somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোকেয়া বেগম, বয়েস ৭৮

১০ ই মে, ২০১০ দুপুর ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বৃষ্টির আগে আগে আকাশ কালো করে মেঘ জমা দেখেছেন না? আমার চারপাশে আজকাল সেরকম মেঘেরা ভিড় করে খুব! আমার সাথে খাতির আছে ভালোই, বিরক্ত করে না, নিজেদের মাঝেই খেলা করে, রাগারাগি-মারামারি যদিও সব আমাকে ঘিরেই! খোলা হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে অভ্যস্ত আমি চারদিকের ধূসর ঘেরাটোপে অস্থির হয়ে পড়ি, দমবন্ধ লাগে, শ্বাসনালীর জোর থাকলে মনে হয় এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবার চেষ্টাও করতাম, কিন্তু পারি না। অনেক কিছুর মতোই না পারার খাতায় এটাও লাল কালিতে যোগ করি। লিস্টের বৃদ্ধির সাথে সাথে মনের বেড়ে ওঠা ব্যাস্তানুপাতিক হয়! আমি তার অপেক্ষা করি, সবসময়।

ন্যাপথালিনের গন্ধ আমার তেমন ভালো লাগে না। ওষুধ ধরনের কোনও গন্ধই সহ্য হয় না তেমন। এজন্যেই পিছনে ফিরে তাকাতে ভালোবাসি না। স্মৃতিরা যে প্রায় সবই আষ্টেপৃষ্টে আবদ্ধ এই বিকট অসুস্থ গন্ধটার সাথে। তবু ফিরে তাকাতে হয়, অ্যালবামের পাতা উল্টিয়ে খুঁজে বের করতে হয় ঝরে পড়া প্রিয়জনগুলোকে। নিজেকে দেখে প্রায়ই হেসে উঠি, শণের মতো চুলগুলো দু'আঙ্গুলে পেঁচিয়ে আস্তে-ধীরে আলগা করি, পাছে যদি ঝরে যায় অনাদিকালের স্মৃতিগুলো নিয়ে। চুলের মাঝেও দেখি ন্যাপথালিনের গন্ধ! আমিও তো সেই পুরোনো হয়ে গেছি স্মৃতিগুলোর মতো, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিজেকে ধরে রেখেছি নিজের সাথে, প্রতিদিন ঝরে পড়া চামড়াগুলো হলুদ হয়ে যাওয়া নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলি আর আপনমনে হাসি!

মাঝে মাঝে মনে হয় সেইসব সময়গুলোতে ফিরে যেতে পারলে কতোই না ভালো হতো, যখন দোলনায় বসে মনে হতো - আমি না, জগৎটাই দুলছে আমার সাথে, যখন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পানীয় ছিলো মার বানানো রুহ আফজা, বাবাকে মনে হতো সবার চেয়ে শক্তিশালী পুরুষ, যখন মা-কে ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করা যেত না- সেই সব দিনগুলো কতোই না ভালো ছিলো! তখন নুন-ছাল ওঠা হাঁটুই ছিলো জগতের সব ব্যথার কারণ, ভাই-বোনগুলোর মতো শত্রু কেউই ছিলো না, একট খেলনা ভেঙে ফেলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো খুব, আর বাবা আদর করে কাঁধে নিলে সব ব্যথা ভুলে মনে হতো বিশ্বজয় করে ফেলেছি! কী আশ্চর্য সুন্দর সেইসব দিনগুলো!



কতো কথা মনে আসে কতো সূক্ষ্ণতর খুঁটিনাটিসহ, অবাক হই! মনের হলুদ বিবর্ণ পাতাগুলোর মাঝে সোনাবুবুর ঝিনুকের চুন দিয়ে পান খাবার দৃশ্যও যেমন আছে, তেমনি আছে বড়ো দুলাভাইয়ের খলবল শব্দের হাসির ছোটো-বড়ো শব্দ, বিন্যস্ত-অবিন্যস্ত গুচ্ছের আকারে! ছেলেবেলায় দেখা বায়োস্কোপের মতো ভেসে যায় কতো দৃশ্য, টুনিকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে মায়ের বেসুরো পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত শুনে বাবার দাঁত কিড়মিড়, ভুলু ভাইজানের হো হো হাসি, প্রথমবার শাড়ি পরে বাবাকে সালাম করার পরে বিস্মিত বাবার বলা, "আমার মায় দেখি বড় হয়ে গেসে! তোরে কি এহন বিয়া দেওন লাগবো?" লজ্জিত আমার ছুটে পাশের রুমের দরজার আড়ালে যাবার সময় কি একবারের জন্যেও মনে পড়ে নি মাসুম ভাইয়ের কথা? বাবার হাসিমুখের আড়ালে কি দেখি নাই গাঢ় বিষাদের হালকা বেগুনি ছায়া? গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসি। হাসি পায়! সে যেনো গত জন্মের ইতিহাস!

যেমটা হওয়া উচিৎ সেই দ্রুততাতেই বয়েস বাড়ে, সময় পোহায় অনেক। আমি যখন ঢাকায় বসে পাঙ্গাস মাছের গরম ঝোলে আঙুল ডুবাই, তখন দূর গ্রামে বিয়ে হওয়া পোয়াতি ছোটো বোনটা খিদের জ্বালায় পুকুরের শাপলা ফুলের ডাটা চিবায়, যদিও এসব খবর আমার কানে পৌঁছায় না। আমার নরম তুলতুলে বড়লোকী কান এসব দুঃখী-দুঃখী কথা সহ্য করতে পারে না! সন্তান প্রসবের সময় গ্রামের নোংরা দাই যখন আমার মায়ের পেটের বোনটার নাড়ি ছিঁড়ে ফেলে, তখন স্বামী-সোহাগে অচেতন আমি সুখ সাগরে ভুড়ভুড়ি কাটি। বোনের মৃত্যুতেও আমার হুঁশ ফেরে না। বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে না, আমি যে বড্ড বেশি ব্যস্ত আমার সুখের সংসারের তুচ্ছ কোণা সাজাতে! তখনও মনে পড়ে না এ আমার সেই বোন যার সাথে শ্বাসবায়ুর সাথে শ্বাসবায়ু মিশিয়ে দস্যু বনহুর পড়তাম, যার ফোকলা দাঁতের একটু হাসি দেখার জন্য আমসত্বের টুকরোটাও ফ্যালনা মনে হতো। আজ যখন বোনের কথা মনে পড়ে চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা নোনা পানির আভাস জোটে, তখন অবাক হয়ে ভাবি, এখনও মানুষ আছি?

ওরা রুমার বাবাকে আমার সামনে দিয়ে নিয়ে গেলো, তখনও বুঝি নি এটাই শেষ দেখা। মানুষটাকে হাসিমুখে বিদায় দিতেও পারি নি, যাকে জীবনে কখনও ভালোবাসতে পারবো না বলে মনে হয়েছিলো, সে যাবার পরে শূন্যতা কাকে বলে বুঝেছি, চিরটা কাল বাজারের পচা মাছটা আনার জন্যে যাকে বকেছি তার কথা মনে করে কানকো নড়ে ওঠা মাছ দেখলেও কিনতে ইচ্ছা করে নি পরে! এরকমটা তো হবার কথা ছিলো না। রুমা কতোবার করে বলেছিলো ওর কাছে চলে যাবার জন্যে, ইচ্ছে করে নি। মেয়ের সংসারে বাড়তি ঝামেলা হবার মানসিকতা ছিলো না আমার। আস্তে আস্তে সাধারণ কথাবার্তাও ভুলতে শুরু করলাম, হাজার দিনের স্মৃতির ভারে বেকুব মনটা আমার দিনকালের হিসেবটাও গুলিয়ে দিলো। যেখানে বছর তিরিশ আগের এক মেঘলা দুপুরে খিচুড়িতে লবণ কম দেবার কথা মনে পড়ে, সেখানে আমি ভুলে যাই আমার ভাত খাওয়া হয় নি! শেষমেশ ওরা আমাকে নিয়ে আসে এই বৃদ্ধাশ্রমে।

চঞ্চল আমার যেখানে মুহূর্তও বসে থাকতে ভালো লাগতো না, সেই আমি আজকাল ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে আকাশের বদলে যাওয়া দেখি। জানেন, আকাশ কখনও পুরোনো হয় না! কী অদ্ভুত আকাশের রঙ পাল্টানো, আর মেঘেরা, মেঘেরা আমাকে অবসর দেয়না এক পলকের জন্যেও। এ বলে আমায় দেখো আর ও বলে আমায়! মাঝে মাঝে বাগানে বসে গাছের সাথে কথা বলি, গাছেরাও খুব বন্ধু এখন আমার! ছোট্ট শামুকের ভিতরের পোকাটার নিরলস টুক-টুক-টুক-টুক করে হেঁটে যাওয়া দেখতেও খারাপ লাগে না। মাঝে মাঝে গাছে পানি দেয়া বাদ দিয়ে গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে ওদের দেখি! মা এখন আমাকে দেখলে খুশি হতেন! তার গেছো মেয়ে এখন কতো শান্ত! বহমান নদী থেকে বয়েস তাকে পরিণত করেছে টলটলে এক দিঘিতে! ঠান্ডা, নিস্তব্ধ!

ছেলেবেলায় বেশী কথা বলার জন্যে কম বকা খাইনি। আর আজকাল সারাদিনে হয়তো দুটোর বেশী কথা বলাই হয়না! অশান্ত মনের মাঝে কতো কথার ভুড়ভুড়ি ওঠে, প্রকাশভঙ্গী খুঁজে পাইনা! নিঃস্তব্ধতা বাড়ছে, কিছুদিনের মাঝে হয়তোবা সে আসবে আর পুরোপুরিই নিঃস্তব্ধ হয়ে যাবো!

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১০ দুপুর ১২:২৮
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×