somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাঁচের পৃথিবী।।

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




১.
বাইরে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে।

মিসির আলী কেটলিতে চা বসিয়েছেন। গ্যাস এর চুলো, গ্যাস প্রায় শেষ এর পথে। প্রতিদিনই ভাবেন , ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে নতুন একটা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আসবেন, কিন্তু ফেরার পথে তা আর মনে থাকেনা। ইদানিং তার কিছু মনে থাকেনা। ডায়েরীতে নোট করে রাখতে হয়। কোথায় যেন তিনি পড়েছিলেন, এই বয়সে প্রতিদিন মস্তিষ্কের প্রায় ৯-১০ হাজার নিউরন মারা যায়। এটাই বোধ হয় বার্ধক্যের লক্ষন। তিনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন!

মিসির আলী চিন্তিত মুখে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়েছে। ক্লান্ত লাগছে। আকাশে প্রচুর মেঘ, চারপাশ কালো হয়ে আছে। তবে গাছের পাতা স্থির। নড়ছে না। কেমন যেন একটা দম আটকানো দম আটকানো ভাব। তার মানে বাইরে বাতাস নেই। শোঁ শোঁ শব্দ হওয়ার প্রশ্ন আসে না।

এমনও হতে পারে, শোঁ শোঁ শব্দটা আসলে আসছে রান্নাঘর থেকে। তিনি চোখ দিয়ে বাইরের অন্ধকার অবস্থা দেখেছেন, আর কান দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ শুনেছেন। তাই তার মস্তিষ্ক দুটোকে কো-রিলেট করেছে। আলাদা আলাদা দুটো ব্যাপার একসাথে মিলিয়ে অনেকটা ১+১ এর মতো ২ বানিয়েছে।

মিসির আলী অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করছেন। তার মস্তিস্ক ইদানিং আগের মতো কাজ করছে না। মাঝে মাঝেই এটা ওটা ভুল করে ফেলছে। তিনি এটাকে সহজভাবে মেনে নিতেও পারছেন না, আবার সত্যিটাকে অস্বীকারও করতে পারছেন না। রহস্য সমাধান তার পেশা না, তার সখ। সখের জিনিসের প্রতি মানুষের গোপন দুর্বলতা থাকে। কোন কারনে সেই সখ বিঘ্নিত হলে মন খুঁত খুঁত করবে, এটা অস্বাভাবিক নয়।

মিসির আলীর মন খুঁতখুঁত করার আরেকটা বড় কারন- তিনি আজকাল এলোমেলো কিছু স্বপ্ন দেখছেন। এলোমেলো স্বপ্ন দেখা কোন সমস্যা না। ঘুমের জগতে মানুষের মন এর উপর মানুষের নিয়ন্ত্রন থাকেনা। সমস্যা হচ্ছে, একই স্বপ্ন তিনি বার বার দেখছেন। মিসির আলী কয়েকটা স্বপ্ন এতো বার দেখেছেন, যে তার মুখস্ত হয়ে গেছে।

যেমন তিনি দেখছেন, কোন একজন ভদ্রলোক কোন এক নির্জন পুকুরপাড়ে বসে আছেন। বসে বসে তন্ময় হয়ে তিনি পুকুর দেখছেন। ভদ্রলোকের বয়স বেশি না। ৬০- ৬৫ হবে। আবার পরক্ষনেই দেখছেন, ভদ্রলোক একটা হাসপাতালের বিছানায় বসে আছেন। খুব সম্ভবত তিনি তার ডায়েরীতে কিছু লিখছেন। তবে তাকে সেখানে আরও বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোন এক ভয়ংকর রোগ ইচ্ছে করে টেনে হিঁচড়ে তার শরীরে বার্ধক্য নামিয়েছে।

এই স্বপ্ন বার বার দেখার কারন কি? তিনি ভদ্রলোককে চেনেন না। তিনি অনেক খেয়াল করে ভদ্রলোকের চেহারা মনে রেখেছেন। এই ভদ্রলোককে তিনি আগে কখনো দেখেন নি। তবু স্বপ্নটা দেখার সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়। তার কাছে কেন জানি মনে হয়, এই মানুষটাকে তিনি বহুকাল ধরেই চেনেন।

মিসির আলী একটা সিগারেট ধরালেন। বার বার এই স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা একটু ধোঁয়াটে। তিনি টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করলে তার আর কোন ব্যাখা খোঁজার প্রয়োজন ছিলো না। তিনি বিশ্বাস করেন লজিক। এই পৃথিবীতে লজিক ছাড়া কোন কিছুই হয়না। এই কারনেই এটা পৃথিবী। বেহেশত কিংবা দোজখ না।

