আজ একজন সার্জনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, মেডিসিন পড়তে চাই সেই সুবাদে কিছু প্রয়োজনীয় আলোচনার জন্য। লন্ডনে ধর্ম নিয়ে সাধারণত মানুষ কোনো কথা সরাসরি বলে নাহ, কেননা ধরা হয় এতে মানুষের ‘personal viewpoint’ কে আঘাত করা হচ্ছে। তাই উনি কথা শেষে একটু ইতস্তত করে আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, আসলে বলা উচিত হবে নাকি বুঝতে পারছি না, ... কিছু মনে কোরো না, তোমার ইন্টারভিউতে কি তুমি এই পোশাক পরে যাবে?’ এই বলে উনি যে আমার বোরকার দিকে ইঙ্গিত করলেন বুঝতে বাকি রইল না। বোরকার বিষয়ে কথা উঠবে এটা নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। উনাকে সাহস দিয়ে বললাম, ‘স্যার যদি কিছু বলার থাকে, তাহলে better হয় আপনি আমাকে এখনি বলেন কারণ আমি জানি আমাকে একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ত আবারো হতে হবে। তাই আপনি কিছু বললে আমি mind করব না’।
এই সার্জনের সাথে আমি আগেও একবার কাজ করেছি, এবং উনার নাম থেকে মনে হয় উনি হিন্দু। উনি বললেন, ‘দেখো, তোমার ইন্টারভিউ এর দিন বোরকা না পরে যদি সম্ভব হয়, তাহলে তাই করো। ব্যাপারটা তো শুধু ঠিকভাবে শরীর ঢাকা নিয়ে কথা। তাই তুমি হয়ত long skirt and tops পরার কথা ভাবতে পার। মানুষ তো কতোভাবেই শরীর ঢাকতে পারে, তাইনা? কেননা যারা তোমার ইন্টারভিউ নিবে বলা যায় না, তারা কিছু মনে করতে পারে, যদিও মনে করা উচিত না। নাকি তুমি সবসময় ই এই পোশাক পর? আর এটা ছাড়া একদিনও অন্য কিছু পরবে না?’
উনার মন্তব্য শুনেই আমার মাথার মধ্যে অজস্র কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। থামতেই একটু সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘স্যার, ব্যাপারটা আসলে শুধু শরীর ঢাকা নিয়ে নয়। আমি বিশ্বাস করি একজন সৃষ্টিকর্তায়। আর তার ইচ্ছাতেই আমি এই পোশাক পরি। তাই আমার কাছে এটা একটা ইবাদতের কাজ’ তবে আমি কথা বলে শেষ করতে পারলাম নাহ। আমার একথা শুনেই মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে উনি আমাকে প্রায় আধ-ঘণ্টার একটা লেকচার দিলেন, যার সারাংশ হলঃ
তার মতে 'বোরকা পরা male dominated চিন্তাভাবনার ফল', তার ভাষাতেই লিখছি, “শোনো মেয়েদেরকে দেখা হয় হচ্ছে সম্পত্তি হিসেবে, বহুদিন আগে প্রিস্টরা এসব তৈরি করেছে মেয়েদেরকে তাদের হাতের মুঠোয় রাখার জন্য।
উনার কথার মাঝে আমি বেশ কয়েকবার কথা বলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালাম, কারণ আমি মুখ খুললেই উনি বলছিলেন, ‘থামো-থামো’ এবং নিজের কথাই বলে চলছিলেন। কয়েকবার হাত তুলেও কাজ হল না! তাই একমাত্র তার মনের কথা ধৈর্য্য সহকারে শোনা ছাড়া কোন উপায় নেই!
তবে মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা অসাধারণ। এইসব অভিযোগ গুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি মনে মনে কিছু উত্তর দিচ্ছিলাম..।
[‘male যদি dominate করবেই তাহলে বোরকা দিয়ে কেন করবে? ওরা তো মিনি স্কার্ট দিয়ে করবে, coz তাহলেই ওদের বেশি সুবিধা...বোরকা পরা দেখে bore কেন হবে?!!’]
