তোর কি মনে আছে আমি সেদিন লাস্ট বেঞ্ছে বসেছিলাম।ছোট্ট একটা মেয়ে তুই হেড মিস্ট্রেসের হাত ধরে ক্লাস এ ঢুকলি।নিজের মুখে নামটা বললি।মৌ।হাহ্,তোর এই নামটা নিয়ে আমরা তোকে কতদিন খেপিয়েছি মনে পড়ে
তোর?আমি জানি তোর খুব মনে পড়ে,কিছু হলেই তুই আমাদের রেখে উঠে যেতি আর ১০ মিনিট পর এসে আবার
ঝগড়া শুরু করতি তোকে ছাড়া খেলা শুরু করেছি কেন?ছোট বেলার সে মুহূর্তগুলো সব মনে পড়ে না কিন্তু ঝাপসা
স্মৃতিগুলোই যে আমার কাছে অনেককিছু।এক একটা ক্লাস উপরে উঠছিলাম আমরা আর যেন আরও কাছের বন্ধু
হয়ে উঠছিলাম।ক্লাস নাইনের শুরুর দিকে হটাৎ করে কেন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিলি,সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম
সবাই তোর কি হয়েছে?বলিস নি।বুঝি নি।হুট করে যখন তোর বাবার সাথে কোথায় চলে গেলি সেদিন কিছু বুঝতে
পারি নি।শুধু বারবার আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠছিল,জানি না কেন হয়ত প্রিয় কোন বন্ধু চলে গেলে এমনি করে
কাঁদতে হয় বলেই কেঁদেছি।মনে হচ্ছিল কিছু বোধহয় বলার ছিল কিন্তু বলি নি।তুই চলে যাওয়ার কিছুদিন পর
আদিব,নীলয় দুজনেই ফ্যামিলির সাথে ঢাকা চলে এল।আর আমি রয়ে গেলাম একা।জানতাম তোদের সাথে আর
দেখা হবে না।তাই একাই চলতে লাগলাম কিন্তু তারপর আগের আমিকে আমি কোনদিনও দেখতে পাই নি।
তুই কে ছিলি আমার?নিজেকে এ প্রশ্ন আমি কোনদিনও করি নি।।কিন্তু চিটাগাং এ এসে তোর সাথে যখন আবার
দেখা তখন তুই তখন অনেক বদলেছিস কিন্তু আমাকে আবার কাছে টেনে নিলি ঠিক আগের মত।আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল,আমি জানতাম কিন্তু কোন চেষ্টা করি নি নিজেকে বাঁচানোর।কিন্তু তোর জন্য আর হল না।আমাকে তোর নরম হাত দিয়ে খুব শক্ত করে ধরেছিল।আস্তে আস্তে টেনে তুললি।জীবনটা হেরে যাওয়ার না,নিজেকে কষ্ট দেয়ার না তুই আমাকে শিখিয়েছিলি।আমি হারি নি জিততে শুরু করেছিলাম।
সেবার যখন রিকশা থেখে পড়ে গিয়ে পা টা ভেঙ্গে গেল,হাসপাতালে এসে তুই কি বলেছিলি মনে পড়ে?নার্স আমার
ভাঙ্গা পা টা ড্রেসিং করছিল আর তখনি তুই হুড়মুড় করে ঢুকলি।
-এই গাধার গাধা,রিকসায় বসতে শিখিস নাই তো উঠিস কেন?
-আরে বস বস,পা না ভাঙলে কি তুই দেখতে আসতি?
নার্স চলে গেল।তুই একটু চুপ করে হটাৎ আমার হাতটা ধরলি আর বললি,
-প্লিজ আবির আর রিকসায় উঠিস না।আমি প্রত্যেকদিন তোকে ভার্সিটিতে ড্রপ করে দিব।
-আরে গাধা নাকি একবার পা ভেঙ্গেছে বলে রিকসায় উঠা বাদ দিব নাকি?
