'মাইরা ফালান মাইরা ফালান। ছারপোকাগুলা মাইরা ফালান। ছারপোকা। ছারপোকা। ছারপোকা। এই ছারপোকা যার ঘরে সেই বোঝে ছারপোকার কি জ্বালা। এই যে দশ হাজার, বিশ হাজার টাকা খরচা কইরা দামী দামী খাট বানাইসেন আপনে। এই খাটে বংশবিস্তার করে ছারপোকা। আর আপনে ঘুমান মাটিতে। অনেকেই বলে 'ছারপোকার নির্যাতনে চইলা যাইতে হবে বনে'। কথায় আছে- মনের দুঃখে গেলাম বনে বান্দরে কয় পিঠ চুলকাইয়া দেই। এই মনের দুঃখে আর যাইতে হবে না বনে। ...'
বাহ কি সুন্দর কথাগুলো! যেন অদ্ভুত একটা কবিতা। অদ্ভুত আর শান্ত।
চৈত্রের দুপুর। আকাশ থেকে মুষলধারে রোদ পড়ছে। কুকুর-বিড়াল রোদে পিচগলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি শুনতে কেমন জানি নেশা লাগে। এই খুব গরমেও চোখ ঢুলুঢুলু হয়। গরমে আর ধূলায় বাতাস ভারী হয়ে আছে। সেই বাতাসে মানুষের মগজপোড়া গন্ধ। কেমন যেন এক মাদকতা।
কষে শেষ চুমুটা দিয়ে একজন প্রতারক প্রেমিকের মত হাতের সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে মারলাম। যে প্রেমিক প্রয়োজন শেষ হলে কেটে পড়ে। পড়ে থাকে সাদা ছাঁই।
অবশ্য বাস্তব জীবনেও কি আমি তেমনই একজন না? হয়ত। না, হয়ত না। নাহলে সেই বিকেলে রোদেলাকে ঐভাবে চলে যেতে দিতাম না। ওর চোখ চিকচিক করছিল। কিন্তু কাঁদে নি। আমি অবশ্য আশাও করিনি। রোদেলা শক্ত মেয়ে। আধুনিক যুগের প্রচন্ড ন্যাকাধরনের মেয়ে নয় মোটেই। মধ্যবিত্ততার সবগুলো সূত্র ওর জানা। আমাদের জীবনে সেই সূত্রগুলো কষে অংক করতে হয়। সূত্রের বাইরে যাওয়া যায় না।
লেখাপড়া শেষ। মাঝারি ঘরের মেয়েদের জন্য এইসময়টা খুব খারাপ। দূরসম্পর্কের আত্নীয়রা চারিদিকে কিলবিল করে। এবং সবার কাছেই প্রচন্ড ভালো ভালো পাত্রের খোঁজ থাকে।
সেইসময়টায় আরো দু'টো ছোট বোন আছে, এমন কোন মেয়েকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া যায় না। আমিও দিতে পারি নি। তাই রোদেলারও বেলাবোস হয়ে ওঠা হয় নি। চাকরি পাবার খবর দিতে না পারলেও, আমিও একদুপুরে রোদেলাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম- 'বিকেলে এসো। জরুরি কথা আছে।'
ঠিক ধরেছেন। চাকরিটা আমার হয়নি।
অচিরে হবে সেই সম্ভবনাও কম ছিল। মামা-চাচার জোর নেই। রেজাল্টও আহামরি না। ঠিকভাবে কথাও বলতে পারি না। রোদেলা যে কি দেখেছিল, সে-ই জানে। ও সবসময়ই বোকাদের দলে। শেষ বিকেলের অপরিচিত আলোয় দাঁড়িয়ে ওকে শেষবারের মত বলেছিলাম 'ভালো থেকো।' রোদেলা কিছু বলে নি। একটু হাসার চেষ্টা করেছিল। খুব একটা সুবিধা হয় নি। আমি জানি বোকা মেয়েটা জীবনে হয়ত আর কখনোই ভালো থাকবেনা। তবু মাঝে মাঝে এই তুচ্ছ-অনর্থক শব্দটাই আমাদের নতুনভাবে বাঁচিয়ে রাখে- 'হয়ত'।
'যা হয় ভালোর জন্যই হয়'
নিজের ঠোঁটের কোণে একটা আক্ষেপের বোকা হাসি আবিষ্কার করতে গিয়ে দেখি দুপুরের রোদটা পড়ে এসেছে। সামনেই একটা কৃষ্ণচূড়া দাঁড়িয়ে আছে। গাছের নিচে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। আরাম করে বসা যায়।