উনি বলে চলেছেন, ‘পুরুষেরা ভাবে, “এই বাড়ি আমার, এই দাসদাসী আমার, এই স্ত্রীগুলো আমার, এই জন্তুগুলো আমার” এভাবেই নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা চায়, তাদের বউকে যেন অন্য কেউ না দেখে, তাই তারা নারীদেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে।’
[ওহ আচ্ছা! তাহলে নিজের বউকে পুরা সমাজের সামনে exhibit করাটা কি খুব ভাল কথা?]
আমার কাছে মনে হয় বোরকা নিতান্তই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা কৌশল। এখানে মেয়েদের কোন ‘say’ নাই।
[আমাকে এখনও অতি ধৈর্য্যের সাথে চুপ করে শুনতে হচ্ছিল, মনে মনে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখনকার সমাজে মেয়েরা যে পোশাক পরে তা কোত্থেকে আসছে? যখন একজন নারীর প্রতিটা অঙ্গের আকার ফুটিয়ে তোলা হয়? এটাতে কি খুব ‘say’ আছে মেয়েদের?]
এদিকে মহান নারীবিদের মত সেই সার্জন প্রায় অভিনয় করে করে বলে চলছেন, ‘...কোন মেয়ে কি চাবে নাকি যে তার পুরা মুখ ঢাকা থাকুক যেন সে অন্ধের মত পুরা পৃথিবী দেখতে না পাক?’
[আমার simply বলতে ইচ্ছা করল, ‘নিকাব পরলে সবই দেখা যায়, চোখ অন্ধ হয়ে যায় নাহ’ তবে সুযোগ দেয়া হল না।]
‘আমার কাছে তো মনে হয় পুরুষেরা এক্ষেত্রে অনেক সুযোগ নিচ্ছে। নারীরা এসব করে পুরুষদের কথা মান্য করে..।’
[নারীদেরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো হয়!]
‘... হ্যাঁ হতে পারে আগেকার দিনে হয়ত এটা নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হত, যেমন ধরো মরুভূমির মধ্যে, কোন মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, যখন তখন কেউ ঘোঁড়া ছুটিয়ে এসে মেয়েটাকে তুলে নিতে পারে, অথচ বোরকা পরা থাকলে তো আর বুঝতে পারবে না সে দেখেতে কেমন, তরুণী সুন্দরি, নাকি বয়স্ক মহিলা। তাই বোরকা পরে হয়ত সেই সমাজে সুবিধা ছিল।
[নিরাপত্তা মোটেও হিজাবের কারণ নয়। নিরাপত্তা লাভের আশায় আমরা বোরকা পরি না, কারণ তার অর্থ এটা বলা যে, যদি বোরকা পরিহিত অবস্থায় কেউ ধর্ষিত হয়, তাহলে বোরকা তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ, সুতরাং পরার কোন মানে নেই। বোরকা কেন পরি এটা না জেনেই এতো অনুমান...!]
‘...দুনিয়ার সব বড় বড় ধর্মেই তো চুরি করা খারাপ, খারাপ ব্যবহার, হত্যা এইসব নিষেধ করা হয়েছে; কিন্তু যারা ধর্ম প্রচার করেছে, তারাই মূলত নিজেদের ইচ্ছামত তখনকার সময়ের জন্য এইসব নিয়ম বানিয়েছে, বুঝলে...।
[আসতাগফিরুলাহ, ইতিহাস ঠিকভাবে জানলে আপনি এইকথা বলতেন না, প্রিস্ট আর ইসলাম ধর্মের মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি অয়াসাল্লাম) কে একই কাতারে বিচার করে ক্রিশ্চিয়ান আর ইসলামের জগাখিঁচুড়ি কাহিনী আসলে অজ্ঞতার-ই পরিচয় দেয়]
উনি অবশেষে পয়েন্টে আসলেন, ‘আমি অবশ্য ‘disbeliever’ ... কোনো God-এ বিশ্বাস করি না। এসব হল অন্ধ অনুকরণ।’
[‘God যদি নাই-ই থাকে, তবে how did everything come into existence?’ এই basic প্রশ্নটা করার অনেক ইচ্ছা হল। তবে কথা বলার অনুমতি নাই]
তার শেষ উপদেশ, ‘যা হোক কোন western dress পরতে পার ঐ দিনের জন্য। এই বলে তিনি ইতি টানলেন।’
[আর আমি ভাবছি, এতো shallow mentality যে ড্রেস দিয়ে একজনকে বিবেচনা করবে?]
