Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
২৮)
আমি তোমার প্রিয় মামা
জানাজা,কবর হলো বেশ জাঁকজমক করেই,বলতে পারি অনেকটা আমার মনের মতই।ভাল লাগছিল সবাইকে দেখে আমার পুরোনো জানাশুনা,সবাই ছিল সাথে অজানা বেশ কয়েকজন।উজির নাজিরদের মধ্যে,সাইপ্রাসের হাজী হুসেইন পাশা,খোড়া বাকী পাশা,যাদের আমি কম উপকার করিনি।সুলতানের হিসাব নিকাশের উজির কিরমিজি (লাল) মেলেক পাশা,আমার মৃত্যুর সময় যাকে নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছিল,যার সুবাদে আমাদের এলাকার মসজিদের চেহারা বদলে বেশ সুন্দর হয়ে গেছে।বেঁচে থাকলে আর সুলতানের দপ্তরে কাজ করলে নিঃসন্দেহে এক পর্যায়ে পদমর্যাদায় মোস্তফা আগার সমকক্ষ হতাম,যে এখন সুলতানের দপ্তরের প্রধান ঘোষক।জানাজায় উপস্থিত লোকজনের মধ্যে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারী,সম্মানিত ব্যাক্তিরা উপস্থিত ছিল, প্রাসাদের আসবাব পত্রের দায়িত্বের উজির কেমালউদ্দীন পাশা, উজিরে আজম(প্রধান মন্ত্রী) সালিম এফেন্দী যার মেজাজের বেশ নাম ডাক আছে,দপ্তরের অন্যান্য ঘোষকরা যারা অনেকেই আমার বন্ধু আর অনেক কজনকে বলা যায় চরম শত্রু।আরও ছিল উচ্চপদস্থ লোক যারা সুলতানের কাজ ছেড়ে ব্যাবসা বানিজ্য, অন্য কাজ করতো,আমার স্কুল জীবনের বন্ধুরা,আত্মীয় স্বজন যারা খবর পেয়ে ছুটে আসতে দ্বিধা করেনি।
আমার এলাকার লোকজন তাদের দুঃখী ভাব দেখে আমাকে কম অবাক হয়নি।খাজাঞ্চী হাজম আগা,সুলতানের প্রধান সেনাপতিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মহামান্য সুলতান আমার অকাল মৃত্যু বা খুন খুব সহজভাবে মেনে নেয়নি।তবে জানি না খুনীকে ধরার কতটুকু চেষ্টা করা হবে?তবে এটা জানি ঐ খুনী এখন সকলের সাথে এখানে এসে আমার লাশ দেখে মায়াকান্নায় ভেসে যাচ্ছে।আমার খুনী জানে, এটা তার সৌভাগ্য প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে আমি বসে নাই,যদিও আমার আত্মা রাগে দুঃখে অতিষ্ঠ হয়ে ভাবছিল যদি কোন ভাবে তাকে খুন করা যায়।তবে এখন আমি অন্য এক জগতে,যেখানে কোন অশান্তি নাই ,দুনিয়াতে যুগ যুগ ধরে যন্ত্রনা ভোগ করে আমি এখন ,শান্তির রাজ্যে।
আমার আত্মা ছেড়ে গেছে শরীর,কালির দোয়াতের মারের দাগ আর রক্তে ভঁরা শরীর যন্ত্রনা ছেড়ে গেছে শান্তির দেশে ।আলোয় ছড়ানো শরীরটা কাঁপছিল মাঝে মাঝে,দুজন ডানাওয়ালা ফেরেশতা আমাকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল,যে ভাবে লেখা আছে আত্মা কাহিনিতে।অদ্ভুত,নির্মল এক ছোঁয়া, বেহেশতী সুর সেই ছোয়ায়,একটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম,আমরা।ছেড়ে গেলাম আগুনের জোয়ার,আলোর নদী,ঘুটঘুটে অন্ধকার সমুদ্র,নানান ধরনের পোকামাকড় আর জীবজন্তদের মাঝ দিয়ে। ‘কে যাচ্ছে,কাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছে’? দূরের থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করবে, ফেরেশতা নাম,বংশ পরিচয় সব কিছু বলে দিবে। ‘আল্লাহর একজন অনুগত ভক্ত যাচ্ছে’,কথাটা শুনে কান্নায় আমার চোখ ছলছল করবে,কিন্ত জানি কেয়ামতের দিন সে হয়তো হাজার হাজার বছর পরে,যখন দোজখ আর বেহেশতের মানুষদের আলাদা করা হবে।
