আমার এক ছোটভাই সম্প্রতি একটি ভয়াবহ লেখা লিখেছে। লেখার শিরোনাম-
‘যে কারনে আমি ডাক্তারের কাছে যেতে চাইনা’
সেই ছোটভাইটি আমার কাছের মানুষ, এদিকে আমি পেশায় চিকিৎসক। সে যদি ঢালাওভাবে চিকিৎসকদের থেকে দূরে থাকে তাহলে আমার জন্য ব্যাপারটা অত্যন্ত বেদনার হবে। আমি লেখার ভেতরে ঢুকলাম, সেখানে ‘যেসব কারনে’ তার মতো সম্ভাবনাময় তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী ডাক্তারবিমুখ হয়ে পড়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করলাম। আমার ধারণা, ওর বক্তব্য ও আমার বিশ্লেষণ কারো কোন কাজে আসবে না। তবুও আমাদের দৃষ্টিতে যা আমরা দেখেছি তা নিয়ে কথা বলতেই হবে, অন্যথায় সত্য জানা যাবে না। আর সত্য না জানলে আমরা চারপাশের জগতের কিছুই বদলাতে পারব না। তো দেখা যাক সে কী লিখেছে-
‘শরীরে রোগ পুষে রাখার পরও আমি সাধারণত ডাক্তারের কাছে যেতে চাইনা। প্রথমতঃ যেসব ডাক্তারের কাছে যাই তারা পৃথিবীর অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। এবং ব্যস্ততার চেয়ে রোগী রোগ বর্ননা শেষ করবার আগেই ডাক্তার ওষুধ লিখতে শুরু করেন। ফলে সেই ওষুধ কতটা কার্যকরী তা প্রশ্ন থেকে যায়’।
ওর প্রথম লাইনেই পরের লাইনগুলোর উত্তর দেয়া আছে। ও যদি এমন চিকিৎসকের কাছে যায় যিনি দিনে ৫০-১০০ রোগী দেখেন, অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই তিনি রোগীপ্রতি বেশি সময় দিতে পারবেন না। কারন সবার জন্যই দিন ২৪ ঘণ্টার, তিনি ট্রাম্প, ডাক্তার কিংবা মুচি- যাই হন না কেন। এমন ব্যস্ত চিকিৎসকদের মাঝে ‘প্রধান উপসর্গ’ শুনেই রোগ ধরার প্রবণতা দেখা যায়, এবং তারা তদানুযায়ী চিকিৎসা দেন। ফলে চিকিৎসার মান স্বাভাবিক থাকে না। আমার সেই বিজ্ঞানী ভাইটি তো বটেই, যেকোন সচেতন রোগীর পক্ষে এই ‘গুরুত্বহীনতা’ মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
তাহলে সমাধান কী?
আপাত দৃষ্টিতে চিকিৎসক নির্বাচনে জোর দেয়া যেতে পারে। সম-যোগ্যতার সব চিকিৎসকের কাছে রোগীর ভিড় এক রকম থাকে না। যিনি অল্প রোগী দেখেন, তার কাছে গেলে সময় বেশি পাওয়া যাবে। যেকোনো রোগের চিকিৎসায় শুরুতে জেনারেল প্রাকটিশনারের কাছে যাওয়া চিকিৎসাবিদ্যায় একটি স্বাভাবিক নিয়ম, তিনি রোগ ধরতে না পারলে সিনিয়রের কাছে রেফার করবেন। বাংলাদেশে এই নিয়মের চূড়ান্ত ব্যত্যয় দেখা যায়, অধিকাংশ রোগী সরাসরি অধ্যাপকের কাছে যেতে চান, এবং অধিকাংশ অধ্যাপক সাহেবরাও হাসিমুখে চিকিৎসা দেন, যেটা কম ব্যস্ত জুনিয়র চিকিৎসক বেশি সময় ও যত্ন সহকারে দিতে পারতেন। এই সমস্যার সমাধানে রোগী ও চিকিৎসক উভয়েরই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন, সঙ্গে রোগী দেখার বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসঙ্গত নীতিমালাও প্রয়োজন।
এরপর সে আরও লিখেছে-
‘দ্বিতীয়তঃ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে কোন যোগসাজশ আছে কিনা জানিনা, নানাবিধ টেস্টের একটা ফর্দ ধরিয়ে দেন এবং সুপারিশ করেন অমুক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে যেন টেস্ট গুলো করানো হয়। স্বভাবতই একই মানের একই টেস্ট এর মূল্য অত্যন্ত বেশি হয় ওই ডাক্তারের সুপারিশকৃত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে’।
