প্রত্যেক মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখের উত্থানপতন হয়। কিন্তু নাহিদের সুখের সময়টা সম্ভবত তার বুঝে উঠার আগেই শেষ হয়েছিল। তার বয়স যখন ছয়, তখন তার বাবার মৃত্যু। দশ বছর বয়সে রোড এক্সিডেন্টে তার বোনের মৃত্যু। তের বছর বয়সে শেষ আশ্রয় তার মাও তাকে ছেড়ে পরপারে চলে যায়। এরপর সে তার মামা চাচাদের সহযোগিতায় মাধ্যমিক পাশ করে। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় এলাকার কিছু ব্যক্তিদের সাহায্যে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর মফস্বলের কলেজ থেকে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে নেয়। এখন তার দরকার একটা চাকরী। কিন্তু বর্তমানে চাকরীর বাজারে মেধা মূল্যহীন - এটা বুঝতে নাহিদের বেশিদিন লাগে নি। ঢাকায় টাকা ওড়ে- এই প্রত্যাশায় “স্বপ্নের শহর" ঢাকায় আগমন। বিশিষ্ট লেখকদের মত বলতে হয় ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। প্রথম দিনেই এক পকেটমারের সদ্ব্যবহারের ফলে তার পকেট শুন্য হয়ে যায়। ঢাকায় মানুষের অভাব নেই কিন্তু খাবার আর থাকার যায়গার বড্ড অভাব অন্তত নাহিদের যার কোন আত্মীয় বা পরিচিত কেউ ঢাকায় নেই। রাত ১২ টা পর্যন্ত উদ্দেশহীনভাবে ঘুরাঘুরি করে চোখের ও মনের ক্লান্তি অবসানের জন্য একটু বিশ্রামের আশায় ফার্মগেট পার্কের মধ্যে একটি বেঞ্চে বসল। সারাদিন অভুক্ত থাকার ফলে ক্লান্তিটা চেহারায় চেপে বসেছে। পার্কের কোনায় একটা দোকান এখনো খোলা দেখা যাচ্ছে। নাহিদ দোকানে গিয়ে এক গ্লাস পানি চাইল। দোকানের মধ্যবয়স্ক লোকটা জিজ্ঞেস করল, স্যারকে কি দেব?
-যা খুশি তাই দিতে পারেন। কিন্তু আমি আপনাকে কিছুই দিতে পারব না।
-ট্যাকা নাই?
-না।
-এই ন্যান, কলা আর রুটি খান।
-যদি কোনদিন হাতে টাকা আসে আপনার এই বিলটা আগে দিয়ে যাব।
দোকানী লোকটার ঠোঁটের কোনে কেমন যেন ভ্রুক্ষেপের হাসি দেখা গেল।
-আর কিছু লাগব স্যার?
-একটা সিগারেট দেন। আপনি কি এখন ঘুমিয়ে পড়বেন?
-হ, অহন দোকান খোলা রাইখ্যা কি করমু?
নাহিদ সিগারেটটা জ্বেলে আগের বেঞ্চে এসে বসল। আনমনে সিগারেট টানছে। আজ সিগারেটটা খুব ভাল লাগছে। হয়তো মধ্যরাতে কারও করুণায় দেওয়া সিগারেট ভালই লাগে।
-এই কে ওখানে? দারাজ কন্ঠে কে যেন বলল।
- কিরে কথা বলিস না কেন?
নাহিদ দেখল কয়েকজন পুলিশ তার দিকে আসছে।
-এখানে কি করিস?
-বসে বসে সিগারেট টানি।
-পরিচয় কি?
-নাম নাহিদ হাসান, বেকার।
-কনস্টেবল, ওকে ভাল করে চেক কর। দেখ, ওর কাছে কী আছে?
কনস্টেবল বলল, আপনার হাত উঁচু করেন।
দারোগা সাহেব তাকে তুই করে বলছে। আর কনস্টেবল তাকে আপনি করে বলছে। ভালই তো।
(কিছুক্ষণ পর)
-একি? এটা কিসের প্যাকেট?
-জানি না। আর এটা আমার না।
-তোর না? তাহলে তোর পকেটে কেন? দেখি- এটা তো হিরোইন।
-এই হিরোইন প্যাকেটের দাম কত?