ইমামা গাজ্জালী,আল জেভজিয়ে,অন্যান্য নামকরা ধর্মীয় গুরুদের যে ভাবে বলা মৃত্যুর পরের পর্ব, অনেকটা সেই ভাবেই ঘটছিল সবকিছু।অবিশ্বাস্য ঘটনা যা শুধু মৃতদের উপলদ্ধি করা সম্ভব একে একে ফুটে উঠছিল আমার চোখে,নানান রংএ।
জানিনা কি ভাবে বর্ননা করবো ইহলোক থেকে পরলোকের এ যাত্রা, রং এ ভরা এই পৃথিবী,রং ছড়ানো জগতের আনাচে কানাচে,এই রং এর জোয়ার একটা দেয়ালের মত দাঁড়িয়েছিল,আমার ছেড়ে আসা চেনা জগত আর মরলোকের সাথে।এখন জানি এই রংএর আকাশটার মায়াতে আটকে ছিলাম চেনা জগতটায়,কমলা রং এর আকাশ,সবুজ পাতার শরীর,বাদামী রং এর ডিম,নীল রং এর ঘোড়া।
আমার আঁকা ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ছুটে আসছিল আমার কাছে,অবাক হয়ে দেখছিলাম সৃষ্টির রহস্য প্রথম বারের মত,যেন স্বপ্ন ভেঙ্গে জেগে ওঠা নতুন একজন।আমার সামনের পৃথিবী,অস্তিত্ব যার কোন আদি ছিল না, অন্ত নাই,আমি এখন সেখানে,তবুও ছেড়ে আসা পৃথিবী চিরন্তন হয়ে থাকবে আমার স্মৃতির পাতায়। রং এর ঐ জগতে মুক্ত এক বিহঙ্গ আমি,কোন বাঁধন নাই,মানা না মানার কিছু নাই,সময়ের কোন বাঁধন নাই,দিগন্ত থেকে দিগান্তরে ছুটে যেতে পারি ইচ্ছামত।
এই স্বাধীনতায়,ভঁয়ে আর আনন্দে মনটা ভঁরে গেছে আমারঃআমি তো এখন সেই মহাশক্তির কাছে,আমি এখন আল্লাহর দরবারে,আমি এখন আল্লাহর অবিশ্বাস্য লাল রং এর ছোঁয়ায়।অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই সেই লাল এর প্রাচুর্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেল সবকিছু,অভিভুত হয়ে গেলাম আমি আর স্তব্ধ হয়ে ছিল আমার চারপাশের জগতটা।এগিয়ে যাচ্ছিলাম আল্লাহর কাছে,ইচ্ছা হচ্ছিল আনন্দে কেঁদে উঠি, তবে রক্ত মাখানো এই চেহারা নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হতে বেশ অস্বস্তি লাগছিল আমার।বই এ পড়া ,আল্লাহ ফেরেশতা আজরাইল আর অন্যান্যদের দিয়ে বান্দাদের ডেকে পাঠানোর দৃশ্যটা ছবির মত ভেসে আসছিল আমার সামনে।
আমি কি দেখতে পাব,আমার সৃষ্টিকর্তাকে?উত্তেজনায় নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না ,যে লালটা আমার দিকে ছুটে আসছিল, ছড়ানো ছিল চারপাশে,আর মাঝে ছিল সম্পূ্র্ন জীবজগত-ঐ সৌন্দর্য ব্যাখা করার মত শক্তি আমার নাই।আনন্দে আমার চোখ কান্নায় ভরে গেছে তখন,আমি মহান আল্লাহর সামনে হাজির হতে যাচ্ছি।জানতাম ঐ মহান শক্তিকে এর চেয়ে বেশী কাছে উপলদ্ধি করার সূযোগ কোনদিন ঘবে না।আল্লাহ আমার খোঁজ পাবে ফেরেশতাদের কাছ থেকে,তার অনুগত একজন ভৃত্য,] আমি,যদি তার আদরের যোগ্য হই এর চেয়ে আর বেশী কিছু চাওয়ার কিইবা থাকতে পারে?