অথচ আমারও কিছু স্বপ্ন ছিল। একটা চাকরির খবর শুনব। সেদিন সবাইকে উপেক্ষা করে রোদেলা আর আমি হাত ধরে হেঁটে যাবো ক্লান্ত সন্ধ্যায়। বাসার সবার মুখে একটা চাপা আনন্দ। হাজার চেষ্টা করেও কেউ লুকাতে পারছেনা। মা একটুপর পর পর রঞ্জুকে চাপা গলায় ধমকাচ্ছেন। তবে সেটা যে নকল ধমক সেটা রঞ্জুও বুঝতে পারছে এবং আগের চেয়ে জোরে খিলখিল করছে। কল্পনায় দেখতাম প্রথম মাসের বেতন দিয়ে বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছি। মায়ের মুখে কপট রাগ- 'কি দরকার ছিল এতগুলো টাকা নষ্ট করার।' অথচ টাকাগুলো এরচেয়ে সুন্দর করে নষ্ট করা যেত না।
রঞ্জুর একটা সাইকেলের খুব শখ। অনেক আগে যখন সে আরো ছোট ছিল, একদিন আমার পাশে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, 'ভাইয়া'। যেন বিরাট কোন অপরাধ করে ফেলেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, 'কিরে কিছু বলবি?'
'তুই মাকে বলবিনা বল'
'আচ্ছা বলবোনা'
এত ভয়ে ভয়ে ভাইটা এসে ইনিয়ে বিনিয়ে একটা সাইকেলের গল্প বলল। ওর বন্ধুর সাইকেল। ওর বন্ধুদের অনেকের সাইকেল আছে। একটা সাইকেলের দাম কত? ও কাউকে জিজ্ঞেস করে নি।
সেদিনই ঠিক করেছিলাম হাতে কিছু টাকা আসলে ওকে একটা সাইকেল কিনে দিব। কিন্তু টিউশনি করিয়ে যা পেতাম তাতে নিজেরই নানান কায়দা করে চলতে হয়। ভেবেছিলাম চাকরিটা হয়ে গেলে একদিন ওকে বলব- 'নিচে তোর কোন এক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে, দেখে আয়।'
রঞ্জু নিচ থেকে ঘুরে আসবে। ওর কোন বন্ধুকেই দেখবেনা। বরং সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা জীবন্ত সাইকেল। ওর চোখ চিকচিক করবে। আমি পাত্তা না দিয়ে বলব, 'দেখিস, গাড়ির নিচে পড়িস না আবার।'
ভাবতেই আবার হাসি পেয়ে যায়। আমাদের জীবনের অপূর্ন নাটকগুলোই আমরা কল্পনায় সবচেয়ে বেশিবার দেখি। মনে মনে বারবার রিহার্সেল করি। সবগুলো ডায়লগ একেবারে মুখস্ত থাকে। কিন্তু নাটকগুলো শেষমেশ কেন যেন জমে না আর।
তবে এই নাটকটা করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। হল না। চাকরিটা হতে না হয় একটু দেরিই হচ্ছিল। আরতো ক'টা দিন, কিন্তু সবার দেরি সহ্য হয় না। আমাদের রঞ্জু একদিন হঠাৎ করে চলে গেল। যেখানে গিয়েছে, সেখানে অনেকগুলো সাইকেল থাকার কথা। কিন্তু সে কথা আর কখনো জানতে পারবোনা। সেখানকার কোন খবর আমরা পাই না। পাওয়ার উপায়ও নেই।
আমার বাবা প্রথমে কাঁদতে পারেন নি। তারচেয়ে অবাক হয়েছিলেন বেশি। রঞ্জুর কি হয়েছিল, আমরা সঠিকভাবে জানিনা। ডাক্তার অবশ্য অনেকগুলো টেস্ট দিয়ে জানার চেষ্টা করেছিলেন। সাথেসাথেই টেস্টগুলো করানো যায় নি। অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। সেদিন বুঝেছিলাম পৃথিবীর সেরা জীব বলতে যদিও আমরা মানুষ বুঝি, আসলে তা টাকা।
মনে আছে, রঞ্জুর মরে যাবার খবর শুনে আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা এসেছিল তা হল- হাসপাতালে যাবার টাকা নেই পকেটে। ইদানিংকালে মৃত্যুর খবর শুনে দুঃখ পেতেও টাকা লাগে। আহা জীবন।
দুপুরের রোদে হাঁটতে ক্লান্ত লাগছে। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি অবশ্য। ঘরের কথা ভাবলেই মায়ের কথা মনে পড়ে। রঞ্জুর চলে যাবার পর থেকে আমাদের ঘরটা যেন থমকে গেছে। সেখানে কোন হাসি নেই, আনন্দ নেই, কথা নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখীতম জায়গার তালিকা করলে তাতে আমাদের তিন কামরার ঘরটারও জায়গা হবে, উপরের দিকেই হবে।
