"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।" নাহিদ কাউকে ডাকে নি তার সাথে চলার জন্য তাই সে একা একা চলছে এই রাজধানীর রাজপথে। সাধারণ মানুষের এই গতানুগতিক জীবন থেকে তার ছন্নছাড়া জীবন খারাপ না। পার্কের বেঞ্চে ঘুমানো, চাচার দোকান থেকে চা, সিগারেট, নাস্তা- সব মিলিয়ে ভালই চলছে। তার কোন আয় উপার্জন না থাকলেও এই মুহূর্তে তার কাছে প্রায় আট হাজার টাকা আছে। সত্য বলতে কি, জীবনে এই প্রথম সে একান্ত নিজের করে আট হাজার টাকা পেয়েছে। দুদিন আগে দুপুরবেলা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সে রাস্তায় একটা মানিব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে। মানিব্যাগের স্বাস্থ্য ভাল থাকায় তার নজরে আসে। ওটা তুলে দেখে ওর মধ্যে পাঁচশ টাকার বিশটা নোট ও কিছু খুচরা টাকা। সে মানিব্যাগটা রাজপথে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। কারও নজরে পড়ছে না। প্রায় দশ মিনিট পর একটা লোক এগিয়ে এসে এদিকওদিক তাকিয়ে মানিব্যাগটা তুলল।
-মানিব্যাগটা কি আপনার? নাহিদ জিজ্ঞেস করল।
-না, মানে ইয়ে...
-মানে মানে করছেন কেন? আপনার কি মানিব্যাগটা দরকার?
-জ্বি হ্যাঁ।
-এটা দিয়ে কী করবেন?
-এটা খুব সুন্দর, আমার পছন্দ হয়েছে।
-তার মানে আপনার মানিব্যাগটা লাগবে, মানিব্যাগের টাকা নয়।
লোকটা চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। নাহিদ মানিব্যাগ থেকে টাকা রেখে দিয়ে মানিব্যাগটা লোকটাকে দিয়ে দিল। লোকটা হা করে নাহিদের চলে যাওয়া দেখছে।
নাহিদের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। মানুষের লোভ নিয়ে খেলা করতে ভালই লাগে। এরপর কিছু টাকা দিয়ে সে একটা পাঞ্জাবি কিনল। চাচাকে একহাজার টাকা দিল। এখন তার কাছে আছে আট হাজার তিনশো টাকা।
সুর্যের আলোর রং লাল হতে শুরু করেছে। জিয়া উদ্যানের মধ্যে একটা রাস্তা আছে তা সচরাচর ফাঁকা থাকে। নাহিদ সে রাস্তা ধরে উদ্দেশহীনভাবে হাটছে।
হিমু দা, এই হিমু দা।
কেউ একজন পিছন থেকে নাহিদকে হিমু দা বলে ডাকছে এবং তা নাহিদ বুঝতে পারছে। কিন্তু তার নাম হিমু নয়, নাহিদ।
ছেলেটি দৌড়ে এসে তাকে ধরল। হাপাতে হাপাতে বলল, সেই কখন থেকে তোমাকে ডাকছি, তুমি ফিরছই না।
ছেলেটা তাকে আপন কেউ ভেবেছে। নাহিদও তার সাথে আপনের মত ব্যাবহার করা শুরু করল।
-আরে আমি শুনতে পাই নি। তোর খবর বল। কেমন আছিস?
ছেলেটাকে হঠাত তুই করে বলাতে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেল।
-সরি ভাই, আমি ভেবেছিলাম আপনি হিমু। আপনি হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হাটছেন তো তাই আপনাকে হিমু ভেবেছি। হিমুও ঠিক এরকম।
নাহিদ তখনই খেয়াল করল তার পাঞ্জাবীর রং হলুদ আর জুতা ছিড়ে যাওয়ায় সে খালি পায়ে হাটছে।
-আমি হুমায়ুন স্যারের বিখ্যাত চরিত্র হিমু নই, আমি নাহিদ।
-আমি বাদল।
-এটা আপনার মিথ্যা নাম। আসল নাম কী?
ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কিভাবে বুঝলেন এটা আমার আসল নাম না?
-থাক, তা পরে বলা যাবে।
-আমার নাম সজীব। আপনি কী করেন? আর আপনি আমাকে তুই করে বলবেন, আমি আপনাকে তুমি বলব।
-ঠিক আছে। আমি কিছুই করি না। পার্কে থাকি আর হাটাহাটি করি। অনেকটা হিমুর মত। পার্থক্য হল,হিমু কাল্পনিক আর আমি বাস্তব।
-সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আজ রাতে জোছনা গ্রাস করব।
-তুমি কি আমাকে সাথে রাখবে?
