somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইনভিজিলেশন এবং আমার কিছু ভাবনা

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই পেশায় খাতা দেখার পর সবচেয়ে অপ্রিয় কাজ হচ্ছে পরীক্ষার সময়ে ইনভিজিলেশনে থাকা। ঘণ্টা তিনেক পরীক্ষার হলে পরীক্ষা না দিয়ে দাঁড়িয়ে বসে থাকার মত বিরক্তিকর কাজ আর হয় না। সব পেশারই কিছু ধূসর দিক আছে। হয়তো শিক্ষকতার ধূসর দিক এটা।

যাই হোক!!! বিশ্বস্ত সূত্র থেকে খবর পাওয়া যে আমি খুবই একজন অজনপ্রিয় মানুষ পরীক্ষার হলে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে। আমি বুঝতে পারি এরা আমাকে তাঁদের হলে দেখলে খুবই কষ্ট পায়। গালিও দেয় নিশ্চয়ই। দুই তিনটা পরীক্ষার হল রুম পাশাপাশি থাকলে এরা দোয়া করে আমি যেন তাঁদের হলে না ঢুকি। আমি তাঁদের চোখের তারায় ১ বলে ছয় রানের প্রয়োজনের মত আর্তি দেখি। প্লিজ স্যার যেন আজকে আমার হলে না পড়ে। প্লিজ প্লিজ। ছাত্র অবস্থায় আমিও বিভিন্ন শিক্ষক শিক্ষিকাকে বিভিন্ন কারণে অপছন্দ করতাম। কিন্তু আমার ছাত্র-ছাত্রীদের আমি খুবই পছন্দ করি। এটা হয়তো তাঁরা বিশ্বাস করবে না। চেহারা প্রকৃতিগতভাবেই গম্ভীর থাকার কারণে তাঁরা আমাকে হয়তো ভয়ই পায়। তাই কষ্টই হয় যখন শুনি এরা আমাকে গালি-গালাজ করে। ছাত্র অবস্থায় আমিও যে একেবারে ধোঁয়া তুলসী পাতা ছিলাম না, এটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!!! আমি কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। ভালো ছাত্রদের মত শিক্ষকদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সামনের সিটে বসতাম না। ক্লাসের বাইরে শিক্ষকদের সাথে সামাজিকতা রক্ষা করতাম না। এবং পরীক্ষার হলে শেষ রাতের প্রস্তুতিতে না কুলিয়ে উঠলে আশপাশ থেকে সাহায্যের আশায় বসে থাকতাম। নিতাম এবং দিতামও। এখন আমার ছাত্র-ছাত্রীরা হয়তো পেয়ে বসবে যে তাহলে আমাদের সাথে এরকম করেন কেন। আসলে টেবিলের এপাশ আর ওপাশ দুটোই বড় অদ্ভুত স্থান। বোঝানো যায় না। তারপরো পরীক্ষার হলে হাল্কা এদিক ওদিক তাকানো, দুই একটা ভুলে যাওয়া পয়েন্ট জিজ্ঞেস করাকে আমি অতিরিক্ত দোষের মনে করি না। কিন্তু এই ঘটনা টানা ঘটতে থাকলে তা আমার ব্যক্তিত্বে আঘাত করে। দায়িত্ব বলেও একটা কথা আছে!!! কি আর করা!!!

কিন্তু পরীক্ষার হলে আমি কখনোই মানতে পারি না নকল করা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা বলা যদি আমার ব্যক্তিত্বে আঘাত করে থাকে। তবে নকল করা আমাকে যেন শারীরিকভাবে আঘাত করে, অপমান করে। আমার মনে হয় যেন এই পেশার এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর হতে পারে না। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমার পড়ানো বোঝে না। মানতে পারব। কিন্তু ভুল ঠিকের সংজ্ঞাও শেখাতে পারিনি। এই ব্যর্থতা মানতে পারব না। সত্যিই পারব না।

সাম্প্রতিককালে, আমার চরম দুর্ভাগ্য হয়েছে এরকম নকল করতে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের হাতেনাতে ধরার। ছাত্র এবং ছাত্রী উভয়ই ছিল। আশংকাজনক হারে ছাত্রী বেশী ছিল। নারীবাদের এই যুগে নারীদের নিয়ে কথা বলা মুশকিল। কিন্তু এটা সত্যিই যে আমাদের সমাজ নারীদের সতী হিসেবেই দেখতে চায়। তাই আমরা যারা ইনভিজিলেশনে থাকি তাঁরা কখনোই নারীদের নকলবাজ হিসেবে দেখি না। এঁদের আমরা খুব সৎ মনে করি। নারীবাদিরা বলে বসতে পারেন, কেন!!! শুধু পুরুষরাই অসৎ হতে পারবেন!! আমাদের নারীদের অসৎ হওয়ার অধিকার নেই!!! ঐ তর্কে যেতে চাই না। যেহেতু সমাজ পুরুষবাদি। সেহেতু আমিও মনে হয় পুরুষবাদি। এই ব্যর্থতাও আমার।