আনন্দ ভঁয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, ‘গত বিশ বছরে আমি ভেনিসের ঐ কাফেরদের ছবি আঁকা দেখে অভিভুত হয়ে গেছি।একটা সময় ছিল যখন নিজেও ওদের প্রভাবে ছবি আঁকার লোভ সামলাতে পারিনি,তবে আঁকা হয়ে উঠেনি।বরং সুলতান,তার রাজত্ব,ক্ষমতা,প্রতিপত্তির ছবি ঐ কাফেরদের মত এঁকেছি’।
আল্লাহর স্বর আমার জানা নাই,তবে আমার মন আমাকে বলে দিল,
‘পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিন সবই আমার আয়ত্বে’।
আমি আমার উত্তেজনাকে ঢেকে রাখতে পারিনি।
‘তা হলে এই পৃথিবী,এ সব কিছুর মানে কি’?
‘ওটাই তো রহস্য’,জানি না ওটা কি আমার মনের কথা নাকি মহান সৃষ্টিকর্তার ইঙ্গিত।
ফেরেশতা্রা তখন আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল,বুঝলাম আমাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে,কিন্ত তবুও আমাকে অপেক্ষা করতে হবে ঐ হাজার হাজার আত্মাদের সাথে যারা অপেক্ষা করে আছে বেরজায়-পৃথিবী আর বেহেশতের মাঝে,অপেক্ষা করছে কেয়ামতের দিন,শেষ বিচারের জন্য।আমাদের ধর্মীয় বই এ যেভাবে লেখা আছে,ঠিক সে ভাবেই ঘটছে সবকিছু।মনে পড়ে গেল লেখা আছে কেতাবে ,শরীর আর আত্মা একসাথে যোগ হবে আবার,শেষ বিচারের দিনে।তবে লাশের সাথে আত্মার ঐ যোগাযোগের কথা আর কিছু না শুধু কথার কথা।।শোক,কান্নাকাটি শেষ হওয়ার পর লোকজন দোয়াদরুদ পড়ে আমাকে হিলক কবরস্থানে চিরদিনের জন্য বিদায় দিল।
পাহাড়ে হেঁটে যাওয়া লোকজনদের দেখে মনে হচ্ছিল টানা লম্বা একটা রশি এগিয়ে যাচ্ছে।
যাক গে,আমার অবস্থাটা একটু পরিষ্কার করে বলা দরকারঃ যে ভাবে জানা আমাদের সম্মানিত পয়গম্বরের কথায়- ‘আত্মা একটা বিশ্বাসী পাখী যে তার খাবার খুঁজে পায় বেহেশতের গাছপালায়’,-মৃত্যুর পরে মানুষের আত্মা ঘুরে বেড়ায় চারপাশে।এটা আবার অন্যভাবে বলা আছে আবু ওমর বিন আবদ ইবেরের ভাষায়- ‘ঐ কথার মানে এই না যে মানুষের আত্মা একটা পাখীর রূপ নেয়’’,
গুনী আল জেভজিয়ের কথায় সেটা হলো যেখানে পাখীদের সমাগম সেখানে মানুষের আত্মাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।যেমন আমি দেখতে পাচ্ছি,একটা রশি যেন হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে কবরস্থানের দিকে,অনেকটা যেন একটা ছবি বিশ্লেষণ করার আনন্দ নিয়ে দেখছিলাম আমি,একটা নৌকা তার পাল নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বসফরাস নদীর ধারে সুলতানের প্রাসদের দিকে।মসজিদের মিনার থেকে মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবীটা যেন একটা বই আর তার পাতাগুলো আমি এক এক করে দেখে যাচ্ছি।
