লেখক- হাসনাত মোবারক
কাঁচির মতো বাঁকা চাঁদের হাসির ফোয়ারা ছুটছে কাব্য পাড়ায়। কবিতার বাঁক বদলের সারথী হয়ে উঠছেন তারুণ্যের আগমনী হাওয়ায়। আর যে সকল কবিতাক্রান্ত তরুণে যাত্রপথে কবিতাকে নতুন পথে ধাবিত করছেন তাদেরই একজন কবি জব্বার আল নাঈম। কাব্য দেবীর নিরন্তর প্রণোদনায় কবি জব্বার আল নাঈমের সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘তাড়া খাওয়া মাছের জীবন ; এ যে কবিতারই প্রাণ। হ্যাঁ সামন্যতম অত্যুক্তি হবে না যদি বলি তিনি যে এক রাজসিক কবি। তাঁকে নিয়ে এই কাঁচা হাতে কীভাবে যে করি তাঁরই ক্যারিশম্যাটিক কাব্যের বিশদ বর্ণনা। বহুত্ববাদে ভরপুর ‘তাড়া খাওয়া মাছের জীবন’ গ্রন্থখানা। দৃঢ় আত্মপ্রত্যায়ে বিশ্বাসী তার প্রমাণ রেখেছেন গ্রন্থলোকের উৎস্বর্গপত্রে। এমনটি স্বভাবতই বিরল। কবি মানে স্বাতন্ত্র্যেবাদে বিশ্বাসী। তা প্রমাণিত হয় কবিতার আদ্যেপান্তে বিচরণ করলে। শব্দ কল্পে রং মিশিয়ে বুনট বেঁধেছেন কবিতার শরীরে। ‘এই রকম সময়’ শিরোনামের কবিতায় এক আধ্যাত্মিক জব্বার আল নাঈমকো খুঁজে পাবে পাঠক। এটা যে এক ঐশ্বরিক মতবাদ বটে। অসাধারণ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন । থরথর শব্দরাশির জালে মলাটবদ্ধ কবিতার শরীর থেকে বলে উঠলেন-
‘অস্থিমজ্জা আর রক্তপান নিয়ে উঠে এসে / মাসিদের মজলিসে ভীষণ ভাবছি...’
- মা
গ্রন্থলোকে মুখ এঁটে দেখতে পাই লাটিম কবিতায় জীবন প্রবাহের যাপিত অধ্যায়ের ঘ্রাণ। বেদনাবিঁদুর কথন জুড়ে রয়েছে এই কবিতায়।
‘ফুটবলে সবাই সমান তালে লাথি মারে / কোন দিকে যাব?/তাড়া খাওয়া মাছের জীবনের আনুকূল্য খুঁজি’
- লাটিম
সারিসারি শব্দরাশির জালে ‘ময়লা মাটি’ কবিতায় অনায়াসে বলে দিলেন-
‘ ক্যানভাস থেকে তুলির আঁচড়ে প্রকৃতি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর মতো চন্দন সুবাসে বারবার সাজে। আর সূর্যের খোঁচা খেয়ে কাঁচা ফসল হাসতে হাসতে গর্ভবতী হয়ে ওঠে...’
এখানে কবি রূপকের অন্তরালে সূর্যকে পুরুষ হিওেসবে উপস্থাপন করেছেন। কাঁচা ফসল বলতে কবি ফলবতী রমণীকে বুঝিয়েছেন। এটা নির্দ্ধিধায় একটি সফল কাব্য বয়ান। কবিতার ক্ষেত্রে আমি বরাবরই বলি নদীর সৌন্দর্য ঢেউ আর কবিতার সৌন্দর্য আড়াল। প্রকৃতির রূপ এবং রূপকের প্রয়োগ যথেষ্ট রয়েছে তার কবিতায়। অদৃর্শ ছায়াকোরাজির মাঝে খেলা করে মন্ত্রমুগ্ধ কবিতাগুলো।
‘আয়না ও নেলসেন ম্যান্ডেলা’ কবিতায় শ্বেতশুভ্র শয়তানকে ছেখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যথেষ্টে সাহসী উচ্চারণ রয়েছে তার কবিতার বুক জুড়ে। জীবনের খানাখন্দ খুঁড়ে আবাদযোগ্য প্রাণ রয়েছে তার কবিতায়। যা বারবার বহুদা রূপে উপস্থিত হয়।
‘ কফিশপে সন্ধ্যার চাঁদ স্মরণ দিনের সূর্য হাবুডুবু খায়;/ নিসর্গের সামনে অমন ভাওতাবাজির খেল ওঁৎপাতা আকাশ দেখে... ’
-সন্ধ্যার কফিশপে
