দার-রাই তার নিজের ঘরে বসে ধ্যানমগ্ন, ঠিক যেমনটি সে করে আসছে গত কয়েক শতবছর, প্রত্যেকটা দিনই।
দরোজার বাইরে সে একটি মানসিক তরঙ্গ সঞ্চালন অনুভব পারল, যেটাকে অনেকটা দরোজায় নক করার মত বলা যায়। কেউ একজন তার ঘরে আসার অনুমতি চাইছে। সে দরোজার দিকে একটা মানসিক তরঙ্গ পাঠায়, দরোজা আস্তে করে খুলে যায়।
“ভেতরে এস, বন্ধু আমার।” শান্তভাবে বলে সে। এই আহ্বানটা সে টেলিপ্যাথিক্যালিও জানাতে পারতো। তবে যখন মাত্র দুজন একসাথে কথা বলে, তখন মুখে কথা বলাই ভদ্রতা।
ইজন-খী ভেতরে প্রবেশ করে, “আজ আপনি দেখছি ঘুমাতে যেতে দেরি করছেন, লীডার।”
“হ্যা খী, তবে তার কারনও আছে। আর মাত্র এক ঘন্টার মাঝে পৃথিবী থেকে একটা রকেট ল্যান্ড করার কথা মঙ্গলে। আমি সেটার ল্যান্ড করা দেখতে চাই।" একটু হাসে সে।
"হ্যা, আমি জানি সেটা এখান থেকে এক হাজার মাইল উত্তরে নামবে যদি তাদের হিসাব নিকাশ সঠিক হয়। তার উপরে সেটা আবার আমাদের দিগন্ত রেখার কারনে আমাদের দৃষ্টিসীমায় থাকবে না। কিন্তু এটা যদি তার দ্বিগুন দুরত্বেও নামে, তারপরেও সেই রকেট এ থাকা পারমানবিক বিস্ফোরণ এখান থেকে দেখা যাবে।”
একটু থেমে খী এর দিকে গভীর দৃষ্টি দেয় রাই, “আমি এই প্রথম যোগাযোগ এরজন্য অনেকদিন থেকে অপেক্ষা করছি। যদিও কোন পৃথিবীর মানুষ তাতে থাকবে না, তারপরেও এটা তাদের বিচারে হবে প্রথম যোগাযোগ। যদিও আমাদের টেলিপ্যাথিক পর্যবেক্ষন দল গত অনেক শতাব্দী থেকেই তাদের চিন্তা ভাবনার দিকে নজর রাখছে, তারপরেও মঙ্গল আর পৃথিবীর মাঝে বাস্তব যোগাযোগ হবে এটাই প্রথম।”
খী ঘরের একটা নিচু চেয়ারে আরামদায়কভাবে বসে একটু নড়েচড়ে। “এটা সত্যি কথা, কিন্তু আমি তাদের বিষয়ে গত বেশ কিছুদিন এর রিপোর্ট পড়ার সময় পাইনি। কেন তারা আমাদের গ্রহে পারমানবিক বিষ্ফোরণ ঘটাচ্ছে? আমি জানি তারা ভাবে আমাদের এই লাল গ্রহটা প্রানশুন্য, কিন্তু তারপরেও এটার কোন যুক্তি হয়না।”
“তারা তাদের লুনার টেলিস্কোপ দিয়ে দেখবে এই পারমানবিক বিষ্ফোরণের ফ্ল্যাশ, তারপরে সেটা নিয়ে করবে-- হ্যা, স্পেকট্রোগ্রাফি এনলাইসিস। তাতে নাকি তারা জানতে পারবে কি আছে আমাদের এই গ্রহের বাতাসে, আমাদের মাটি কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি। এতে করে তাদের আমাদের গ্রহ সম্পর্কে জ্ঞান আরও বাড়বে, যদিও যতটুকু তারা জানে তার বেশিরভাগই ভুল।” একটু হাসে দার-রাই।
“এটাকে তারা বলে সাইটিং শট। এর পরের কয়েকবার চেষ্টাতেই তারা সশরীরে চলে আসবে এখানে আর তখনই--” শান্তভাবে স্মিত হাসে দার রাই।
