কিরণ দেবীর স্বামী দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ, হসপিটাল বাড়ি এসব করেই চলছে । ছেলে আসার সময় সেই কখন পেরিয়ে গেছে এখনও আসেনি সেই কখন থেকে পথ চেয়ে বসে আছেন , হয়ত কোনও কাজে আটকে গেছে , ইদানীং ছেলে ঠিক সময়ে আর আসেনা, কিছু জিজ্ঞেস করলেই রেগে যায় । কাজের চাপ , বাবার অসুখ এসব বিভিন্ন ঝামেলার কারনে ছেলের মন মেজাজ ঠিক নাই থাকতে পারে , এই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তিনি বাইরে ফুটপাতের পাশে টিফিনের দোকানে চলে এলেন, ইদানীং এই টিফিনের দোকানই স্বামী-স্ত্রীর একমাত্র ভরসা ।
আজ তিনি লক্ষ্য করলেন দোকানের পাশেই ফুটপাতে এক অশীতিপর বৃদ্ধ গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে আর মাঝেমাঝে ভয়ানক ভাবে কাশছে , প্রথমবার দেখে পাগল মনে হয়েছিল একটু ভালো করে দেখে বুঝলেন পাগল না রোগী , একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
>> “ মেসো আপনের কি হইসে ?? কিছু খাইবেন ??”
বলে নিজের হাতের রুটির টুকরো এগিয়ে দিলেন । কিন্তু বৃদ্ধ মাথা নেড়ে না করে দিলেন ।
কিরণ দেবী দোকানদার কে জিজ্ঞেস করলেন উনিকে , দোকানদার যা তা শুনে কিরণ দেবীর মুখ থেকে একটি আওয়াজ বেরোয়নি ,
>> “ আর কইয়েননা বুড়ার মরনের টাইম হইসে এইখানে আইয়া জুটসে , আজ সকালে বেডার পোলা রিক্সা দিয়া নিয়া আইয়া বেডারে এইখানে ফালাইয়া গেসে আর আইসেনা , বেডার ও জানি কিতা হইসে খালি রক্তবমি করে , হসপিটালের বেড ভরাইয়া রাকসে না , হাইগ্যা মুইত্ত্যা যাচ্ছেতা অবস্থা ।লগে কোনও লোকনাই তাই হাসপাতালের লোকেরা বেডারে বাইরে রাইখ্যা গেসে ।তখনতে এইখানেই পইরা আসে ।”
কিরণ দেবী আর সেখানে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখতে পারেননি সেখান থেকে চলে আসেন ।একটা কথাটাই বার বার তার মাথায় ঘুরছে , তার ও তার স্বামীর শেষ অবস্থাটাও এমন হবে নাতো !!!!
এদিকে বয়স্ক লোকটা ক্রমাগত কেশেই চলছে , শ্বাস কেমন আটকে আসছে । মাথায় শুধু একটা দৃশ্যই ঘুরপাক খাচ্ছে ; তার ছেলে রিক্সা করে চলে যাচ্ছে ,কিন্তু বৃদ্ধ বাপটার দিকে একবারের জন্যও ফিরে তাকালো না । এই ছেলেকেই কোলেপিঠে করে মানুষ করলেন, বিয়ে দিলেন কোনওদিন ছেলের কোনও আবদার রাখেননি এমন হয়নি । নিজে না খেয়ে হলেও ছেলে যা চেয়েছে তাই দিয়েছেন, অথচ আজ তাকে এভাবে একা ফেলে রেখে চলে গেলো! শেষ বারের মতোও বাবা বলে ডাকল না, কিছু না বলেই চলে গেল ।
মাথাটা অবশ হয়ে আসছে, চারদিক কেমন ঘোলা ঘোলা লাগছে । ওইতো রিকশায় করে তার ছেলে যাচ্ছে না ? চেহারাটা কেমন আবছা লাগছে , তার ছেলেই তো তার বুকের ধন , মানিক । নাহ বুঝা যাচ্ছে না । কানের পাশে কেমন একটা রি রি আওয়াজ হচ্ছে ।
>>বাবা !!!!!!
কচিগলায় বাবা ডাকটা শুনে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো , পাশ দিয়েই একটা ছোট্ট ছেলে তার বাবার হাত ধরে হেঁটেহেঁটে যাচ্ছে , তাদের কে একটু দেখার জন্য মাথাটা একটু উঠাতে গিয়েও পারলেন না । তারপর হটাত সব কোলাহল শান্ত হয়ে গেল ।
ওইদিন বিকালে অনেকেই এসেছিলো প্রচুর প্রেস, মিডিয়া , লোকজন শুধু একজনই আসেনি , দরকারই বা কি আপদ বিদেয় হল । বডিটার মুখ দিয়ে তখনও রক্ত সহ ফেনা বের হচ্ছিলো , আর চোখ দুটো ছিল আধখোলা অবস্থায় , ছেলেকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য শেষ প্রচেষ্টা ।