somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্পেস এলিভেটর: বাস্তবতা থেকে কতদূর?

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৪:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এলিভেটরে চড়ে মহাশুণ্যে যাওয়ার স্বপ্ন মানুষের অনেকদিনের। মূলত মহাশুন্যে প্রথম নভোঃযানটি পাঠানোর আগে থেকেই মানুষ এলিভেটরের চিন্তা করে বসে আছে। নাভোঃযানের বাস্তবায়ন যদিও অনেক আগেই হয়ে গেছে এমনকি এই বিষয়ে প্রযুক্তি দিন দিন উন্নততর হচ্ছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত স্পেস এলিভেটরের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে।

স্পেস এলিভেটর হচ্ছে একটি অনুভূমিক টাওয়ার সদৃশ স্থাপনা যা পৃথিবীর ভূমির সাথে সংযুক্ত থেকে মহাশুন্য পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে।এই টাওয়ার বরাবর ভুমি থেকে মহাশুন্যে পরিবহন করা যাবে। এর ফলে প্রচলিত পরিবহন পদ্ধতির রকেটের প্রয়োজন হবে না বরং এলিভেটরের মত পুলির ব্যাবস্থা থাকবে যার সাহায্যে ওঠা-নামার কাজটি সম্পন্ন হবে।এই ধরনের স্থাপনা বাস্তবায়ন করা গেলে মহাশন্য অভিযান এখনকার মত খরুচে হবে না বরং প্রচুর জ্বালানী ও অর্থ সাশ্রয় ঘটবে এবং গবেষণা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রচুর অগ্রগতি সূচিত হবে।

স্পেস এলিভেটরের ধারনা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে। কনস্ট্যানন্টিন সোকোলভস্কি নামক একজন সোভিয়েট রকেট বিজ্ঞানী প্রথমবারের মত একটি compressive space এলিভেটরের ডিজাইনের ধারনা দেন যা উচ্চতায় হবে ভূ-পৃষ্ঠ হতে ৩৫,৮০০ কি.মি. পর্যন্ত।এই দুরত্ব হচ্ছে ভূ-পৃষ্ঠ হতে geostationary কক্ষপথের দুরত্ব। (geostationary কক্ষপথ হল পৃথিবীর বিষুবীয় অঞ্চল বরাবর পৃথিবী থেকে নির্দিষ্ট দুরত্বে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার কক্ষপথ। এই পথে পৃথিবীকে পরিভ্রমণকারী কোন বস্তু ২৪ ঘন্টায় একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে যা পৃথিবীর নিজ অক্ষে একবার ঘুরের আসার সময়ের সমান। ফলে এই দুরত্বে যদি কোনো বস্তু ঘুর্নায়মান থাকে তাহলে পৃথিবী পৃষ্ঠের একজন মানুষ বস্তুটিকে সর্বদা একই অবস্থানে দেখবে।) এই পদ্ভতিতে তৈরি স্পেস এলিভেটর অন্যান্য ভবনের মত উপর থেকে নিচের দিকে চাপ প্রয়োগ করবে। কিন্তু এই গঠনের সমস্যা হলো এত সুউচ্চ কাঠামোর যেই চাপ প্রয়োগ হবে সেটা ধারন করার মত কোনো উপাদান পৃথিবীতে নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকার সম্ভবনা ক্ষীণ। মানুষ এখন পর্যন্ত ১ কিমি উঁচু কোনো স্থাপনাও তৈরি করতে পারেনি। সেই হিসেবে হাজার হাজার কি.মি. উঁচু স্থাপনা তুলামূলকভাবে অলীক কল্পনা বৈ কী?

এর পর এলো টানা কাঠামোর ধারনা। এই ধারনা অনুযায়ী স্পেস এলিভেটর হবে নামনীয় টাওয়ার যা স্থাপন করার পর পৃথিবীর উপর চাপ প্রয়োগ করবে না বরং পৃথিবী থেকে মহাশুন্যের দিকে একটি টান প্রযুক্ত হবে (আমরা একটি সুতার একপ্রান্তে একটি ভারী বস্তু ঝুলিয়ে অপর প্রান্ত ধরে ঘুরালে যেমন টান তৈরি হয় সেই রকম)।এই টাওয়ারটি নমনীয় ফিতা বা তার দিয়ে তৈরি করা হবে এবং বিষুব অঞ্চলে স্থাপন করা হবে যেখানে এটি একপ্রান্তে পৃথিবীর ভূমির সাথে যুক্ত থাকবে এবং অপর প্রান্তে (ভুমি থেকে লক্ষাধিক কিলোমিটার উপরে) একটি ভারী বস্তু যুক্ত থাকবে যা পৃখিবীর ঘূর্ণন গতির ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রবিমূখী বলের কারনে অভিকর্ষ বলের একটি বিপরীত বল সৃষ্টি করবে যার মাধ্যমে এই স্থাপনাটি স্থিতিশীল থাকবে। ভারী বস্তুটি এমনভাবে যুক্ত করা হবে যাতে এর মাধ্যমে প্রযুক্ত কেন্দ্রবিমুখী বল পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের তুলনায় সামান্য বেশী হয়। এই দুই পরস্পর বিপরীত বলের প্রভাবে স্পেস এলিভেটরে প্রযুক্ত একপক্ষীয় বলের পরিমান কম হবে, ফলে ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভবনা হ্রাস পাবে। এই ধরনের প্রস্তাবনা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬৪ সালের একটি জার্নালে।