কনস্টেবল বলল, সাত থেকে আট হাজার টাকা।
-এটা আমার কাছে থাকলে পার্কে বসে থাকতাম না। যাই হোক, এটা আমাকে দিন। আমার কয়েকদিনের খরচটা হয়ে যাবে।
কনস্টেবল দারোগাকে ফিসিফিসিয়ে বলল, স্যার, চালু মাল। এখানে ধান্দা হবে না। চলেন অন্যদিকে যাই।
দারোগা নাহিদকে বলল, রাতে বাইরে ঘুরাঘুরি করবেন না। সমস্যায় পড়বেন।
-ধন্যবাদ।
দারোগা সাহেবের ভদ্রতার গোড়ায় পানি পড়েছে। তিনি সরাসরি তুই থেকে আপনি করে বলছেন।
নাহিদ বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়ল। আর অদ্ভুত ব্যাপার হল, প্রায় দশ বছর পর তার শুয়ে পড়ামাত্র ঘুম এসে গেল।
কাকের কর্কশ ডাকে নাহিদের ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখে সূর্য মাথার উপর। সে কিছুটা অবাক হল। এত কোলাহল, হইচই এর মধ্যে তার এত গভীর ঘুম হয় না। সে দোকানের দিকে গেল।
-স্যারের ঘুম তাহলে ভাংচে? দশটার দিকে দেহি আপনি মরার মত ঘুমাইতাছেন। আমি ভাবলাম মইরা গ্যালেন নাকি। আপিনার দম পরীক্ষা কইরা টের পাইলাম যে আপনে মরেন নাই।
-ধন্যবাদ ভাই।
-অহন কই যাইবেন?
-কই আর যাব? ঘুম ভাঙার পর আমার ব্যাগটাও দেখছি না, মাথার নিচে ছিল। কোন ভদ্র চোর হয়তো নিয়ে গেছে। সমস্যা হল, ব্যাগের মধ্যে আমার সব সার্টিফিকেট রয়েছে।
-ও। ন্যান। কুলি কইরা দুইখান বিস্কুট খান।
নাহিদ বিস্কুট খেয়ে হাটতে বের হল। উদ্দেশহীন হাটা। বিচিত্র শহরের মানুষের বিচিত্রতা দেখে দিনটা শেষ করল।রাতে আবার সেই পার্কে প্রত্যাবর্তন। ভদ্রলোকের দোকান থেকে ফ্রিতে রুটি, কলা বিস্কুট খেয়ে তার দিন যাচ্ছে।
রাত ১২ টা। বেঞ্চে বসে দিনের প্রথম ও শেষ সিগারেট টানছে। ভিক্ষা বা করুণা দিয়ে ক্ষুধা মেটানো যায়, নেশা করা যায় না। তাই সারাদিনে সে সিগারেট খায় না।
-কার জন্য অপেক্ষা করেন?
এক অপরিচিতার কন্ঠে অদ্ভুত প্রশ্ন।
-কে আপনি?
-রুপা। ইংরেজীতে বলে সিলভার। কিন্তু আমি ডায়মন্ডের চেয়েও দামী।
-আমার কাছে কি এত রাতে?
-আপনাদের মত যুবকদের কাছে রাতে আসাটাই তো আমার কাজ।
-মানে কি?
-কল গার্ল বুঝেন?
নাহিদ নিশ্চুপ হয়ে গেল। এমন প্রশ্নে বাংলা সিনেমার নায়কদের মত “what?” বলে চিৎকার করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে তা করল না।
-দেখুন, মিস সিলভার। সরি, রুপা। রুপা। আপনি ভুল যায়গা টার্গেট করেছেন। আমি ইচ্ছুক নই। আর থাকলেও সম্ভব হত না। আমার কাছে টাকা পয়সা নেই।
- আপনি ফকির নাকি? চেহারা দেখে তো মনে হয় না।
-চেহারায় মানুষের কিছুই বুঝা যায় না। আপনার চেহারা দেখে মনে হয় আপনি নিষ্পাপ। কিন্তু আপনি নিষ্পাপ নন।
কথা শুনে রুপা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, আমি নিষ্পাপ। আমি নিষ্পাপ।
নাহিদ কিছু বুঝে উঠার আগেই রুপা চলে গেল। হয়তো কোন যুবকের কাছে রাত্রি যাপন করবে। নয়তো বাসায় গিয়ে কেঁদে বালিশ ভেজাবে। নাহিদ বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আজ সে দোকানে গেল না। পার্কের বাইরে ফুটপাতে এক লোক বই বিক্রি করছে। একটা বইয়ের দিকে তার দৃষ্টি আটকে গেল। বইয়ের নাম "ধনী হওয়ার সহজ উপায়" আগ্রহ নিয়ে বইটা দেখল সে।
-এই বইটার দাম কত?
-পঞ্চাশ টাকা।
-মাত্র পঞ্চাশ টাকায় ধনী হওয়া যায়?
-বইয়ে যখন লেখা আছে তাহলে তো যায়।
-আপনি বইটা পড়েছেন?