যাই হোক!!! অন্যায়-অপরাধ বহু মানুষ জীবনে ক্ষেত্র বিশেষে করে। সে মোতাবেক অনুশোচনাও থাকবে বলে আশা করা হয়। আমরা চাইলেও জীবনে সব ঠিক পথে চলতে পারব না। কিন্তু এখন আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, ছাত্র-ছাত্রীরা নকল করা, হাতেনাতে ধরা পড়া। এসব কোন কিছুতেই তেমন লজ্জা বোধ করে না। আমার নকল করতে থাকা ছাত্রীরা পরীক্ষার হলের অন্য এক ছাত্রের উপর চড়াও হয় এই কারণে যে তাঁদের ধারণা সেই ছাত্র আমাকে তাঁদের ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। কি রকম যেন ভাষাহারাও হই। এখনো হচ্ছি। পরীক্ষার হলে সবার সামনে নকল করতে গিয়ে ধরা পড়ল। এতেই ওঁদের কি লজ্জা হওয়া উচিৎ না!!! একটা অন্যায় করতে গিয়ে ধরা পড়ল। এতেও কি অনুশোচনা আসা উচিৎ না!!! উল্টো তাঁদের রাগ কেন তাঁরা ধরা পড়ল। কে তাঁদের ধরা পড়ার জন্য দায়ী তাঁর উপর তাঁদের ক্ষোভ!!! তাহলে আমরা কাদের পড়াচ্ছি। পড়া শেষে এরা যখন কর্ম জীবনে নামবে, তখন আমরা এঁদের কাছ থেকে কি পাব!! ন্যায়-অন্যায়ের কোন পার্থক্য কি এদের মাঝে থাকবে!!! এরা ঘুষ খাবে। নিজের বাবা-মা-ভাই-বোন সবার সাথে এদের স্বার্থের সম্পর্ক থাকবে। এরা সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করবে। শুধু লাভ যেখানে যেভাবে। ভুল ঠিক। ন্যায় অন্যায়। কোন কিছুর সংজ্ঞা এদের অভিধানে থাকবে না। পরে আরো শুনলাম যে আমার এক নম্র সহকর্মীকে এক নকল করতে গিয়ে ধরা পড়া ছাত্রী কৈফিয়ত হিসেবে বলেছে, “স্যার, আমি তো নকল সাথে আনসি। করি তো নাই।“ শুনে আমি আবারো বাক্যহারা হলাম।

পরে আমার মনে হল। আমি কি ওঁদের উপর খুব বেশী চড়াও হচ্ছি মনে মনে। আমাদের চারপাশই কি অন্যায়ে ভরা না!!! ক্লাস ওয়ানে পড়া বাচ্চাকে ৭ লাখ টাকা দিয়ে ভিকারুন্নিসা স্কুলে ভর্তি করানো হচ্ছে। ঐ বাচ্চা যদি ভবিষ্যতে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় টাকা দিয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন বের করে নেয়। তাহলে কার দোষ!!! সে কি আগে থেকেই বাবা-মা কর্তৃক এই দীক্ষায় দীক্ষিত না!! পাগল ছাগলের মত মুখস্থ করে কোন আদর্শ ছাড়া সরকারী আমলা হতে চায় এদেশের অধিকাংশ যুব সম্প্রদায়। কারণ সরকারী চাকরিতে স্বেচ্ছাচারিতা এবং উপরি আছে। ঘুষ দিয়ে পুলিশের সার্জেন্ট, সাব-ইন্সপেক্টর হতে চায়। কাস্টমস এ চাকরি চায়। যত ঘুষ দিয়ে ঢুকবেন তাঁর শত গুণ ঘুষ আপনি পরে পাবেন। এমনকি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে আপনাকে অনেক বড় রকমের ধামাধরা হতে হবে। তবেই মিলবে সুযোগ। এরাই আমাদের সামাজিক হিরো। এদের আমরা ভূয়সী প্রশংসা করি। বাচ্চাদের সামনে। সবার সামনে।

তাহলে আর কেনই বা আমার এই মিছে কষ্ট পাওয়া। যেখানে ফলাফলই মুখ্য। তা যেভাবেই আসুক না কেন!!! ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। ওটা বোকাদের অভিধানে থাকে।

সব শেষে একটা কথাই বলতে হয়। বাবা-মা হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। বাবা-মায়েরাই সন্তানের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। বাবা-মায়ের প্রত্যেকটা কথা, কাজ, বিচার সবকিছু সন্তানের অবচেতন মনে গভীর প্রভাব ফেলে। ঐ দিন দেখি, রেল ক্রসিং-এ ট্রেন আসবে বলে আটকে দেয়া রাস্তায় এক মোটর সাইকেল আরোহী ব্যারিকেড উঠিয়ে ট্রেন আসার আগেই কেটে পড়ল। সামনে দেখলাম তাঁর ছোট বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। কি শিখল বাচ্চাটা। একটু নিয়ম ভাঙলেই আগে আগে কেটে পড়া যায়।

তাই আমি চুপ করে থাকাই শ্রেয় ভাবি। অনেক কিছুর উত্তর যে পাই না। প্রশ্ন পাই। উত্তর না। ন্যায়-নীতি মেনে চললে কি লাভ? এর কি উত্তর হয়!! কেউ জানেন!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:০৮
৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×