(Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
(১১)
সিয়াহ কিছুটা হতাশ হলো,তারপর আমাকে খুশী করার জন্যে তাড়াহুড়া করে এগিয়ে আসলো।আমি যদি সেকুরের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাবে প্রস্তাবে রাজী হই,সে কি আমাদের সাথে একই বাড়ীতে থাকবে?
ইডিরনের গেট থেকে বের হয়ে শহরের দিকে যাচ্ছিলাম,দূরে লাশ নিয়ে লোকজন কুয়াশায় হারিয়ে যাচ্ছে,সাথে শিল্পী,কালিগ্রাফ্রার আর শিক্ষানবীসরা,পাহাড় থেকে নামার সময় লাশ নিয়ে যাওয়ার লোকজন কাঁধ বদল করছিল।এত তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছিল সবাই যে,এর মধ্যেই বরফ ঢাকা কাদা মাখানো ইয়েপ্ত এলাকায় যাওয়ার রাস্তা পার হয়ে গেছে।বাম দিকে সুলতানের মোমবাতি কারখানার চিমনীর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল,দেয়ালের নীচে ইয়েপ্তের গ্রীক কসাইদের বিশাল কসাইখানা,চামড়ার কারখানা।
ছুটে আসা দূর্গন্ধে চারপাশের বাতাস যেন দূষিত হয়েছিল,সেই দূর্গন্ধ চলে গেছে ইয়েপ্তের মসজিদের মিনার পর্যন্ত,শোনা যাচ্ছিল।বালাতের ইহুদী বস্তির ছেলেমেয়েদের চীৎকারটাও।
যখন ইয়েপ্তের কবরস্থানে পৌছালাম,কেলেবেক(প্রজাপতি)বেশ রাগের সাথেই বললো, ‘আমার কোন সন্দেহ নাই,জেয়তিন(জলপাই) আর লেইলেক(বক) এই খুনের জন্যে দায়ী’,সে আরও বললো, ‘সবাই জানে যে তাদের শত্রুতার কথা,ঈর্ষা,রাগারাগির কোন অভাব ছিল না ওদের মধ্যে।সবসময় ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো,ওস্তাদ ওসমানের পর কে প্রধান শিল্পীর দায়িত্ব পাবে,আরও এটা ওটা নিয়ে।এখন তাদের মনে নিশ্চয় অপরাধ বোধে ভঁরা,আর খাজাঞ্চির প্রভাবে সুলতান এখন আমাকে ছেড়ে অন্যদিকে,না মানে আমাদের ছেড়ে অন্যদিকে দেখবে’।
‘এই যে “আমরা”,কথাটা তুমি বললে,সেটা কারা’?
‘আমরা বিশ্বাস করি,ওস্তাদ ওসমান পারস্যের ওস্তাদদের পদ্ধতিতে ছবি আঁকাটাই যথাযথ,
শুধু শুধু টাকাপয়সার জন্যে শিল্পকে বিক্রি করে দেয়াটা ঠিক না।আমরা বিশ্বাস করি যুদ্ধ,অস্ত্রশস্ত্র,জয় পরাজয়,দাসত্বের গল্প একপাশে রেখে,বলা উচিত পুরোনো ইতিহাস,
কিংবদন্তী আর মানুষের গল্প।পুরোনো কেন ছুড়ে ফেলবো আমরা,বাজারের কয়টা কুরুশের জন্য নোংরা ছবি,এঁকে বেড়াবে কেন শিল্পীরা?আমাদের সুলতানের কাছেও এটা যুক্তিযুক্ত হওয়ার কথাই’।
‘নিজেই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেলে,কেন’,এ জন্যেই বললাম যাতে কেলেবেকের বকবকানিটা থামে, ‘আমার কোন সন্দেহ নাই যে ওস্তাদের ছবি আঁকার জায়গায় ও ধরণের কোন অপরাধী লোক থাকতে পারে।ওখানে তোমরা সবাই তো ভাই এর মত,তুমিই বল যে ছবি আঁকা হয়নি সেটা আঁকাতে দোষ,
ঝগড়াঝাটি,শত্রুতা করার মত কিইবা আছে’।
জারিফ এফেন্দীর খুনের কথা শুনে মনে হয়েছিল খুনী হয়তো নামকরা শিল্পীদের একজন,এটাও আমার বিশ্বাস খুনী এখানেই,জানাজার দলের সাথেই আছে।এটা তো জানাই খুনী তার শয়তানী,অপকর্ম থেকে সরে যাবে না,আমি যে বইটা নিয়ে ব্যাস্ত সে তো নিঃসন্দেহে ওটার সম্পূর্ন বিপক্ষে।কে জানে,হয়তো এর মধ্যে আমার বাড়ী থেকে বই এর ছবি,লেখাও হয়তো সরানো হয়ে গেছে।কেলেবেক(প্রজাপতি)আর অন্যান্য শিল্পী যারা আমার বাসায় গেছে,সবাই সেকুরের সৌন্দর্যে হাবুডুবু খাচ্ছে?কেলেবেক কি মন্তব্য করার সময় ভুলে গেছে,কয়েকবার আমিই তাকে ছবি আঁকতে বললাম,যা নিঃসন্দেহে ছিল তার অন্ধ বিশ্বাসের বাইরে,এ সব মন্তব্য করে সে কি আমাকে খোঁচা মারছে’?