তবে আমার দেখায় একটা বিশেষত্ব আছে,এটা তো মানুষের চোখের দেখা না,শরীর হারানো আত্মার দেখা,আমি সবকিছুই দেখতে পারি এক দেখায়ঃযেমন বসফরাস নদীর অন্যদিকে শেখদার ছেড়ে খালি কবরস্থানে বাচ্চা ছেলেরা খেলা করছে,একদিকে পররাষ্ট্র দপ্তরের উজিরের বজরা বয়ে যাচ্ছে সাতজন মাঝি নিয়ে বার বছর সাতমাস আগে,ভেনিসের রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে আমরা প্রধান উজিরের সাক্ষাৎকারের জন্যে এগিয়ে যাচ্ছি,টাক মাথার রাগীশ পাশা হেঁটে যাচ্ছে,লাঙ্গা বাজারের ব্যাবসায়ী মহিলা তার বিশাল বাঁধাকপি নিয়ে বসে আছে,সুলতানের ঘোষক রামাজান এফেন্দীর মৃত্যুর পর আমার চেহারার আনন্দ,ওটা ছিল আমার উপরে উঠার সূযোগ,দাদীর কোলে বসে লাল পোশাক অবাক হয়ে দেখছি,কি ভাবে সেকুরের জন্মের সময় দাই এর জন্যে চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম।
লাল চামড়ার বেল্টটা যেটা প্রায় চল্লিশ বছর আগে হারিয়ে গেছে(জানি ভাসিল ওটা চুরি করে নিয়ে গেছে),বছর পচিশ আগে দেখা সুন্দর বাগানটা,আল্লাহর কাছে আমি যার জন্যে সবসময় দোয়া করতাম,ইস্তাম্বুলের আলী বেগের কাছে আনা বিদ্রোহীদের নাক,কান,মাথার চেহারা,ঐ ভাবেই জর্জিয়ার পাশা বিদ্রোহীদের খুব সহজেই দমন করেছিল,আমার প্রিয় সেকুরে সকলের কাছ থেকে সরে গিয়ে আমার জন্যে কাঁন্নাকাটি করছে।
নানান বই যে ভাবে লেখা আছে,তা ছাড়া কথাটা জ্ঞানীগুনীদেরও বিশ্বাস,মানুষের আত্মা চারটা অবস্থায় থাকে
১)মায়ের জরায়ুতে
২)এই পৃথিবীর হিসাব নিকাশে
৩)বেরজা বা যেটাকে বলা যায় বেহেশত আর পৃথিবীর মাঝামাঝি
৪)বেহেশত বা দোজখ যেখানে পাঠানো হবে আমাকে বিচারের পরে
বেরজার এই মাঝপথে,পুরানো আর নতুন এক সাথে ভেসে উঠে চোখের সামনে,,মনের খাতায় আটকে থাকা স্মৃতি,সময়ের কোন বাঁধন নেই সেখানে।মানুষ যখন সময় আর অবস্থানের যাঁতাকল থেকে বের হয়ে আসে,তখনই সে বুঝতে পারে জীবন,বেঁচে থাকা আর কিছুই না,বাঁধনের এক কারাঘর।শরীর ছাড়া জীবন মৃতদের মাঝে,একই ভাবে আত্মা ছাড়া শরীর মানুষের কাছে,দুটো তো এক।দেখলাম সেকুরে কাঁদছে,অবুঝ মনের অযথার কান্না,আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম যেন মানুষকে দেয় আত্মা ছাড়া শরীর পৃথিবীতে,আর দেয় শরীর ছাড়া আত্মা মরলোকে।
এটা আমি,ওস্তাদ ওসমান
