তা ওর জানাছিল না ..।।
হুজুরের নাম "মোহাম্মদ আলী " ।
হুজুর বলেন " আমাকে তুমি আলী ভাই বলে ডাকতে পার " ।
১ম ২ দিন "আলী ভাই" শুধু ওয়াজ নসিহত ও রোজার ফজিলত বুঝিয়েছেন । কেন জানি ইসলাম ও তার এই মহা মুল্যবান মাসের বরকতময় বানী রিফাতের মন কে ছুয়ে দেয় ...।
আলি ভাই খুব ভাল বক্তা । মুখ দিয়ে যেন মধু ঝরে । আগে এমন মানুষ সে দেখে নি কখনো ।
রিফাতের ব্যাবহারে অনেক চেঞ্জ আসে । রিফাত কুরআন ও হাদীস শরীফ পড়াশুরু করে । আলী ভাই মাঝে মাঝে রিফাতকে নিয়ে ইফতার করতে মসজিদে যায় । সব গরীব ও অসহায় মানূষের সাথে ইফতার করে রিফাতের ভাল লাগতে শুরু করে । সেও "তারাবি নামায" শুরু করে । এভাবেই চলে যায় ৯ টি রোযা ।
রিফাতের এই উন্নতি দেখে রিফাতের বাবা খুশী হন ।তিনি "আলি ভাই" কে তাদের বাসায় " হাউস টিউটর " হিসেবে থাকতে বলেন । রিফাত অনেক অনুরোধ করে আলী ভাইকে রাজি করান ।
রিফাতের রুটিন টা এমন হয়ে ওঠে --
-- রাত ১১ টার মধ্যেই ঘুমুতে যাওয়া ।
--রাত ৩ টায় সেহেরী খেতে ওঠা ।
--সেহেরীর পড়ে আলী ভাইয়ের সাথে পাশের জামে মসজিদে নামায পড়তে যাওয়া
-- নামায পড়ে মসজিদের হুজুরের তালিম শুনা ।
-- তার পরে "আলী ভাইয়ের কাছে কুরআন শরীফ পড়া
--৯ টা ৩০ মিনিট থেকে ১২ টা পর্যন্ত একটু ঘুম দেওয়া ।
-- ১২ টা থেকে গোসল ও ১ টার দিকে আলি ভাইয়ের সাথে নামাযে যাওয়া ।
--মসজিদে আবার একটু তালিম শুনা । তারপরে বাসায় এসে পড়তে বসা । আসরের আজান পর্যন্ত পাঠ্য বই পড়া ।
-- তারপর আবার আলী ভাইয়ের সাথে আছরের নামায পড়া ।
-- আছরের নামাযের পড়ে বাইরে হাটতে যাওয়া । আলী ভাই রিফাতকে দুনিয়া আল্লাহর কি সৃষ্টি তা নিয়ে গল্প করেন । অনেক সাইন্টেফিক গল্প করেন যা রিফাতের ভাল লাগে ।
তাই সময় কোন দিক দিকে চলে যায় তা রিফাত বুঝতেই পারে না ।
-- মাগরিবের আজানের আগেই মসজিদে যাওয়া । ইফতারীর থালা সাজাতে আলি ভাইকে সাহায্য করা ।
রিফাতের বাবা প্রতি মাসে এই মসজিদে হাজার হাজার টাকা অনুদান দিয়ে থাকেন । এই রমজানের সব ইফতার তিনিই করাবেন বলে জানিয়েছেন । রিফাতকে পাশে পেয়ে মসজিদের হুজুর ও খাদেম অনেক খুশি
-- মাগরিবের নামায শেষে বাসায় এসে পড়তে বসা ।
এই সময় কিছুক্ষন অংক করে মাথার জটিলতাকে দূর করার একটা প্রচেষ্টা মাত্র ।
-- রাত ৮ টা বেজে গেলে আলী ভাইয়ের সাথে এশার সালাত ও তারাবীহ পড়তে যাওয়া ।
তারাবীহ পড়ে বাসায় এসে একটু খেয়ে নেওয়া । এভাবে রুটিন করায় রিফাতের স্বাস্থ্য দিন দিন ভাল হতে থাকে । চিহারায় একটা সুন্দর ভাব চলে আসে । আলী ভাই বলেছেন " নামায পড়লে চিহারা সুন্দর হয় । হয় তো তাই আল্লাহর রহমতে সুন্দর হচ্ছে রিফাত "
মাত্র ১৫ টা রোযা যেতে না যেতেই রিফাত অনেক চেঞ্জ হয়ে যায় । ১ম রোজার দিন সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল । এখন আর হয় না । মেয়েদের ফোন আসলে রিসিভ করে না । বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে মন চায় না । সে শুধু আলী ভাইয়ের সাথে ইসলামিক আলোচনা করতে চায় । সাহাবীদের ইতিহাস শুন্তে চায় ।
