নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম অম্বরনগর। জেলা সদরের সাথে এই গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা সুবিধা ছিলো না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসহাক মিয়া নামে স্থানীয় এক আওয়ামীলীগ নেতা তাঁর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়া এবং সাময়িক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন। যারা বিভিন্ন কারনে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষন গ্রহন করতে পারেন নি, তারা এই বাড়িতে এসে ইসহাক মিয়া এবং তার সহযোগীদের হাত থেকে ট্রেনিং নিতেন। তাঁকে সাহায্য করত তাঁর বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে জসীম উদ্দিন। ইসহাক মিয়া নিঃসন্তান থাকার জন্য বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলেকেই তিনি পিতৃ স্নেহে বড় করেছেন।
জসীম উদ্দিন তখন সবে মাত্র ইন্টার পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চিন্তাভাবনা করছে। তিনিও তখন বাড়িতে বসে চাচা ও তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষন গ্রহন করলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সেক্টরটি ছিলো মেজর খালেদ মোশারফের অধীনে। সেন্ট্রাল কমান্ডের আদেশ অনুসারে ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তের কাছাকাছি একটি সম্মুখ যুদ্ধে যাবার সময় বর্তমান সেনবাগ উপজেলার জমিদারহাট অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকসেনা এবং স্থানীয় রাজাকাদের সম্মুখে পড়ে যায় এবং কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ইসহাক হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো একটি দল তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায়। এই সময় চাচার নিষেধ অমান্য করে তার ভাতিজা সেই যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং ২ জন স্থানীয় রাজাকারকে হাতে নাতে ধরে ফেলতে সমর্থ হয়। এর পরে জসীম উদ্দিন স্থানীয়ভাবে আরো কিছু ছোটখাটো অপারেশনে অংশগ্রহন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষে দিকে স্থানীয় এক রাজাকারের বাড়িতে অভিযান চালানোর সময় প্রতিপক্ষের বেয়নেটের খোঁচায় কিছুটা আহত হন। পরিপুর্নভাবে সুস্থ হবার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
এই জসীম উদ্দিন আহমেদ হচ্ছেন আমার বাবা। ইসহাক মিয়া হচ্ছেন তাঁর চাচা। আমার বাবা সারাজীবন তাঁর চাচাকে ভালোবেসেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন। আমি কখনও আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধ পরিচয় বিক্রি করি নি। অর্থাৎ যেচে পড়ে বলিনি যে আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের গর্ব আমাদের নিজেদের ভেতরেই ছিলো। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করেছি আমাদের অন্তরে। জোট সরকারের আমলে আমাদের অঞ্চলের একজন চিহ্নিত রাজাকার নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষনা দিয়ে যখন নির্বাচন করে বিজয়ী হয়, তখন আমার বাবা প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি ঘৃণায় দীর্ঘদিন গ্রামের বাড়িতে যান নি। ২০১১ সালে ঐ রাজাকার বইল্লা ( ভালো নাম বলি, কিন্তু তিনি বইল্লা নামে পরিচিত) যখন মারা যান তখন তিনি আবারও গ্রামের বাড়িতে যান। নিজের চাচার কবর জেয়ারত করেন। চারিদিকে যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়াছড়ি শুরু হলো, তখন থেকে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেয়া থেকে বিরত থাকতেন। এমন কি তিনি যখন মারা যান, তখন আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান, আব্বার সহযোদ্ধারা অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেছিলো তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার জন্য। সবাই বলেছেন এটা নাকি তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু আমার বাবা বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকে দ্রুত দাফন করি। এই সব কিছুই তাঁর প্রয়োজন নেই। এটা তাঁর ক্ষোভ ছিলো না অভিমান ছিলো আমি জানি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিয়েছি। একজন সন্তান হিসাবে নিজের বাবাকে বিক্রি করতে আমিও চাই না। আশা করি তিনি যেখানেই আছেন, ভালো আছেন।
অনেক ব্লগার যারা আমার বাসায় এসেছেন, তাঁরা অনেকেই আমার বাবাকে চিনতেন কথা বলতেন। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে অনেকেই আমাকে ফোন দিয়েছেন, ইমেইল করেছেন। আমার বাবা প্রচন্ড গোছালো একজন মানুষ ছিলেন। সেই তুলনায় আমি প্রচন্ড অগোছালো। মৃত্যুর ৫ মিনিট আগেও তিনি নিজের বিছানার চাদর টান টান করে পরিষ্কার করেছেন। বাথরুম থেকে অযু করে, মাথা আচড়িয়ে বসেছেন। মনে হচ্ছে যেন তিনি যাত্রার জন্য প্রস্তুত।
সন্তান হিসাবে পিতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি। আমি এখনো তার ঘরে গেলে তাঁর গন্ধ পাই। আমার বিশ্বাস হয় না তিনি মারা গেছেন। কিন্তু এটাই বাস্তব। আমাকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমার পিতাকে অসম্ভব ভালো রাখেন, মায়ায় রাখেন, আদরে রাখেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ৮:০০