জানিনা কজন জানে এই গোঁড়া বুড়োদের কথা,যারা সারা জীবন উৎসর্গ করে গেল শিল্পকলার স্বার্থে।পথ আটকানো পাথর সরাতে তারা কোন স্বিধা করেনি,যে কোন শক্তির সম্মুখীন হতে তারা ভয় পাইনি,ধর্ম,সৃষ্টির রহস্য ছিল তাদের কাছে তুলির আঁচড়ে।ফেলে আসা দিন আর সামনের দিনগুলোর মাঝে কোন তফাৎ ছিল না,নাই তাদের কাছে।চেহারায় লম্বা,পাতলা বা অন্য যে রকমই হোক,তাদের মেজাজ মোটামুটি সবসময়ই খারাপ থাকে,তাদের সন্তষ্টি,তৃপ্তি নাই কোন কিছুতেই,আছে অভিযোগের পর অভিযোগ।সব কিছুই আয়ত্বে আনার জন্যে তারা অস্থির,ওদের কাজকর্ম ব্যাবহার চারপাশের মানুষকে হতাশ করে ।সব কিছুই তাদের অপছন্দ,আমি কি ভাবে জানি,
আমি তো তাদেরই একজন।
সব ওস্তাদদের ওস্তাদ যাকে বলা হয়,সেই নুরুল্লা সেলিম ছেলেবী,তার সাথে বসে ছবি আঁকার সৌভাগ্য হয় আমার।যদিও ওস্তাদ নুরুল্লার বয়স তখন আশির কাছাকাছি,আর আমি বছর ষোল বয়েসের অবুঝ দাম্ভিক শিল্পী (অবশ্য ওস্তাদ আমার মত এত খিটখিটে মেজাজের ছিল না)।সোনালী চুলের ওস্তাদ আলী,বছর তিরিশ আগে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন,তার ব্যাবহার ছিল অনেকটা আমার মত(অবশ্য দেখতে লম্বা পাতলা ছিল না ওস্তাদ আলী)।ঐ সব কিংবদন্তীর ওস্তাদদের নামে যখন লোকজন অযথা কাদামাটি ছুঁড়ে সেটা আমার গায়েও এসে লাগে।
আমি এটাও বলতে চাই, ঐ অভিযোগগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন,অযথাই মানুষ ঐ ওস্তাদদের গোয়ার ভাবের জন্যে তাদেরকে ও ভাবে নাজেহাল করার কোন মানে হয় না।
এগুলো সত্যি কথাঃ
১)যে কারণে আমরা নতুন কিছু পছন্দ করি না,পচ্ছন্দ করার মত কিছু থাকে না বলে।
২)বেশীর ভাগ লোককেই আমরা নির্বোধ ভাবি,এ জন্যেই বেশীর ভাগ লোক আসলেই নির্বোধ,না বুঝে অযথার ঝড়,ঝগড়াঝাটিতে ব্যাস্ত।অবশ্য এমন না যে আমরা হিংসায় অহংকারে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি(স্বীকার করতে আপত্তি নাই অবশ্য তাদের সাথে একটু ভাল ব্যাবহার করতে দোষ কোথায়)
৩)যে কারণে আমি লোকজনের নাম,মুখ ভুলে যাই-শুধু শিল্পী আর আমার ছাত্র,যারা বছরের পর বছর আমার সাথে কাজ করে যাচ্ছে,অন্যান্য মানুষদের মনে রাখার মত কোন বিশেষত্ব হয়তো ছিল না।
এনিষ্টে এফেন্দীর জানাজার সময়(যাকে আল্লাহ সময়ের আগেই আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে) ভাবছিলাম,এনিষ্টে ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরন করার জন্য আমাকে প্রায়ই বলতো,অন্ধত্ব আর মৃত্যু দুটোই আমার কাছাকাছি এখন।জানি ততদিনই আমি মানুষের মনে থাকবো,যতদিন আমার ছবি,বই এর পাতা দিয়ে পৌঁছাবে মানুষের চোখে।যদিও আমি এখন মৃত্যুর কাছাকাছি তবুও অনেক কিছু যা আমার মনে আনন্দ জোগায়,হাসির খোরাক টেনে আনেঃ
১)ভাবতে মজাই লাগে,বাচ্চা,ছেলেমেয়েরা-তারা কি জানে তাদের কি দরকার এই পৃথিবীতে?