স্পেস এলিভেটরের কার্যপদ্ধতি

এই গবেষণাটি প্রকাশের পর একই বছর সালে চার আমেরিকান প্রকৌশলী এই ধারনাটি নিয়ে পুনরায় বিচার বিশ্লেষণ করেন এবং একটি সুষম ব্যাসের স্পেস এলিভেটর ডিজাইন করেন এবং দেখান যে এধরনের একটি স্পেস এলিভেটর তৈরির জন্য তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে দৃঢ় বস্তুর(গ্রাফাইট, হীরক, কোয়ার্টজ প্রভৃতি) চেয়ে দ্বিগুন দৃঢ় বস্তুর প্রয়োজন। সেই সময়ের প্রাপ্ত সবচেয়ে দৃঢ় বস্তুগুলো অবশ্য চাঁদ কিংবা মঙ্গল গ্রহে এলিভেটর তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিলো কেননা এই উপগ্রহ এবং গ্রহের অভিকর্ষ বল পৃথিবীর তুলনায় যথেষ্ট কম। এর বাইরেও বিভিন্ন সময় স্পেস এলিভেটরের বিভিন্ন মডেল প্রদর্শিত হয়। কিন্তু এই মডেলগুলোর কোনোটিই বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য ছিলনা যথেষ্ট মজবুত বস্তুর অভাবে।


শিল্পীর তুলিতে স্পেস এলিভেটর


কার্বন ন্যানোটিউব (CNT)

৯০ এর দশকে কার্বন ন্যানোটিউব উদ্ভাবণের পর নতুন করে স্পেস এলিভেটরের স্বপ্নদ্রষ্টাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। কার্বন ন্যানোটিউব বা সংক্ষেপে CNT প্রচলিত যেকোনো বস্তুর চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। এটা প্রচলিত সবচেয়ে দৃঢ় স্টীলের দড়ির চেয়ে প্রায় ৩০০ গুন শক্ত। CNT উদ্ভাবণের পর এই বস্তুটিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকৌশলী আবারো স্পেস এলিভেটর ডিজাইনে তৎপর হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, স্পেস এলিভেটর ডিজাইন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগীতামুলক কর্মসূচী ঘোষনা করা হয় (সম্প্রতি যেমন চাঁদে চরে বেড়ানোর উপযোগী পরিবহন নিয়ে একটি প্রতিযোগীতা বেশ আলোচিত হয়েছে)। এর মধ্যে অন্যতম হল Elevator:2010। এই প্রতিযোগীতা নাসাকর্তৃক ২০০৫ সালে চালু করা হয় এবং প্রাথমিকভাবে প্রতিযোগীতার বিজয়ীর জন্য ৫০ হাজার ডলার পুরষ্কারমুল্য ঘোষনা করা হয়। পরের বছরগুলোতে এই পুরস্কারের পরিমান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১১ সালে গুগল স্পেস এলিভেটর নির্মানে গবেষণা করার ঘোষনা দেয় এবং একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে। ২০১২ সালে Obayashi Corporation নামক একটি প্রতিষ্ঠান পরবর্তী আটত্রিশ বছর অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ CNT প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি স্পেস এলিভেটর নির্মানের ঘোষনা দেয় যা ঘন্টায় দু’শ কিমি বেগে এর কাঠামো বরাবর চলাচল করবে এবং একবারে ৩০ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

স্পেস এলিভেটর নির্মান যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয় তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে সর্বোচ্চ প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ যা আমাদের পরিচিত পৃথিবীকে নিমিষেই মহাশুন্যের সাথে যুক্ত করে দেবে। সেদিন থেকে মহাশুণ্য হয়ে যাবে আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি।

(লেখাটি ইতিপূর্বে বিজ্ঞানব্লগে প্রকাশিত।)
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×