লিখেছেন- জব্বার আল নাঈম
আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাইরে.../ ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় .../ নদীর কূল নাই কিনার নাইরে...আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাবো.../ প্রাণ সখিরে আমার হাড় কালা করলামরে .../ আমায় এতো রাতে কেন ডাকি দিলি... এই রকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা পল্লীকবি জসীম উদদীন। লোকজ এবং মাটির গানগুলোকে তুলে দিয়েছেন শহুরে মানুষের মুখে মুখে। আধুনিক গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান এবং উর্দুসহ অসংখ্য গান লিখে বাংলা গানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল। জসীম উদদীনের হিরন্ময় গানের ছোয়ায় আব্বাসউদ্দিন হয়ে উঠেন সহজাত শিল্পী। তবে পল্লীগীতিতে তার মৌলিকতা এবং সাফল্য উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এই কবি আপন প্রতিভাবলে নিজেকে অত্যন্ত সফলভাবে গুরুত্বপূর্র্ণ করে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীতে। লালন সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত কিংবা নজরুল সঙ্গীত আমাদের গানের ভান্ডারে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মাত্রার ভিন্নতায় যোগ দিয়ে হাছন রাজা, শাহ আবদুল করীম, রমেশ শীল গানের জগতকে ভরিয়ে দিয়েছেন মুগ্ধতায়। কিন্তু একজন জসীম উদদীন জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মারফতি গানে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে মোহিত করেছেন। কিন্তু জসীম উদদীনের কালজয়ী এসব গানগুলো কেন জানি অনাদর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার কালজয়ী অসংখ্য গানের মধ্যে “প্রাণ সখিরে ওই শোন কদম তলায় বংশী বাজায় কে”... আমাদের চেতনার বাড়িতে বারবার দরজা নাড়ে। সভ্য সুন্দরে অতি যত্নে গড়া গানগুলো এখনো আমাদের বিবেককে জাগায় এবং ভাবায়। “কেমন তোমার পিতা মাতা কেমন তাদের হিয়া” পারিবারিক শিকলে বন্দী হয়ে ব্যর্থ মনে প্রেমিক এখনো অজান্তে গেয়ে উঠে জসীম উদদীনের ভূবন ভুলানো এইসব জনপ্রিয় গান। পাইরেসি এবং নকল গানের আড়ালে ঐতিহ্য বহন করা গানগুলো যত্নের অভাবে হরিয়ে যেতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হারিয়ে যেতে পারে “ছলছল কলকল নদী করে টলমল.../ ও বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে... কিংবা কি বলবি সোনার চাঁদ... অথবা তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে.../ নিশিতে যাইও ফুল বনে গো ভোমরা, নিশিতে যাইও ফুল বনে.. আবার রঙ্গিলা রঙ্গিলারে” মতো জনপ্রিয় গান। এই রকম অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের স্রষ্টা পল্লীবাংলার সুখদুঃখের কবি জসীম উদদীন।
আবার ইসলামি কিংবা আধ্যাত্মিক গানেও জসীম উদদীন সমান দক্ষতায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন। “আমার সোনার ময়না পাখি, কোন দেশেতে গেলি.../ রসূল নামে.../ যোগী ভিক্ষা ধরো../ কি বলিব সোনার চাঁদ.../ আগে জানিনারে দয়াল তোর পিরিতে”...
কবি জসীম উদদীনের বাংলা গান এখনো মনের অজান্তে গুনগুন করে ছেলে- বুড়োরা গেয়ে উঠে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অন্যান্য সঙ্গীতের মতো তার গানগুলোকে জসীম উদদীন সঙ্গীত বলে খুব কম পাই। এর জন্য রাষ্ট্র, পরিবার এবং আমাদের ব্যর্থতা কোন অংশে কম নয়। তার চির সবুজ এবং ভূবন ভুলানো গানগুলো আজীবন শ্রোতার মানে দাগ কেটে যাবে।
জসীম উদদীনকে শুধুমাত্র চেনা যায় সবুজ গাঁয়ের মেঠো কাঁচা পথে ধূলা উড়া মেঘে রাখাল ছেলে বারেকের আড্ডায়? না, তাকে পাওয়া যায় গাঁয়ের
‘চাষার ছেলে’র বর্ণনা ও বন্দনায়-
এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!