তারপর থেকে মা-টা অন্যরকম হয়ে গেছে। হাসতে ভুলে গেছে। ইদানিং ঘরের ভেতর কেমন রোবটের মতো চলাফেরা করেন। খেতে হয় বলে খান, খাওয়াতে হয় বলে খেতে ডাকেন। সেই ডাকে কোন প্রান নেই। বাবার শুধু চোখে না, মনেও ছানি পড়েছে। রঞ্জুটা বাবার খুব নেওটা ছিল। বাবাটাও। আমরা একদিন ভালো ছিলাম- ভাবতে নিজের কাছেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে। যেন অনেক অনেক দিন আগের কথা। 'এক যে ছিল রাজা'র মত।
সামনের দরজাটা খুলে যেতেই চমক ভাঙ্গলো। মা-ই দরজা খুলে দিলেন। সেই পুরনো ক্লান্ত চেহারা। কে এসেছে দেখার কোন আগ্রহও নেই যেন। অথচ সবসময়ের গল্পটা এমন ছিল না। আমি ঘরে ঢুকে জুতাজোড়া রেখে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বাবা চশমার ওপর দিয়ে খবরের কাগজের ওপর চোখ বোলাচ্ছেন। তার গায়ে একটা সুপ্রাচীন গেঞ্জি। গেঞ্জিটার মলিনতা যেকোন রিকশাচালককেও লজ্জা পাইয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। আমি বাবার দিকে সরাসরি না তাকিয়েও এসব বুঝতে পারি। চোখের কোন দিয়ে এভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখতে পারার মত কিছু ব্যাপার বেকার হওয়ার পর থেকে কিভাবে জানি শিখে গেছি।
ফ্যানটা ছেড়েই বিছানায় এলিয়ে পড়লাম।
মা দরজায় এসে তার সেই রোবটিক গলায় ভাত খাবো কিনা জানতে চাইলেন। ইদানিং তিনি এই ঘরের দরজার এদিকে খুব কমই আসেন। কথাবার্তাও শুধুই খাওয়াসংক্রান্ত। আগে হলে মা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতেন। কোথায় গিয়েছিলাম। চাকরির কোন নতুন খবর আছে কিনা। এখন আর করেন না। নতুন খবর শোনার আশায় থাকতে থাকতে তিনি আরো অনেক খবর শুনে ফেলেছেন।
আজ অবশ্য জিজ্ঞেস করলে মাকে নতুন কিছু বলতে পারতাম। কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। পকেট থেকে এপয়ন্টমেন্ট লেটারটা বের করে পাশে শুইয়ে দিলাম। একটু ঘুমাক।
অনেকদিন আগে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। তারাই ডেকেছিল আজকে। ডেকে হাতে এপয়ন্টমেন্ট লেটারটা ধরিয়ে দিল। ভালো চাকরি। মোটা বেতন। বছরে একবার কোম্পানীর খরচে পরিবারসহ ট্যুরের ব্যবস্থা।
কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না। শরীর ভরা ক্লান্তি আমার। চোখ বন্ধ করতেই একচুমুক অন্ধকারে ডুবে যেতে হয়। সেই অন্ধকারে জেগে থাকে একটা সাইকেল। নীল সাইকেল। রঞ্জুটা ভীষন নীল-পাগল ছিল। একবার ওকে একটা নীল ঘড়ি কিনে দিয়েছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে সে মাঝে মাঝে ঘড়িটার সাথে কথা বলত। এত কি কথা লুকানো ছিল ওর ছোট বুকে, খুব জানতে ইচ্ছা করে। খুব বেশি ইচ্ছা করে।
বুকটা ভীষন হালকা লাগে। যেন বুকের ভেতর অনন্ত শূন্যতা। কিছু একটা চেপে বসতে চায় গলার উপর। ঢোক গিলতে খুব কষ্ট হয়। বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে নামা বৃষ্টি নিয়ে আমি অপেক্ষা করি। একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ভাঙ্গার অপেক্ষা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১:০১