কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম আমার ফাঁসি হবে। আমি বাসাতেই আছি। কারণ ঐটাই সেখানকার নিয়ম। নির্ধারিত দিনে জল্লাদরা বাসায় গিয়ে ফাঁসি দিয়ে আসে। অনেকটা হোম ডেলিভারি সিস্টেম।
তো যেদিন আমার ফাঁসি, দুপুর দুপুর জল্লাদ বাসায় এসে হাজির। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ছোটবেলায় বাসায় টিউশনির স্যার আসার মতো মন খারাপ হয়। আরেকটু পর এলে কি ক্ষতি হতো।
জল্লাদের চেহারা মোটেও গোঁফওলা জল্লাদদের মতো না। অল্পবয়স্ক একটা ছেলে। মামুন-টামুন ধরণের চেহারা। তার সাথে ফাঁসি দেয়ার যন্ত্রতন্ত্র। কাপড়ে জড়ানো একটা বেশ লম্বা লাঠি। আরো কি কি- দড়িফড়ি হবে বোধহয়।
স্বপ্নের মধ্যে রাগ করবো কীনা বুঝতেছিলাম না। কারণ মা তাকে আমার ঘরে এনেই বসালো। চা-নাস্তা দিলো। আমি তাকে না দেখার ভান করলাম। এর মধ্যে আমার নানী এসে তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে জল্লাদের সাথে তার পূর্ব চেনাজানা আছে।
‘তুমি ছেলেটা একটু পাগল ধরণের। নইলে বিয়েটা তো দিয়েই দিতাম।’
তিনি জল্লাদের সাথে আমাদের কাজের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা বলছিলেন।
জল্লাদ মুচকি হাসছে। মুরুব্বিদের সামনে বিয়ের আলাপজনিত লাজুক হাসি। আবার মাঝে মাঝে চোখের কোনা দিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার গা চিরচির করে উঠছে এই ব্যাক্কলকে দেখে। আমি উঠে অন্য রুমে চলে যাই। আবার এই রুমে আসি। বারবার ঘর বদল করছি। বোধহয় মৃত্যুজনিত অস্থিরতা।
যদিও জল্লাদ কিছু বলছে না। কিন্তু নিজের কাছেই একটা অস্বস্তি লাগে। সে বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। তার যন্ত্রপাতি অন্য রুমে রাখা। বোধহয় সেখানেই ফাঁসি দিবে।
এদিকে আমার মায়ের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সে এমন একটা ভাব করছে যেন সবকিছুই খুব স্বাভাবিক। একটু পরে আমার ফাঁসি, অথচ সে জল্লাদের কি লাগবে না লাগবে তা-ই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। কয়েকবার ডেকেও তার কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।
সবমিলিয়ে বিরক্তি আর রাগ যেন আমার গলার উপর চেপে বসেছে। ইচ্ছে করছে জল্লাদকে ডেকে বলি- ফাঁসি দিয়ে দিক। একটা অপরাধবোধও কাজ করছে- তার জন্য। আর কতক্ষণ তাকে অপেক্ষায় রাখবো। আজকে ছুটির দিন। তারও নিশ্চয়ই আরো কাজ-টাজ আছে।
আমাকে ফাঁসি দিয়ে হয়ত সে হাসপাতালে খালাকে দেখতে যাবে কিংবা প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে শহরের আরেকদিকে। আমার জন্য হয়ত এটা একটা জীবন। তার জন্য তো এটা একটা বেলা শুধু।
নাহ, এরকম আর কতক্ষণ- ভেবে আমার ঘরে এসে দেখি সেখানে মানুষ আর মানুষ। গিজগিজ করছে। কেউই আমার দিকে খেয়াল করার মতো অবস্থায় নেই।
আর ঘরের একেবারে মাঝখানে জলচৌকির উপর বসে আছে জল্লাদটা। গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে আমার মা। আর আমার নানী কি একটা বাইচলামি ধরণের কথা বলতে বলতে তার কপালে ঘষে দিচ্ছে হলুদ- আর জল্লাদ হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু জল্লাদের হাসির দিকে ভালো করে খেয়াল করতেই দেখি সে আসলে জল্লাদ না, ঐটা আমিই। আর না দেখেও বুঝতে পারলাম যে এই আমিই হচ্ছি জল্লাদ। যে কীনা ফাঁসি দিতে এসেছে। ঘরভর্তি উৎসব তখন।
আমি সেখান থেকে আস্তে করে অন্য রুমে যেখানে আমার যন্ত্রমন্ত্র দাঁড় করিয়ে রাখা ছিলো সেখানে চলে এলাম ও কাউকে কিছু না বলে সদর দরজা পেরিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লাম, আমার অপেক্ষমাণ প্রেমিকার প্রতি।