খুব অস্থির লাগছে আমার। কিন্তু অস্থির হওয়া যাবে না। যা করার ধীরেসুস্থে, ঠাণ্ডা মাথায় করতে হবে। একমাস ধরে পরিকল্পনা করছি। আর আমার পরিকল্পনা কখনো ভেস্তে যায় না। বিয়ের দিন থেকেই পরিকল্পনা করেছি। কাউকে খুন করার জন্য একমাস যথেষ্ট সময় আর সে যদি নিজের স্ত্রী হয় তাহলে তো কোন কথাই নয়। একমাসে মিতুর সম্পর্কে মোটামুটি সব জেনে গেছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হল তার সাবেক প্রেমিক তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। ছেলেটার সাথে যোগাযোগ না থাকলে পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হত। যাইহোক, কিছুক্ষণ আগে মিতুর ভাগ্নির জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে আমরা দুজনেই একসাথে ফিরেছি।
.
বাসায় এসে মিতু বাথরুমে ঢুকেছে। তার গোসল করতে প্রায় আধাঘণ্টা লাগবে। এই সুযোগে ব্যবস্থাপত্রের একটা রিভিউ করে ফেললাম। আমি মাঝেমাঝে বাসায় ড্রিংক করি। বিয়ের দ্বিতীয় দিন যখন আমি তাকে বললাম, মিতু, প্রত্যেক মানুষের কিছু ব্যক্তিগত বিষয় থাকে যেখানে কারও ইন্টারফেয়ার করা উচিৎ নয় সে হোক স্বামী বা স্ত্রী। আমার কথা শুনে মিতু মিষ্টি হেসে বলল, তুমি কি ড্রিংক করতে চাচ্ছ?
আমি অবাক হলাম, তুমি কিভাবে বুঝলে?
সে সহজভাবে বলল, সকালে তোমার আলমারিতে দুইটা শ্যাম্পেইনের বোতল দেখেছি। যেহেতু এই বাড়িতে তুমি একা, সো.....
আমি মিতুর বুদ্ধিমত্তা দেখে অবাক হয়েছি। সে বলল, আমি কি তোমার সাথে জয়েন করতে পারি?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
আমিও সহজভাবে নিলাম। যাক, একজন সঙ্গী তো পেলাম।
আজ আমি ড্রিংক করব, তবে মাতাল হব না। মাতাল হলে সব পরিশ্রম পণ্ড হবে। গতকাল আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা রেড ওয়াইনের বোতল উপহার পেয়েছি। ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আমি ড্রিংক তৈরি করতে লাগলাম। ইতোমধ্যে মিতুর গোসল শেষ। যেহেতু বাসায় আমি আর মিতু ছাড়া কেউ থাকে না তাই বাসার মধ্যে মিতুর চলাফেরা খুবই খোলামেলা। সে শুধু একটা তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বের হল। ঐ অবস্থায় আমার কাছে এসে বলল, ফোনটা দাও। আপুকে একটা কল করতে হবে। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই।
-ফোন কথা বলবে ভাল কথা, কিন্তু কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন?
মিতু আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তার ভেজা শরীরের শীতল উষ্ণতায় আমি প্রায় পাগল হয়ে গেলাম। তার উপর তার শরীরের সুগন্ধ, উফ! মিতু চলে যাচ্ছে। সাদা তোয়ালে হাটুর উপরেই শেষ, তার উপর তার পিঠের লাল তিল-আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
কিছুক্ষণের মধ্যে মিতু নাইটি পরে চলে এল। বলল, আজ আমার খাওয়া বেশি হয়েছে। গরুর মাংসের ভুনাটা এত সুস্বাদু হয়েছে যে লোভ সামলাতে পারলাম না। অনেক খেলাম। আর তুমি তো জান, গরুর মাংস খেলে আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। আমি ড্রিংক করতে চাচ্ছি না।
-ওকে, নো প্রবলেম। কিন্তু আমার পাশে বসে থাকতে নিশ্চয় কোন প্রবলেম নেই?
