মানুষের জীবনে ঘটন-অঘটনের শেষ নাই।
সাক্ষাৎ, বন্ধুত্ব, তারপর অনন্ত প্রেম। হয়েই যায় কখনো-সখনো।
আবার শুধু প্রেম দিয়েও শুরু হতে পারে জীবনের গল্প। এক্ষেত্রে বয়সটা কোন ফ্যাক্ট না। সাতও হয়, সত্তুরে হলেও বা ঠেকাচ্ছে কে?
আদনানের ক্ষেত্রে এই দুই ফরমুলার কোনটাই প্রযোজ্য না।
ক্লাস ওয়ানে থাকতেই মাহজাবিনের সাথে প্রথম দেখা হয় তার।
তবে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেছে, পাঁচ-ছয় বছরের একটা ছেলের ক্ষেত্রে এই চিরন্তন সূত্রটা খাটে নাই।
বাস্তবিক, মেয়েটাকে অপছন্দই করেছিলো ছোট্ট আদনান।
চোখা মুখের একটা মেয়ে। হিংসুটি স্বভাবের। সারাক্ষণই ঝগড়া করছে এর-ওর সাথে।
পেন্সিল নিয়ে ঝগড়া।
বই নিয়ে হাতাহাতি।
টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি।
মেয়েটা ক্লাসে একটা ত্রাসে পরিণত হয়েছে। মেয়েরা কি, ছেলেরাও প্রাণ হাতে নিয়ে থাকে।
আদনান চাপা স্বভাবের ছেলে, ভীতু বললেও খুব একটা অবিচার হবে না। মানুষের সাথে কথা বলা তার খুব বেশী ভালো লাগে না, মোটামুটি গুটিয়েই থাকে।
মাহজাবিনের সাথে তার খাতির হওয়ার কোন কারণ নাই।
স্পষ্ট করে বললে, তার জীবনটা হাবিয়া হয়ে গেছে মেয়েটার কারনে।
ভয়ংকর মেয়েটা বুঝে গেছে আদনান একটু ভীরু স্বভাবের। এটা নিয়ে সে সুযোগ পেলেই হাসাহাসি করে ক্লাসের মধ্যে, খোঁচা-খুঁচি করে।
ছোট বাচ্চাদের আত্মসম্মান বোধ কিন্তু ভয়াবহ মাত্রায় বেশী।
একটা মেয়ে তার সাহস নিয়ে হাসে, এরচেয়ে অপমানজনক আর কি আছে?
বাংলা সিনেমায় সবাই দেখেছে নায়করা কেমন বাঘের মত বিক্রমশালী আর নায়িকারা বিড়াল ছানার মত জুবুথুবু।
আর মাহজাবিন তাকে উল্টোচক্র দেখিয়ে দিচ্ছে।
কি মুশকিল!
অসহায় আদনান।
ঘটনাটা ক্লাসের প্রথম দিনের। মানে আদনানের প্রথম দিন, ক্লাস শুরু হয়েছে আরও দুই মাস আগে। সে ভর্তি হয়েছে দেরীতে।
দুরু দুরু বুকে আদনানের প্রবেশ সিনে। কাঁধে একটা মিকি মাউসের কার্টুন আঁকা ব্যাগ। বাবা ক্লাসের দরজা পর্যন্ত এনে দিয়েছেন। কিন্তু দরজা দিয়ে তাকে ঢুকতে হয়েছে একাই।
একরাশ হৈ-হল্লা যেন ধাক্কা দিলো তাকে। কিছুটা সংকুচিতভাবে সামনে তাকিয়ে দেখে সে।
চেঁচামেচি।
ছুটো-ছুটি।
ভয়াবহ!
এতজন সমবয়সী ছেলে-মেয়েকে একসাথে কখনো দেখেনি মুখচোরা আদনান। সে ঠিক বুঝতে পারলো না তার কি করা উচিৎ।
কথা বলবে?
কী বলবে?
সবচে’ বড় সমস্যা কাকে বলবে?
সবাই ব্যস্ত দুষ্টামিতে।
বাবা তাকে এ কেমন জায়গায় ফেলে গেলো?
ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো তার।
তবে কাঁদার সাহস হল না তার।
যদি কেউ কিছু বলে?
আদনান?
চকিতে ঘাড় ঘুরায় আদনান। বাব্বাহ! এখানে যে একজন বড় মানুষ আছে তা খেয়ালই করা হয়নি।
মহিলা দেখতে বড় মিষ্টি, ভয় ভয় লাগলো না দেখে। গোলগাল শরীর, চোখে চশমা। পরনে শাড়ী।
আমি তোমার ক্লাস টিচার। আমাকে আম্বিয়া ম্যাডাম ডাকবে।
ম্যাডামকে ঠিক কি বলা উচিৎ বুঝতে পারলোনা আদনান। ভদ্রতাসূচক কিছু বলা যায় কিনা ভেবে দেখলো সে। ভাগ্যিস ম্যাডাম আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না ওকে। ক্লাসে বাকিদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনিঃ
- বাচ্চারা! এর নাম আদনান। তোমাদের নূতন বন্ধু। সবাই আদনানকে হাই বলো।
পুরো ক্লাস একসাথে এতো জোরে হাই বলে উঠলো যে আদনানের বিশ্বাস ওটা বড় রাস্তা পর্যন্ত শোনা গেছে।
ম্যাডাম তাকে তার বসার জায়গা দেখিয়ে দিলেন।
ছোট ছোট প্লাসটিকের রঙিন সিট, বেশ পছন্দই হলো আদনানের। বাক্য-ব্যয় না করে সিটে বসে পড়লো সে।
ওহ তাহলে তুমি আদনান?
মেয়েটাকে তখনই প্রথম খেয়াল করল আদনান। একরাশ বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার পাশের সিটেই বসেছে সে।
উম হ্যাঁ। তুমি?
আমি মাহজাবিন।
মেহজাবিন?
মেহজাবিন না গাধা ছেলে, মাহজাবিন। দুটো এক হল?
একটা মেয়ে প্রথম দেখাতেই তাকে গাধা বলে দিলো। আদনান বুঝলো তার রাগ হওয়া উচিৎ। কিন্তু মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখে সে ঠিক সাহস করে উঠতে পারলো না। রাগটা মনে চেপে চুপ করে বসে থাকলো সে।
ম্যাডাম এগিয়ে এলেন তার দিকে।
-আদনান, বাসায় তুমি কদ্দুর পড়েছো?
পড়েছে সে অনেক কিছুই। কিন্তু ক্লাসে বসে হটাৎ সব গুলিয়ে গেছে ইশুবগুলের ভুসির মত।
অংক কী পারো?
এই এক, দুই, তিন, চার...
আমতা আমতা করে জবাব দিলো আদনান।
খুব ভালো, দেখি খাতায় লিখে ফেলো যতটুকু পারো।
আসলে এক,দুই, তিনের চেয়ে অনেক বেশীই পারে সে, ওটাতো স্রেফ কথার কথা। কিন্তু খাতায় লিখতে বসে হটাৎ আদনান বুঝতে পারলো চারের পর আর কিস্যু মনে নেই তার। গত চার মাসে আম্মু যা শিখিয়েছে তা ভোজবাজীর মত মিলিয়ে গেছে অকস্মাৎ।
মাথা ঘুরাতেই সে দেখলো মাহজাবিন নামের কুটনি মেয়েটা গভীর মনোযোগে তার কাজকর্ম খেয়াল করছে। ঠোটের কোণে একটা ‘তুমি কিস্যু জানো না’ গোছের হাসি।
লেখা বন্ধ হয়ে গেলো আদনানের।
তার ডেস্কে ঝুঁকে এল মেয়েটা।
- ওমা! তুমি চারের বেশী লিখতে পারো না? ছি ছি! আমি একশো পর্যন্ত লিখতে পারি! কি গাধা ছেলে!
ভয়ে পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবার উপক্রম হলো আদনানের। মা তাকে গত চার মাস ধরে কিলিয়ে- হাকিয়ে বাংলা, ইংরিজি আর অংকের কত কিছু শিখিয়েছে। ক্লাসে এসে এতসব ভুলে যাওয়াটা অবশ্যই মারাত্মক অপরাধ!
অসহায় চোখে মাহজাবিনের দিকে তাকালো আদনান। ফুঁপিয়ে উঠলো মৃদুভাবে।
আম্মু আমাকে সব পড়িয়েছে, আমার কিস্যু মনে নাই। প্লিজ ম্যাডামকে বলো না। উনি মারবেন আমাকে, তাইনা?
আবার সেই ‘তুমি কিস্যু জানো না’ হাসিটা ফিরে এলো মাহজাবিনের ঠোঁটে।
তুমি একদিনও হয় নাই ম্যাডামকে দেখেছো, আর এখুনি ভয় পেয়ে গেলে? ছি! কি ভীতু ছেলেরে বাবা! ধুর ম্যাডাম মারবে না।
স্বস্তির হাঁফটা আদনানের অত তাড়াতাড়ি ফেলা উচিৎ হয় নাই। কারণ মাহজাবিন বুঝে গেছে সে কতটা ভীতু।
বেচারা বুঝতেও পারে নাই কি কিয়ামত তার সামনে অপেক্ষা করছে।