বিরহে ক্লান্ত কাতর জসীম উদদীন অনাথ নাতিকে একমাত্র অবলম্বন ভেবে কবরের কাছে শোকের মাতমে বর্ণনা করেন‘
এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম-গাছের তলে
ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ
পুতুলের বিয়ে ভেঙ্গে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক ...
শিশুর মতোই শিশুকে চমৎকার ভাবে আবেদন করেছেন তার কবিতায়-
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা - ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মারা গলায় দিয়ে - মামার বাড়ি যাই
প্রকৃতঅর্থে এসব কেবল পল্লীরাজা জসীম উদদীনের পক্ষেই সম্ভব। এই হলো অমর কালজয়ী সাহিত্যিক পল্লী বাংলার পল্লীকবি জসীম উদদীন (১৯০৩-১৯৭৬)। ১৪ ই মার্চ পল্লীসম্রাট চিরদিনের জন্য ডালিম তলে ঘুমোতে চলে যান। যিনি রচনা করে গেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতা-ছড়া-জারি-সারি ও পল্লীগীতি গান। ১৯০৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানায় পল্লীকবি খ্যাত জসীম উদদীন জন্মলাভ করেন। পল্লীকবিকে শুধুমাত্র পল্লীকবি হিসেবে গন্য করলে তা হবে সাহিত্যের চরম সংকীর্ণতার পরিচয়। তার কাব্য ভাব, ভাষা, চিন্তা, যুক্তি, শিল্পমানের গভীরতা, ভাষা ও কাহিনীর বুনন, কাব্য চয়ন, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক এবং প্রতীক বিনির্মাণে সত্যিকারের শেষ প্রতিনিধি। গ্রামীণ জীবন তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিতো এ কথা আজো সত্য। কিন্তু বিস্ময়করভাবে শব্দচয়নে তিনি সর্বোচ্চ আধুনিকতাকেই টেনে ধরেছেন। অর্থাৎ গ্রাম্য শব্দ কিংবা আঞ্চলিকতা ছিলো না বলাই যায়। যা ছিলো সত্যিকার অর্থে অনেক কঠিন। আর জসীম উদদীন সেই কঠিনকে নিয়েছেন নিমগ্ন সাধনা হিসেবে। রবীন্দ্র-নজরুল-কল্লোল-তিরিশোত্তর যুগের উজ্জল আলো-সাম্পাতে বংঙ্গীয় সাহিত্যে যখন সমৃদ্ধ, গ্রাম-বাংলায় ধূলোর রাস্তায় রোদ-বৃষ্টির মাঝে বিনি সূতোর মালা নিয়ে চেনা পরিবেশ আওড়িয়ে স্বতন্ত্র প্রতিভার সিগ্ধ আলো হাতে বাংলা কাব্যে এবং গানে এই মহান শৈল্পিককবির আবির্ভাব।
ময়মনসিংহ গীতি বা পুঁথিকাব্যর আহ্বায়ক প্রখ্যাত পন্ডিত ড. দীনেশ চন্দ সেন জসীম উদদীনের গানের প্রেক্ষাপটে বলেন, জসীম উদদীন যেমন খাটি কবি তেমনি করে সাধনায় ব্রত হয়ে গানকে করে তুলেছেন মানুষের মুখের ভাষা। এসবের মূল কারণ হলো ষোল আনাই পল্লী নিবেদিত প্রাণের মানুষ। তার সময়ের সকল শ্রেষ্ঠ মানুষদের বাইরে গিয়ে শুধু কবিতাই চর্চা করেন না। গানকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। আবহমান বাংলার লোকজ-সাংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারন করে শুদ্ধ পরিস্নাত এক স্বাতন্ত্রধিকারী ভাস্বরে ভাস্বরে যে কবি ধান-গম-কাউন-ভুট্টা দিয়ে ক্রমানয়ে পর্বত বানিয়েছেন। যেখানে ধারন করেছেন গ্রাম বাংলার সহজ সরল সাধারন মানুষের জীবন-বৈচিত্র্য, সুখ-দঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, ছায়া-ঢাকা সবুজ দিগন্ত, বিস্তুত মাঠে শস্য, নদ-নদী-ফুল-পাখি, ধানক্ষেত সহ যার নিখুত কলমে তুলে আনাটা একমাত্র জসীম উদদীনের পক্ষে সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথের মতে, জসীম উদদীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সর্ম্পূন নতূন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় ছিলো এই লেখকের কাছে।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে যুবক জসীম উদদীন ছাত্রবস্থায় গ্রাম বাংলা হতে লোকগীতি সংগ্রহের কাজ হাতে নিয়ে সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ (১৯২৭) দুইটি কাহিনী কাব্য- নকশী কাথার মাঠ (১৯২৯) ও সোজন বাদিয়ার ঘাট(১৯৩৬), বালচুর (১৯৩০), ধানক্ষেত (১৯৩১), গানের সংকলন ‘রঙ্গিলা নায়ের মাঝি’ (১৯৩৫)এবং এক পয়শার বাঁশি (১৯৪৯) পল্লীকবির মোট বই ৪২ টি। হীরার চেয়ে দামি এক একটি গ্রন্থ কবিকে দেশ বিদেশ পরিচিতি এবং খ্যাতি এনে দেয়।