তবে মনে হয় না,কেলেবেক খোঁচা মারছে,কেন না খোঁচা মারার মত লোক সে না।তা ছাড়া কেলেবেক(প্রজাপতি)আরও অন্যান্য অনেক ওস্তাদদের মত আমার কাছে অনেক ব্যাপারেই ঋনীঃযুদ্ধের কারণে সুলতানের কাছ থেকে টাকাপয়সা উপহার কমে যাওয়ার সময়,তাদের উপার্জনের নতুন একটা উৎস আমিই ছিলাম।ওদের একে অন্যের মধ্যের দলাদলিটা তো আমার জানাউ-সে জন্যেই কখনও একসাথে ওদের সকলের সাথে একসাথে আলাপ আলোচনা করতাম না,এ জন্যে আমার সাথে ওদের শত্রুতা হওয়ার কোন কারণ নাই’।
বিষয়টা এড়ানোর জন্যে বললাম, ‘আল্লাহর মহত্বের শেষ নাই,ওরা লাশ নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পাহাড় দিয়ে নেমে গেল,উঠে যেতেও ওদের কোন কষ্ট হয়নি’।
কেলেবেক(প্রজাপতি)দাঁতগুলো বের করে হেঁসে বললো, ‘ওটা আর কিছু না শীত এত বেশী ছিল যে কারও তেমন খুব একটা কষ্ট হয়নি’।
এই লোকটার মনে কি হিংসা থাকতে পারে যে আরেকজনকে মেরে ফেলবে?সত্যিই কি খুন পারতে এই লোকটা?এই লোকটা আমার ধর্মবিশ্বাসের সাথে খেলা করছে নাকি?
না,না,এটা হতেই পারে না,ওতো নিঃসন্দেহে একজন চরম প্রতিভাবান শিল্পী,ও কেন খুন করতে যাবে?বয়স মানুষকে যেমন পাহাড়ে উঠতে যন্ত্রনা দেয়,আর মৃত্যুর ভঁয় থেকেও সরিয়ে নেয়।জীবনে কোন প্রেরনা থাকে না বয়স হলে,রাতের অন্ধকারে চাকরানীর ঘরে যাই,কোন শারীরিক উত্তেজনায় না,একাকীত্ব থেকে পালানোর জন্যে।মনের কথাগুলো কেলেবেককে বললাম, ‘মনে হয় না এই বইটা নিয়ে আর আগানো ঠিক হবে না’।
‘কি’?কেলেবেক(প্রজাপতি)এর চেহারা সম্পুর্ন বদলে গেল।
‘অবশ্য কিছু দূর্ভাগ্যও জড়ানো এর সাথে,সুলতানের এই বই এর জন্যে টাকাপয়সা দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে।জেইতিন(জলপাই) আর লেইলেক(বক)কে কথাটা বলো’।হ্য়তো কেলেবেক আরও কিছু বলতো,তবে আমরা তখন কবরস্থানের গাছপালা,কবরের কাছে পৌছে গেছি।লাশটাকে কবরে নামানো হচ্ছিল আর কানে ভেসে কিছু ছিল না,শুধু ‘বিসমিল্লাহ’,আর ‘আল্লাহ মিলাতি রাসুল্লাহ’।
কেউ একজন বললো, ‘ওর মুখটা সম্পুর্ন খুলে দাও’।
লোকজন লাশের সাদা কফিনটা সরিয়ে দিচ্ছিল,হয়তো তারপর চোখে চোখে দেখা হয়েছে কারও,পাথর দিয়ে মাথা ভেঙ্গে দেয়ার পর যদি কিছু থাকে।আমি একবার লাশের চোখ দেখছিলাম,তবে কবরের মধ্যে দেখা সেটাতো অন্যকিছু।
একটা স্মৃতিঃপ্রায় তিরিশ বছরের পুরোনো একটা ইতিহাস,আমাদের সুলতানের দাদা,
