গত ক’দিনে চারপাশে যা ঘটছে, যা ঘটে চলেছে আমাদের জাতীয় জীবনে, তার বর্ননা করা নিতান্তই বাতুলতা হবে। আমরা সবাই পত্রিকা পড়ছি, চ্যানেলের নিউজ কাভারেজ দেখছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কী বলছেন পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া মারফত আমরা সবই দেখছি জানছি। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি বোঝেন, মানুষ এখন নিজের কাছে নিজেই যে কেনো ব্যপারে ব্যাখ্যা করতে পারেন। ভালোভাবে উপলব্ধি করার মতো নূন্যতম সচেতনতা এখন মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
আমরা দেখছি হঠাৎ করেই যেন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। চরম এক অস্থিরতা চারদিকে। মানুষের মনে কোন শান্তি বা স্বস্তি নেই। শহরে তো বটেই গ্রামের মানুষও এখন ঘরের বাইরে স্বস্তি নিয়ে চলতে পারছেনা। একটা অজানা আতংক ঘিরে রয়েছে তাদের।
একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতদের বিচার চলছে। তিনটি মামলার রায় হয়েছে। আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের রায় নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। কারন কী? বিশ্লেষকরা বলছেন, দুটো কারন হতে পারে। এক. তিনি এখন আর কোন দলের সাথে নেই। বহুদিন আগে জামায়াতে ইসলামী ছেড়েছেন। দুই. হতে পারে তিনি কোন দূরদেশে কোথায় অবস্থান করছেন কেউ জানেনা। কিভাবে তিনি গেলেন বা কোথায় আছেন তা এখনও রহস্যঘেরা। ফলে এই রায় নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা নেই। আবদুল কাদের মোল্লার মামলার রায় নিয়েই হৈচৈ বেধেছে। কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা মেনে নিতে পারিনি আমরা। তরুণ প্রজন্ম তাই রাস্তায় নেমে এসেছে। শাহবাগে বিক্ষোভ চলছে।
এর মধ্যে বিক্ষোভকারীদের একজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি রাজীব হায়দার। তিনি এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। রাজীব হায়দারের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। কিন্তু খবরে প্রকাশ, একই সাথে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি বিষোদগারেও সক্রিয় ছিলেন। বেনামে প্রকাশিত তার ব্লগের লেখাগুলোতে প্রবল ইসলাম বিদ্বেষের আলামত পাওয়া গেছে। বেনামে প্রকাশিত লেখাগুলো সত্যিই তার লেখা কীনা সেটা নিয়ে যদিও সংশয় রয়ে গেছে এখনও, তবু যার লেখাই হোক সেটা যাচাই পূর্বক প্রমাণিত না হওয়ার আগেই রাজীব হায়দারকে জাতীয় বীর আখ্যা দেয়া হয়ে গেছে। ইসলাম বিদ্বেষীকে জাতীয় বীরের সম্মান দেয়াকে মেনে নিতে পারেনি উলামা-মাশায়েখ সমাজ। তারা ক্ষোভে নেমে গেছে রাস্তায়।
একদিকে জামায়াত-শিবির তাদের অভিযুক্ত নেতাদের মুক্তির দাবীতে রাস্তায়। তাদের হরতাল-আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল। আরেকদিকে সংক্ষুব্ধ উলামা-মাশায়েখ, কওমীপন্থী-মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আলেমসমাজ, ধর্মানুসারী মুসলমানরাও রাস্তায় নেমে এসেছে বিক্ষোভে। ধর্মবিদ্বেষীকে পৃষ্ঠপোকতা দেয়ার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ।
কিন্তু পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে গোলমেলে। জামায়াত-শিবিরের দাবীসংশ্লিষ্ট আন্দোলনকে প্রতিহত করতে সরকার লাঠি মেরেছে ধর্মবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে করা বিক্ষোভকারীদের শরীরেও। উলামা-মাশায়েখ ও তাদের ভক্ত ইসলাম-অনুসারী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকের চোখেও লেগেছে টিয়ারসেলের ঝাঁঝ। সাথে কিছু নিরীহ মুসলমানকেও সইতে হচ্ছে আঘাতের যন্ত্রণা। এসব মুসলমানের মনে এখন দ্বিমুখী যন্ত্রণা। একদিকে তাদের ধর্ম ও ধর্মপ্রবক্তাকে বিদ্রুপ করে কেউ কেউ রাষ্ট্রের সম্মান পায়- সেই কষ্ট, অন্যদিকে সেই কষ্টে তারা বিক্ষোভ করতে গিয়ে সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের আঘাতে কাতর হয় সেই যন্তণা। মসজিদের নিরীহ ইমামকে দেখছিলাম সেদিন- ব্যথাতুর মুখ নিয়ে চ্যানেলে দেখছে জাতীয় মসজিদে ঘটে যাওয়া সরকারী একশন। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে তো তাকে ব্যথাতুর হতে দেখিনি!
