আব্দুসসামাদ
৩য় খণ্ড
(নিচে অন্য পর্বগুলোর লিঙ্ক দেয়া আছে)
- ওই জালাল মিয়াঁ কই যান? আমার বাড়ির পাশে দিয়ে জালাল মিয়াঁ হেঁটে যাচ্ছিল। আমি ডাক দিলাম।
- না সামাদ, তেমন কিছু না। এমনেই হাঁটি।
- কিন্তু চেহারা একটারে জলহস্তীর মত করে রাখছেন ক্যান? কোন সমস্যা হয়নি তো?
- না না কোন সমস্যা হয়নি। এই যে দেখ দেখ, আমি হাসতেছি।
- আরে আমি বুঝতেছি, আপনি অনেক সমস্যার মধ্যে আছেন। সমস্যাটা বলে ফেলেন মন খুলে। দেখবেন নগদে সমাধান করে দেব।
- না মিয়াঁ। তোমারে বলা যাবে না। বললেই বরং বিপদ। সমাধান তো হবেই না, উল্টো দৌড়ের উপর থাকতে হবে।
- না বলেন, সব সময় যে বিপদে পড়বেন এমন তো কোন কথা নেই। মাঝে মাঝে তো উপকারে আসতেও পারি। অবশ্য এটাও সত্য আগে উপকারের কোন রেকর্ডও নাই।
- ঠিক আছে তুমি যখন এত করে বলতেছ। তাহলে বলি, গতকাল রাতে আমার ৩ টা গরু চুরি হয়ে গেছে। ভোর ৪ টার দিকে গরুগুলো সব আছে দেখছি। ৫ টার দিকে নামাজ পড়তে উঠে দেখি ৩ টা গরু নাই। এক ঘণ্টায় ৩ টা গরু গায়েব।
- বড়ই পরিতাপের বিষয়। কিন্তু আপনার তো মিয়াঁ ৫ টা গরু ছিল। তাহলে চোর ৩ টা গরু চুরি করে ২ টা গরু রাখল কেন? চোর ব্যাটা তো মহা বেকুব!!!
- তা ঠিক কইছ সামাদ। বাকি ২ টা গরু দেখলে এখন দুঃখ আরও বেড়ে যাইতেছে।
- তাহলে একটা কাজ করেন, বাকি ২ টা গরু চুরি হওয়ার ব্যবস্থা করেন।
- দূর মিয়াঁ, তোমাকে কথাটা বলাই আমার লস হয়েছে। সব কিছু নিয়ে ফাজলামি ভাল লাগে না। আমি মরি আমার দুঃখে, তুমি মিয়াঁ সারেঙ্গী বাজাও।
- আচ্ছা, ফাজলামি বাদ। এখন কাজের কথায় আসি। একটা কাজ করেন, আজ দুপুরের দিকে পুরো গ্রামে মাইকে একটা ঘোষণা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। মাইকে বলাবেন যে, “জালাল মিয়ার ৫ টা গরুর মধ্যে ৩ টা চুরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে চোর ব্যাটা ধরা পড়েছে। আজ বিকেল ৫ টায় তার কঠোর বিচার হবে। স্কুল মাঠে সবাইকে আসার জন্য আমন্ত্রণ”
- তোমারে মিয়াঁ ফাজলামি করার জন্য মানা করলাম। তাও তুমি ফাজলামি করছ। আমার গরু চুরির খবরই এখনও মানুষজানে না। এর মধ্যে চোর ধরা পড়ে গেল!!! আমি চোর পাব কই। বিপদের মধ্যে ডবল বিপদ ডেকে আনবা?। এলাকার মানুষের কাছে আমারে ভণ্ড বানাতে চাও?!!!
- আরে এত রাগ করেন কেন। আমার উপর বিশ্বাস রাখেন। চোর ইনশাআল্লাহ্ ধরা পড়বেই, এই আব্দুসসামাদ গ্যারান্টি দিচ্ছে। আর সময় মত যদি চোর ধরতে না পারেন, তাহলে আমাকে চোর বলে ধরে নিয়ে যাইয়েন। আমি চোর হিসেবে সব স্বীকার করে নেব। তাহলে তো সমস্যা শেষ। কি বলেন?