হতে পারে, তার অবচেতন মন তাকে নিজেকেই ওই ব্যক্তি হিসেবে তার স্বপ্নে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। তিনি নিজেও বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। রোগ-শোক, মৃত্যুভয় তারও হয়। তিনি ভুলো মনা। ডায়েরীতে সব কিছু নোট করে রাখেন। স্বপ্নের ব্যক্তিকেও তিনি ডায়েরী লিখতে দেখেছেন।

সহজ ব্যাখা। কিন্তু ব্যাখা এর মধ্যে অনেক ফাঁক আছে। লোকটাকে তিনি চেনেন না। কিন্তু তাকে বার বার দেখছেন। এটার কোন উত্তর তার কাছে নেই। লোকটাকে কেন তার আপন মনে হয়, তাও তিনি জানেন না। স্বপ্নে দেখেছেন, লোকটা পুকুরপাড়ে বসে আছে। অথচ ঢাকা শহরে কোথাও পুকুর নেই। তার নিজের অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে পুকুর আসার কথা না। তিনি যে পুকুরের প্রতি খুব বেশি আকৃষ্ট , অথবা কল্পনাপ্রবন, তাও নয়। তার গ্রামের বাড়িতেও কোন পুকুর ছিলো না।

মিসির আলীর সিগারেট শেষ। তিনি রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের কেটলিটা নামালেন। চায়ের কাপে চা ঢাললেন। টোস্ট এর প্যাকেটটা বের করলেন। তিনি টোস্ট বিস্কুট দিয়ে চা খাবেন। সকাল বেলা তার ভারী কিছু খেতে কখনো ইচ্ছা করেনা। বমি বমি লাগে।

আরেকটু পরে তাকে আজ ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। ১১ টায় একটা লেকচার ক্লাস আছে। ১১টায় ক্লাস থাকলেও তাকে অনেক আগে বের হতে হয়। ক্লাস নেবার আগে টিচার্স রুমে বসে তিনি বেশ কিছুক্ষন বইপত্র ঘাঁটেন। পড়াশোনা না করে তিনি কোন লেকচার নেন না।

মিসির আলী সময় নিয়ে কাপড় পড়লেন। চুল আঁচড়ালেন। ভেতরের রুমের দরজা আটকালেন। আকাশে মেঘ, ছাতা নিতে হবে। দরজার পাশে এসে তার খেয়াল হলো, তিনি গতরাতে সিরাজ সাহেবের বাসায় ছাতাটা ফেলে এসেছেন।

ছাতা নেই, তাই বলে তো আর বসে থাকা যায়না। তিনি ছাতা ছাড়াই রাস্তায় নামলেন। একটা রিকশা পেয়ে গেলে আর ছাতার প্রয়োজন হবেনা। কিন্তু আজ রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। কোন রিকশা চোখে পড়ছে না। বেশি মানুষজনও নেই, দোকানপাট গুলো প্রায় বন্ধ। আশ্চর্য!

মিসির আলী মনে করার চেষ্টা করলেন আজ কতো তারিখ, কি বার। আজ জুলাই মাসের ১৯ তারিখ। আজ কি কোন সরকারী বন্ধের দিন? হওয়ার তো কথা না। তাহলে কি আজ হরতাল? তার খুব একটা খবরের কাগজ পড়া হয়না ইদানিং। খবরের কাগজ এর উপর থেকে হঠাৎ করেই আগ্রহ হারিয়েছেন তিনি।

রাস্তার মোড়ে একটা ফার্মেসী খোলা। সেখানে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বিরক্ত মুখে বসে আছে। মিসির আলী এগিয়ে গেলেন।

"ভাই, আজ কি কোন কারনে হরতাল?"
"হরতাল হবে ক্যান?"
"রাস্তাঘাট ফাঁকা কেন তাহলে?"
দোকানি বিরক্তভরা কণ্ঠে জবাব দিলো- "জানি না।"

মিসির আলী রাস্তায় নেমে এলেন। ইদানিং সব কিছুই কেমন যেন একটু অনিয়ন্ত্রিত, খাপছাড়া খাপছাড়া লাগছে। অসামঞ্জস্যতাটা ঠিক কোথায় তিনি ধরতে পারছেন না।

তিনি রিকশার অপেক্ষা না করে হাটা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে তিনি এমনিই হাঁটেন। তবে আজকের কথা আলাদা। আজ তার শরীরটা তেমন একটা ভালো নেই। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আর আজই রিকশা উধাও।