(এখানে আমি একই কথার পুনরাবৃত্তি গুলো বাদ দিয়ে লিখলাম। উনি নিজের পয়েন্টগুলো জোরালো করতে যেয়ে একই কথা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বার বার বলছিলেন)
উনার কথা শেষ হতেই যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া দেখে আমি বললাম, আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনার কথা শুনছি, এবং অবশ্যই এই ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে পেরে ভাল লাগল, তবে আমারও কিছু বলার আছে। একজন কেন বোরকা পরে সেটা হয়ত আমার থেকে আপনি শুনতে পারেন, যেহেতু আমি বোরকা পরি।
উনি আমাকে আবারো থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাকে যেতে হবে। যেতে হবে আমাকেও! এতো কথা শুনতে যেয়ে আমার মাগরিব না চলে যায়! দ্রুতভাবে বললাম, ‘স্যার আমরা নিজেদের ব্রেইন ইউজ করে চিন্তা ভাবনা করেই এটা করছি। তবে হ্যাঁ আজ আপনার সময় না থাকলেও আমি আপনাকে আমার মতামত জানাতে চাই। এবং এজন্য আপনার সাথে একদিন নিশ্চয়ই দেখা করব।’
উনি প্রায় ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘আচ্ছা! আচ্ছা! ব্রেইন ইউজ করলে তো ভাল কথা!’ এই বলে দ্রুত আমাকে ‘Best of luck’ বলে বিদায় করলেন, বললেন, ‘তোমার রেজাল্ট কি হয় জানিও’ আমিও বললাম ‘জ্বি জানাব, আর ডিসকাশনটা বাকি থাকল’। [মনে মনে ভাবলাম, বাহ! আমার ব্রেইন আছে নাকি মনে হচ্ছে সেটা নিয়েও তার সন্দেহ আছে!]
আজ সময় ও সুযোগের অভাবে অনেককিছু বলতে পারলাম না। ইন শা আল্লাহ সে সুযোগ একদিন আসবে।
বাসায় এসে মা জানতে চাইলে বললাম, আমাকে বলেছিল অন্য কোন ড্রেস পরলে ভাল হয়। মেডিসিনে পরার আমার নিজের যতটা না ইচ্ছা তার চেয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন আমার মা বুনেছেন মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে। বিষয়টা আমাদের পরিবারের কাছে কতখানি মূল্যবান তা প্রকাশ করা কষ্টকর! যেকোন মূল্যে তাই আমার টিকতে হবে। এমুহূর্তে ছোটবড় কোনকিছু নিয়েই risk নেয়া যায় না। মা কিছুটা বেহাল হয়ে প্রশ্ন করলেন, পরবা নাকি লং স্কার্ট তাহলে একদিনের জন্য? আমলাহদুলিল্লাহ আমার মা নিজেও হিজাবি, এবং খুব সুন্দরভাবে বুঝেন কেন হিজাব করতে হয়। তাও মায়ের মন তো, সন্তানের জন্য অনেক চিন্তা! আমি মাকে আশা দিয়ে বললাম, ‘মা আমি আজ যে ইন্টারভিউতে চান্স পেয়েছি এটাই তো আল্লাহর অশেষ রহমত! কি করে আমি আল্লাহর আদেশ উপেক্ষা করতে পারি? চান্স পাই, না পাই, ওরা যদি আমাকে বের-ও করে দেয় আমি বোরকা পরেই যাব। যাবই। দ্বীন নিয়ে একফোটা compromise করব না, এরপর যা হবে তা আল্লাহর হাতে।
মা সাহস ফিরে পেলেন। গভীরভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ মা, আসলেই, আল্লাহ ভরসা’
আজ আমার বোনদেরকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। (including my friends)
আপুরা, তোমরা কি জানো? পৃথিবীর কতো স্থানে মুসলিম বোনেরা পর্দা করতে পারছেনা? ঠিকভাবে হিজাব করার জন্য তাদেরকে ক্রমাগত লড়াই করতে হয়। আর তোমরা, কি তোমাদেরকে ভুলিয়ে রাখে? কি তোমাদেরকে বাধা দেয়?