(আল্লাহ তাকে যেন বেহেশতবাসী করে),ঠিক করলো ভেনিসানিয়ানদের কাছ থেকে সাইপ্রাস দখল করে নিবে।শেখ হুলি ইসলাম ইবুসসুল এফেন্দীর কথামত ঐ দ্বীপটা একসময় ছিল মক্কা,মদিনা থেকে আসার সময় অবসরের জায়গা,এই পবিত্র জায়গা অবিশ্বাসীদের ক্ষমতায় থাকা একেবারেই অবাঞ্ছনীয়।সেই সময় ভেনিসের দূত হিসাবে যাওয়ার দায়িত্বটা আমার হাতেই পড়লো।ঐ সময় আমার ভেনিসের গির্জা,প্রাসাদ,পুলগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়,তবে সবচেয়ে অবাক হওয়ার মত যা ছিল সেটা ভেনিসের প্রাসাদগুলোতে ঝুলানো ছবিগুলো।যাই হউক এই চোখ জুড়ানো ছবিগুলো,প্রাসাদ আনন্দে দেখার পর ভেনিসের শাসককে দূসংবাদটা আমাকেই দিতে হলো,যে আমাদের সুলতান সাইপ্রাসকে তার রাজত্বের আওতায় নিতে চায়।
ভেনিসের ক্ষমতাসীন সরকার এটা শুনে বেশ রেগে আমাকে বেশ কড়া করে একটা
চিঠিতে উত্তর দিল।সেখানকার লোকজন এতই ক্ষেপে ছিল যে ভঁয়ে আমাকে রাস্ট্রীয় প্রাসাদে আমাকে নিজেকে লুকিয়ে থাকতে হতো।তবুও যখন কয়েকজন আততায়ী প্রাসাদে কোনভাবে ঢুকে গন্ডগোল করা আরম্ভ করলো,কয়েকজন সৈনিক আমাকে লেকে নৌকায় ভেনিসের বাইরে নিয়ে যায়।সেই সময় গন্ডোলার মাঝিকে,সাদা কাপড়ের লম্বা চেহারায়,মনে হচ্ছিল যেন মৃত্যু আমার সামনে দাড়ানো।
তখন ঠিক করলাম দেশে ফিরে এই বইটা গোপনে শেষ করবো।কবরে মাঠি দিয়ে ঢাকা হয়ে গেছে সবকিছু।এই সময় ফেরেশতারা হয়তো জারিফ এফেন্দীকে জিজ্ঞাসা করছে,সে কি ছেলে না মেয়ে,তার ধর্ম কি,কাকে সে পয়গম্বর হিসাবে মানে।
নিজের মৃত্যুর কথাটা মনে ভেসে বেড়াচ্ছিল তখন।
একটা কাক আমার পাশে বেশ চীৎকার করে ডাকছিল,সিয়াহকে কাছে ডেকে বললাম,
আমার হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যেতে।বললাম আগামীকাল বইটার কাজ করার জন্যে সে যেন বাসায় আসে।মৃত্যুর কথায় এটাই মনে হলো,যে কোন ভাবে বইটা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।
আমাকে সবাই খুনী বলবে
ঠান্ডা,বরফ মাখানো কাদামাটি সবাই দিচ্ছিল জারিফ এফেন্দীর বিকৃত চেহারায়,আমি অন্যান্যদের চেয়ে হয়তো একটুঁ বেশীই কান্নাকাটি করলাম।চীৎকার করে এটাও বললাম, ‘আমি আর বাঁচতে চাই না,আমাকে মরতে দাও ওর সাথে,ঐ কবরে যাব ওর সাথে’।
লোকজন আমার কোমর ধরে আঁটকে রাখলো,যাতে কবরে পড়ে না যাই।নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে হাপাচ্ছিলাম,কজন কপালে হাত রেখে মাথাটা পেছনে ধরে রাখলো,যাতে আমার শ্বাস নিতে একটু সুবিধা হয়।মৃতের আত্মীয়স্বজনদের দেখে মনে হলো,আমার কান্নাটা একটুঁ বেশীই হয়ে গেছে।আমার এই অতিরঞ্জিত দুঃখের চেহারা দেখে ষ্টুডিওর অনেকেই ভাবতে পারে যে আমি জারিফ এফেন্দীর সাথে প্রেমে মাতামাতি করছিলাম।