মঙ্গল অপেক্ষা করে আছে পৃথিবীর জন্য। অনেক অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। অপেক্ষা করে আছে মঙ্গল এর অধিবাসীরা, অন্তত তাদের যতজন টিকে আছে এখন পর্যন্ত। একটা ছোট্ট শহরে নয়শ’ত মঙ্গলবাসী নিয়ে তাদের পুরো নি:শেষপ্রায় জাতি। মঙ্গল সভ্যতা পৃথিবীর থেকে অনেক বেশি পুরনো, কিন্তু তারা এখন ধ্বংস হয়ে যাবার পথে। শেষ হতে হতে তারা এখন মাত্র একটা শহরে নয়শত অধিবাসীর এক সভ্যতায় এসে ঠেকেছে।
এখন তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পৃথিবীবাসীদের জন্য, তারা কবে এখানে আসবে। অপেক্ষা করছে একটা নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধার এর জন্য, আবার আরেকটা নিঃস্বার্থ কারনেও বটে।
মঙ্গলীয় সভ্যতা পৃথিবীর থেকে একটু ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। তারা প্রযুক্তি বা পদার্থ বিজ্ঞান এ তেমনটা অগ্রসরতা লাভ করতে পারেনি, কিন্তু উন্নয়ন লাভ করেছে সামাজিক ও মনোবৈজ্ঞানিক দিকে। এ দুটি ক্ষেত্রে তারা এতটাই উন্নতি লাভ করেছে যে তদের সমাজে কোন অপরাধ নেই, এমনকি কোন যুদ্ধও সংগঠিত হয়নি গত পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে। আবার তারা অতিন্দ্রীয় মনোবিজ্ঞানে যে পরিমানে দক্ষতা অর্জন করেছে, পৃথিবীর মানুষ তার কেবলমাত্র সামান্য একটু অংশই আবিস্কার করতে পেরেছ কিংবা কাজে লাগাতে পেরেছে।
মঙ্গল এর সভ্যতা মানুষকে শেখাতে পারে কিভাবে অপরাধ শুরু হবার আগেই তার কারন কে অপসারণ করতে হবে, কিভাবে এমন সমাজ গড়তে হবে যেখানে কোন সমস্যা থাকবে না, দারিদ্রতা থাকবে না, মানুষ বসবাস করতে পারবে স্বর্গ সুখে। এর পাশাপাশি তারা মানুষকে শেখাতে পারবে উন্নত টেলিপ্যাথি, টেলিকাইনেসিস, এমপ্যাথি.. আরও কতকিছু!
এর বদলে মঙ্গল আশা করে যে, পৃথিবী তাদের সাহায্য করবে এমনকিছু শিখতে যা মঙ্গল এর জন্য অনেক বেশি দামী। তারা শেখাতে পারবে প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান- যেটা ব্যবহার করে তারা হয়ত মঙ্গলকে আবার বসবাস উপযোগী করে তুলতে পারবে।
এমন নয় যে তারা এটা নিজেরা করতে পারতো না, কিন্তু মঙ্গল এখন চরমভাবে বসবাস অনুপযোগী, সেখানে না আছে কোন উল্লেখযোগ্য পরিমানে ব্যবহারযোগ্য খনিজ-সম্পদ, না আছে সেই পরিমানে মঙ্গলীয়প্রান ধারন করার ক্ষমতা, তাই তাদের সংখ্যা কমতে কমতে এসে দাড়িয়েছে মাত্র নয়’শ তে। এই অবস্থায় তদের পৃথিবীর মানুষদের সাহায্য কামনা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মানুষরা সাহায্য করলে তারা আবার মঙ্গলকে বসবাস উপযোগী করতে পারবে, আবার মঙ্গলে তারা একটা বড় সভ্যতা হিসেবে বিস্তার লাভ করতে পারবে।
এভাবে দুটি গ্রহই একে অপরের দ্বারা লাভবান হবে, ক্ষতিগ্রস্থ হবে না কেউই।
আজই হল সেই রাত, যখন পৃথিবী মঙ্গলে তাদের প্রথম আগমন করতে যাচ্ছে। প্রথম বারে হবে একটা সাইটিং শট, পারমানবিক বোমার সাহায্যে। এর পরের স্রোতেই আসবে মানুষ. সাইটিং শটের চার মঙ্গল বছর পরেই।