কী ভেবে নাহিদ বলল, আচ্ছা, তুই থাকবি আমার সাথে।
এতক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
দুজনে একটা হোটেল থেকে ভাত আর মুরগির মাংস খেল। এখানে দেশী মুরগি রান্না হয়। খাওয়া শেষে পার্কে নাহিদের নির্দিষ্ট বেঞ্চে এসে বসল তারা। সজীব এর ফাঁকে নাহিদের জন্য এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট এনেছে। পরপর দুইটা সিগারেট টেনে নাহিদ বেঞ্চের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
-ভাই, আমি তোমার মাথা ম্যাসেজ করে দেই?
-দে।
সজীব নাহিদের মাথা ম্যাসেজ শুরু করতেই নাহিদ ঘুমিয়ে পড়ল। যেনতেন ঘুম নয়, একেবারে নাক ডেকে ঘুম।
রাত এগারোটার দিকে নাহিদের ঘুম ভেঙে যায়। সজীব তখনো নাহিদের মাথা ম্যাসেজ করছে।
-অনেক হয়েছে। তুই অনেক সুন্দর মাথা ম্যাসেজ করতে পারিস। আজ এই পর্যন্ত।
-ভাই, জোসনা গ্রাস করতে যাবে না?
-হুম, চল।
নাহিদ সিগারেট ধরিয়ে হাটা শুরু করল। সজীব তার পিছুপিছু হাটছে। কেউ কোন কথা বলছে না। যেন মৌনব্রত চলছে। হাটতে হাটতে তারা ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় এসে পড়েছে। একটা গলির ভিতরে ঢুকে পড়ল তারা। গলির মাথায় একটা দশতলা বিল্ডিংএর শুধু সপ্তম তলায় আলো জ্বলছে। বাকীগুলো অন্ধকার। নাহিদ সেই বিল্ডিংএর নিচে এসে দাঁড়ালো।
গেটের সাথে লাগানো কলিং বেল টিপে অপেক্ষা করতে লাগল।
-ভাই, এটা কার বাসা?
-জানি না।
তাহলে এতরাতে এখানে আসলে যে? আর কেউ এসে বকাবকি করলে কী বলবে যেহেতু তুমি চিন না?
-আগে আসুক, তারপর দেখি কী বলা যায়।
-কিছুক্ষণের মধ্যে একটা মেয়ে এসে গেট খুলল।
-আপনারা কারা? এতরাতে কী চান?
-আমরা অতি সাধারণ মানুষ। জোসনা গ্রাস করতে চাই।
-মানে?
-আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আপনাদের ছাদে গিয়ে জোসনা দেখব।
মেয়েটা বিস্মিত হল। পাগল নাকি? কিছুক্ষণ ভেবে মেয়েটা বলল, আসেন।
লিফটে আটতলা পর্যন্ত গেল। মেয়েটা বলল, আপনারা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে যান, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।
নাহিদ ও সজীব ছাদে এসে দেখল অনেক সুন্দর ও মনোরম পরিবেশ। এমন ছাদে এক বুক দুঃখ নিয়ে আসলে তা সুখে পরিণত হয়। চারটা চেয়ার ও একটা টেবিল রাখা আছে, পাশে একটা দোলনা। দোলনাটা দুলছে। মনে হচ্ছে দোল খেয়ে কেউ এইমাত্র উঠে গেছে। কিন্তু এত রাতে কারও ছাদে তথা দোলনায় থাকার কথা নয়। একটা গানে নাহিদ শুনেছিল, দোলনা একা একা দুলতে পারে না। তাকে দোলাতে হয়। এই দোলনাটা সম্ভবত গানটাকে মিথ্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
একটা ফ্লাস্ক ও তিনটা মগ নিয়ে মেয়েটা ছাদে আসল।
মেয়েটা বসতে বসতে বলল, আপনারা কি নিয়মিত একেকজনের বাসায় গিয়ে জোসনা গ্রাস করেন?
-না, কারণ নিয়মিত জোসনা হয় না। আজই প্রথম এলাম এখানে। আপনাকে বিরক্ত করতে।
-ও আচ্ছা।
-আপনাদের পরিচয় দিবেন?
-নাহিদ, পেশায় প্রবঞ্চিত যুবক, পার্কে থাকি। আর ও হল আমার নিবেদিত ছোটভাই সজীব।
-ও।
-আপনি থাকেন এখানে বুঝতে পারছি। নাম আর কী করেন বলবেন কি?
-নাম অপরাজিতা। কিন্তু একমাত্র আমার বাবা সবাই আমাকে অপি বলে ডাকে। বাবা অপরাজিতা ডাকেন। এবার বিসিএস পাশ করলাম। আর আমার বাবাকে আপনি হয়তো চিনবেন। বাবার নাম আয়নাল হাবীব।
-তিনি কে?