২)স্মৃতির পাতার সুন্দরী মেয়েটা,অপূর্ব সুন্দর কিশোরের মুখটা,একটা ভাল ছবি আঁকার আনন্দ,আমার বন্ধুত্বের সময়ের ছবি।
৩)হেরাতের পুরোনো ওস্তাদ শিল্পীদের আঁকা ছবি উপভোগ করার আনন্দ।
এ জন্যেই এ সব আলোচনা করছি,সুলতানের ছবি আঁকার দপ্তরের পরিচালনার দায়িত্ব আমার,তবে এটাও জানি ও ভাবে সাজিয়ে কোন ভাল ছবি আঁকা সম্ভব না। জানি শিল্পের ঐ আকাশ ছোঁয়া রুপ নিঃসন্দেহে শেষ হয়ে যাবে এ ভাবে একদিন।দুঃখের সাথে বলতে হয়,সারাজীবন সাধনার পরও আমরা আজও হেরাতের ওস্তাদ শিল্পীদের প্রতিভার ধারে কাছে পৌছাতে পারি নি,সহজে বলতে পারলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যেত,তবে বিনয়ী চরিত্রের মানুষ শিল্পীদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।
তবে ওস্তাদ হেরাতের পদ্ধতিতে আমার আঁকা বেশ কিছু ছবি আছে-সুলতানের প্রাসাদের অনুষ্ঠানের ইতিহাসের বইটায়-আছে শাহজাদার মুসলমানীর অনুষ্ঠান-মিসরের গর্ভনরের দেয়া উপহার-সোনার পাতে মোড়ানো নীলা মনিমুক্তা দিয়ে সাজানো তলোয়ারের খাপ,লাল ভেলভেট কাপড় দিয়ে মোড়ানো,সাথে ছিল তার বিদ্যুতের গতির দ্রুত ঘোড়া,যার নাকে সাদা রশি,গায়ে রুপালী পোষাক।তুলির আঁচড়ে আমার হাতে আঁকা ঘোড়ার ছবিটা,তলোয়ার তার খাপটা,আর দর্শকদের ছবিগুলো আঁকা শিষ্যদের হাতে,আমার নির্দেশে।প্রাসাদের ঘোড়দৌড় এলাকার গাছটায় ছিল আমার দেয়া বেগুনী রং,তাতারের রাষ্ট্রদূত খানের পোশাকের হাতায় আর বোতামে ছিল হলুদ রং।ঘোড়ার রশিটা যখন সোনার গুড়া দিয়ে সাজাচ্ছিলাম,কেউ একজন দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাক দিল।
দেখলাম দাঁড়ানো সুলতানের পেয়াদা,খাজাঞ্চীর ডাক,সারা শরীর যেন ব্যাথায় কুঁচকে উঠলো,
চশমা হাতে ছেলেটার সাথে গেলাম।ভালই লাগছিল ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে কাজ করার পর,
রাস্তার খোলা বাতাসে হেঁটে যেতে, মনে হচ্ছিল আমি যেন নতুন একটা পৃথিবীতে-এটা কোন ছবিতে উপলদ্ধি করা যায় না,আল্লাহর হাতে বানানো নতুন একটা জগৎ।একটা কুকুরকে দেখলাম যা আমার আঁকা অন্যান্য কুকুরদের তুলনায় অন্যন্য।একটা ঘোড়া ছুটে যাচ্ছিল-আমার দেখা ওস্তাদ শিল্পীদের তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেক উচুমানের।একপাশের গাছটা আরেকটু ভাল করে পরখ করে দেখলাম,কিছুক্ষন আগে ঐ গাছটাতে আমি বেগুনী রং দিয়ে সাজাচ্ছিলাম,কিন্ত এ গাছের সাথে তার তুলনা হয় না।
ঘোড়দৌড় এলাকা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম,যার ছবির পর ছবি আঁকলাম গত বছর দুয়ে,কিছুটা যেন নিজের আঁকা ছবিতেই ফিরে গেছি।ভেনিসের আঁকা শিল্পীদের ছবি হলে,আমরা ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম,হেরাতের ওস্তাদদের আঁকা হলে আমরা সবকিছু দেখতাম বাতাসে ভেসে ভেসে,আর চীনা পদ্ধতিতে আঁকা হলে আমি হতাম ছবির একটা অংশ,ওদের ছবি আঁকার ধরণটা যেন সীমা হারানো,অনন্ত আকাশ।