হাঁটতে হাঁটতে তিনি কলাবাগান থেকে শাহবাগ পর্যন্ত চলে এলেন। শাহবাগ এর মোড় পর্যন্ত আসা মাত্রই ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। ঝুম বৃষ্টি, বিশাল বিশাল ফোঁটা। মিসির আলী দু মিনিটেই ভিজে একেবারে চুপসে গেলেন। প্রতিবার তিনি ছাতা সঙ্গে করে আনেন, বৃষ্টি হয়না। আজ আনেন নি, আজই বৃষ্টি হলো। মিসির আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অপেক্ষা না করে, তিনি দ্রুত পা চালিয়ে ইউনিভার্সিটি চলে এলেন।

২.
মিসির আলী টিচার্স রুমে বসে আছেন। তার কাপড় ভেজা। শীত শীত লাগছে। ঠাণ্ডা না লাগলেই হয়। ভেজা কাপড়ে ক্লাস নিতে হবে, সেটা তেম্ন কোন সমস্যা না। ক্লাস শুরু হতে বাকি আছে আধ ঘণ্টা। এর মধ্যে কাপড় কিছুটা শুকিয়ে যাওয়ার কথা।

"স্যার, আসবো?"
মিসির আলী দেখলেন, দরজার কাছে কালো শাড়ি পড়া একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে।
"আসো।"

মেয়েটার বয়স কতো? ২৭-২৮ হবে। নাকি তারও বেশি? এই মেয়েটি কি তার ডিপার্টমেন্ট এর ছাত্রী? মনে হয় না। তিনি আগে কখনো মেয়েটিকে দেখেন নি বোধহয়। দেখে থাকলেও মনে পড়ছে না। মেয়েটা অনেক ফর্সা, রূপবতী। কালো রঙের শাড়িতে তাকে দেখতে ভালো লাগছে।

"তুমি কি আমার ডিপার্টমেন্ট এর?"
মেয়েটা একটু হাসলো।
"না স্যার, আমি আপনার ডিপার্টমেন্ট এ ছিলাম না। আমি sociology তে ছিলাম। তবে এখন আর নেই। পাশ করে বের হয়ে গেছি।"
"ও আচ্ছা।"
" ইউনিভার্সিটিতে থাকা অবস্থায় আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনার কাছে আমার আসার ইচ্ছা ছিলো অনেক আগেই। নানান কারনে আসা হয়নি। আজ আসলাম, একটা প্রশ্ন নিয়ে।"
"কি প্রশ্ন?"
"তার আগে একটা আনুষঙ্গিক প্রশ্ন করি। আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?"
"দেখো, ঈশ্বর হচ্ছে একটা ধাঁধা। এই ধাঁধার কোন উত্তর হয়না। হতে পারে, ঈশ্বর সত্যি সত্যিই আছে। আবার এও হতে পারে, ঈশ্বর বলে কেউ নেই। পুরোটাই মানব মনের সৃষ্ট কল্পনা। মানুষের মন সবসময়ই কিছু নির্ভরতা খোঁজে। চরম বিপদের সময় সে যখন আবিস্কার করে, সে তলিয়ে যাচ্ছে, তখন সে আশা বাঁচিয়ে রাখার শেষ শক্তিটা পায় এই ঈশ্বর বিশ্বাস থেকে।"
"আপনি কি বিশ্বাস করেন? ঈশ্বর আছে, নাকি নেই?"
"আমি কোন প্রমান পাইনি। তবে আমারও প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, যে ঈশ্বর আছে। তবে আমরা যে রুপে ঈশ্বর দেখি, সেই রুপে হয়তো নেই। হয়তো অন্য কোন রুপে আছে। যেমন ধরো, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান মনে করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়েছিলো। যেটাকে আমরা অন্যভাবে বলতে পারি- প্রাকৃতিক ঘটনা। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? Nature has done all of these things. Nature is God."
"তাহলে বলতে চাইছেন, আমরাও প্রকৃতি থেকে এসেছি। আমরা প্রকৃতির অংশ।"
"হ্যা।"
"তাহলে আমাদের মৃত্যু হয় কেন? প্রকৃতির তো মৃত্যু নেই। আমরা প্রকৃতির অংশ হলে তো দুই দিকের ক্ষেত্রেই একই রকম ধারা থাকা উচিৎ।"
"প্রকৃতিরও মৃত্যু থাকতে পারে, হবে হয়তো কোন এক সময়।"
"স্রষ্টার মৃত্যু হলে তার সৃষ্টির কি হয়, স্যার?"
"সৃষ্টিও শেষ হয়ে যায়।"
"তাই কি?"