কবির অসাধারন আবেদন-নিবেদন, প্রত্যয়-অভিব্যক্তি, সহজ-সরল ছন্দ-উপমা পরিমিতিবোধ, এইসব শুধুমাত্র পল্লীর বন্ধু পল্লীকবি জসীম উদদীনের পক্ষেই সম্ভব। দার্শনিক প্লেটো বলেছেন কবিদের মহৎ এবং বিশিষ্ট কবিতাগুলিই অজ্ঞাতে রচিত, যা তাঁরা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারে না। যেখানে কবি জসীম উদদীন কাব্য পংক্তিতে অনন্য অসাধারন। সজ্ঞানে গ্রামীণ পটভূমির আদর্শ তার বিজ্ঞাপনে এসেছে অত্যন্ত সরল ভাবে। সরল ভঙ্গিমায় কবির আবেদন ছিলো মাটির মতো-
তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে?আমাদের ছোট গায়, গাছের ছায়ায় লতায়-পাতায় উদাসী বনের বায়।
এই হলো কবি জসীম উদদীন। অঘোষিত সাহিত্য সম্রাট। অঘোষিত পল্লী মানুষের সম্রাট। জসীম উদদীনের কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, চেক ও রুশ প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত ও প্রশংসিত হয়েছিলো। একজন জসীম উদদীন সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কথা হলো গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা। বস্তুতপক্ষে তার সমান জনপ্রিয়তা পূর্ব বাংলার কোন কবি এখনো অর্জন বা দাবি করতে পারে না। এটা ছিলো জসীম উদদীনের পরিশ্রমের ফসল।
পল্লীপাগল কবিকে কেবল পল্লীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে আমাদের চরম ভুল হবে। পল্লীর মেহনতি মানুষের কবিকে অবমাননা মানেই সমগ্র বাংলার কবি ও কবিতাকে অবমূল্যায়ন। তার কাব্য সম্ভাষণে সত্যিকার অর্থে প্রকৃতির প্রকাশতম, পল্লীহৃদয়ের পুঞ্জীভূত চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। জসীম উদদীনরে কাব্যধর্ম বাংলাকাব্য ভাণ্ডারে প্রকাশিত বিক্ষপ্তি সত্য এবং প্রিয় বলে লোকমুখে প্রকাশিত এবং প্রচারিত। কবির কাব্যহৃদয় শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের এজেন্ডা। যেখানে শারিরিক জসীম উদদীন এই ভাষার যোগ্যতম অ্যাম্বাসেডর। কবি স্বাধীনতাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। স্বাধীনতা আসে পরম বিপ্লবে। বিপ্লবকে ধারণ করে কবি সেই সময় ছন্দনামের তুজম্বর আলী যেন নজরুলের অন্যতম প্রতিনিধিই ছিলো। সাহিত্যের একজন অপরিচিত তুজম্বর আলী’র জাতীয় চেতনা- কেন্দ্রিক কবিতাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারত থেকে। মূলত এসব কবিতার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতি বিশ্বমানবতার সর্বোচ্চ নিরাবেগ সমর্থন।
বীভৎস ক্ষমতালোভী পাক হানাদার বাহিনীর ঘুম, খুন, হত্যাযজ্ঞে শহর বন্দর এবং গ্রামে সর্বজনীন ভাবে ছিলো। এজন্য তার কবিতায় ছিলো বিদ্রোহী কবিতার মূল সুর। সরল আন্তঃপ্রাণ কবি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন আদায়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
জসীম উদদীনের কাব্য ভাবনায় ছিলো কৃষক মজুরদের জীবনের কথা। ধর্মবর্ণের ভেদহীন কথা। গ্রামীণ ঐতিহ্যই তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি সুন্দরকে সবুজের বিনির্মাণে পাঠকের কাছে স্পষ্ট করেছেন সুনিপুণ অথচ মমতাময়ী কলম দিয়ে। আসমানীরা তার ছোয়ায় কালজয়ী সাহিত্যে হয়ে উঠে প্রতিবাদী প্রতিক। রুপাই যেন অসংখ্য বাঙ্গালী কৃষকের নিবেদিত প্রাণ এবং পরিচিত চরিত্র। জসীম উদদীনের কবিতায় পাওয়া যায় হাজার যুগের বাংলা মাটির সোঁধাগন্ধ। আর বারেক, রাখালী, হাসু এবং মধুমালার মতো অসংখ্য কালজয়ী চরিত্র বারবার পল্লীবাংলার