যেই ফ্রেন্ডের জন্য তুমি হিজাব করো না। তার কাছে কি তোমার মতের মূল্য বেশি? নাকি তোমার সৌন্দর্য্যের?
তুমি কারো অমতে গেলেই যদি সে তোমাকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সে কি তোমাকে সত্যিই ভালবাসে?
তুমি কি জানো না তুমি এসেছ আল্লাহর কাছ থেকে? কি তোমাকে বাধা দিচ্ছে? চিন্তা করো। তুমি জানো এর উত্তর কি...।
তুমি তো জানো, ‘ভাল কাজ করতে ইচ্ছা করেনা’ এই মনোভাব আসে শয়তানের থেকে, কেন তুমি তাহলে শয়তানকে ছাড় দিচ্ছ?
তোমার সৌন্দর্য কি এলাকার সবার দেখার বস্তু? নাকি শুধু স্বামীর জন্য? যদি তাই হয় তবে কেন বিয়ের আগেই যার-তার সাথে প্রেম করে তাকে দেখাতে হবে?
আপু, আল্লাহ তোমার পরীক্ষা নেয়- আকাঙ্ক্ষা দিয়ে, কষ্ট দিয়ে, দুর্বলতা দিয়ে। আর সেই পরীক্ষায় জিততে হয় ধৈর্য্য ধারণ করে।
তোমার মাঝে কি এতোটুকু ধৈর্য্যের অভাব যে তুমি তোমার এই অনুভূতিগুলোকে দমন করতে পারছ না?
আপু, তোমার জীবনের উদ্দেশ্য টা কি? এটা কি শুধুই কিছু মানুষকে বিমোহিত করা? নাকি আল্লাহকে খুশি করা? আল্লাহ বলেছেন, "সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখেনি? আমি কি তাকে দেইনি চক্ষুদ্বয়, জিহবা ও ওষ্ঠদ্বয়? বস্তুতঃ আমি তাকে দু’টি পথ প্রদর্শন করেছি। অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি।" (বঙ্গানুবাদ সুরাহ বালাদ: ৭ - ১১)
কিছুদিন আগে কলেজ পড়ুয়া এক অল্প বয়সের বোন মারা গেছে। ক্যন্সারে। মৃত্যু যখন-তখন আসে। আল্লাহর উপর বিশ্বাস করে তার আদেশ নিষেধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বোকামি। হয়ত যখন বুঝতে পারব আমরা, অনেক দেরি হয়ে যাবে। এখনো সময় আছে। সতর্ক হওয়ার।
আমরা যদি ইসলাম সম্পর্কে এখনই সতর্ক না হই, তাহলে আমার আর সেই নাস্তিক সার্জনের মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য থাকল নাহ। কেননা সে ভাবে যে সে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে পারবে। আর আমরাও তেমন আল্লাহকে মেনে নিয়েও ভাবি, আমাদের নিজেদের খেয়াল খুশিমত চলতে পারব।
নিজেকে ‘অমুসলিম’ ‘কাফির’ হিসেবে আমরা কেউ-ই ভাবতে চাই না। শেষ পর্যন্ত মুসলিম হিসেবেই পরিচয় দিতে চাই। তাহলে কেন এই মিথ্যা লুকোচুরি খেলা? আল্লাহর কথা না ভেবে, কোথা থেকে এসেছি, এ জীবনের শেষে কোথায় ফিরে যাব, সেসব না চিন্তা করে আমরা আসলে কাকে ফাঁকি দিচ্ছি?
আপুদেরকে শেষ প্রশ্ন, তোমরা কি চাও জীবনে? কি এই জীবনের আসল উদ্দেশ্য? তোমরা কি চাও না, জীবনটা নিয়ে আরেকটু ‘serious’ হতে? সারাদিনের ব্যস্ততায় জীবনের পরম ‘সত্য’ কি ভুলে যাবে? আর তা ঠিকভাবে জানার কোন চেষ্টা করবে না?
এখনো দেরি হয়নি। আমি নিজেও এই ধাপগুলো পার করেছি। আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে অনেক সন্তুষ্ট আলহামদুলিল্লাহ! আমার জীবনে এখনও ‘fun’ আছে, ‘friendship’-ও আছে। Truth does not make you robot. It gives you another chance to live your life as a better human.
Collected From
Sister
Jîhäd Príncess Tuba
.