দেখলাম পেয়াদা,মহামান্য সুলতানের দরবারের খাজাঞ্চীকে ছবি দেখানোর জায়গা,যেখানে শিল্পীদের শারিরিক সুস্থতা নিয়েও আলাপ আলোচনা হতো,যা রং,সোনার পাতা নিয়ে যাওয়ার জায়গা,খাজাঞ্চীর অকেজো জামাইকে নিয়ে আলাপ আলোচনার জায়গা,সেখানে না গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সুলতানের ব্যাক্তিগত বাগানে।অবশ্য ঠিক সেখানে না গিয়ে আরেকটু এগিয়ে সুলতানের ময়রার ঘর ছেড়ে আমরা গেলাম,প্রাসাদের পাহারাদারদের ঘরে,খাজাঞ্চী আর রক্ষীবাহিনীর প্রধান বসে ছিলঃফেরেশতা আর শয়তান।রক্ষীবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বের মধ্যে ছিল,জল্লাদের কাজ,বন্দীদের অত্যাচার করে জবানবন্দী নেয়া,আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো সে।কেন জানি মনে হলো বন্দী অবস্থায় জেলে বসে আমাকে গল্প দেয়া নেয়া করতে হবে।
খাজাঞ্চী একটু জোর গলায় বললো, ‘আমাদের সুলতান বছর খানেক হলো, গোপনে একটা বই বের করার দায়িত্ব দিল আমাকে,যেটা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতকে উপহার দেয়া হবে। ঠিক করা হলো সে সময় যে সালতানাত এর ঐতিহাসিক ওস্তাদ লোকমানকে বই এর গল্পকথা লেখার দায়িত্ব দেয়াটা ঠিক হবে না।ওস্তাদ ওসমান আপনাকেও বই এর কাজে নেয়া হবে না,যদিও আপনার দক্ষতায় সুলতান পঞ্চমুখ।তা ছাড়া সে সময় সুলতানের দরবারের অনুষ্ঠানের বই নিয়ে আপনি বেশ ব্যাস্ত ঞ্ছিলেন।
ঘরে ঢুকে বুঝতে পারলাম আমার নামে লোকজনের অপবাদে সুলতানের দরবারের কান ভারী হয়ে আছে, চুগলিখোররা নিশ্চয় বলতে ছাড়েনি,আমার আঁকা ছবিতে সুলতানের নিন্দা ভঁরা চেহারা কথা।বোঝাই যাচ্ছে ঐ চুগলীখোরদের কথায় সুলতানের বেশ আস্থা আছে,আর আমার কপালে আসছে হয়তো অত্যাচার,যন্ত্রনা।তবে দেখলাম যাতে আমি অসম্মানিত বোধ না করি খাজাঞ্চী আমাকে সুলতানের নতুন বই এর দায়িত্বটা না দেয়ার ব্যাখা বোঝানোর চেষ্টা করছিল,শুনলাম বইটার গল্পকথা,যা আমার জানাই ছিল।আমার উৎসুক্য ছিল ইরুজুমির নুসরেত হোজাকে নিয়ে,আর ছবি আঁকার দপ্তরের সাথে তার যোগাযোগের গল্প গুজবের কথা।
‘বই এর দায়িত্ব কার হাতে’?আমি প্রশ্ন করলাম।
‘দায়িত্ব ছিল এনিষ্টে এফেন্দীর হাতে,আপনার সাথে তার তো ভালই জানা শোনা ছিল’,খাজাঞ্চী বললো,একটু থেমে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে খাজাঞ্চী যোগ দিল, ‘আপনি তো তার মৃত্যুর কথাও নিশ্চয় জানেন,আর এটাও নিশ্চয় জানেন কেউ এনিষ্টে এফেন্দীকে খুন করে গেছে’?
