সারাবিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তো বটেই, যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না কিংবা ইন্টারনেট জিনিসটা কি তাও জানেন না— তাদের কাছেও গুগল একটি অতি পরিচিত শব্দ। বিশেষ কোন দিন উদযাপন বা ঘটনার স্মরণে এই গুগলের হোমপেজের লোগোতে পরিবর্তন নিয়ে আসে যা গুগল ডুডল (Google Doodle) নামে পরিচিত। ধারনা করা হয় ডুডল (Doodle) জার্মান শব্দ থেকে এসেছে, এবং প্রথম ব্যবহারের ইতিহাস আমাদের নিয়ে যাবে সপ্তদশ শতাব্দীতে। সে সময় ‘বোকা’ বা ‘পাগল’ বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু আধুনিকালে ডুডল বলতে সাধারনভাবে আঁকা অর্থবহ রেখাচিত্র কিংবা দুর্বোধ্য বিমূর্ত চিত্রকলা (Abstract art) বোঝায়। আর গুগল ডুডলের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই খুবই সাধারন ছবিতে নির্দিষ্ট একটি ঐতিহাসিক বিষয় বিশ্ববাসীর সামনে সহজেই তুলে ধরা হয়। সভ্যতার ইতিহাসে যেসব ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের জন্ম বা মৃত্যুদিন, ঐতিহাসিক কোন ঘটনা, ভিন্ন ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী কিংবা দেশের জন্য বিশেষ দিনগুলোসহ অনেক কিছুই গুগল ডুডলের বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, এবং সাময়িকভাবে তারা ব্র্যান্ড লোগো পরিবর্তন করে থাকে।
বিশ্বজয়ের পথে যাত্রা শুরুর তিন বছর পর ১৯৯৮ সালে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ এবং সারর্গেই ব্রিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা মরুভূমিতে আয়োজিত Burning man festival-এর সময় “গুগল ডুডলস” নামে একটি অভিনব জিনিস গুগলের হোম পেজে সংযুক্ত করে। গুগল ডুডলের ইতিহাসের প্রথম ডুডলটি ল্যারী পেইজ এবং সারর্গেই ব্রিন নিজেরাই ডিজাইন করেছিলেন। Google শব্দটির দ্বিতীয় ‘o’-র পেছনে একটি খুব সাধারন রেখচিত্র যুক্ত করে মজার একটি বার্তা (comical message) হিসেবে হোমপেইজে রাখার সিদ্ধান্ত নেন যাতে গুগল ব্যবহারকারীরা বুঝতে পারে তারা অফিসে বাইরে আছেন। এভাবেই আসলে ডুডল ধারনাটির জন্ম হয়েছিলো।
গুগল ডুডল ইতিহাসের প্রথম ডুডল
দুই বছর পর ২০০০ সালে ল্যারি পেইজ এবং সারর্গেই ব্রিন গুগলে তৎকালীন ইন্টার্নরত ডেনিস ওয়াং (Dennis Hwang: current webmaster) কে Bastille Day উপলক্ষ্যে আরেকটি ডুডল তৈরির নির্দেশ দেন। বস্তুত এই ডেনিস হলেন গুগলের প্রথম চিফ ডুডলার। এরপর থেকে গুগল নিয়মিত পৃথিবীর বিভিন্ন উৎসব, বিখ্যাত কোন ব্যক্তির জন্ম অথবা মৃত্যু দিন, বিশেষ কোন দিবস উপলক্ষ্যে তাদের লোগো পরিবর্তন করে আসছে।
Dennis Hwang ডিজাইনকৃত ডুডল
ডুডল নিয়ে কাজ করার জন্য গুগলের দক্ষ ইলাস্ট্রেটর, ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিজাইনারদের নিয়ে একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে, যারা ডুডলার হিসেবে পরিচিত। দলগত প্রচেষ্টা এবং প্রচুর যাচাই-বাছাইয়ের পর এক একটি ডুডল তৈরী করা হয় যা সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। এছাড়াও ব্যবহারকারীদের প্রস্তাবিত ডুডলও প্রকাশনার জন্য বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
মঙ্গল গ্রহে পানির অস্তিত্বের প্রমান পাওয়ার পর প্রকাশিত ডুডল যা পৃথিবীর সব দেশ থেকেই গুগলের হোমপেইজে দেখা যায়
বৈদ্যুতিক ট্রাফিক ব্যবস্থার ১০১ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ডুডল
নিজের ১৭তম জন্মদিনে গুগলের প্রকাশিত ডুডল
নিউ হরাইজন প্লুটো অতিক্রম করার সময় গুগলের প্রকাশিত ডুডল
বিশ্বকাপ ২০১৪, মজার একটি ডুডল... তাই না?
