খুঁজে দেখলাম- জন্ডিসে বিখ্যাত কেউ মারা যায়নি। এরচেয়ে বরং ম্যালেরিয়ার দিকে তাকালে মাথা নত হয়ে আসে। চেঙিস খান থেকে শুরু করে মাদার তেরেসাকে পর্যন্ত ম্যালেরিয়ার জীবাণুরা ধরাশায়ী করেছে।
উইকিপিডিয়ায় লেখা আছে- জন্ডিস আসলে কোন রোগ নয়, এটি রোগের লক্ষণ মাত্র। তবে রোগ হোক বা লক্ষণ, এটি বেশ একটা শিক্ষা সফরের মতো ব্যাপার। অন্যদের বেলায় কি অবস্থা হয়েছিলো জানি না- তবে আমার বেলায় মুখের রুচি বেড়ে গেছে কয়েকগুন। ডাক্তার যেদিন বললেন তেলজাতীয় খাবার একেবারেই অফ, সেদিনই জীবনে প্রথমবারের মতো বুঝলাম যে শুধু টকজাতীয় খাবারের কথা ভাবলেই জিভে জল আসে- কথাটা ভুল। তেলে কিছু ভাজা হচ্ছে, সেটা মুরগী বা আলুভাজি যাই হোক না কেন, ছসসস করে একটা শব্দ হচ্ছে- চোখ বন্ধ করে করা এই কল্পনাটা যে কতটা সুন্দর, কতোটা মোহনীয়, কতোটা পবিত্র তা জন্ডিস মামার হাতে না পড়লে ঠিকঠাক বোঝা সম্ভব না। একমাত্র এই সময়ে বোঝা যায় যে সভ্যতার সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপারটাই হচ্ছে তেলেমাখা খাবার।
বেশি কিছু না, রাস্তার ধারের মুড়ির ভর্তা, আহা, ১০টি টাকা নেয়, তেল ছাড়া সেটাও অচল। সসের স্পর্শে একটু গরম গরম কলিজার শিঙাড়া খেতে মন চাচ্ছে? মাথা খারাপ! পাশের হোটেলের নরমাল শিঙাড়াই পেঁয়াজ দিয়ে কচ করে খাওয়া যাবে না, আবার সমুচা। গ্রিলড কিংবা ফ্রাই, মুরগীর কথাতো ভাবাই পাপ। আর যদি চোখের সামনে আলুসমেত একপ্লেট ধোঁয়াওঠা গরম নরম কাচ্চি বসে বসে হাসতে থাকে, ভুলেও চোখ বন্ধ করবেন না। চোখ বন্ধ করলেই নান্নার মোরগ পোলাও বা হাজির বিরিয়ানী সামনে চলে আসবে। তাই যেভাবে আছেন চুপচাপ সেভাবেই পড়ে থাকুন, সামান্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকাতে গেলেই সর্বনাশ- আপনার পুরো ঘরটা বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরের চিপায় পরিণত হবে। ভাগ্য খারাপ হলে একটা ছোকরামতো ওয়েটারও চলে আসতে পারে কল্পনায়। একহাতে একটা মুরগীর চাপ, অন্যহাতে ৩টা পরোটা আর তেঁতুলের টকে ভেজানো পেঁয়াজের কুঁচি।
তখন আপনার মনে পড়ে যাবে যে চুইঝাল দিয়ে রান্না করা মাংস কিংবা সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংসের মিশনটাও এখনো সময় আর সুযোগের অভাবে কমপ্লিট হয়ে ওঠেনি। ভাগ্য খারাপ হলে পিজ্জা কিংবা বার্গার শেষ কবে খেয়েছিলেন, তার স্বাদ কেমন সেটাও আপনার মাঝে মাঝেই আবছা আবছা মনে পড়তে চাইবে। এবং একটা কথাই মনে হবে- ইশ।
সবচেয়ে অসহায়ত্বের ব্যাপার- এই কথাগুলো কাউকে বলার সুযোগ বা উপায় কিছুই পাবেন না। দিনের বেলার এসব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হবে, জানালার পাশে বসে পাশের হোটেলে সিঙ্গারা, বেগুনী, আলুর চপ ভাজতে দেখবেন, শুধু দেখেই যাবেন। যদি ভাবেন রাতের বেলা এইসব যন্ত্রণা থাকবে না, তাহলে ভুল করলেন। রাতটা আপনার কাটবে সুস্থ হলে কোথায় কোথায় খেতে যাবেন, সেই লিস্ট করতে করতে। জিভের জল সামলাতে সামলাতে এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়বেন টেরও পাবেন না। টের পাবেন মাঝরাতে, ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে যখন ঘুম ভাঙবে।
সেদিন এমনই এক রাতে দেখলাম স্বপ্নে দেখলাম সমুদ্রের ধারে চোখ বুজে শুয়ে আছি, সমুদ্রের হালকা বিড়ালমার্কা গর্জন শোনা যাচ্ছে, ভালোই লাগছে। হঠাত সমুদ্র অফ হয়ে গেলো। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম। অনেক মানুষ কথা বলছে। চোখ খুলে দেখি কোথায় সমুদ্র! এইটাতো কলকাতা কাচ্চিঘর! একজন ওয়েটার হাতে কাচ্চির প্লেট নিয়ে হিংস্র ভঙিতে এগিয়ে আসছে। প্লেট থেকে মেঘের মতো ধোঁয়া উড়ছে আর এতদূর থেকেও একটা চমৎকার গন্ধের খিল খিল হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বুঝলাম আজকে খবর আছে। তিনলাফে বেরিয়ে পড়লাম। পেছনে ফিরে দেখি ওয়েটার তাড়া করছে। 'খেয়ে যা হারামজাদা।'
চলার গতি বাড়িয়ে দিলাম। এখন রীতিমতো দৌড়াচ্ছি। পথও দৌড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাই। কোত্থেকে একটা বিরাট চিকেন বার্গার তার বড় বড় পা ফেলে ছুটছে পেছনে পেছনে। চিকেনের বড় টুকরাটা বনের গায়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে বসে আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। একগ্লাস বিউটির লাচ্ছিও দৌড়াচ্ছে তার সাথে। তাদের পেছনে রাস্তার ধারের বিশাল এক চিতই পিঠা তার ৫৩ রকমের ভর্তা নিয়ে এলোমেলো পায়ে তাড়া করছে।
একসময় বুঝতে পারলাম যে আমি আসলে একটা গোলকধাঁধায় আটকে গেছি। যেদিকেই যাচ্ছি, যত জোরেই দৌড়াচ্ছি, আসলে পুরান ঢাকা থেকে বেরুতে পারছি না। একটু পর পর হাজি, নান্না, রয়েল এরা হাসিমুখে হাজির হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত বাঁক নিই। তাতে লাভ হয় না। একটু পর পর তারা আবার সামনে চলে আসে।
শেষে হাজীর ইয়া বড় একটা বিরিয়ানির ডেকচিতে যখন মাথা ঠুকে গেলো, পা পিছলে স্বপ্নটা ভেঙে গেলে উঠে বসলাম। তখনো বুকের ভেতর টিপ টিপ করছে, বুকটা লাফাচ্ছে। জানালা গলে বাইরের তেলহীন ল্যাম্পপোস্টের আলো চলে আসছে ঘরের ভেতর। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখলাম টেবিলের ওপর রাখা একটা ডাব, একবাটি বিস্বাদ ফিরনি আর একগ্লাস গ্লুকোজ নিজেদের মধ্যে কি জানি বলাবলি করে নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ছে।