somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিডনি রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার !

৩১ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কিডনি রোগ বা অন্য কোন রোগে কিডনি আক্রান্ত হওয়ার ফলে এর কার্যকারিতা তিন মাস বা ততোধিক সময় পর্যন্ত লোপ পেলে, তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বলা হয়। ক্রনিক নেফ্রাইটিস কিডনির ফিল্টারকে (ছাঁকনি) আক্রমণ করে ক্রমান্বয়ে কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলতে পারে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপও কিডনির ফিল্টার ধ্বংস করতে পারে। আবার কারও যদি জন্মগতভাবে কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে, অথবা কিডনির আকার ছোট বা বেশি বড় থাকে, তাহলেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।
মানুষ জন্মগ্রহণ করার ছয় সপ্তাহের মধ্যেই কিডনির ফিল্টার মেমব্রেন পুরোপুরি তৈরি হয়ে যায়। ফলে কিডনি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০-১২ লাখ ফিল্টার রয়েছে, প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে। এই পরিশোধিত রক্তের মধ্য থেকে এক থেকে তিন লিটার শরীরের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়া হয়। কোন কারণে যদি এ ধরনের ফিল্টার বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামের জৈব পদার্থ পরিমাপ করা হয়, যার মাধ্যমে কিডনি কতটুকু কাজ করছে তা বোঝা যায়।

দুঃখজনক বিষয় হলো- এই জৈব পদার্থটি কিডনির ৫০ শতাংশ কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার পরই শরীরে বাড়তে পারে। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম এবং একজন মহিলার শরীরে ১ দশমিক ৩ মিলিগ্রাম স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। যদি শরীরে এর থেকে অধিক মাত্রায় ক্রিয়েটিনিন তিন মাস বা ততোধিককাল স্থায়ী থাকে, তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীর কোন উপসর্গ বোঝা যায় না। ফলে বছরের পর বছর তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা প্রয়োজন। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে বমি-বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা, রক্তস্বল্পতা, শরীরে পানি জমা, শ্বাসকষ্ট এবং প্রস্রাবের পরিমাণে তারতম্য, চর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো হওয়ার ফলে এসব উপসর্গ ছাড়াও আমাদের শরীরে অনেক জটিলতা দেখা দেয়। তার মধ্যে প্রধান হলো হৃৎপি-ের রোগ। দেশে ৮০ শতাংশ কিডনি রোগী এই উপসর্গগুলো নিয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় এবং রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় কিডনির অন্তত ৮০ ভাগ কার্যকারিতাই তখন নষ্ট হয়ে গেছে।

কিডনির কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পেলে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। এক সময় রোগী মত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ নিরূপণ করা যায়, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগগুলোকে আংশিক বা পরিপূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হয়।
সুতরাং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ থেকে বাঁচতে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরী। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার। শুধু সচেতনতার মাধ্যমেই একজন রোগীর কিডনিতে সমস্যা আছে কি-না, তা জানা সম্ভব। যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রস্রাবে এ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কি-না এবং ডায়াবেটিস আছে কি-না, তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে, তার বছরে অন্তত একবার প্রস্রাবের সঙ্গে এ্যালবুমিন বা মাইক্রো এ্যালবুমিন যাচ্ছে কি-না এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক কি-না, তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

দেশে এক কোটি ৮০ লাখ কিডনি রোগী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে কিডনি ফাউন্ডেশন ও বিএসএমএমইউয়ের উদ্যোগে সাভারের চাকুলিয়া গ্রামে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের ওপর তিন বছর ধরে গবেষণা চালানো হচ্ছে। তিন হাজার প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওপর চালানো গবেষণার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশের রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে ১৫ হাজার ৬২৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওপর গবেষণা সমীক্ষায় দেখা যায়, এদের ১১ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। অস্ট্রেলিয়ায় এই সংখ্যা ১৬ শতাংশ এবং আইসল্যান্ডে ১০ শতাংশ।
বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে মারা যায়। কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ হিসেবে নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। নেফ্রাইটিস রোগের প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন, ভাইরাল হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ মেশানো ও ভেজাল, ক্রনিক ইন্টারস্টেশিয়াল নেফ্রাইটিসকে এর কারণ হিসেবে দায়ী করা যেতে পারে। এমনকি পানিতে অধিক পরিমাণে আর্সেনিক কিডনি রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। মার্কারি, লেড, গোল্ড ও অন্যান্য ধাতব পদার্থ কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।

কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে শুধু ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন প্রয়োজন হয়। বর্তমানে বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী পাঁচ থেকে ১৫ বছর এবং সফল কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। পৃথিবীতে নিয়মিত হেমোডায়ালাইসিসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত রোগী বেঁচে আছে এবং সফল কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৩ বছর বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে তিনবার চার ঘণ্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা বোঝায়। নিকটাত্মীয়ের কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপনকে কিডনি সংযোজন বোঝায়। অবশ্য উন্নত বিশ্বে মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ের চলমান গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর মধ্যে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশরই উচ্চরক্তচাপ, পাঁচ শতাংশ ডায়াবেটিস এবং ছয় শতাংশের প্রস্রবের সঙ্গে প্রোটিন নির্গত হয়। উল্লিখিত পাঁচ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর ৩০ শতাংশ এবং ১৮ শতাংশ উচ্চরক্তচাপের ১৫ শতাংশ এবং প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন নির্গত হওয়া ছয় শতাংশ রোগীর সবাই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। ওই সমীক্ষায় রোগীদের প্রশ্ন রাখা হয়েছিলÑ তাঁরা ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হওয়া সম্পর্কে জানে কি-না। শতকরা ৬০ শতাংশ রোগী জানেই না যে, তাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ অথবা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়নি। সুতরাং এই রোগীরাই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে ভোগে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের কিডনি সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়। এই রোগীদেরই শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মাইক্রো-এ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া এবং চর্বি জাতীয় খাবারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেয়ে বা ধূমপান পরিহার করে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হৃদরোগ থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। কিডনি রোগীদের সচেতন করে তোলা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে লাখ লাখ কিডনি রোগীর কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কিডনি অকেজো রোগীরা ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের বিশাল খরচ থেকেও পাবে মুক্তি ।

(সংগৃহীত)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×