-ওকে, থাকছি।
আমি পরপর দুই পেগ খেলাম। মিতুর দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে মিথ্যা মাদকতা তৈরি করলাম। এই মাদকতা দেখে মিতু কেন যে কেউ না খেয়ে থাকতে পারবে না। পরের পেগ যখন ঢাললাম, তখন মিতু গ্লাসটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিল।
-তোমার এখন খাওয়া উচিৎ না। তোমার শরীর খারাপ করবে।
মিতু কিছু না নিঃশব্দে হাসতে লাগল। সে পরপর কয়েক পেগ খেয়ে ফেলল। আমি তাকে আর খেতে দিলাম না। সে টলছে। আমি তাকে ধরে বেডরুমের দিকে নিতেই মিতু আমার গায়ে হড়হড় করে বমি করে দিল না। আমি ওকে শুইয়ে দিয়ে বাথরুমে গেলাম। এক সিরিয়াল কিলারের কথা জানি, সে খুন করার আগে কর্পূর মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল করত। আমি কর্পূর ছাড়া গোসল করতে গেলাম। একগ্লাস রেড ওয়াইন নিয়ে বাথটাবে শুয়ে পরবর্তী ধাপগুলো ভাবতে লাগলাম। এতক্ষণে মিতু হয়তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তারমত মেয়ের নাক ডাকা মানায় না।.
আমি উঠে এলাম। এসে দেখি মিতু ঘুমাচ্ছে কিন্তু নাক ডাকছে না তবে বড় নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। যা করার এখনই করতে হবে।
.
রাত এগারোটা বাজে। চারিদিকে সুনসান। এখানে সন্ধার আগেই সুনসান হয়ে যায়। আমার বাড়িটা ফাঁকা যায়গায়। বাংলোর মত বাড়ি। কারণ আমার কাজটা খুবই নির্জনে করতে হয়।
আমি জিরো পাওয়ারের লাইট জ্বালালাম। তখন মিতু নড়েচড়ে উঠল। আমার মনে হচ্ছে মিতু জেগে আছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি মিতু সত্যিই জেগে আছে। উঠে বসেছে। আমি বললাম, ঘুম ভেঙে গেছে?
-হুম, কেরোসিনের গন্ধে ঘুম আসছে না।
-কেরোসিন কোথা থেকে আসবে।
-আপুর বাসায় রান্নাঘরে যখন গিয়েছিলাম, কাজের মেয়েটার হাত থেকে কেরোসিনের বোতলটা আমার গায়ে পড়ে যায়।
-আমি তো আগে গন্ধ পাইনি।
-তুমি হয়তো খেয়াল করনি, আমি আপুর ওড়না পরে এসেছি। আমার ওড়না আলনায় রেখেছি। দেখ।
আমি বুঝতে পারছি না যে কী হচ্ছে। আলনা থেকে মিতুর ওড়না শুঁকে দেখলাম। কেরোসিনের গন্ধ নেই। হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।
.
মিতু পানির ছিটা দিয়ে আমার জ্ঞান ফিরাল। চোখ মেলে দেখি আমি একটা চেয়ারে বস, হাতপা শক্ত করে বাঁধা। ঘরে এখন জিরো পাওয়ারের লাইট না, টিউবলাইট জ্বলছে তাই আলো চোখে লাগছে। মিতু আমার চারপাশে ঘুরছে। খালি পায়ে হাটছে কিন্তু মনে হচ্ছে ভারী বুটজুতো পরে হাটছে। কেমন যেন গমগম ভাব। একটা হাতল বিহীন চেয়ার টেনে আমার সামনে বসল। তার চোখেমুখে খুব উত্তেজনা। একটু ঝুকে বলল, কী ব্যাপার মিস্টার রাকিব, জ্ঞান ফিরেছে আপনার?
আমি তার চোখের দিকে না তাকিয়ে বুকের দিকে তাকিয়ে আছি। নাইটির গলা ঢিলা হওয়ায় তার বুকের ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে। মিতু বুঝতে পেরে বলল, তুমি কি বুঝতে পারছ না তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আর তোমার দৃষ্টি আমার বুকের দিকে? এতদিন আমার বুক দেখনি?
-দেখেছি। কিন্তু এটা বুঝতে পারিনি যে তোমার কলিজা এত বড়!
-তুমি একজন সাইকোপ্যাথিক সিরিয়াল কিলার। এটা আমি প্রথম রাতেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তুমি বুঝতে পারনি যে আমি বুঝতে পেরেছি।
-কিভাবে বুঝলে?