‘যমুনার অগোচরে নোঙরা সংসারে কুলীন পাহাড় ঘুমায়; ’
-প্রীতিলতা
কুলীন পাহাড় ঘুমানোর দৃষ্টিবোধটি একমাত্র কাবর নির্মোহ দৃষ্টিবোধের জায়গা থেকেই ধরা পড়েছে। কবি যে সাধারণের থেকে ভিন্নতাই কবিসত্তাকে টিকিয় রাখে। এক্ষেত্রে জব্বার আল নাঈমের ‘তাড়া খাওয়া মাছের জীবন’ কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা যাবে। একই কবিতার আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়‘ রানিক্ষেতের মতো সুরের ঘোমটা খোলে ঘষেটি বেগম;’
- প্রীতিলতা
শব্দশৈলির আয়োজনে ইতিহাসকে উপস্থাপনটা অসাধারণ লেগেছে। তারচেয়ে বড় ব্যাপার হলো কবি ঘষেটি বেগমের অসুস্থ অভীপ্রায়কে কবি কী নান্দনিকভাবে রানিক্ষেতের সুরের মতো করে তুলে ধরলেন। এই যে নতুত্ব একজন নতুন কবিকে জায়গা করে দিবে বলে মনে হয়। উচ্চমার্গীয় এই কাব্যগ্রন্থে যে আন্তর্জাতীকতাবাদ তা এই সময়ের কম কবিতাতেই লক্ষ করা যায।
প্রত্যহ কবিতা যাপনে এই কবিকে শব্দের কারিগর হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও দেখি । যথাপোযুক্ত উপমা লক্ষ্য করা যায় যোগফল কবিতায়। যেমন- ‘অসহায় বিশ্বচোখ একলা হাঙ্গরের মতো চেয়ে আছে’
যোগফল
পঙক্তির প্রথম শব্দটি অসহায় বিশ্বচোখ । খুবই অর্থবহুল শব্দ। কিন্তু পরক্ষণই আপত্তি ওঠে কবি যখন বললেন ‘একলা হাঙ্গরের মতো চেয়ে আছে’ এখানে হাঙ্গর শব্দটির পরিবর্তে অন্য একটি শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন। সেটার দায়ভার তাকেই নিতে হবে।
‘ সন্ধ্যাসঙ্গীত শোনার আগ্রহ নিয়ে পুকুর ঘাটে/ কতকাল বসে থাকবি মনমালতি?/পাহাড়ি করাতকল থেকে সঙ্গীত মন্ত্রণা আসে/ এই বোধোদয় বহুকাল...’
- গিটার
সাধারণ শব্দগুচ্ছের আর্বতে অসাধারণ ব্যঞ্জনা তৈরিতে সফল হয়েছেন। আবেগেকাতর কবিকে উপস্থিত হতে দেখ যায়।
‘কোলবালিশ ছিঁড়ে সাদা ক্লোন চিঠি;/ বুকের টাওয়ালের মতো উড়তে থাকে জারিগান/ ভেসে ওঠে চরপদ্মার অভিমান ’
- নায়িকার মাংসের আওয়াজ ও আমাদের গ্রাম
কবিতা যে শিল্পিত শব্দমালা সে প্রমাণ উপর্যুক্ত কবিতায়। চমকপ্রদ উপমা উৎপেক্ষা কবিতা হয়ে উঠেছে গ্রহণযোগ্যতার চূড়ায়।
‘জলজোয়ারের লবণের বসবাস দেখে অন্ধকার সময়কে ভেবেছি কুঁড়েঘর;/ তারকাটায় পুঁতেছি শরীরের সব ওয়াদা/ কেউ বুঝুক আর না বুঝুক ভগমান পছন্দ করে বেকার জব্বার’
- আত্মকথন
গতানুগতিকতার ধারা এবং সামাজিক বৈষম্যকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে কবি শিল্পিত ঢংয়ে অনবদ্ধ সাহসী উচ্চারণ করলেন। আর এমনটি পারেন শুধু কবিরাই। স্বচ্ছন্দ গতি রয়েছে এই গ্রন্থে। আলতোস্পর্শে অনুভূত হয় তার কবিতার বয়ান। বিমোহিত শব্দের সারবেত্তায় প্রকাশ পেয়েছে কবিতালয়ে।
তিন ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থলোকে বিরচণ করে দুই চারটি কবিতা ব্যতীত সব কবিতাই পাঠযোগ্যতার দাবিদার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫৯