somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আন্ডারস্ট্যান্ডিং মোহাম্মদ -৮(মূল : আলি সিনা , অনুবাদ : দুরের পাখি)

১৯ শে জুলাই, ২০১১ রাত ১০:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব-৭, এইখানে

পর্ব-৮
-----

পরবর্তী দুই বছর মোহাম্মদ তার পিতামহ আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে কাটায় । ছেলে আব্দুল্লাহর একমাত্র নিশাণ এই এতিম নাতিটিকে মুত্তালিব স্নেহে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন । ইবন সা’দ লিখেছেন আব্দুল মুত্তালিব তার এই নাতির প্রতি যতোটা মনোযোগী ছিলেন, তার কোন সন্তানের প্রতিও ততোটা ছিলেন না । (টীকা-১৪) । মোহাম্মদের জীবনিতে Muir লিখেন; “এই বালকটির প্রতি তার ছিলো অপরিসীম ভালোবাসা । কাবার ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে বসতেন আব্দুল মুত্তালিব, সম্মানসূচক বেশ কিছুটা জায়গা খালি রেখে বসতেন তার ছেলেরা । মোহাম্মদ সেখানে দৌড়ে চলে যেত, আর কোনরকম ভয় সম্মানের তোয়াক্কা না করেই দাদার কোলে চড়ে বসত । মুত্তালিবের ছেলেরা মোহাম্মদকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি তাদের ধমকে দিতেন; আমার বাচ্চার গায়ে হাত দিস না । এরপর তিনি মোহাম্মদের শিশুসূলভ বকবকানিতে মজা পেয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিতেন । যদিও তখনো মোহাম্মদের দেখাশোনার ভার ছিলো আব্দুল মুত্তালিবের দাসী বারাকা’র উপর , কিন্তু মোহাম্মদ তার কাছে এক মুহূর্তও থাকতো না । সুযোগ পেলেই সে দৌড়ে চলে যেত দাদুর ঘরে, মুত্তালিব একা কিবং ঘুমন্ত থাকলেও । (টীকা-১৫)

দাদুর কাছ থেকে পাওয়া স্নেহের কথা মোহাম্মদ আজীবন মনে রেখেছিলো । নিজের কল্পণাজাত কিছু মসলা মিশিয়ে মোহাম্মদ পরে বলে যে তার দাদু বলতেন, “ ওকে ওর মত থাকতে দাও, কারণ ওর বিশাল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত আছে, আর সে হবে এক বিশাল রাজ্যের অধিপতি ।” দাসী বারাকাকে বলতেন, “ ওকে সাবধানে রেখো ইহুদি খ্রিস্টানদের কাছ থেকে, ওরা ওকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, পেলে ক্ষতি করতে চাইবে ” (টীকা-১৬) ।

কিন্তু সে ছাড়া কারোরই এইসব কথা মনে ছিলো না, কারণ তার চাচাদের কেউ-ই তার নবীত্বের দাবী মেনে নেয়নি কেবল তার সমবয়সী হামজা ছাড়া । আব্বাস অবশ্য পরে তার দলে যোগ দেয়, কিন্তু একেবারে শেষে, যখন মোহাম্মদ মক্কা আক্রমণ করে ।

মোহাম্মদের ভাগ্য এবারও তাকে প্রতারণা করে । দাদুর স্নেহে মাত্র দুই বছর থাকার পরেই ৮২ বছর বয়স্ক আব্দুল মুত্তালিব মারা যান । মোহাম্মদের দায়িত্ব নেন তার চাচা আবু তালিব ।

স্নেহশীল দাদুর মৃত্যুতে জীবনে বিষণ্ণতা নেমে আসে মোহাম্মদের । হাজুন গোরস্তানে তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়ার পথে মোহাম্মদকে কাঁদতে দেখা যায় । আর জীবনভর সে বহন করে দাদুর মধূময় স্মৃতি ।