মানুষের প্রাণের কবি জসীম উদদীনকে বাস্তবের আয়নার সামনে দাড় করায়। কবি জসীম উদদীন গোটাবিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ম। অদৃশ্য জগত থেকে হাজারো কৃষককে ফসলের মাঠে যওয়ার জন্য ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙাবে যে গান “ও বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে”। সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রয়োজনে প্রতিদিনই জসীম উদদীন প্রাসঙ্গিক আকারে মেঠো কাঁচা পথে “আমায় এতো রাতে কেন ডাকি দিলি” বলে আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন।আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাইরে.../ ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় .../ নদীর কূল নাই কিনার নাইরে...আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাবো.../ প্রাণ সখিরে আমার হাড় কালা করলামরে .../ আমায় এতো রাতে কেন ডাকি দিলি... এই রকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা পল্লীকবি জসীম উদদীন। লোকজ এবং মাটির গানগুলোকে তুলে দিয়েছেন শহুরে মানুষের মুখে মুখে। আধুনিক গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান এবং উর্দুসহ অসংখ্য গান লিখে বাংলা গানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল। জসীম উদদীনের হিরন্ময় গানের ছোয়ায় আব্বাসউদ্দিন হয়ে উঠেন সহজাত শিল্পী। তবে পল্লীগীতিতে তার মৌলিকতা এবং সাফল্য উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এই কবি আপন প্রতিভাবলে নিজেকে অত্যন্ত সফলভাবে গুরুত্বপূর্র্ণ করে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীতে। লালন সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত কিংবা নজরুল সঙ্গীত আমাদের গানের ভান্ডারে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মাত্রার ভিন্নতায় যোগ দিয়ে হাছন রাজা, শাহ আবদুল করীম, রমেশ শীল গানের জগতকে ভরিয়ে দিয়েছেন মুগ্ধতায়। কিন্তু একজন জসীম উদদীন জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মারফতি গানে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে মোহিত করেছেন। কিন্তু জসীম উদদীনের কালজয়ী এসব গানগুলো কেন জানি অনাদর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার কালজয়ী অসংখ্য গানের মধ্যে “প্রাণ সখিরে ওই শোন কদম তলায় বংশী বাজায় কে”... আমাদের চেতনার বাড়িতে বারবার দরজা নাড়ে। সভ্য সুন্দরে অতি যত্নে গড়া গানগুলো এখনো আমাদের বিবেককে জাগায় এবং ভাবায়। “কেমন তোমার পিতা মাতা কেমন তাদের হিয়া” পারিবারিক শিকলে বন্দী হয়ে ব্যর্থ মনে প্রেমিক এখনো অজান্তে গেয়ে উঠে জসীম উদদীনের ভূবন ভুলানো এইসব জনপ্রিয় গান। পাইরেসি এবং নকল গানের আড়ালে ঐতিহ্য বহন করা গানগুলো যত্নের অভাবে হরিয়ে যেতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হারিয়ে যেতে পারে “ছলছল কলকল নদী করে টলমল.../ ও বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে... কিংবা কি বলবি সোনার চাঁদ... অথবা তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে.../ নিশিতে যাইও ফুল বনে গো ভোমরা, নিশিতে যাইও ফুল বনে.. আবার রঙ্গিলা রঙ্গিলারে” মতো জনপ্রিয় গান। এই রকম অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের স্রষ্টা পল্লীবাংলার সুখদুঃখের কবি জসীম উদদীন।
আবার ইসলামি কিংবা আধ্যাত্মিক গানেও জসীম উদদীন সমান দক্ষতায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন। “আমার সোনার ময়না পাখি, কোন দেশেতে গেলি.../ রসূল নামে.../ যোগী ভিক্ষা ধরো../ কি বলিব সোনার চাঁদ.../ আগে জানিনারে দয়াল তোর পিরিতে”...