-আমি বই বিক্রি করি, পড়ি না।
-পড়বেন। তাহলে আপনাকে আর ফুটপাতে বই বিক্রি করতে হবে না।
-আপনি বই কিনবেন? না কিনলে ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ করেন।
নাহিদ চলে গেল। সন্ধ্যায় পার্কে ফিরে এসে দোকানদার লোকটাকে বলল, ভাই একটা ওষুধ কিনব। দুইটা টাকা দেন।
দোকানদার তাকে দশ টাকা দিল। সে একটা ওষুধের দোকান থেকে দুইটা সিডিল কিনে খেয়ে নিল। বাকি আট টাকা দিয়ে আধা কাপ চা আর একটা সিগারেট খেয়ে শুয়ে পড়ল। আজ তার আগে আগে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। নাহিদ মাগরিবের আজানের সাথে সাথে শুয়ে পড়ল।
রাত ১২ টার দিকে নাহিদের ঘুম ভেঙে গেল একটা রোমান্টিক স্বপ্ন দেখে। রুপাকে সে বিয়ে করেছে। রুপার কোলে মাথা রেখে সে শুয়ে আছে। আর রুপা তাকে গান শুনাচ্ছে, "তুমি আমায় করতে সুখী জীবনে অনেক বেদনা সয়েছ.......
ঘুম ভাঙতেই সে পাশে রুপাকে দেখল। সে গান গাচ্ছে, "আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো..... নাহিদ উঠে বসল।
-আপনি কি একটু আগে "তুমি আমায় করতে সুখী জীবনে .... " এই গানটা গেয়েছেন?
-হ্যাঁ। আপনি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান শুনছিলেন?
নাহিদ তাকে স্বপ্নের কথা বলতে গিয়েও বলল না।
-হ্যাঁ, ঘুমের ঘোরেই শুনছিলাম। আপনি কখন এলেন?
-ঘন্টাখানিক হল। এই নেন?
-কী?
-টাকা।
-আমি আপনার টাকা নিব। যদি না নিই তাহলে ভাববেন যে আমি হয়তো আপনাকে ঘৃণার চোখে দেখছি। আমি এখন হাটতে বের হব।
-আমি কি আপনার সাথে আসতে পারি?
-পারেন।
দুজন একসাথে হাটছে। কেউ কোন কথা বলছে না। একটা দোকান থেকে সিগারেট আর একটা জুস কিনল রুপা। নেন, সিগারেট খান। নাহিদ সিগারেট নিল।
-আপনি থাকেন কোথায়?
-নিষিদ্ধ এলাকায়।
-ও।
আবারও নিশ্চুপ।
একটা গাড়ি এসে পাশে ব্রেক করল। আপনি একটু সামনে যান। আমি একটু কথা বলে আসি।
কিছুক্ষণ পর রুপা আসল। সরি, আপনার সাথে হাটতে পারলাম না।মালদার পার্টি পেয়ে গেছি। দুহাজার দিতে চেয়েছে।
রুপা চলে গেল। নাহিদ বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। তার ব্যথা পাওয়া উচিৎ না। তবুও ব্যথা করছে।
পরদিন সন্ধ্যা থেকে নাহিদ পার্কে বসে থাকল রুপার অপেক্ষায়। কিন্তু রুপা এল না। তার ঠিকানাও জানে না যে তাকে খুঁজে বের করবে। তৃতীয় দিন রাত দশটার দিকে রুপা আসল হাতে একটা টিফিন বক্স নিয়ে। নাহিদ তাকে এই তিন দিন না আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।কারণ সে প্রশ্নের উত্তর হবে হয়তো কোন মালদার পার্টি তাকে নিয়ে গিয়েছিল। এটা শুনতে তার ভাল লাগবে না। রুপা নাহিদের দিকে টিফিন বক্স এগিয়ে দিল। ভুনাখিচুড়ি, নাহিদের খুবই প্রিয় খাবার। নাহিদ খুব মজা করে খাচ্ছেব আর রুপা দেখছে। খাওয়া শেষে রুপা তাকে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট দিল। সিগারেটের সাথে একটা লাইটার। সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে নাহিদ বলল,
-আমার প্রতি আপনার এ করুণা কেন?
-জানি না।
আর কেউ কোন কথা বলল না। রুপা উঠে চলে গেল। নাহিদের মনে হচ্ছে সে আর কোনদিন এই পার্কে আসবে না। হয়তো নাহিদ নিষিদ্ধ পল্লীর রাজপথে দুএকবার রুপাকে খুঁজবে। সেখানে রুপা থাকবে না। হয়তো কোন মালদার লোকের সাথে রাত্রি যাপন করবে। রুপা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। তার কন্ঠে শোনা যাচ্ছে, তুমি আমায় করতে সুখী জীবনে অনেক বেদনাই সয়েছ ..........