মা অথবা আম্মা। কত মধুর ডাক। পৃথীবির সমস্ত ভালবাসা আর আবেগ এই শব্দের মাঝে।
দুই ডাকের কোনটিতে তৃপ্তি রয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে 'মা' ডাকের মধ্যে কেমন যেন একটা অতৃপ্তি, শুন্যতা বোধ হয়। 'আম্মা' ডাকের মধ্যে কোন ফাক-ফোকড় নেই। সর্বদিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ। ডেকেও সুখ পাওয়া যায়।
আমি একটা তত্ত্ব উদঘাটন করেছি- আমরা যারা গন্ডুগ্রামে বাস করি তারা 'আম্মা' ডাকি। আর যারা অজপারাগা ও শহরে বাস করে তারা 'মা' ডাকে। লেখাতেও 'মা' ই ব্যবহার হয়।
.
মা শহুরে-গ্রাম্য, কালো-সাদা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত যা-ই হোক না কেন 'মা, মা-ই'
'মা' সবার শেষ আস্তানা, মা'র আঁচল ছাড়া জীবনটা বেদনা। কে আছে? আমাকে চোখের আড়াল করতে ভয় পাবে, আমাকে বিদায় দিয়ে গমনদৃশ্য অপলক নেত্রে তাকিয়ে দেখবে, আমার অনুপস্থিতিতে অশ্রু বর্ষন করবে, আমার অপেক্ষায় অস্থির মনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, গভীর রাত পর্যন্ত দরজা খুলা রেখে কুপি জ্বালিয়ে বসে থাকবে।
নেই কেউ নেই। সবাই স্বার্থের পাগল। মার মাঝে কোন স্বার্থ নেই। তিনি তো নিজের শেষ সম্বলটুকু দিয়েও আমাকে গড়াতে চেয়েছেন। নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেন নি। তার হাতে ছিলই বা কি? বিয়ের সময়কার এক জোড়া কানের দুল। তাও তো বিক্রি দিলেন। আমাকে মানুষ বানাবেন বলে। দুল দুটি বিক্রির সময় আমি দেখেছি তার বুক ফাটা দুঃখের বেদনাভরা চোখের অশ্রু। কই! দুল বিক্রির টাকা গুলো দেয়ার সময় তিনি তো বুঝতেও দিলেন না। হাজারও কষ্ট চেপে হাসি মুখেই দিলেন টাকা গুলো। (এখন অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে)
'আম্মা' (মা লিখে তৃপ্তি পাচ্ছি না। আমি ভাই! গ্রামের মানুষ) তুমি আমাকে রেখে পৃথীবি ছেড়ে যেও না। তুমি গেলে আমি কার কাছে মাথা লুকাব? বিপদে কার কাছে দৌড়ে যাব? কাকে আম্মা বলে ডাকব? আমার আবদার কে পূরণ করবে?
আমার মরণ যেন, হয় আগে তুমার। প্রভুর কাছে মিনতি, এই হতভাগার।
.
প্রথম সাময়িক পরিক্ষা শেষে দীর্ঘ ছুটি। বাড়িতে এসেছি। অনেকদিন পর বিকালে চা'র কথা মনে পরল। আম্মাকে বললাম- আম্মা! চা খেতে মন চাচ্ছে।
আম্মা মাগরীবের নামাজ পড়ে চা বানাতে লাগলেন। আমার আম্মা একদম গ্রাম্য মানুষ। গায়ের রং কালো তবে মনটা তার বেশ সাদা। সহজ সরল। এমন মানুষ আমি আর কোথায় খুজে পাব?