কিন্তু আমাকে শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হল।সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এমন করার কি আছে।কিন্তু কথা বলার সময়
তোর চোখ দুটো কেন এত ভেজা ভেজা মনে হল,কন্ঠে কিসের এত উদ্বিগ্নতা।আচ্ছা মৌ তোরা কি এমনই...
ক্লাস নাইনে তুই যখন আমাদের ছেড়ে তখন আমার কি যেন বলার ছিল আমি বলি নি।এবার আমি তোকে বলবো।হ্যাঁ সব।আমাকে ভার্সিটিতে ড্রপ করার সময় যখন তুই যখন আমার পাশে এসে বসতি তখন আমার খুব বলতে ইচ্ছে হত,এমনি করে পাশে থেখ জনম জনম ভর।হাসপাতাল এ আমার হাতটা যখন ধরেছিলি আমার খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল এমনি করে আমার হাতটা ধরে থাকিস চিরজীবন।
সেদিন যখন তুই আমাকে মেসেজ দিলি বাবার বেড়াতে সাথে বেড়াতে যাচ্ছি সিলেট,আট দিন থাকব,যেখানে যাচ্ছি
নেটওয়ার্ক নেই,ফোনে পাবি না।আমি বললাম যা ঘুরে আয়।কিন্ত এই আট দিন তোকে ছাড়া থাখা আমার পক্ষে সম্ভব
না বুঝলাম তিন দিনের মাথায়।তোকে ফোনে পাচ্ছিলাম না।কিচ্ছু করার ছিল না।সাতটা দিন কাটল প্রচণ্ড অস্থিরতায়।আট দিনের দিন সকালে কে যেন কলিং-বেলটা বাজালো।এই ফ্ল্যাটে একা থাকি তাই আমাকেই দরজা খুলতে হল।প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দেখি।আঙ্কেল দাড়িয়ে আছে সামনে।আমি বললাম,
-আঙ্কেল আপনি এত সকালে?সিলেট থেখে কবে এলেন?মৌ কোথায়?আসেন আঙ্কেল,ভিতরে এসে বসেন।
উনি ভিতরে এসে বসলেন তারপর যা বলতে শুরু করলেন আমি শুধু শুনেই গেলাম,আমার আর কিছু বলার শক্তি ছিল।আমার চারপাশটা বড় বেশি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
সিলেটে যাওয়া,বেড়ানো সব ছিল মিথ্যা।এত কাছে থেখেও আমি কোনদিন বুঝতে পারি নি ওর শরীরে বাস করছে খুব খারাপ কিছু।ও জানত।আমাকে জানায়নি।শুধু কষ্ট পেয়েই গেছে।বেড়ানোর কথা বলে ভর্তি হয়েছে হসপিটালে। মায়োকার্ডিয়াল ইনফেকশন।হ্যাঁ,এই দূর্লভ ঘাতকটাই টেনে নিয়ে গেছে অন্য কোথাও।।মৌর আব্বা যাওয়ার সময় বলে গেলেন মৌ এই চিঠিটা তোমাকে দিতে বলেছে।সাদা খামের মাঝে লাল কাগজে শুধু ছটা লাইন।
আবীর,
নিজের পরিনতি জানতাম তাই তোকে আমার করতে চাই নি কিন্তু তারপরেও আমি জানি তুই আমারই।আবীর ছোটবেলায় তুই কখনও হারতে চাইতি না কিন্তু আজ তোকে হারতে হবে।তুই আজ যতই বলিস,
মৌ মাছি মাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও নাএকবার ভাই।
আমি রাগবো না,ঝগড়া করবো না।জীবনের কাছে হারিস না।
ইতি
আমি
তাকিয়ে আছি চিঠিটার দিকে,তোর লেখা শেষ চিঠি,অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।হয়ত এমনই অস্পষ্ট রয়ে যাবে আজীবন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:০২