মিসির আলী বিভ্রান্ত হলেন।

"আমি বুঝতে পারছিনা তুমি কি বলতে চাইছো।"
"মানে ধরুন, একজন চিত্রকর একটা ছবি আঁকলো। একদিন সেই চিত্রকর মারা গেলো। তার সৃষ্টি- মানে ছবিটাও কি শেষ হয়ে যায়?"
"না।"
"ছবিটা তো থেকে যায়। স্রষ্টার সৃষ্টি আটকা পড়ে যায় একটা কাগজের ভেতর।"
"হম।"
"তাহলে যে স্রষ্টা আমাদের তৈরি করেছে, প্রকৃতি, বা অন্য কেউ- তার যদি কোন কারনে মৃত্যু ঘটে, তাহলে আমাদের কি হবে? কে আমাদের মৃত্যু দিবে? আমরাও কি বিলীন হবো? নাকি ছবির মতোই এই পৃথিবীতে আটকা পড়বো?"

মিসির আলী জবাব দিতে যেয়েও জবাব দিতে পারলেন না। প্রশ্নটা তার মনে গভীরভাবে গেঁথে গেলো।

মেয়েটি বললো- "আমার বিশ্বাস, আপনি আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেবেন। আমি আজ চলি। আপনার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। আর, ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ থাকবেন না। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

মিসির আলী জিজ্ঞাসা করলেন- "তোমার নাম কি?"
মেয়েটি একটু ঘুরে বললো-"অনেকে বলে, আমার কথাবার্তা-চেহারার সাথে আমার নামের অদ্ভুত মিল। আপনার তো অনুমানশক্তি ভালো। ধারনা করতে পারেন, আমার নাম কি?"
"খুব সম্ভবত তোমার নাম কোন ধাতুর নাম দিয়ে। আমি কি ভুল বলেছি?"
"না। কিন্তু এমনটা মনে হওয়ার কারন?"
"তোমার আত্মবিশ্বাস মজবুত। তুমি স্পষ্ট, তোমার কথাবার্তাও কিছুটা ধারালো। তোমার চোখ, নাক, মুখ কাটা কাটা। তুমি রূপবতী, উজ্জ্বল। এই সব বৈশিষ্ট্যগুলি ধাতব বৈশিষ্ট্য।"
মেয়েটা পিছন ফিরে একটু হাসলো। "স্যার, আমার নাম রুপা। যাই স্যার, ভালো থাকবেন।"

মিসির আলীর প্রচণ্ড খারাপ লাগছে। মাথা ভার হয়ে আছে। শীত শীত ভাব আরও বেড়েছে। খুব সম্ভবত জ্বর আসবে। লেকচার ক্লাসে বকর বকর করতে তার আজকে ভালো লাগছে না। মাথার মধ্যে বৃত্তের মতো একটা কিছু ঘুরছে। চলমান বৃত্তের গতি তিনি বন্ধ করতে পারছেন না।

মিসির আলী ক্লাস ছুটি দিয়ে দিলেন। শুকনো মুখে বললেন- আজ আর পড়াবো না। ক্লাস ডিসমিস।
"স্যার এর কি শরীর খারাপ?"
"না, তেমন কিছুনা। ঠাণ্ডা লেগেছে একটু। ঠিক হয়ে যাবে।"

ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি আধাঘণ্টা দুই হাতে মাথা ধরে বসে রইলেন। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে -"স্রষ্টা মারা গেলে তার সৃষ্টির কি হয়?"

বাড়ি ফেরার পথেই মিসির আলীর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। প্রবল জ্বরে তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। এলোমেলো পা ফেলছেন। তার শরীর দ্রুত টলছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, তিনি পড়ে যাবেন। তিনি থামলেন। চারপাশের রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি, কেমন যেনো মৃত মৃত লাগছে। মানুষজন নেই। আলোটাও কমে এলো হঠাৎ করে। এটা কি সত্যি সত্যিই ঘটছে? নাকি জ্বরের ঘোরে তিনি উল্টাপাল্টা দেখছেন?