এই অভিযোগটি আমার কাছেও সত্য বলে মনে হত, বিশেষত নটর ডেম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে। পরবর্তীতে ডাক্তারি পড়তে এসে দেখেছি, অধিকাংশ চিকিৎসকই এই যোগসাজশ পছন্দ করেন না। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ডেটা নেই যে শতকরা কতজন চিকিৎসক এই বাণিজ্যের ঊর্ধ্বে, যদি দুর্বৃত্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ১০-১৫ শতাংশও হয় তাহলে তাদের জন্য বৃহত্তর চিকিৎসক সমাজ ও চিকিৎসা পেশাকে দোষারোপ করা সমীচীন হবে না। প্রসঙ্গত একটি উদাহরণ দেয়া যায়। আমাদের সমাজে ধর্ম ব্যবসায়ী আছেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ মৌলানা ধর্মভীরু ও দরিদ্র মানুষ। আমরা ধর্ম ব্যবসার বিরদ্ধে কথা বলার সময় ঢালাওভাবে সব মৌলানাদের দোষ দিতে পারি না।
এবার লেখার পরবর্তী প্রসঙ্গে আসা যাক-
‘তৃতীয়তঃ বেশীরভাগ ডাক্তারের সম্মানী ফি অত্যন্ত বেশি। দুই থেকে পাচ মিনিট সময়ের কারনে তারা যে সম্মানী নিয়ে থাকেন তা আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার তুলনায় অযৌক্তিক। অন্যদিকে তারা যে টেস্ট গুলো করাতে দেন তার রিপোর্ট দেখার জন্য মূল সম্মানীর অর্ধেক ফী নিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে টেস্ট গুলো যেহেতু তিনি দিয়েছেন এর রিপোর্ট দেখে চিকিৎসাপত্র প্রদানের জন্য বাড়তি টাকা নেওয়া কতটা যৌক্তিক? রিপোর্ট তিনি না দেখলে দেখবে কে?
চতুর্থতঃ রোগ ভাল না হলে এক সপ্তাহ পর পুনর্মূল্যায়নের জন্য মূল সম্মানীর অর্ধেক এবং দুই সপ্তাহ পর গেলে আবার নতুন রোগী হিসেবে গন্য হবে। ডাক্তারভেদে অবশ্য কিছুটা এদিক ওদিক হয়’।
ওর লেখার এই অংশটি পড়ে আমি কিছুক্ষণ হাসলাম। এটা সম্ভবত রোগীর জায়গা থেকে চিকিৎসকের দিকে তোলা সবচেয়ে সাধারণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর আমি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভাবতে অনুরোধ করব। পৃথিবীতে একটি পেশাও নেই যাতে ‘মার্জিন’ বা ‘লাভ’ নেই, আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ঠিক করে কোন পেশার মার্জিন কেমন হবে। যেমন আমরা রাস্তার পাশে চা খাই ৩-৫ টাকায়, অথচ সামান্য উন্নতমানের চা রেস্তোরাঁয় খাই ২০-৫০ টাকায়। একইভাবে আমাদের দেশের ডাক্তারদের ভিজিট যদি মধ্যম উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করা হয় (বেশি উন্নত দেশের দিকে গেলাম না), তাহলে সেটা অবশ্যই হাতের নাগালে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গরিব লোকের কী হবে? যার কোটি টাকা আছে তিনি থাইল্যান্ড যাবেন, যার লাখ টাকা আছে তিনি ভারত কিংবা দেশের পাঁচ তারকা হাসপাতালে যাবেন, যার হাজার টাকা আছে তিনি বিশেষজ্ঞের চেম্বারে যাবেন। কিন্তু আমার দেশের গরিব মানুষের সে সামর্থ্য তার কোথায়?