- এই সকাল সকাল আমার মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছ। তোমার মত ফাজিল লোক আর পৃথিবীতে একটাও নাই। মানুষের বিপদ নিয়ে মজা কর। দূর হও মিয়াঁ আমার সামনে থেকে।
জলিল মিয়াঁর ধমকটা খেয়ে খুবেই মজা পেলাম। কিন্তু এই মজা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। হাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। পশ্চিম পাড়ার দিকে যেতে হবে।
দুপুরের দিকে আমি পশ্চিম পাড়ার দিকে রওয়ানা করলাম।
- সামাদ ভাই খবর পাননি? , পেছন থেকে তারেকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
- কিসের খবর? সব খবর পাইতে হবে এমন কোন কথা নেই। জগতে প্রতি সেকেন্ডে লক্ষ লক্ষ খবর বের হইতেছে। এত খবর নিতে গেলে চলে না। নিজের খবরটা পৃথিবীর সবচে গুরুত্বপূর্ণ।
- তা ঠিক কইছেন ভাই। কিন্তু খবরটা একটু নিয়েন। খাদিজা খালা অনেক অসুস্থ। বাঁচবে মা মরবে ঠিক নাই।
- তো, খাদিজা খালা অসুস্থ। তাতে আমার কি? শুনে আমি কি নাচবো? শুনো মিয়াঁ, পৃথিবীতে অনেক খাদিজা খালা আছে। সবার খবর নিতে গেলে আমার নিজের খবরটাই ভুলে যাব।
- না ভাই, এই খবরটা আপনার নেয়া দরকার। শুনেছি, আপনার জন্মের আগেই আপনার বাবা কোথায় যেন চলে গেছে, সেই থেকে আর আসেনি। আপনার জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে আপনার মা মারা যায়। তখন থেকেই খাদিজা খালাই আপনার দুধ মাতা হয়েছেন। আপনার লেখাপড়া চালাতে গিয়ে উনি উনার বাড়ির ভিটা ছাড়া সব জায়গা জমি বন্ধক রেখে দিয়ে আপনাকে টাকা দিয়েছেন, এখন আর হাতে কিছুই নাই। জমিগুলোও উদ্ধারের অবস্থা নেই। এখন তো আপনি উনাকে দেখাশুনা করা দরকার, ভরণপোষণ করা দরকার।
- মিয়াঁ বেশী বুঝিওনা। উপকার করেছে ঠিক আছে। কিন্তু উপকারীর উপকার করতে হবে এমন কোন কথা নাই। এই সব খাদিজা খালা-টালা কত আসবে কত যাবে। যেখানে যাইতেছিলা সেখানে যাই। আমার কাজের ভিতর বাম হাত ঢুকাইতে আসিওনা।
- ভাই ভাই যাইয়েন না, একটা কথা। শুনলাম ঢাকায় বড় একটা চাকুরী করতেন। গাড়ি-টারিও চালাইতেন। তো, অনেকদিন দেখতেছি, চাকুরী ছেড়ে দিয়ে এলাকায় হুদাই বসে আছেন। এর সাথে ওর প্যাঁচ লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই সব কেন করতেছেন ভাই? কি মজা পান এতে? এখন একটা অনুরোধ ভাই, অন্তত খাদিজা খালাকে এক পলক দেখে আসিয়েন। বাঁচে না মরে তার গ্যারান্টি নাই।
-মিয়াঁ, নিজের চরকায় তেল দাও। অন্যরে উপদেশ নিতে আসিও না। আর বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তোমার বাবা-মা তোমাকে শেখায়নি? আমি এখন অনেক ব্যস্ত। তোমার কথা শুনার টাইম নাই। শুনেছ, জালাল মিয়াঁর ৫ টা গরুর মধ্যে ৩ টা চুরি হয়ে গেছে। চোর ধরা পড়েছে। বিকেল ৫ টায় স্কুল মাঠে চোরের বিচার হবে। চোর ধরা পড়েছে মিয়াঁ, এর থেকে বড় সুসংবাদ আছে? এলাকার সবাইরে খবরটা দাও। এই সব খাদিজা খালা-টালার খবর নিয়ে লাভ নাই, সময়ও নাই।
তারেক কি একটা যেন বলতে চাইল। আমি আর কিছু না শুনার ভান করে সামনের দিকে এগিয়ে চলে আসলাম। একটু হেঁটে পেছনের দিকে তাকালাম। দেখলাম তারেক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারাটা চরম বিস্মিত করে রেখেছে। বিস্মিত চেহারাগুলো সব সময় বোকা বোকা মনে হয়। ভালই লাগছিল তাকে দেখতে।
কিন্তু আমার সত্যি সত্যি এত কিছু দেখার সময় নাই তখন। আধা-ঘণ্টা আগে অ্যাম্বুলেন্স খবর দেয়া হয়েছে। সাথে সদর হাসপাতালের ডাক্তারও আসতেছে। ডাক্তার আমার পূর্ব পরিচিত, HSC তে আমরা একসাথে ছিলাম। খাদিজা খালাকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাকে যে করে হোক সুস্ত করে তুলতে হবে। কারণ তাকে ছাড়া আমার পৃথিবীটা প্রায় অন্ধকার।
এ্যাম্বুলেন্সে করে যখন খাদিজা খালাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন শুনলাম, মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে। মাইকে বলছে, " সুখবর, সুখবর, উত্তর পাড়ার জালালের ৫টা গরুর মধ্যে ৩টা গরু চুরি হয়ে গেছিল। শেষ পর্যন্ত গরু চোর ধরা পড়েছে। আজ বিকেল ৫ টায় স্কুল মাঠে এই চোরের কঠিন বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামের সকলে আমন্ত্রিত"।
(চলবে)
এখান থেকে পড়ুন
১ম খণ্ড
২য় খণ্ড
৪র্থ খণ্ড
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৩:১৩