"স্যার, কেমন আছেন?"
প্রশ্ন শুনে মিসির আলী তাকালেন। তার পাশে একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে। তার বড় চুল। দীর্ঘদিনের শেভ না করা দাড়ি। ছেলেটার পরনে একটা হলুদ পাঞ্জাবী। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ছেলেটা খালি পায়ে দাড়িয়ে আছে। তার পায়ে কোন স্যান্ডেল নেই।

ছেলেটা হাসি হাসি মুখে আবারো বললো-
"স্যার, কেমন আছেন?"
মিসির আলী বিড়বিড় করে বললেন- "বুঝতে পারছিনা। সব কিছু এলো মেলো লাগছে। আলো কমে গেলো কেন? এটা কি আমার বিভ্রম?"
"না স্যার। বিভ্রম না।"
"কেন এমন হচ্ছে?"
"আপনি জানেন না?"
"না।"
"স্রষ্টার মৃত্যু হলে তার সৃষ্টির কি হয়, স্যার?"

মিসির আলী চমকে উঠে ছেলেটার দিকে তাকালেন।

ছেলেটা হাসতে হাসতে বললো- "আমি জানি, আপনার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। আমি রুপাকে সে কথা বলেছিলাম। সে বিশ্বাস করেনি। সে ছুটে গিয়েছে আপনার কাছে। তার বিশ্বাস ছিলো, আপনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। স্যার, আপনি কি জানেন, আপনি আর কোনোদিনও কোন রহস্যের সমাধান করতে পারবেন না?"
"কেন?"
"কারন, উনি চলে গেছেন একটু আগে।"
"উনি টা কে?"
"তাকে আপনি স্বপ্নে দেখতেন।"
"তুমি কিভাবে জানো?"

ছেলেটা আবারো হাসলো।

মিসির আলী বিভ্রান্তিমাখা দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে আছেন।
"তুমি কে?"
"আমি কেউ না। আপনিও কেউ না। আমি, আপনি, সবাই কল্পনা। কোন একজনের চোখের কল্পনা। এটা একটা কল্পিত পৃথিবী। চারপাশে যা কিছু দেখছেন, তা শুধুমাত্র একজনের কল্পনার সমষ্টি। এখানের ঘর- বাড়ি কল্পনা, রাস্তা- ঘাট কল্পনা। আমরা সবাই কল্পনার মানুষ।"

"তাহলে কি আমাদের অস্তিত্ব নেই? জন্ম নেই? মৃত্যু নেই? বার্ধক্য নেই? তা কি করে হয়?"

"সত্যিকার ভাবে আমাদের আসলে অস্তিত্ব নেই। আবার এক অর্থে অস্তিত্ব আছে। এই কল্পনার পৃথিবীতেই আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের জন্ম ছিলো, কারন একজন এই কাঁচের পৃথিবীতে আমাদের জন্ম দিয়েছেন। তবে তিনি মৃত্যু দিয়ে যেতে পারেন নি। তার আগে নিজেই চলে গেছেন। আমাদের মৃত্যু নেই। আজকের পর থেকে আমাদের বয়স আর বাড়বে না কোনোদিন। একটা অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে আমাদের এখানে থাকতে হবে চিরকাল। আপনি, আমি এই কাঁচের পৃথিবীতে হঠাৎ করে আটকা পড়ে গেছি।"
"তুমি মিথ্যা বলছো।"
"কল্পনার সত্যি মিথ্যা হয়না স্যার। কল্পনা পুরোটাই মিথ্যা। আবার কল্পনা সত্যি, কারন কেউ তার নিজের ভেতরের কল্পনার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারে না।"
"কি ভয়ংকর! কোনোভাবেই কি এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি নেই?"
"আছে।"
"কিভাবে?"
"যদি মানুষটা আবার কোনোদিন কোনভাবে ফিরে এসে আমাদের মৃত্যু দেয়।"
"সেটা কখনো সম্ভব না। এই সম্ভাবনায় কোন লজিক নেই।"
"সব কিছু স্যার লজিক দিয়ে হয়না। প্রকৃতি বড় রহস্যময়। সে মাঝে মাঝেই কিছু ব্যাখাতীত ঘটনার জন্ম দিতে পছন্দ করে। তার নাম "মিরাকেল"।


মিসির আলী সাহেব কখনো 'মিরাকেল" এ বিশ্বাস করেন নি। কিন্তু এই একটি মিরাকেল এর জন্য তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছেন।




পাদটীকাঃ

"আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে--এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।"
-জীবনানন্দ দাশ।

উৎসর্গঃ হুমায়ুন আহমেদকে। স্যার, কোন ভাবে, কোন রুপে আবারো ফিরে আসুন আমাদের মাঝে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৮:০৬
৩৮টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×