লোকের দৃষ্টি এড়ানোর জন্যে একটা গাছের পেছনে গা ঢাকা দিয়ে দাড়িয়েছিলাম,বোকা মানুষটা যাকে নিজের হাতে নরকের রাস্তায় ঠেলে দিলাম,তারই এক নির্বোধ আত্মীয় গাছের পেছনে আমাকে দেখে সান্তনা দেওয়া আরম্ভ করলো।এক সময় বেকুফটা আমাকে জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোমাকেই কি সবাই , “বুধবার” বলে ডাকতো,
নাকি “শনিবার”কোনটা’?‘বুধবার’,ছিল আমাদের প্রিয় মানুষটা যে চলে গেল,তার ছবি আঁকার আখড়ায়।
ষ্টুডিওতে একেকজনের একেকটা ডাকনাম ছিল,আমাদেরকে গুপ্তচক্রে ব্যাবহারের জন্যে।
ছাত্রাবস্থায়,ওস্তাদ ওসমানের,সহকারী প্রধান শিল্পী থেকে প্রধান শিল্পী হওয়ায় শ্রদ্ধায়,আনন্দে আমরা সবাই অভিভুত ছিলাম।ওস্তাদ ওসমানের গুনের বর্ননা করে শেষ করা যাবে না, তার কাছে এত কিছু শেখার আছে সেটা বলেও শেষ করা সম্ভব হবে না,কেননা আল্লাহর কৃপায় শিল্পী হিসাবে তার প্রতিভা ছিল অতুলনীয়,তা ছাড়া তার প্রখর বুদ্ধির প্রশংসা না করেও উপায় নাই।প্রতি সকালে একজন ছাত্রের দায়িত্ব ছিল ওস্তাদের জন্যে ছবি আঁকার কলম,ব্রাশ,রং,কাগজ কাজের ঘরে নিয়ে যাবে,তার সঙ্গ পাওয়ার বিরাট সূযোগ।আর এই সূযোগ নেয়ার আমরা ছাত্ররা রীতিমত নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি,মারামারি ব্যাস্ত হয়ে
যেতাম।ওস্তাদ ওসমানের একজন প্রিয় ছাত্র ছিল যদিও,তবে প্রতিদিন তাকে ওস্তাদের কাছে যাওয়ার সূযোগ দেয়া আর নানান ধরনের গুজব,কানাঘুষার সূযোগ করে দেয়া একই কথা,তাই সপ্তাহের একেক দিন একেকজন ছাত্রের জন্য নির্ধারিত করা ছিল। শুক্রুবারে আর শনিবারে ওস্তাদ বাড়িতেই সময় কাটাতো।ওস্তাদের ছেলে,যে পরে ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো,-সে ছেলেও সাধারণ ছাত্রের মতই মঙ্গলবারে তার কাগজ,ব্রাশ ইত্যাদি নিয়ে যেত।আমাদের সাথে,বেশ লম্বা একজন ছাত্র ছিল ‘বৃহষ্পতিবার’,তার প্রতিভার কাছে আমরা ছিলাম খুবই সাধারণ,হঠাৎ কমবয়সেই প্রচন্ড জ্বরে ছেলেটা মা্রা গেল।জারিফ এফেন্দীর যাওয়ার দিন ছিল বুধবার,তাই তার নামটা, ‘বুধবার’ হয়ে গেল।পরে ওস্তাদ সকলের নাম আদর করে বদলে দিল,তার সাথে দেখার দিনের হিসেব করে।ওস্তাদ নাম বদলে, ‘মঙ্গলবার’কে করলো, ‘লেইলেক(বক)’, ‘শুক্রুবার’ হলো, ‘জেইতিন’,আর ‘রবিবার’ হলো, ‘কেলেবেক(প্রজাপতি)’,বিগত জারিফ এফেন্দীর নামটা তার বই এর পাতার নক্সার জন্য।আজকে কি ওস্তাদ ওসমান তাকে ঐ ভাবেই ডাকলো, ‘কেমন আছ,বুধবার’?সেই আগের সুরে।