‘না’,উত্তর দিয়ে আমি চুপ করে ছিলাম।
‘আমাদের সুলতান ঘটনাটা শুনে দুঃখে,রাগে বেশ বিচলিত হয়ে আছে’,খাজাঞ্চী বললো।
এনিষ্টে এফেন্দী ছিল একটা গবেট।ওস্তাদ শিল্পীরা তাকে নিয়ে সব সময় হাসি ঠাট্টা করতো, তার জানার চেয়ে হামবড়াই ভাবটাই ছিল বেশী,জ্ঞানের চেয়ে আকাঙ্খা ছিল আকাশ ছোয়া।কি ভাবে সে খুন হলো,কে জানে?
খাজাঞ্চী মোটামুটি আমাকে বিস্তারিত সবকিছুই বললো খুনের ব্যাপারে।
‘সুলতা্নের আদেশ বইটা শেষ করতে হবে’,খাজাঞ্চী বললো, ;আর হ্যা ঐ বইটা শেষ করতে হবে,আর আনুষ্ঠানিকতার বই এর গল্প কথাটা ভুলে গেলে চলবে না...’।
‘সুলতানের আদেশ ‘,বললো সুলতানের প্রধান প্রহরী, ‘খুনী যদি শিল্পীদের কেউ একজন,তাকে খুঁজে উদহারণ মূলক শাস্তির ব্যাবস্থা করতে হবে,যাতে রাজ্যের প্রতিটা মানুষ যেন সেটা সব সময় মনে রাখে’।প্রধান প্রহরীর কথা শুনে মনে হচ্ছিল তার জানা আছে খুনী কে,আর শাস্তি দেয়ার জন্যে তার হাত নিশপিশ করছে।মাত্র দিন কয়েক আগে মহামান্য সুলতানের দুজনকে নতুন বই এর দায়িত্ব দেয়ার কথা আমার কান এড়িয়ে যায়নি,এটাও আমার জানা ছিল রেশারেশি থাকা সত্বেও অনেকটা বাধ্য হয়েই ওরা একজন আরেকজনের সাথে সহযোগীতা করছিল।খবরটা শোনার পর সুলতানের প্রতি আমার সম্মানটা আরও বেড়ে গেছে তখন।একটা ছেলে সরবত এনে দিল আমাকে,
আরও কিছুক্ষন বসে থাকলাম আমরা ওখানে।
শুনলাম এনিষ্টে এফেন্দীর বোনের এক ছেলে আছে,সিয়াহ (ব্ল্যাক )এফেন্দী, এনিষ্টে এফেন্দীর কাছেই তার ছবই আঁকা,লেখার শিক্ষাদীক্ষা।মনে পড়ে না সিয়াহকে আমি চিনি,না চিনি না।দিন কয়েক আগে সিয়াহ(ব্ল্যাক),এনিষ্টে এফেন্দীর অনুরোধে যুদ্ধ থেকে ইস্তাম্বুলে ফিরেছে-যেখানে এক দলের সেনাপতির ছিল সে।ইস্তাম্বুলে ফিরে সে এনিষ্টের সাথে তার বইটার কাজ নিয়ে বেশ ব্যাস্ত ছিল।
সিয়াহ(ব্ল্যাক) এর মতে এনিষ্টে এফেন্দীর শিল্পীদের মধ্যে কেউ একজন রাতের অন্ধকারে খুন করে একটা ছবি চুরি করে নিয়ে গেছে,সুলতানের ছবি যার মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশী সোনার পাতা ব্যাবহার।দুই দিন সিয়াহ(ব্ল্যাক) এনিষ্টের খুনের খবর খাজাঞ্চী বা প্রাসাদের কাউকে জানায় নি,ঐ দুই দিনে এনিষ্টের মেয়ের সাথে সিয়াহর বিয়ে হলো,যা বেশ একটু খাপছাড়া,বেমানান।ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছিল খাজাঞ্চী আর প্রধান প্রহরী দেকনের কাছে সিয়াহ(ব্ল্যাক),অপরাধী,তারা কি ভাবছে সিয়াহই খুনী।
০০০০০০০০০০
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ২:৩৪