আবু তালিব বিশ্বস্ততার সাথে মোহাম্মদের দেখভাল করা শুরু করেন । Muir এর লেখায় পাওয়া যায়, “বালকটির প্রতি তার স্নেহ, আব্দুল মুত্তালিবের মতই ছিলো । বাল্যকালের অসহায় অবস্থা কেটে উঠার আগ পর্যন্ত আবু তালিব মোহাম্মদকে পাশে নিয়ে খেতেন, তাকে পাশে নিয়ে ঘুমাতেন, এবং দূরে কোথাও গেলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন (টীকা-১৭)। ” ওয়াক্কাদির বর্ণনা থেকে ইবনে সাদ লিখেন, আবু তালিব যদিও ধনী ছিলেন না কিন্তু তিনি তার নিজের সন্তানদের চাইতেও বেশি যত্ন দিয়ে মোহাম্মদকে লালন করেন ।

বাল্যকালের এইসব দুঃসহ মানসিক অভিজ্ঞতার কারণে মোহাম্মদ হয়তো সবসময় এই ভয়ে থাকতো যে তাকে সবাই ছেড়ে চলে যাবে । তার মানসিক ক্ষতও নিশ্চয়ই ব্যাপক গভীর ছিলো । তার ১২ বছর বয়সের একটি ঘটনা থেকে একথা বুঝা যায় ভালোভাবে । আবু তালিব ব্যবসার জন্য সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন । মোহাম্মদকে সাথে নেয়ার কোন পরিকল্পণা ছিলো না তার । “কিন্তু কাফেলা যখন রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আর আবু তালিব উটের পিঠে চড়লেন, বালক মুহাম্মদ চাচার কাছ থেকে এতদিন দূরে থাকতে হবে এটা মেনে নিতে না পেরে চাচার কাছ থেকে সরতে চাইছিলো না । আবু তালিব বাধ্য হয়ে মোহাম্মদকে সাথে নিলেন । (টীকা ১৮) । চাচার প্রতি এই নির্বাধ ভালোবাসা প্রমাণ করে যে মোহাম্মদ সবসময় কাছের মানুষদের হারানোর ভয়ে থাকতো ।
এত ভালোবাসা স্বত্তেও, এবং যদিও আবু তালিব জীবনভর মোহাম্মদকে রক্ষা করে গেছেন, নিজ সন্তানদের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছিলেন মোহাম্মদকে, শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ অকৃতজ্ঞ ভাতিজার মতই আচরণ করে । আবু তালিব যখন মৃত্যশয্যায়, মোহাম্মদ তাকে দেখতে যায় । আব্দুল মুত্তালিবের অন্য ছেলেরাও সেইখানে ছিলো । মোহাম্মদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আবু তালিব তার ভাইদের অনুরোধ করেন মোহাম্মদকে রক্ষা করার জন্য । তারা রাজি হয় , এমনকি মোহাম্মদ যে আবু লাহাবকে অভিশাপ দিয়েছিলো, সে-ও । এর পরেই মোহাম্মদ আবু তালিবকে ইসলাম গ্রহণ করার অনুরোধ করে ।

মোহাম্মদ খুব ভালোভাবেই জানতো যে তার অনুসারীরা সব ছিলো নীচু বংশের ভীরু মানুষ । স্ট্যাটাস পাওয়ার জন্য তার দরকার ছিলো উচ্চবংশীয় ক্ষমতাশীল কাউকে অনুসারী হিসেবে পাওয়া । ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় এসেছে, “ যখনি কোন মেলায় লোকসমাগম হতো অথবা যখনি রাসুল শুনতেন যে গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তি এসেছেন মক্কায়, তিনি তার বাণী নিয়ে তাদের কাছে যেতেন (টীকা-১৯) ” ।

ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়, মোহাম্মদ ব্যাপকভাবে আনন্দ করেছিলো যখন আবু বকর এবং ওমর তার দলে নাম লেখায় । আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ করলে চাচাদের এবং কুরাইশ গোত্রের কাছে মোহাম্মদের সম্মান বাড়তো । কুরাইশরা ছিলো মক্কার পবিত্র কাবা গৃহের রক্ষাকর্তা, তাদের নিকট সম্মন এবং দাম পাওয়ার জন্য মোহাম্মদ বেপরোয়া ছিলো । কিন্তু আবু তালিব মোহাম্মদের অনুরোধে সাড়া না দিয়ে হেসে বললেন, আমি আমার পূর্বপুরুষদের ধর্মে থেকেই মরতে চাই । আশাহত হয়ে মোহাম্মদ ঘর থেকে বের হয়ে যায়, বিড়বিড় করতে করতে, “আমি তাঁর জন্য দোয়া করতে চাইছিলাম কিন্তু আল্লাহ আমাকে নিষেধ করলেন । ”