ওস্তাদের কথাগুলো,তার আদরের ছোঁয়ার কথা মনে পড়লেই এখনও আমার চোখ দুটো কান্নায় ভরে যায়ঃআমাদের আঁকা ছবি দেখে ওস্তাদ অনেক সময় কেঁদে উঠতো আনন্দে,হাত ধরে চুমু খেত সময়ে সময়ে,মার খাওয়া সত্বেও ছাত্রদের মনটাও ভরে যেত আনন্দে।আমাদের মধ্যের ঈর্ষাটাও ছিল বন্ধুত্বসুলভ।
এখন আমি সম্পুর্ন নতুন এমন এক মানুষ,যে অনেক ভাগে ভাগ হয়ে আছে,একটা ছবির মত যার মাথা,হাত আঁকা এক ওস্তাদ শিল্পীর হাতে আঁকা আর শরীরের অন্যান্য অংশ,কাপড়চোপড় আঁকা আরেক ওস্তাদ শিল্পীর হাতে।আমার মত একজন আল্লাহর পথের বিশ্বাসী একজন মানূষ যখন খুন করে,অনেক সময় নেয় মনটাকে শান্তনা দেয়ার জন্যে।নিজের দ্বিতীয় একটা ছবি তৈরী করলাম,যা খুনীর সাথে মানানসই,আর আছে একপাশে আমার সাধারণ জীবনটাও।তবে আমি এখন সেই নিষ্ঠুর দ্বিতীয় মানুষটা,আমার সাধারণ জীবনযাত্রার বাইরের আরেকটা চরিত্র।অবশ্যই আশা করি কোন একসময় সেই সাধারণ মানুষটা ছুটে আসবে,ছুঁড়ে ফেলবে খুনী চেহারাটা দূরে কোন অজানায়।কেউ যেন ভুলেও না ভাবে ঐ দুটা চরিত্র আসলে একটা মানুষ,এ ভাবেই একজন শিল্পীর সাথে আরেক শিল্পীর সাথে আরেক শিল্পীর পার্থক্য।
স্বীকার করছি,এটা একটা সমস্যা,ওস্তাদ ওসমানের দেয়া নাম দিয়ে কথা বলতে পারি,কিন্ত এটাও আমার কাম্য না,যেন কেউ বুঝতে পারে আমি কেলেবেক,জেইতিন না লেইলেক।এ ভাবে তো যে কেউ আমাকে সুলতানের সৈন্যদের হাতে অত্যাচারের জন্যে তুলে ধরতে দ্বিধা করবে না।
এটা তো জানাই,যখনই কোন কথা বলছি,সেটা নিশ্চয় বিশ্লেষন করছে সবাই।যাই বলি না সর্তকতার সাথেই আমাকে বলতে হয়,যাতে নিজেকে কোন ভাবে জড়িয়ে না ফেলি।এমন কি আমার ‘আলিফ’, ‘বে’, ‘জিম’, এর গল্পকথায় বেশ সর্তক ছিলাম,কেন না যে ভাবে তুমি আমার দিকে তাকিয়েছিলে।
একদিকে যোদ্ধারা,প্রেমিকরা,শাহজাদারা,কিংবদন্তীর নায়কেরা যাদের ছবি আমার তুলিতে আঁকা হাজার হাজার বার সময়ের ছবিতে যেখানে যেটা দরকার,সেই গল্পের দেশে-কোন সময় শত্রুদের সাথে যুদ্ধ,কোন সময় ড্রাগনের যুদ্ধে,যোদ্ধারা হত্যায় ব্যাস্ত না হয় কাঁদছে কোন সুন্দরীকে হারিয়ে।তাদের শরীরের একপাশটা তাকিয়ে থাকে বই এর দিকে,
আর কিছু না হোক ছবি আঁকাতে আমার দক্ষতা নিঃসন্দেহে অপুর্ব,আর প্রশংসার যোগ্য।কেউ কি বলতে পারবে আমার কথা বলার ভঙ্গীতে,আমি কে?