কবি জসীম উদদীনের বাংলা গান এখনো মনের অজান্তে গুনগুন করে ছেলে- বুড়োরা গেয়ে উঠে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অন্যান্য সঙ্গীতের মতো তার গানগুলোকে জসীম উদদীন সঙ্গীত বলে খুব কম পাই। এর জন্য রাষ্ট্র, পরিবার এবং আমাদের ব্যর্থতা কোন অংশে কম নয়। তার চির সবুজ এবং ভূবন ভুলানো গানগুলো আজীবন শ্রোতার মানে দাগ কেটে যাবে।
জসীম উদদীনকে শুধুমাত্র চেনা যায় সবুজ গাঁয়ের মেঠো কাঁচা পথে ধূলা উড়া মেঘে রাখাল ছেলে বারেকের আড্ডায়? না, তাকে পাওয়া যায় গাঁয়ের
‘চাষার ছেলে’র বর্ণনা ও বন্দনায়-
এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!
বিরহে ক্লান্ত কাতর জসীম উদদীন অনাথ নাতিকে একমাত্র অবলম্বন ভেবে কবরের কাছে শোকের মাতমে বর্ণনা করেন‘
এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম-গাছের তলে
ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ
পুতুলের বিয়ে ভেঙ্গে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক ...
শিশুর মতোই শিশুকে চমৎকার ভাবে আবেদন করেছেন তার কবিতায়-
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা - ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মারা গলায় দিয়ে - মামার বাড়ি যাই
প্রকৃতঅর্থে এসব কেবল পল্লীরাজা জসীম উদদীনের পক্ষেই সম্ভব। এই হলো অমর কালজয়ী সাহিত্যিক পল্লী বাংলার পল্লীকবি জসীম উদদীন (১৯০৩-১৯৭৬)। ১৪ ই মার্চ পল্লীসম্রাট চিরদিনের জন্য ডালিম তলে ঘুমোতে চলে যান। যিনি রচনা করে গেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতা-ছড়া-জারি-সারি ও পল্লীগীতি গান। ১৯০৩ সালের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানায় পল্লীকবি খ্যাত জসীম উদদীন জন্মলাভ করেন। পল্লীকবিকে শুধুমাত্র পল্লীকবি হিসেবে গন্য করলে তা হবে সাহিত্যের চরম সংকীর্ণতার পরিচয়। তার কাব্য ভাব, ভাষা, চিন্তা, যুক্তি, শিল্পমানের গভীরতা, ভাষা ও কাহিনীর বুনন, কাব্য চয়ন, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক এবং প্রতীক বিনির্মাণে সত্যিকারের শেষ প্রতিনিধি। গ্রামীণ জীবন তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিতো এ কথা আজো সত্য। কিন্তু বিস্ময়করভাবে শব্দচয়নে তিনি সর্বোচ্চ আধুনিকতাকেই টেনে ধরেছেন। অর্থাৎ গ্রাম্য শব্দ কিংবা আঞ্চলিকতা ছিলো না বলাই যায়। যা ছিলো সত্যিকার অর্থে অনেক কঠিন। আর জসীম উদদীন সেই কঠিনকে নিয়েছেন নিমগ্ন সাধনা হিসেবে। রবীন্দ্র-নজরুল-কল্লোল-তিরিশোত্তর যুগের উজ্জল আলো-সাম্পাতে বংঙ্গীয় সাহিত্যে যখন সমৃদ্ধ, গ্রাম-বাংলায় ধূলোর রাস্তায় রোদ-বৃষ্টির মাঝে বিনি সূতোর মালা নিয়ে চেনা পরিবেশ আওড়িয়ে স্বতন্ত্র প্রতিভার সিগ্ধ আলো হাতে বাংলা কাব্যে এবং গানে এই মহান শৈল্পিককবির আবির্ভাব।