২০ রোযা চলে । আজকে সেহেরীর পড়ে আলী ভাইকে আর দেখা গেল না । রিফাত তার রেগুলার কর্মকাণ্ড চালু রাখল । আলী ভাই নেই তাই রিফাতের কেমন জানি লাগল । আলি ভাইয়ের ফোন ও সুইচ অফ ।
রিফাতের আর ভাল লাগছে না । আলী ভাইয়ের উপর রিফাতের একটা মায়া পড়ে গেছে । এই মায়া ভালোবাসার মায়া । প্রতিটা মুমিনদের একে অপরের প্রতি এমন ভালবাসা থাকা উচিত...।।
দুপুরের শেষ দিকে আলী ভাই রুমে আসে ।
রিফাত আলী ভাইকে অনেক প্রশ্ন করে । কোথায় ছিলেন , কি প্রবলেম আরো অনেক প্রশ্ন । কিন্তু আলী ভাই কোন জবাব দেয় না । শুধু রিফাত কে নিয়ে বাইরে চলে যায় । একটা পার্কের গাছতলায় এসে বলে --
" রিফাত , তুমি অনেক বড় ছেলে । এই যে বড় বট গাছ দেখছ ? এই গাছের নিচে ছোট ছোট বট গাছ হচ্ছে । এই বড় গাছ মারা গেলে ছোট টা বড় হয়ে উঠবে । বড় টা মারা না গেলে ছোট টা বড় হতে পারে না । এই টাই আল্লাহর সৃষ্টি । আজকে তুমি সারা দিন রেগুলার রুটিন ফলো করেছ তাই না ? কাল থেকেও করবে কেমন ? আমি থাকব না কাল থেকে ? "
রিফাতের বুকের মাঝে একটা চিন চিন ব্যাথা করে । কেন জানি চোখের কোনে পানি জমে যায় । এই ভালবাসার কষ্টে মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারে না । শুধু বলে " কেন ভাইয়া ? " :/
আলী ভাই বলেন " বাড়িতে মা অসুস্থ । দেখতে যাব । ঈদ বাড়িতেই করব । অনেক দিন বাড়ি যাই না । ঈদ হচ্ছে আনন্দের মাস । আত্তীয় স্বজনদের সাথেই করতে হয় । তোমাদের আত্তিয় স্বজন নেই ?"
রিফাত বলে " আছে , দেশের বাড়িতে । আমাদের দেশের বাড়ি রাজশাহী । অনেক আগে গিয়ে ছিলাম । ছোট বেলায় । আমাদের আত্তিয়দের সাথে তেমন সম্পর্ক নেই " ...।।
আলী ভাই বলেন " তোমার বাবা হাজার হাজার টাকা গরীবদের দেন । অনেক ভাল কথা । কিন্তু ছেলে হিসেবে একটা কাজ তোমার করা উচিত । তোমার আব্বুকে বল , এমন কোন আত্তীয়কে তিনি চিনেন কি না যিনি মাসিক মাত্র ৩ হাজার টাকা বা তার নিচে ইনকাম করেন । তাকে ঈদের জণ্যে কিন্তু জামা কাপড় দেও । প্রত্যেক বড় লোক মানূষের কোন না কোন গরীব আত্তীয় থাকে । সবাই নিজ নিজ আত্তিয়কে দান করলে আল্লাহর ইবাদত ও আত্তিয় সম্পর্ক ২ টাই হয়ে যেত । "
রিফাত আলী ভাইকে জড়িয়ে ধরে । আর বলতে থাকে " ভাইয়া আপনি অনেক ভাল । আমি আপানার কথা মত চলব । আপনি আবার আসবেন । আমি আব্বুকে বুঝিয়ে বলব এই বিষয়ে । ফোনে কথা হবে । আমি এখন বড় হয়েছি। আর পাপ করব না । ভাল হয়ে সুন্দর ও পবিত্র রাস্তায় চলব
আলী ভাইয়ের চোখের কোনে একটু অশ্রু এসে গেল । তিনি মুখ দিয়ে বলে ফেলেলন - সুবহানাল্লাহ । আল্লাহ তুমি সাক্ষী থেকো এই দিনের । এই সুন্দর মুহূর্তের ।
আসুন আমরা ও রমজানের এই মাস কে সুন্দর ও পবিত্রতার কাজে ব্যাবহার করি । আত্তীয় ও পরিবারের সাথে সুন্দর ভাবে ঈদ পালন করি । রমজান মাসের সংযম, শুদ্ধতা, পরিচ্ছন্নতা ও সহমর্মিতায় আমরা সবাই যেন নিবিষ্ট থাকি । সেই দোয়াই করি । আমীন ...।