অনেকের ধারণা আমাকে ধরে শাস্তি দিতে পারলে,নিঃসন্দেহে জারিফ এফেন্দীর আত্মা পুরোপুরি শান্তি পাবে।আমি এই যে গাছের নীচে পাখীদের কিচির মিচিরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি,সবাই এখন জারিফের উপর মাটি ফেলছে,এখন মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার আনন্দটা অন্য সব অনুভতিকে ছাপানো,হয়তো বেহেশতে যাওয়ার আনন্দের চেয়েও।জারিফ এফেন্দী ঘৃনা ভঁরা ইরুজুমের মোল্লাদের সাথে যোগ দেয়ার সাথে সাথেই আমাকেও ঘৃনা করা আরম্ভ করলোঃঅথচ পচিশটা আমরা দুজনে সুলতানের নানান বই এর উপর একসাথে কাজ করলাম,বলা যায় দুজনে একাত্মার মতই ছিলাম।আমাদের সম্পর্কটা গড়ে উঠে যখন সুলতানের বেহেশতবাসী বাবাকে নিয়ে কাজ করছিলাম,ঘনিষ্ঠতা বাড়লো আরও যখন আজারবাইজানের কবি ফুজুলির কবিতার ছবির কাজ শুরু হলো।উপলদ্ধি করার জন্যে শিল্পীরা প্রায়ই লেখাগুলো পড়তো,একদিন দেখি জারিফ এফেন্দী ফুজুলির কবিতা আবৃত্তি করছে,আর কটা পাখী আমাদের মাথার উপরে ঘোরাঘুরি করছে,নিঃসন্দেহে বেশ অবাক হওয়ার মত ব্যাপার।এখনও আমার মনে পড়ে সেই সন্ধ্যার কবিতার কথাটা, ‘আমি সেই আমি নই,আমি সেই একের এক’,জানি না অন্যরা এটাকে কি ভাবে বর্ননা দিবে।
যখন শুনলাম জারিফের লাশ পাওয়া গেছে,ছুটে গেলাম সেই বাসায়,বাগানে বসে আমাদের ফুজুলির কবিতা পড়ার পুরোনো দিনে,এখন বরফে ঢাকা,গাছপালা সব মরে গেছে,আগাছা,জঙ্গলের,পড়ে থাকা একটা বাগানের মত।বাড়ীর চেহারাটাও অনেকটা সে রকম।পাশের ঘর থেকে চীৎকারের স্বরে মেয়েদের কান্না ভেসে আসছিল,একে অন্যের সাথে কান্নার প্রতিযোগীতায়।জারিফের বড় ভাই যখন কথা বলছিল,বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলামঃ
‘আমার প্রিয় ভাই জারিফের মাথাটা ভেঙ্গে চুরমার করে দিল এভাবে।চারদিন পরে কূয়া থেকে তুলে আনার পর তার ভাইরা কেউ তো তাকে চিনতে পারেনি,হতভাগী কালিবেকে কোন রকমে তার লাশ সনাক্ত করলো’।মনে পড়লো অনেকটা যেন,মিডিয়ানের ব্যাবসায়ীরা কূয়ায় ফেলে দেয়া ইউসুফকে যে ভাবে তুলে আনে।আমি ইউসুফ আর জোলায়খার ছবিটা এঁকে খুবই আনন্দ পেতাম,আমার কাছে মনে হতো হিংসা দ্বেষ মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় আবেগ।
কিছুক্ষন একটা নিস্তব্ধতা,সকলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি কি কাঁদবো?সিয়াহর সাথে চোখাচোখি হলো আমার।হারামজাদা,শয়তানটা,আমাদের তাকিয়ে আছে,যেন এনিষ্টে এফেন্দীর পাঠানো,রহস্য উদঘাটন করার জন্যে।
‘কে সেই মানুষটা যে এই ধরণের নিষ্ঠুর অপকর্ম করতে পারে?চীৎকার করে প্রশ্ন করলো জারিফ এফেন্দীর বড় ভাই, ‘নিষ্ঠুর পাশব খুন করলো আমাদের ভাইকে,আমাদের ভাই যে একটা পিঁপড়ারও ক্ষতি করেনি,কোনসময়’?