ময়মনসিংহ গীতি বা পুঁথিকাব্যর আহ্বায়ক প্রখ্যাত পন্ডিত ড. দীনেশ চন্দ সেন জসীম উদদীনের গানের প্রেক্ষাপটে বলেন, জসীম উদদীন যেমন খাটি কবি তেমনি করে সাধনায় ব্রত হয়ে গানকে করে তুলেছেন মানুষের মুখের ভাষা। এসবের মূল কারণ হলো ষোল আনাই পল্লী নিবেদিত প্রাণের মানুষ। তার সময়ের সকল শ্রেষ্ঠ মানুষদের বাইরে গিয়ে শুধু কবিতাই চর্চা করেন না। গানকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। আবহমান বাংলার লোকজ-সাংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারন করে শুদ্ধ পরিস্নাত এক স্বাতন্ত্রধিকারী ভাস্বরে ভাস্বরে যে কবি ধান-গম-কাউন-ভুট্টা দিয়ে ক্রমানয়ে পর্বত বানিয়েছেন। যেখানে ধারন করেছেন গ্রাম বাংলার সহজ সরল সাধারন মানুষের জীবন-বৈচিত্র্য, সুখ-দঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, ছায়া-ঢাকা সবুজ দিগন্ত, বিস্তুত মাঠে শস্য, নদ-নদী-ফুল-পাখি, ধানক্ষেত সহ যার নিখুত কলমে তুলে আনাটা একমাত্র জসীম উদদীনের পক্ষে সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথের মতে, জসীম উদদীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সর্ম্পূন নতূন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় ছিলো এই লেখকের কাছে।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে যুবক জসীম উদদীন ছাত্রবস্থায় গ্রাম বাংলা হতে লোকগীতি সংগ্রহের কাজ হাতে নিয়ে সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ (১৯২৭) দুইটি কাহিনী কাব্য- নকশী কাথার মাঠ (১৯২৯) ও সোজন বাদিয়ার ঘাট(১৯৩৬), বালচুর (১৯৩০), ধানক্ষেত (১৯৩১), গানের সংকলন ‘রঙ্গিলা নায়ের মাঝি’ (১৯৩৫)এবং এক পয়শার বাঁশি (১৯৪৯) পল্লীকবির মোট বই ৪২ টি। হীরার চেয়ে দামি এক একটি গ্রন্থ কবিকে দেশ বিদেশ পরিচিতি এবং খ্যাতি এনে দেয়।
কবির অসাধারন আবেদন-নিবেদন, প্রত্যয়-অভিব্যক্তি, সহজ-সরল ছন্দ-উপমা পরিমিতিবোধ, এইসব শুধুমাত্র পল্লীর বন্ধু পল্লীকবি জসীম উদদীনের পক্ষেই সম্ভব। দার্শনিক প্লেটো বলেছেন কবিদের মহৎ এবং বিশিষ্ট কবিতাগুলিই অজ্ঞাতে রচিত, যা তাঁরা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারে না। যেখানে কবি জসীম উদদীন কাব্য পংক্তিতে অনন্য অসাধারন। সজ্ঞানে গ্রামীণ পটভূমির আদর্শ তার বিজ্ঞাপনে এসেছে অত্যন্ত সরল ভাবে। সরল ভঙ্গিমায় কবির আবেদন ছিলো মাটির মতো-
তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে?আমাদের ছোট গায়, গাছের ছায়ায় লতায়-পাতায় উদাসী বনের বায়।
এই হলো কবি জসীম উদদীন। অঘোষিত সাহিত্য সম্রাট। অঘোষিত পল্লী মানুষের সম্রাট। জসীম উদদীনের কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, চেক ও রুশ প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত ও প্রশংসিত হয়েছিলো। একজন জসীম উদদীন সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কথা হলো গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা। বস্তুতপক্ষে তার সমান জনপ্রিয়তা পূর্ব বাংলার কোন কবি এখনো অর্জন বা দাবি করতে পারে না। এটা ছিলো জসীম উদদীনের পরিশ্রমের ফসল।