চাঁদে পানির অস্তিত্বের প্রমান পাওয়ার পর প্রকাশিত ডুডল
মা দিবসের একটি ডুডল
বাবা দিবসের একটি ডুডল
টমাস এডিসনের জন্মদিনে ডুডল
ডুডল হিসেবে শুধু ছবি নয়, কখনও কখনও ভিডিও প্রকাশিত হয়ে থাকে। যেমন-
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৪ উপলক্ষ্যে গুগল ডুডল হিসেবে এই ভিডিওটি গুগলের হোমপেইজে দেখা যায় সারা বিশ্ব থেকে
জন লেননের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ডুডল
২০১২ সালে ভালবাসা দিবসে গুগল ডুডল
এভাবেই গুগল তাদের ব্যবহারকারীদের সাথে বিশেষ দিন বা ঘটনাগুলো উদযাপন করে। আমাদের বাংলাদেশেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিনে গুগল তাদের ব্র্যান্ড লোগো পরিবর্তন করা শুরু করেছে প্রায় বছর দুয়েক আগে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী এবং বাংলা ভাষাভাষীদের দাবী সরব হয়ে উঠে যেন ২১শে ফেব্রুয়ারী (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস), ২৬শে মার্চ (স্বাধীনতা দিবস) এবং ১৬ই ডিসেম্বর (বিজয় দিবস)- এই তিনটি দিনে অন্তত গুগল যেন তাদের হোমপেইজের লোগো পরিবর্তন করে। তারা (গর্ব করি, এই এক্টিভিটিতে আমিও জড়িত ছিলাম!) লক্ষ লক্ষ ইমেইল পাঠাতে শুরু করে গুগলকে। আসুন দেখা যাক সে সময়ে আমাদের প্রস্তাবিত ডুডল গুলো-
২০১৩ সালের স্বাধীনতা দিবসের নিচের এই ডুডলটিই আমার জানামতে বাংলাদেশী ব্যবহারকারীদের জন্যে প্রকাশিত প্রথম ডুডল। মনে আছে এই ডুডলটি দেখার পর খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছিল! এভাবেই গুগল সারা পৃথিবীর মানুষের মুখে হাসি ফোটায় সামান্য একটি ডুডলের মাধ্যমে।
এরপর
২০১৫ সালে আমাদের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ডুডল
পহেলা বৈশাখ, ১৪২২
২০১৫ বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ২য় কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ বনাম ভারতের সেই ম্যাচের কথা কি ভোলার মতো?
গুগলের হোমপেইজের ডুডলে বোধহয় চারবারই আমাদের প্রবেশ। তাও বোধহয় ঐ ২০১১ সালের প্রচারনা আর ইমেইল ফ্লাডিং-এর জন্যে। আমার এক স্কুলফ্রেন্ড এ প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিল, "গুগল আমাদের বিশেষ দিনগুলারে তাদের হোমে রাখে না, তাতে কি **টা ছেড়া গেল হে? সবকিছুর পরেও... দিনশেষে গুগল একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মনে থাকে না তোমাদের?"
আমার মনে থাকে। গুগল ডুডল এমন কোন আহামরি ব্যাপার না যে তাতে বাংলাদেশের কোন বিশেষ দিবস প্রাধান্য না পেলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে অন্যান্য দেশের, সংস্কৃতির বিশেষ দিনে গুগলের এই ডুডল পরিবর্তন দেখে মনে হয় আমার দেশ কি অবহেলিত হচ্ছে? কিন্তু, এবছর ১৪ এপ্রিল- বাংলা ১৪২২ সালের পহেলা বৈশাখে গুগলের ডুডলটি দেখে আমার ভীষন আনন্দ হয়েছিল। সহকর্মীকে ডেকে দেখিয়েছিলাম গুগলের হোমপেইজ। পাগল দেখার দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলেছিলো, 'happy new year buddy!"
কোন বিষয় নিয়ে আপনি আবেগ অনুভব করলে তা আপনার জন্যে অনেক কিছু। আর যদি না করেন... আপনার তো বটেই কারও কিছুই আসে যাবে না।
সবাইকে শুভেচ্ছা।
(courtesy: https://www.google.com/doodles এবং https://en.wikipedia.org/wiki/Google_Doodle)