নিজের কান্নায় উত্তর খুঁজছিল সে,আমিও কান্নায় যোগ দিলাম।ভান করা দুঃখের চেহারায় প্রশ্ন করলামঃকারা ছিল জারিফ এফেন্দীর শত্রু?মনে পড়লো কিছুদিন আগে আমরা যখন ‘ নৈপুন্যতার ইতিহাস’ বইটার প্রস্ততি নিচ্ছিলাম,জারিফ তখন অনেক শিল্পীর সাথে ছবি আঁকার পদ্ধতি নিয়ে তর্ক বির্তকে বেশ ব্যাস্ত হয়ে পড়তো,যারা পুরোনো ওস্তাদদের ছবি আঁকার ধরণ বদলে একেবারে নতুন দিকে নিয়ে যাওয়ার উঠে পড়ে ব্যাস্ত ছিল,তারা আমাদের আঁকা ছবির পাতাগুলোতে জঘন্য রং দিয়ে একেবারে সস্তা ছবি করে ফেলতো।কে ছিল ঐ শিল্পীরা?অবশ্য একটা গুজব ছড়াচ্ছিল চারপাশে যে নীচের তলার এক ছাত্রের সাথে জারিফের সম্পর্ক নিয়ে এই রেশারেশি।আবার অনেকে বিরক্ত হতো জারিফ এফেন্দীর একনিষ্ঠ,পরিমার্জিত স্বভাবে,আতেলী মেয়েলী ভাবে-যাকগে সেগুলো
অন্য ব্যাপার।পুরোনো রীতির প্রতি জারিফ এফেন্দীর বিশ্বাসটা ছিল অনেকটা দাসত্বের মত,আর ওস্তাদ ওসমানের সামনে অন্যান্য শিল্পীদের ছবির অযথার খুঁত বের করা ছিল তার আরেকটা আনন্দ।জারিফের শেষ ঝগড়াটা ছিল যখন ওস্তাদ ওসমানের অভিযোগ নিয়ে,যখন প্রাসাদের শিল্পীরা টাকার জন্যে বাইরে ছোটখাট ছবির কাজ করা আরম্ভ করলো।সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতার তখন বেশ অভাব,শিল্পীদের হাতে আগের মত টাকা উপহার ছিল না,তাই অনেকেই অন্যান্য পাশাদের কাজ করতো,আর রাতের অন্ধকারে এনিষ্টে এফেন্দীর সাথে দেখা করতে যেত।
এনিষ্টে এফেন্দীর শয়তানের অশুভ প্রভাবের অজুহাত দিয়ে আমাদের বইটার কাজ বন্ধ করাটা আমাকে তেমন একটা বিচলিত করেনি।হয়তো তার জানা ছিল আমাদের মধ্যেই একজন জারিফ এফেন্দীর খুনী,যারা তার বই এর ছবিগুলোও আঁকছে।তার মনের কথাটা চিন্তা করলে এটাই স্বাভাবিক,কেউ কি আর একজন খুনীর সাথে ছবি আঁকা আলোচনার জন্যে রাতের অন্ধকারে দেখা করবে?যেই হউক না কেন সবাই চেষ্টা করবে খুনীকে আর প্রেষ্ঠ শিল্পীদের খুঁজে বের করার জন্যে।আমি জানি এনিষ্টে নিঃসন্দেহে তার যোগ বিয়োগের হিসাবে জেনে গেছে শিল্পীদের মধ্যে কে কোন বিষয়ে প্রতিভাবান,কে আনতে পারে রংএ ছোঁয়ায় যাদুর প্রভাব,কে আনতে বই এর পাতার নক্সায় আকাশ ছোয়া সৌন্দর্য,ছবি আঁকায় কার হাতে ফুটে উঠে মানুষের চেহারা,কার হাতে জীবন্ত হয় প্রকৃতির সুর,এর মাঝে আমার সাথে তার বই এর কাজ থেমে থাকেনি।আমার মনে হয় না তার চোখে আমি এক সাধারণ খুনী না,বরং একজন প্রতিভাবান শিল্পী।
আড়চোখে দেখছিলাম এনিষ্টের সাথে দাড়ামো গর্দভ সিয়াহকে।যখন তারা দুজন লোকজনের ভিড় এড়িয়ে যাচ্ছিল,আমিও তাদের পেছন পেছন গেলামম।এনিষ্টে আর সিয়াহ
