আমার বন্ধু পৃথকের মুখে তার কথা আমি প্রথম শুনেছিলাম। মেয়েটি নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পারে। প্রথমবার শুনে আমিও ভেবেছিলাম জোচ্চুরি।
'ছাড়তো ওসব'
'না না। সত্যিই।'
'কি দেখে সে?'
'অন্ধকার'
'তুমি না বললে ভবিষ্যৎ দেখে?'
'হ্যাঁ'
'ভবিষ্যৎ না অন্ধকার?'
'দুটোই'। পৃথক সেদিন অনেকটা সময় আমার ঘরে উদাস ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে থেকে একসময় উঠে দাঁড়িয়েছিলো। 'যাই'।
পরে শুনেছিলাম, কোনো এক ভ্রমরসন্ধ্যায় মেয়েটিকে খুবলে খেয়েছিলো শকুন; শকুনেরা। অথচ একটি সাদামাটা আকাশের নিচে দাঁড়ানো বড় সাধারণ মেয়ে ছিলো সে। চারটে শকুনকে বাঁধা দিতে পারেনি- এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে একটি মেয়ের কতটুকুইবা ক্ষমতা। ইরেজার ঘষে ঘষে তাকে মুছে দেয় তারা। অন্ধকার খামচে ধরে সে যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে।
সেই সন্ধ্যেটা মেয়েটিকে নিজের অতীত ভুলিয়েছে, দিয়েছে ভবিষ্যৎ দেখার অসামান্য ক্ষমতা। এখন সে একজন নিঁখুত ভবিষ্যতদ্রষ্টা- বসে বসে নিঃসীম অদ্ভুত আঁধার দেখে। একটি গাঢ় কালো রাত দেখে, যার পাঁজরে শকুনদের অবিরাম ডানা ঝাপটানোর শব্দ। এটিই নাকি তার ভবিষ্যৎ।
সেদিন অনেক রাতে তাকে খুঁজে পেয়েছিলো উদ্ধারকারীরা। কয়েকজন শৃঙ্খলাকর্মী, কিছু মানুষ, দুটি কুকুর, অনেকজন উৎসাহী। একটা নির্মাণাধীন ভবনের নোংরা মেঝেতে বাসি ফুলের মতো পড়েছিলো সে। রক্তস্নাত ও অচেতন। জনতার মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এসে নিঃশব্দে নিজের পরনের কাপড়খানা খুলে মেয়েটির নগ্ন শরীরে জড়িয়ে দিলো। কেউ কিছু বললো না। শুধু মেয়েটি জ্ঞান ফিরে নগ্ন শরীরের মানুষটাকে হঠাৎ দেখে একটু চমকে উঠেছিলো।
পৃথক মাঝে মাঝেই সেই অভিজ্ঞতার কথা বলে ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসতো। সেই প্রথম তাদের পরিচয়। তারপর শুনতাম মেয়েটি ইদানিং একটা নকশী কাঁথা সেলাই করছে। কখনো কখনো জানালার ফাঁক বেয়ে তাতে চাঁদের আলো পড়লে ছায়াকদম ফোটে। কাঁথার কাজ শেষ হলেই নাকি শামিয়ানার মতো টাঙ্গিয়ে দেবে- তার নিজের হাতে বোনা একখন্ড সাধারণ আকাশ।
বিয়ের আগেরদিন পৃথককে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
'সত্যি ভালোবাসো?'
সে কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলো। আর আমি সেই প্রথম তার চোখে জল দেখলাম। চোখের গাল ধরে চিকচিক করছে। তারপর যেন অনন্তকাল পর তার মৃদু আর ভাঙ্গা কণ্ঠ উঁকি দেয়,
'ও জানে না। আমিই ছিলাম চতুর্থজন।'
ঠিক সেই মুহূর্তে চাঁদটা মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেলে আমাদের গিলে নেয় আরেকটি আঁধার। বড় করুণ, বড় শীতল সে অনুভূতি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৭ রাত ১:৩৯