সরকার কি সব টুপি-দাড়িওয়ালাকে একাকার করে ফেলছে? ইচ্ছাকৃতভাবেই জেনেবোঝে? নাকি বুঝতে না পেরে? সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী? মুসলমান মানেই কি ধর্মান্ধ? মুসলমান মানেই কি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি? বাংলাদেশের মুসলমানরা সব জঙ্গীবাদী? তারাই সব নাশকতামূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত?
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, আর ধর্মবিদ্বেষীকে জাতীয় বীর আখ্যা দেয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় মাল্য প্রদান করা এক জিনিস বা এক আদর্শের কাজ হতে পারেনা। শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। এই ৮৮.৩ ভাগ মুসলমান নামাজ না পড়লেও জন্মগতভাবে মুসলমান। এই শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র না চাইলেও তারা মুসলমান। এই শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মসুলমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি না করলেও তারা মুসলমান। রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে এই শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমান বড়ো কোনো ক্ষতি অনুভব করেনা। কিন্তু তাদের ধর্মানুভূতিতে কেউ আঘাত দিলে তাদের মর্মে পীড়া লাগে। আল্লাহ রসুলকে নিয়ে ব্যঙ্গ কটুক্তি করলে তারা আহত হয়।
আমরা জানি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চয়ই কোনো ধমার্নুসারী বৃহৎ গোত্রের অনুভূতিতে আঘাত করাকে সমর্থন করেনা। ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চয়ই ৮৮.৩ ভাগ মসুলমানের বিশ্বাসের মুলে কুঠারাঘাত করে এমন কোনো কথা কাজ বা ব্যবস্থাকে লালন-তোষন করেনা। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারনার সাথেই সেটা সাংঘর্ষিক। অথচ যা হচ্ছে- তার ব্যাখ্যা কী?
সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিহত করতে চান করুন। রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ বানাতে চান বানান। কিন্তু আমার বয়োবৃদ্ধ দাদা ও প্রৌঢ় পিতার মসজিদে যাওয়াকে প্রতিহত করছেন কেনো? তারাতো জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক নয়। আমি ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি তারা জঙ্গীবাদী শক্তির সাথেও জড়িত নয়। এমনকি কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অংশও তারা নয়, কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে তাদের সামান্য পরিমাণ সংযোগ নেই। তারা শুধুই মুসলমান। তারা জাতীয় নির্বাচনে “স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি”র ব্যালটবাক্সও ভরে দেয়। তাদের অনেকে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহন না করলেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেনি। শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানের বৃহৎ অংশই এখনো পর্যন্ত কোনো প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। তাদের অনেকেই আওয়ামীলীগ, বিএনপি জামায়াত বোঝেনা। তারা শুধুই নামাজ রোযার মতো ধর্মীয় আচারগুলো পালন করে। এদের অনেকেই কাঁধে ব্যাগপোটলা নিয়ে মসজিদে মসজিদে গিয়ে ধর্মচর্চা করে। অথচ তারা কেনো মসজিদে যেতে প্রতিরোধের সম্মূখীন? তারা কেনো নামাজ পড়তে গিয়ে টিয়ার সেলের আঘাতে ধরাশায়ী হয়? রাষ্ট্র কেনো তাদের ধর্মচর্চার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে? রাষ্ট্র কি সেটা পারে? রাষ্ট্রের কি সেই এখতিয়ার আছে? রাষ্ট্র কি এই শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানকে বাদ দিয়ে তৈরি হবে নতুন করে? নাকি রাষ্ট্রের নবজন্মের জন্য শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানকে তাদের বিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে?
এই প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোলাসা হওয়ার সময় এসেছে। সরকারকে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করা দরকার। তারা কী চান, তা এই জাতির কাছে পরিষ্কার করা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতদের চলমান বিচারকাজ শেষ করতে হবে। বিচার করতে হবে রাষ্ট্রকেই। রাষ্ট্র যারা চালিয়ে এসেছেন এতোদিন প্রায় সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ছিনিমিনে খেলেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে রাজনীতি করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে নিয়েছে। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক এটা বিশ্বাস করে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাজনৈতিক ইস্যু নয়। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ৪১ বছর পর সেই দায়িত্ব পালনের দায় মাথায় নিয়েছে সরকার। নতুন প্রজন্ম সরকারকে সেই দায়িত্ব পোক্তভাবে পালনের জন্য চাপ দিয়েই চলেছে। কেননা রাষ্ট্রকে এই বিচার সুসম্পন্ন করতেই হবে। আর সেই সাথে শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানকে তাদের বিশ্বাস নিয়ে চলবার নিশ্চয়তা দিতে হবে এই রাষ্ট্রকেই। শতকরা ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানের কতোজন জঙ্গীবাদী? কতোজন সাম্প্রদায়িক অপশক্তির গোত্রভুক্ত?
আমি বিশ্বাস করি এই ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানকে মর্মাহত করে রাষ্ট্র চলতে পারেনা। ৮৮.৩ ভাগ মুসলমানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্র বিনিমার্ণ আদৌ কি সম্ভব?