যে লোক নবীকে বড় করলেন, আজীবন প্রতিরক্ষা দিলেন, নবীর জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলেন তার জন্য দোয়া করতে খোদা বাধা দিবেন এটা ভাবা একটু কষ্টকর । এই ধরণের ঈশ্বর অনেকটা উপাসনা পাবার অযোগ্য ঈশ্বর । মোহাম্মদের জন্য আবু তালিব এবং তার পরিবারের স্বীকার করা ত্যাগের পরিমাণ বিশাল । এই মানুষটি, যদিও মোহাম্মদের নব্যুয়তের দাবীতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন নি, তবু পাহাড়ের মত দাড়িয়ে ছিলেন তার শত্রুদের বিরুদ্ধে, প্রতিরোধ করে গেছেন তাদের যেকোন অনিষ্টকর প্রচেষ্টা, এবং ৩৮ বছর ধরে ছিলেন মোহাম্মদের সবচে বিশ্বস্ত সমর্থক । এত কিছু স্বত্তেও মৃত্যুশয্যার মোহাম্মদের আহবান প্রত্যাখ্যান করায় সে এতই ক্ষিপ্ত হয় যে, চাচার জন্য প্রার্থণা করাও বাদ দেয় । বুখারির বর্ণনায় এসেছে,

“আবু সাইদ আল খুদরি বর্ণনা করেন, কেউ একজন আবু তালিবের উল্লেখ করাতে মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার অনুরোধে হয়তো শেষ বিচারের দিন তাঁকে দোযখের অগভীর আগুনের অংশে রাখা হবে যাতে তার গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে থাকবে, কিন্তু তাঁর মাথার মগজ তাতে ফুটতে থাকবে’ ।(টীকা-২১)”

মোহাম্মদের যৌবন তুলনামূলক ভাবে ঘটনাহী ছিলো । তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি যা সে মনে রেখেছিল । ফলে তার জীবনিকারদের বর্ণনাতেও তেমন কিছু পাওয়া যায় না । সে ছিলো লাজুক, শান্ত এবং খুব বেশি সামাজিক নয় এমন ধরণের । যদিও তার চাচা তার ভালো যত্নই নিয়েছিলেন এবং এমনকি একটু বেশি লাই-ও দিয়েছিলেন, তবু মোহাম্মদ তার অনাথ অবস্থা নিয়ে ভাবিত ছিলো । ভালোবাসাহীন একাকি শিশুকালের স্মৃতি তাকে সারাজাবীন তাড়া করে ফিরেছিলো ।

সময় বয়ে যায় । মোহাম্মদ তখনো ছিলো নির্জন, নিজের একার জগতে বন্দী, এমনকি সমসাময়িকদের কাছ থেকেও কিছুটা বিচ্ছিন্ন । বুখারি (টীকা -২২) বলেন, “মুহাম্মদ ছিলো বোরখাপড়া যুবতীর চাইতেও লাজুক । (টীকা-২৩) ।”
---------------------------------------------------------------------------------------
টীকা -১৪
Tabaqat Ibn Sa’d , Volume 1 , page 107
টীকা-১৫
The life of Muhammad , Sir William Muir [Smith, Elder & Co. , London, 1861] Volume 2, Chapter 1, page -28
টীকা-১৬
kitab al waqidi , page -22
টীকা -১৭
Tabaqat, Vol. 1 page 108
টীকা -১৮
The life of Muhammad , Sir William Muir , Vol. 2, Chapter 1, page 33
টীকা-১৯
Ibn Ishaq, page 195
টীকা -২০
The life of Muhammad , Sir William Muir, Vol. 2, page 195
টীকা-২১
Bukhari , Vol. 5, Book 58, Number 224
টীকা -২২
আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বুখারি(৮১০-৮৭০), হাদিস সংগ্রাহক । বুখারি ১৬ বছর ব্যায় মোট ২৬০২ টি হাদিস সংগ্রহ করেন । হাদিস সংগ্রগে বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার অত্যন্ত কঠিন পদ্ধতি অনুসরণের কারণে তার সংগৃহীত হাদিসগুলে বিশেষভাবে সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে ।
টীকা-২৩
বুখারি, Vol. 4, Book 56, Number 762
১৯টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×