এই প্রসঙ্গে মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, সেখানে সরকারি হাসপাতাল বলে কিছু নেই, সবই বেসরকারি। কাজেই গরিব লোকের যাবার জায়গা নেই। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। ওবামা সাহেব এদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন, যেটাকে সবাই ‘ওবামা-কেয়ার’ বলে ডাকে। সেই উদ্যোগ খুব বেশি সাফল্যের দেখা পায়নি। আমাদের জন্য অতি আনন্দের কথা, বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে তা আমেরিকাসহ অনেক দেশের জন্যই অকল্পনীয়। আমি একজন হতদরিদ্র চিকিৎসক হিসেবে আমার পরিবারের সদস্যদের সরকারী হাসপাতালেই চিকিৎসা করাই এবং নিজেও আমৃত্যু সেই সেবা গ্রহণ করার আগ্রহ রাখি। যতক্ষণ আমি সুলভ সেবাকে আপন মনে না করব, কেবল প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধে কথা বলব, ততক্ষণ আমরা ৫-৭% চিকিৎসাসেবা নিয়েই পড়ে থাকব। অথচ একটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ৯৩-৯৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠাননির্ভর, আগামীতে সেটা আরও বাড়বে। সেই বৃহত্তর সেবাদানের প্রক্রিয়া কীভাবে আরও সুলভ ও ফলপ্রসূ করা যায় আমাদের সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
একেবারে শেষে সে লিখেছে-
‘পুনশ্চঃ বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোটাই টাকার খেলা। টাকা খরচ করেও উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়া সোনার হরিনের মত। আন্তরিকতা ও প্রফেশনালিজমের অভাবের কারনে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা জনপ্রিয় হচ্ছেনা। মানুষ অর্থের বিনিময়ে সেবা চায়, আর সেই সেবা যখন অরাজকতার নামান্তর তখন সেইখানে কোন রুচি থাকেনা’।
এই অংশে সে সম্ভবত না বুঝে অনেক বড় একটা সত্য কথা বলে ফেলেছে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি পদে যেভাবে টাকার খেলা ছড়িয়ে আছে তা অত্যন্ত অমানবিক। দুই টাকা উৎপাদন ব্যয়ের ওষুধের বাজারমূল্য বিশ টাকা, কেবল ওষুধই নয় স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি উপকরণে যে বিশাল বাণিজ্য চলছে তা অচিন্তনীয়। এই মুনাফাখোর চক্রে চিকিৎসকের অংশগ্রহণ খুবই কম, আমাদের সমগ্র রাজার্থনৈতিক ব্যবস্থা এতে সম্পৃক্ত। দেশে রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের কল্যাণ নিশ্চিত করে কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে এরা প্রধান অন্তরায়। এদের কারনে স্বাস্থ্যব্যয় বাড়ছে, প্রাপ্য সুবিধাদি যথাস্থানে যথাসময়ে যথাযথভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমাদের স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে- তার একটা দৃষ্টান্ত দেই।
গত জানুয়ারিতে জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্লাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অন্তত দেড়শ জন জনস্বাস্থ্য শিক্ষার্থী ক্লাস করছিলেন। প্রফেসর রবার্ট এই ক্লাসটি দুই যুগ ধরে পরিচালনা করছেন। তিনি স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন দেশের সাফল্য তুলে ধরছিলেন। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করে বসলেন, বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কত?
ক্লাসের একেবারে পেছন থেকে একজন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উত্তর দিল। প্রফেসর রবার্ট বললেন, এই হার ভারতের চেয়ে অনেক কম, যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে কম খরচে দ্রুত উন্নতি করার সামর্থ্য রাখে।
আমার সেই ভাইটিকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই, আমাদের এখনও অনেক কিছু করার আছে। কেবল গুটিকয়েক অসাধু কিংবা ব্যস্ত চিকিৎসক আমাদের স্বাস্থ্যখাতের পুরো চিত্র নয়, তারা সামান্য অংশমাত্র। আমাদের উচিৎ হবে বৃহত্তর অংশটিকে আরও গতিশীল ও সাফল্যমণ্ডিত করা। সেই পদযাত্রায় চিকিৎসকের যেমন কর্তব্য আছে, তেমনি সচেতন নাগরিক হিসেবে ভুক্তভোগী হাজারো মানুষের কর্তব্যও একেবারে কম নয়। সেই কর্তব্য পালনের প্রথম ধাপ সমস্যাটিকে অনুধাবন ও আত্মস্থ করা।
আমরা যদি জেগে উঠি, তবেই ভোর আসবে, আলো ফুটবে।
সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আপাতত এখানেই শেষ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৭ রাত ২:৩০