-তুমি নিশ্চয় জান, আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়েছি আর আমি থট রিডিং জানি। তোমার প্রতিটা পরিকল্পনা আমি বুঝতে পেরেছি।
-ও আচ্ছা।
আমি হাসলাম। বললাম, একটা সিগারেট খাওয়াবে?
-ওকে, তোমার শেষ সিগারেট তো খাওয়াব। বলেই মিতু সিগারেট ধরিয়ে আমার ঠোটে দিল। মাঝেমাঝে আমার ঠোট থেকে সিগারেট নিয়ে মিতুও টানছে।
তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। বল, কিভাবে মরতে চাও?
আমি মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছি। মাথাগরম করে কিছুই করা যাবে না। বললাম, তুমি তো থট রিডিং জান, তাহলে তুমি বুঝে নাও যে আমি কিভাবে মরব।
-গুড আইডিয়া।
মিতু আমার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার চিন্তাভাবনা বুঝার আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তার চোখের কোণে কপালে শিরাগুলো দপদপ করছে।
.
মিতু নিজেই অবাক হচ্ছে। যে থট রিডিং করতে পারছে না। হঠাৎ তার মনে হল তার মস্তিষ্ক চিন্তাশূন্য। ঠিক তখনই একটু শব্দ করে আমি হেসে উঠলাম।
বললাম, কী হল? পারছ না?
-না।
কেন?
-জানি না। বুঝতে পারছি না।
-আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। তুমি থট রিডিং জান, আর আমি জানি সম্মোহন। সম্মোহন কি নিশ্চয় বুঝতে পারছ?
-হ্যাঁ, হিপনোটিজম।
-ঠিক। তুমি থট রিডিং এর প্রাইমারি লেভেল জান, যা দিয়ে শুধুমাত্র শিশুদের আর বোকা লোকদের চিন্তাভাবনা পড়া যায়। আর আমি হিপনোটিজম এর লাস্ট লেভেল পর্যন্ত জানি যা দিয়ে সবাইকে হিপনোটাইজড করা যায়। তোমাকে বাসর রাত থেকেই আমি হিপনোটিক সাজেশন দিচ্ছি। তাতে তোমার মনে হবে যে তুমি আমার চিন্তাভাবনা বুঝতে পার। তুমি ভেবেছিলে আমি তোমাকে ঘুমের মধ্যে ছুরি দিয়ে খুন করব। তোমাকে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি যে আজই তোমাকে মারব। তুমি ইচ্ছা করেই আমার গায়ে বমি করেছ। তারপর, গামছায় ক্লোরফরম মাখিয়ে রেখে আমাকে কেরোসিনের মিথ্যা গল্প বলেছ। আমি জানতাম তুমি এরকম কিছু করবে। তোমার উচিৎ ছিল পালিয়ে যাওয়া। আমি তোমাকে সুযোগ দেওয়ার ইচ্ছায় তোমার পরিকল্পনা মত এগোই। কিন্তু তুমি জান না যে আমি কি করতে পারি। এখন আমার হাতপায়ের বাঁধনটা খুলে দাও।
মিতু বাঁধন খুলে দিল। আমি তাকে পুরোপুরি হিপনোটাইজড করে ফেলেছি। এখন যা বলব, সে তাই করবে। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বজ্রপাত হওয়ার আগেই যা করার করতে হবে। বজ্রপাত হলে সম্মোহন কেটে যাবে। আর একবার কেটে গেলে আবার সম্মোহিত করা খুবই কঠিন।
আমি মিতুকে বললাম, চল ছাদে যাই। ও আমার সাথেই হাটছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে হাটছি। ছাদে পৌঁছে আমি মিতুকে একটা গভীর চুমু খেলাম। এরপর বললাম, গুডবাই।
মিতু আমার দিকে তাকিয়েই ছাদ থেকে লাফ দিল। এ দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে না। মিতুর নিচে পড়ার ধুপ করে শব্দ পেলাম কিন্তু কোন চিৎকার শুনতে পেলাম না। প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টিতে বসে দুএক পেগ রেড ওয়াইন তো খাওয়াই যায়।