পল্লীপাগল কবিকে কেবল পল্লীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে আমাদের চরম ভুল হবে। পল্লীর মেহনতি মানুষের কবিকে অবমাননা মানেই সমগ্র বাংলার কবি ও কবিতাকে অবমূল্যায়ন। তার কাব্য সম্ভাষণে সত্যিকার অর্থে প্রকৃতির প্রকাশতম, পল্লীহৃদয়ের পুঞ্জীভূত চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। জসীম উদদীনরে কাব্যধর্ম বাংলাকাব্য ভাণ্ডারে প্রকাশিত বিক্ষপ্তি সত্য এবং প্রিয় বলে লোকমুখে প্রকাশিত এবং প্রচারিত। কবির কাব্যহৃদয় শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের এজেন্ডা। যেখানে শারিরিক জসীম উদদীন এই ভাষার যোগ্যতম অ্যাম্বাসেডর। কবি স্বাধীনতাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। স্বাধীনতা আসে পরম বিপ্লবে। বিপ্লবকে ধারণ করে কবি সেই সময় ছন্দনামের তুজম্বর আলী যেন নজরুলের অন্যতম প্রতিনিধিই ছিলো। সাহিত্যের একজন অপরিচিত তুজম্বর আলী’র জাতীয় চেতনা- কেন্দ্রিক কবিতাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারত থেকে। মূলত এসব কবিতার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতি বিশ্বমানবতার সর্বোচ্চ নিরাবেগ সমর্থন।
বীভৎস ক্ষমতালোভী পাক হানাদার বাহিনীর ঘুম, খুন, হত্যাযজ্ঞে শহর বন্দর এবং গ্রামে সর্বজনীন ভাবে ছিলো। এজন্য তার কবিতায় ছিলো বিদ্রোহী কবিতার মূল সুর। সরল আন্তঃপ্রাণ কবি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন আদায়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
জসীম উদদীনের কাব্য ভাবনায় ছিলো কৃষক মজুরদের জীবনের কথা। ধর্মবর্ণের ভেদহীন কথা। গ্রামীণ ঐতিহ্যই তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি সুন্দরকে সবুজের বিনির্মাণে পাঠকের কাছে স্পষ্ট করেছেন সুনিপুণ অথচ মমতাময়ী কলম দিয়ে। আসমানীরা তার ছোয়ায় কালজয়ী সাহিত্যে হয়ে উঠে প্রতিবাদী প্রতিক। রুপাই যেন অসংখ্য বাঙ্গালী কৃষকের নিবেদিত প্রাণ এবং পরিচিত চরিত্র। জসীম উদদীনের কবিতায় পাওয়া যায় হাজার যুগের বাংলা মাটির সোঁধাগন্ধ। আর বারেক, রাখালী, হাসু এবং মধুমালার মতো অসংখ্য কালজয়ী চরিত্র বারবার পল্লীবাংলার মানুষের প্রাণের কবি জসীম উদদীনকে বাস্তবের আয়নার সামনে দাড় করায়। কবি জসীম উদদীন গোটাবিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ম। অদৃশ্য জগত থেকে হাজারো কৃষককে ফসলের মাঠে যওয়ার জন্য ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙাবে যে গান “ও বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে”। সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রয়োজনে প্রতিদিনই জসীম উদদীন প্রাসঙ্গিক আকারে মেঠো কাঁচা পথে “আমায় এতো রাতে কেন ডাকি দিলি” বলে আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫৪