হিমাদ্রি শেখর
মরা গাউনি কালো কালো গুটি,ট্যাংতলা,হাততলা আর্সোনিক রোগ হইছি। ধুরিলে জ্বলে চুলকায়,পানি পড়ে,কামকাজ করি বোক না পায়। গরীব মান চিকিৎসা করিবেক না পায়। ট্যাকা পুইসা নাই ডাক্তরত নাই। চিকিৎসা করিবেক না পায় ধুক ধুক মরিসে। এভাবে আধো বাংলা ভাষায় সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের বহেরাতলি গ্রামের মৃত ভহবান চন্দ্র বানাইয়ের ছেলে জহরলাল বানাই (৪৫) আর্সেনিকোসিস রোগের যন্ত্রনার কথা বলছিলেন। বানাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের ২০টি পরিবারের ৭০/৮০ জন লোক বসবাস করেন। তাদের মধ্যে ১৪ জনই আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। গত ৪ ফেব্রুয়ারি লীলি বানাই (৭) ও পুলি বানাই(৫) বছরের ২ মেয়ের জনক ধরেশ বানাই আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলেন দাবি করেন নিহতের স্ত্রী বিনা রানি বানাই।
এছাড়া আক্রান্ত হয়েছেন দিলীপ বানাই(৩০),পবিত্র বানাই(৩৫),কেমনাথ বানাই(৬০),জহরলাল বানাই(৪৫),অহেন্দ্র বানাই(২৬),কল্পনা বানাই(২৮),মালন্তি বানাই(৪৩),শাপনা বানাই(৩৮),জাগরন বানাই(২২),রুবিলা বানাই(৩২),সুরোজনি বানাই(৪৪),বিনয় বানাই(৩১),কুঞ্জিলা বানাই(৪২),আলআমিন(২৭) এছাড়া সাউদপাড়া গ্রামের,নিজাম উদ্দিন(৩০), জসীম উদ্দিন(৩০),জমিলা খাতুন(৫০) ও মহেশখলা বাজরের সুকুমার চন্দ্র কর্মকার(৫০)। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কুলঘেষা জনপথ বহেরাতলী গ্রামের ২০টি আদিবাসী পরিবারের মধ্যে আনুমানিক শিশু ২৫ জন.২০মহিলা,পুরুষ ৩০ জন পুরুষ বসবাস করেন। সুনামগঞ্জ সীমান্ত সড়কের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বহেরাতলী। গ্রামে আরশাদ মিয়া,লিপ্টন বানাই,নাজির মিয়া,শরীফুল ইসলাম,ইসমাইল মিয়া বাড়িতে একটি করে ব্যাক্তি মালিকানাধীন টিউবওয়ের রয়েছে। আক্রান্তদের বেশীর ভাগ হতদরিদ্র ও সচতেন শ্রেণীর লোকজন। তাই তারা এর ভয়াবহতা সম্পর্কে এতোটা সচেতন নন। দরিদ্রতার কারণে তারা সুচিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। ইউনিয়নের সাবেক স্থাস্থ্যকর্মী সুরঞ্জন সরকার বর্তমানে দক্ষিন বংশীকুন্ডা ইউনিয়নে কর্মরত তিনি জানান, র্ধমাপাশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স্রে তৎকালীন সময়ে কর্মরত ডাঃ অনির্বান সরকার শাওন বহেরাতলি গ্রামের ১২ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ছিলেন। তারা সবাই আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলো।
কল্পনা বানাই বলেন, হাত ও পায়ের তালুতে গুটিগুটি কালো দাগ(আচিল) হইছে। হাত ওপায়ের তলা জ্বালাপোড়া করে। তাদের সম্প্রদায়ের অনেক লোক এ রোগে ভোগছে। কালো বিচিতে পানি পড়লে জ্বালা পুড়া আও বেড়ে যায়। মালন্তি বানাই(৪৩) বলেন. কয়েক বছর আগে থেকে শরীরে কালো দাগ দেখা গেছে। প্রথমে এতো জ্বালা যন্ত্রনা করেনি। এখন বেশী কষ্ট পাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করিয়ে নিয়েছেন কোন কাজ হয়নি। সুর্যমনি বানাই(৩৯) বলেন, গরীব মানুষ আমরা কাজ করলে খাবার না করলে উপোস থাকতে হয় চিকিৎসা করাবো কিভাবে। দিলীপ বানাই(৩০) বলেন, অনেক বছর আগে তাদের শরীরে কালো গুটিগুটি দাগ (আচিল) দেখা দিয়েছে তখন বুঝতে পারেননি এগুলো আর্সেনিকে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষন। এখন স্থানীয় এনজিও কর্মীরা ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করারনোর পর বুঝেছেন এগুলো আর্সেনিকোসিস। রুবিলা বানাই(৩২) বলেন, শরীরের কালো দাগে সাবানের ফেঁনার পানি পড়লে চামরার ভেতরের মাংস বেরিয়ে আসে। শরীরে সাবান ব্যবহার করতে পারেন না। পবিত্র বানাই(৩৫) বলেন, তাদের গ্রামে আসের্নিক মুক্ত নলকুপ নেই। তাই পুরো গ্রামবাসী আর্সেনিক যুক্ত পানি ঘর গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার করছেন। প্রতিবছর ফাল্গুন চৈত্রমাসে পানির সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বিষাক্ত পানির ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। পুঞ্জিলা বানাই (৪০) বলেন, ঘর গৃহস্থালীর কাজ করতে খুব কষ্ট পেতে হয়। কারন শরীরে রগুটিতে খুচা লাগলে ব্যাথা বেড়ে যায় আর কাজ করা যায় না। ডাক্তারের কাছে গেলে কিছু আয়রন ট্যাবলেট আর সবজি খাওয়ার কথা বলে কিন্তু আমাদের সেই সামর্থও নেই। আমরা তিলে তিলে মরতেছি।
সাউদপাড়া গ্রামের আক্রান্ত রোগী জসীম উদ্দিন জানান, তাদের এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীর পদধুলি খুব কম কমে। যদিও মাঝেমধ্যে যান স্থানীয় মহেশখলা বাজারে দেখভারো করে তার দায়িত্ব শেষ করেন। ধর্মপাশা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুর রব সরকার বলেন,ম উপজেলার সেলবরস,পাইকুরাটি ও উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের ভু গর্ভস্থ পানির স্তরে ৪০০ থেকে ৫০০ পিপিবি(পার পার্স বিলিয়ন) মাত্রায় আর্সেনিক ও বিপদজনক মাত্রায় আয়রণ রয়েছে। জুরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আর্সেনিকোসিস এর মহামারী দেখা দিতে পারে। এসব এলাকায় সরকারী ভাবে পানিশোধনাগার স্থানপন করে সীমিত সংখ্যক এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা যেতে পারে। উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক সুদীপ কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, এলাকাটি দূর্গম তাই সেভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এতোদিন কোন খোজ খবর নিতে পারেনি তিনি। ৬/৭ মাস আগে বহেরাতলি গ্রামে ৭/৮ জন আর্সেনিকোসিস রোগীর সন্ধান পেয়েছিলেন। এখনকার অবস্থা তিনি জানেন না। তবে আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত হয়ে একজন মারা যাওয়ার কথা তিনি শুনেছেন। উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের চেয়াম্যান মোঃ জামাল হোসেন বলেন, তিনি সরাসরি আর্সেনিকের বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানান নি। তবে বিভিন্ন মিটিংয়ে আলাপ আলোচানা হয় এসব কথা তিনি শুনেছেন। ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ বাবুল মিয়া বলেন, এরার শইল ফুট খাজলি হইছে আর্সেনিক হইছে না। বেসরাকরী সংস্থা এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নে কর্মরত ফিল্ড ফেসিলেটেটর মোঃ মোস্তফা কামাল বলেন, উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নে আর্সেনিক ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। ভুগর্ভস্থ পানির স্তরে বিপদজনক মাত্রায় আর্সেনিক ও আয়রনের উপস্থিতি রয়েছে। মানব দেহে এ রোগের লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় বলে কেউ এখন বুঝতে পারছেন না। বেসরকারী সংস্থা এশিয়া আর্সেনিকক নেটওয়ার্কের ধর্মপাশা উপজেলার প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল মাজেদ, উপজেলার আশিভাগ অগভীর নলকুপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও আয়রনের উপস্থিতি রয়েছে। তাদের মধ্যে বিপদজনক মাত্রায় আর্সেনিক ও আয়রন রয়েছে উত্তর বংশীকুন্ডা ও পাইকুরাটি,সেলবরষ,সুখাইড় রাজাপার উত্তর ও দক্ষিন ইউনিয়ন। সিভিল সার্জন ডাঃ নিশিত নন্দী মজুমদার বলেন, আক্রান্ত এলাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের টিম পাঠানো হবে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে সমস্যা নিরসনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। বিষটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে। দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোঃ টিটু মিয়া বলেন, মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করলে মানবদেহে ক্যানসার জাতীয় বিভিন্ন রোগ হতে পারে। আর্সেনিক এক প্রকার বিষ । বিষের প্রভাবে মানবদেহে রোগ দেখা দেবে। শরীরে আর্সেনিকোসিস রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে কমপক্ষে ১৫ থেকে বিশ বছর সময় লাগে। রোগী সনাক্তের উপায় হল হাত ও পায়ের তালুতে গোটা গোটা দাগ হয়, চোখ লাল হয়ে যায়, শরীল খসখসে হয়ে যায়। এমন হলে ডা. সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রচুর পরিমান সবজি ও ফলমুল খেলে এই রোগ হয় না। তাই তিনি সবজি খাওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। আর্সেনিক কোন ছুঁয়াছে রোগ বা বংশগত রোগ নয়, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে রোগী ভাল হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এর মতে, প্রতি লিটার পানিতে .০১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক সহনীয়। অর্থাৎ এর বেশি হলে ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আর আর্সেনিকের মাত্রা যদি প্রতি লিটারে .০৫ মিলিগ্রাম হয় তাহলে তা পান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় আর্সেনিক পাওয়া যায় খুবই অল্প। বেশিরভাগই থাকে যৌগ হিসাবে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের মধ্যে।স্থানীয় ভাবে একটি বেসরকারী সংস্থা আর্সেনিক সমস্যা নিরসনে কাজ করলেও তা যৎ সামান্য বলে জানান এলাকাবাসী।