দুজনে চার হালের একটা নৌকায় উঠলো,আমি গেলাম কিছু নতুন শিক্ষা নবীস শিল্পীর সাথে,ছয় হালের একটা নৌকায়,হৈ চৈ এর মত্তহয়ে গেছে সবাই,ভুলেই গেছে যে তারা একটা জানাজা থেকে ফেরত যাচ্ছে।ফানার গেটের কাছে গিয়ে দুই নৌকায় প্রায় ধাক্কা লাগার মত অবস্থা,দেখলাম সিয়াহ এনিষ্টের কানে কানে কিছু একটা বলছে।
ভাবছিলাম,কত সহজেই না মানুষের জীবন শেষ করা যায়,আল্লাহ,তুমি আমাদের হাতে
কত ক্ষমতায় না দিয়েছ,আর তার সাথে প্রচন্ড ভয় ব্যাবহার করার।ভঁয় সরাতে পারলে,সে হয় নতুন চেহারার অন্য একটা মানুষ।এক সময় শয়তানের ভঁয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম,ভঁয় হতো কোন অপকর্ম না করে ফেলি।এখন এটুকু বুঝি যে অপকর্ম এড়ানো সম্ভব,আর এটাও ঠিক যে অপকর্ম শিল্পীর জীবনে অবশ্যই প্রয়োজনীয় কিছু একটা।ঐ মানুষ নামের পদার্থটাকে খুন করার পর,আমার প্রতিভার নবজন্ম হলো,আগের চেয়ে এখন অনেক বেশী ভাল ছবি আঁকছি।এর মাঝে একটাই ইস্তাম্বুলে কতজন আছে যারা আমার ছবির প্রকাশটাকে সত্যি সত্যিই উপলদ্ধি করতে পারবে।
নদীতে বসে জীবালী দিয়ে দূরের ইস্তাম্বুলের চেহারাটা ভেসে আসছিল,বরফে ঢাকা বাড়ীগুলো দেখা যাচ্ছিল,মেঘের ফাঁকে ফাঁকে।একটা শহর যত বড় হয় তত সহজেই সেখানকার মানুষগুলো তাদের পাপ,অপকর্ম লুকিয়ে রাখতে পারে সহজেই,যত বেশী লোক তত সহজেই লুকাতে পারে অপরাধীরা তাদের পেছনে।একটা শহরের পরিচয়,তার শিল্পী,কালিগ্রাফার,লাইব্রেরী,স্কুলে না বরং সেই শহরটার হাজার হাজার বছরের মানুষের অপরাধের ইতিহাসে।আর সে হিসাবে কোন সন্দেহ নাই যে ইস্তাম্বুল পৃথিবীর প্রথম সারির শহরের মধ্যে একটা।
উনকাপান ঘাটে,আমি সিয়াহ,এনিষ্টের পরেই নামলাম।তারা দুজনে একে অন্যের উপর ভর দিয়ে পাহাড়ে উঠছিল,দেখলাম কিছুদিন আগের সুলতানের আগুন লাগা মসজিদের সামনে কথাবার্তা বলে বিদায় নিল একে অন্যের কাছ থেকে।এনিষ্টে তখন যেন একা অসহায় একটে চরিত্র।ইচ্ছা হচ্ছিল আমি এনিষ্টের কাছে ছুটে গিয়ে বলি,ঐ অসভ্য বর্বর যার জানাজা থেকে ফিরে এলাম,সে আমি সবসময় বিভ্রান্ত করারা চেষ্টা করেছে,জিজ্ঞাসা করবো, ‘জারিফ এফেন্দী যা বলতো সেটা কি সত্যি’?আমরা কি আমাদের সুলতানের বিশ্বাসের বিপরীতে কাজ করছি?আমাদের ছবি আঁকার ধরণ কি আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীতে,বিরুদ্ধে?আপনি কি সেই বিরাট ছবিটা শেষ করলেন?
বরফ ঢাকা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম,অন্ধকার তার ছায়ায় ধীরে ধীরে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তাদের রাজ্যে,নির্জন রাস্তায় হয়তো আড়চোখে আমাকে দেখছিল জিন,পরী,সাথে চোর চোট্টারা,আর দুঃখী মনের বাবা,ছেলেরা।রাস্তাটার শেষ মাথায় এনিষ্টে এফেন্দীর দোতালা রাজকীয় প্রাসাদ আর সেই ছাঁদের নীচে থাকে,পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা,কিন্ত তাতে আমি কেন পাগল হবো?
(