-নাম শুনেন নি? তিনি শিক্ষা সচিব।
- ও আচ্ছা।
-আপনি সম্ভবত চিনেন নি। না চিনলেও চলবে। তিনি এখানে থাকেন না। আমি একাই থাকি। এখানে ৩৬টা ফ্লাট আছে। একটাও ভাড়া দেই না। আমি সপ্তম তলায় একা থাকি। আচ্ছা আপনি পার্কে থাকেন কেন?
এ প্রশ্ন শুনে নাহিদের ভীষণ হাসি পেল। হাসি দমন করার জন্য সে অপির কাছে অনুমতি নিয়ে সিগারেট ধরাল। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, আপনার থাকার জন্য দশতলা একটা বিল্ডিং আছে তাই আপনি এখানে থাকেন। আর আমার থাকার জন্য পার্কটাই আছে, তাই আমি পার্কে থাকি। আপনার যদি থাকার যায়গা না থাকত তাহলে আপনিও হয়তো.....
অপিও সিগারেট ধরাল। নাহিদ অবাক হল না, কিন্তু সজীব হা করে তাকিয়ে আছে মেয়েটার সিগারেট ধরানো দেখে। তার ধরানোর স্টাইল দেখে মনে হয় সে প্রফেশনাল স্মোকার। সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, আমি যদি আপনাকে এখানে থাকতে বলি, আপনি থাকবেন?
-না।
-কেন?
-তার আগে এটা বলেন আমার প্রতি আপনার এ করুণার কারণ কী? আর আমি কারও করুণা চাই না। জীবনটাই তো প্রায় শেষ করে ফেললাম করুণায় ভর করে। যাইহোক, একটা কথা বলি, আপনার বয়স ২৯ বছর,এখনো বিয়ে করেন নি কেন?
অপি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করে জানলেন আমার বয়স ২৯?
-হলুদ পাঞ্জাবী আর খালি পায়ে হাটার জন্য আমার মধ্যে হিমুর মত গুণ তৈরি হয়েছে।
মেয়েটা এতক্ষণে খেয়াল করল যে নাহিদের পায়ে জুতা নেই।
-আপনার ধারনা ভুল। কিছু বয়াব্যাপার থাকে যা একরাতের পরিচয়ের মানুষকে বলা যায় না। তবে আপনাকে বলব। আমার বিয়ে হয়েছিল। আমার হাজবেন্ড বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়।
-কিভাবে?
-সে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের একজন পাইলট ছিল।
-ও, সরি।
-ইট'স ওকে।
হঠাত করে নীরব হয়ে যাওয়ায় কেমন যেন থমথমে পরিবেশ হয়ে গেল। নীরবতা ভেঙে সজীব বলল, আপু একটা প্রশ্ন করি, আমরা যখন ছাদে আসি তখন দোলনাটা দুলছিল। এবং এখনো দুলছে। কারণটা কী?
অপির ইচ্ছা হল রহস্যটা বলে দিতে। কিন্তু কি মনে করে বলল, হাওয়ায় দুলছে।
-ও তাই বলেন, আমি ভাবলাম ভুতটুত কিছু একটা।
আবার নীরবতা শুরু হল। হঠাৎ অপি গান ধরল,
"প্রদীপ জাগিয়া রহ শিয়রে আর,
যেন বন্ধু ফিরিয়া নাহি যায়।
এখনো বনের পথ বিজন আঁধার
নিশীথের ঘনতম সায়,
যেন বন্ধু ফিরিয়া নাহি যায়।"
বিভোর হয়ে নাহিদ অপির কন্ঠে নজরুল সংগীত শুনল। এই মেয়েটার গানের গলা যে এত মধুর তা সে কল্পনাও করে নি। জোসনার আলো হঠাৎ করে বেড়ে গেল। তখনই নাহিদ খেয়াল করল, শুধু কণ্ঠ না, অপির চেহারা অনেক সুন্দর। অনেকটা অপি করিমের মত।
দূরের কোন এক মসজিদে ফজরের আজান দিচ্ছে। নাহিদ বলল, জোসনা গ্রাস আজ এই পর্যন্ত। আমরা উঠব।
-ওকে। আপনাদের কি নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হবে?
-না, আমরা পারব। একটা কথা বলি, আপনার নাম অপি না হয়ে রুপা হলে ভাল হত।
কথাটা অপির কানের পর্দায় নয়, হৃদয়ের মণিকোঠায় গিয়ে আঘাত করল। তার স্বামী মেহেদী তাকে রুপা বলেই ডাকত। খুব ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে কারও কাছ থেকে রুপা বলে ডাক শুনার। কিন্তু তাকে রুপা বলে ডাকার কেউ নাই।
নাহিদের ভুলে রেখে যাওয়া সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে অপি রেলিং এর কাছে এসে দাঁড়ালো। নিচে তাকিয়ে দেখল নাহিদ আর সজীব হেটে চলে যাচ্ছে। অপি খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কারণ নাহিদের হাটার ধরন তার হাজবেন্ড মেহেদীর মত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৫