এটা তারা জানে, কারন তাদের পর্যবেক্ষন দল অনেক অনেক দিন থেকেই পৃথিবীর মানুষদের মানসিকতার দিকে নজর রাখছে। এই যোগাযোগের একমুখীতার কারন হল দুরত্ব। আর এই দুরত্বের কারনেই তারা কেবল মানুষের চিন্তা পড়তেই জানে, তাদের কোনকিছু জানাতে পারে না। মানুষদের মন অনেকখানি আবদ্ধ, তারা এত সুক্ষ্ন আর দুরত্বের কারনে দুর্বল মানসিক তরঙ্গ ধরতে পারে না। তাই তারা মানুষদের জানাতে পারেনি নিজেদের অস্তিত্বের কথা, জানাতে পারেনি কি দিয়ে তৈরি মঙ্গল এর মাটি আর আবহাওয়া। জানাতে পারলে পৃথিবীর মানুষদের প্রথম সাইটিং শট এর দরকার হত না, অনেক আগেই তারা হয়ত চলে আসতে পারতো মঙ্গলে।
তাই আজ রাতে, দার-রাই, মঙ্গলীয় নেতা, এবং তার বন্ধু ও প্রশাসনিক সহকারী খী একাগ্র চিত্তে ধ্যান করছে, অপেক্ষা করছে কখন আসবে পৃথিবী থেকে পাঠানো প্রথম রকেটটি।
তারা এই অবতরণের শুভকামনায় পান করে পানীয়, যেটা মেথানল দিয়ে তৈরি, অনেকটা পৃথিবীর এলকোহল এর মতই কাজ করে মঙ্গলীয়দের উপরে। এরপরে তারা উঠে যায় তাদের বাসস্থান এর ছাদে, আকাশে তারারা ঝকমকাতে থাকে, তারা দুজনে অপেক্ষা করে তাকিয়ে, যেকোন মুহুর্তে নামবে রকেটটি এক হাজার মাইল উত্তরে, একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
************** *********
পৃথিবীর পৃষ্ঠে অবজারভেটরি নাম্বার এক এ বসে গভীর মনোযোগে মঙ্গল এর দিকে তাকিয়ে একজন মানুষ, রগ এভেরেট। তার চোখ একটা শক্তিশালী মহাকাশ দুরবীনে।
“আহা! ঐতো, দেখা গেছে ফ্ল্যাশ। এখন ছবিগুলো ঠিকভাবে পর্যবেক্ষন করলেই জানা যাবে অনেককিছু।” সে সোজা হযে দাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গে সে, তার মিশন সফল হয়েছে, কয়েক বছর এর খাটনি আজ সফল হয়েছে। রগ এভেরেস্ট এবং উইলিয়াম ওয়াগনার এখন ইতিহাসের পাতায় একজন নামী বৈজ্ঞানিক হিসেবে স্থান পাবে, যারা মঙ্গলে প্রথম রকেট অবতরণ করিয়েছিল!
“আশা করি এই পারমানবিক বোমা কাউকে মেরে ফেলেনি” মজা করে বলে উইলিয়াম, সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, মঙ্গলে কোন প্রান এর চিহ্ন নেই।
“যাই হোক রগ, রকেটটা কি সাইরস মেজর ক্রেটারে হিট করেছে?
“প্রায় কাছাকাছি, আমার ধারনা এটা প্রায় হাজার মাইল দক্ষিনে পড়েছে। যথেষ্ট নিখুত লক্ষভেদ বলা যায়, বিশেষ করে যেখানে রকেটাটা ছোড়া হয়েছে পাচকোটি মাইল দুর থেকে। সে হিসেবে এর থেকে নিখুত শট আশাই করা যায় না।”
“উইলিয়াম, তুমি কি বিশ্বাস কর, সেখানে কোন বুদ্ধিমান প্রানী আছে, আছে মঙ্গলীয় সভ্যতা, যেমনটা শোনা যায় গল্প কথায়?”
এক মুহুর্ত চিন্তা করে উইরিয়াম, তারপরে বলে, “নাহ।”
উইলিয়াম এর কথাটি সেই সময়ের সাপেক্ষে সত্যি ছিল, আসলেই মঙ্গলে আর কোন প্রান বেচে ছিল না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৩