আম্মা এলাচ, দালচিনি, তেছপাতা, ইত্যাদী গরম মসলা দিয়ে চা বানাচ্ছেন। আমার আম্মা এভাবেই চা বানান।
ও দিকে ভাবি বললেন- তুমার বড় ভাই-এর ঘরে কফি আর দুধ আছে। আনো কফি বানিয়ে দেই। আমার ছোট ভাই দৌড়ে গিয়ে কফি আর দুধ আনল। ভাবি কফি বানালেন। মগে মগে ঢেলে কয়েকজনের জন্য টেবিলে রাখলেন।
এদিকে আম্মা চা বানিয়েছেন। কড়া লিকার, অত্যাধিক গরম।
ভাবি ডাকছে কফি খাওয়ার জন্য। আম্মা নিস্তব্ধ তাকিয়ে আছেন। হয়ত তিনি দেখতে চান আমি কি করি। আমি ভাবিকে বললাম - ভাবি! আমি আজ কফি খাব না। আমার ভাগেরটা ভাতিজিকে দেন।
আমি ঘর থেকে একটা গ্লাস নিয়ে চুলার পারে আম্মার কাছে গিয়ে বসলাম-
`দাও আম্মা চা দাও, চা খামু`
`কে? কফি খা গা`
`আম্মা! আমি কফি খাই না। তুমি চা দেও খাই। দেহি কিবে হইছে`
আম্মা আমার গ্লাসে চা ঢেলে দিলেন। আমি আম্মার কাছে বসে পরম তৃপ্তি সহকারে চা খেলাম। হোক না তিতা, ঝাল ঝাল। এতে তো রয়েছে মায়ের হাতের পরশ।
.
আজকেও আম্মাকে বললাম- আম্মা! চা খামু।
আম্মা চা বানানোর সারঞ্জাম জোগাড় করলেন কিন্তু চিনি নেই। চিনি আনতে পাঠালেন একজনকে।
এরি মাঝে ফোন দিয়েছে 'আমাকে স্নেহকারি এক বড় ভাই' -
`হ্যালো আব্দুল্লাহ! তুমি কোথায়?`
`আমি ত বাড়িতে`
`একটু রেইল গেটে আসো`
`আচ্ছা যাচ্ছি...`
সেখানে গেলাম। ভাপা পিঠা খেলাম। রেইল গেটের সেরা চা খেলাম। ইশার নামাজ পড়লাম। বাড়িতে এসে দেখি আম্মা চা বানিয়ে চুলার পারে বসে আছে।
`আম্মা! এত তাড়াতাড়ি চা বানাইয়া ফালাইছ?`
`হো! তুই না চা খাবি। কই গেছিলি?`
`আম্মা দাড়াও মগ নিয়ে আসছি`
সেরা চা খাওয়ার পর আর কোন কিছু খাওয়ার মানেই হয় না। তবুও মগ নিয়ে আম্মার কাছে এসে বসলাম। আম্মা চা ঢেলে দিলেন।
বললাম- আম্মা বেশি করে দাও কম হবে।
আম্মা আরও চা ঢেলে দিলেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে খেলাম। কিসের রেইল গেটের চা? আমার আম্মার বানানো চায়ের কাছে কোন কিছুর পাত্তা নেই।
.
আমি আমার আম্মার জন্য কিছু করতে পারি নাই। তিনি আমার জন্য করে গেছেন এবং যাচ্ছেন অকাতরে। মায়ের উপস্থিতি ছাড়া আমি বাঁচব কিভাবে?
আম্মা! আমার জীবনের প্রথম উপার্জনের টাকা দিয়ে তুমাকে এক জোড়া দুল বানিয়ে দেব। একটা দামি কাপড় কিনে দেব।
তুমি তো আমার জন্য কোনদিন ভাল কাপড়ও পরো নাই। আমাকে পরিয়েই শান্তির প্রমাদ গুনেছ। প্রায় দিনই মাছের কাটা দিয়ে ভাত খেয়েছ। নিজের ভাগের গোশতটাও তুলে দিয়েছ আমার পাতে। একলা একটা আপেলও কোনদিন খাও নাই।
.
একদিন বললে- বাবা! খুব আপেল খেতে মন চাচ্ছে। অনেকদিন যাবৎ পুরাপুরি একটি আপেলও খাইতে পারি নাই।
বড় ভাই আপেলের কার্টুন একটা এনে দিল। কই! সেদিনও কি তুমি পুরো একটা আপেল খেয়েছিলে?
.
মা এমন একটি জিনিস 'যার যায়, সে বুঝে'
জাগতিক এই একটা ডাক-ই আছে যার মাঝে কোন ক্লান্তি নেই। এইযে আমি এই লেখাতেই কতবার 'আম্মা' লিখেছি, আমার একটু অতিরঞ্জন মনে হয় নি। পাঠক! আপনার কাছেও দেখবেন খারাপ লাগবে না। এ এক অদ্ভুত সৃষ্টি।
.
আমি এধরনের লেখা একদম লিখে অভস্থ নই। পাঠক বুঝতেই পারছে একদম কাচা হাত। কি করব বলেন? মন তো মানে না।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৪৪