somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা এন্ড গেম -এজেন্ট রায়ান।

২৭ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝড়ের গতিতে একটা টয়োটা এসে থামল ওয়াশিংটন ডিসির এক প্রাইভেট হাসপাতালের সামনে। গাড়ি পুরোপুরি থেমে দাঁড়ানোর আগেই প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে বেরিয়ে এল দীর্ঘদেহী এক যুবক। পাঁজাকোলা করে ভিতর থেকে নামিয়ে নিয়ে এল রক্তাক্ত এক লোককে। দীর্ঘদেহী লোকটা নিজেও কমবেশি আহত। ড্রাইভারের দরজা খুলে নেমে এল আরেক যুবক। অচেতন লোকটার সাথে চেহারায় বেশ মিল। পেছনের সিট থেকে অসম্ভব রূপবতী এক তরুণীকে নামিয়ে আনল সে। দুজনকে হাসপাতালের ভেতর নিয়ে আসা হল নার্সদের সাহায্যে। ডাক্তাররা রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাথে সাথে ওটিতে নিয়ে গেল অচেতন দুজনকে। সচেতন দুই যুবককেও ডাক্তাররা জোর করে ধরে ট্রিটমেন্ট করে দিলেন। মাথায় সেলাই লাগল অপেক্ষাকৃত কমবয়সী যুবকের। ওদিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া মানুষটার কোনও খবর ডাক্তাররা এখনও বলছেন না। চিন্তিতমুখে পায়চারী করতে লাগল অন্য দুজন। এক ফাঁকে তাদের একজন কোথায় যেন কল করতেই একহারা গড়নের ফর্মাল পোশাকের ১৫-২০জন লোক হাজির। হাসপাতালের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পজিশন নিল ওরা। হাসপাতালে নিজেদেরকে ইন্টারনাল সিকিউরিটির লোক বলে পরিচয় দিল। কর্তিপক্ষও আর ওদেরকে ঘাঁটাল না। বোঝাই যাচ্ছে আহত ব্যাক্তিরা সরকারের হোমরাচোমরা কোন লোক। এদের এই অবস্থা কি করে সেটা তাদের জানার কথা না। জানতে হলে তাদের আরও অনেক পেছনে ফিরে যেতে হবে।

দশদিন আগে,
নিউ ইয়র্কের এক ব্যস্ত পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে রায়ান। ডেট আছে ওর রিনিসের সাথে। ওদের দুজনের পছন্দের এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করার কথা। দশ মিনিট আগেই বেরিয়েছে ও, তাই দেরি হ¬¬¬¬¬বার কোন কারণ নেই। নিজের পেন্টহাউজের কাছাকছিই রেস্টুরেন্ট হওয়ায় গাড়িটা নেয়নি। হাঁটতেও বেশ ভাল লাগছে। মানুষের ভিড়ে অন্যরকম এক অনুভূতি হঠাৎ স্পর্শ করল ওকে। বহুদিনের পুরনো অনুভূতিটাকে চিনতে ভুল হল না একটুও। কেউ ফলো করছে। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলল রায়ান। তারপর হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে চলন্ত বাসে উঠে পড়ল। ব্যাস, ঝামেলা শেষ। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাসে ঢুকল রায়ান। বাসের যাত্রীদের চেহারা দেখে চমকে উঠল। সবগুলো চেহারায় সামরিক কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট। ফাঁদে পরেছে রায়ান। পেছন থেকে বাড়ি পড়ল মাথায়।
জ্ঞান ফিরার পর ককিয়ে উঠল রায়ান। মাথার পেছন দিকটা অনুভূতিহীন। রুমের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখল। কোনও ধরনের ইন্টারোগেশন রুম। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে মধ্যযুগীয় টর্চারের বিভিন্ন যন্ত্র, তলোয়ার, ছুরি, মুগুর। পেশিবহুল এক ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে ওর এক পাশে। চেনাচেনা লাগলেও মাথার মাথার আঘাতের কারনে তৎক্ষণাৎ চিনতে পারল না রায়ান। তবে ছোকরা ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় চেয়ার নিয়ে পেছনে ওর পায়ে পড়ে অ্যাটাকের প্ল্যান সাথে সাথে বাদ দিয়ে দিল। টেবিলের অপর পাশের চেয়ারে বসা মানুষটার দিকে এবার মনোযোগ দিল। দেখতে খারাপ না। কি ধরনের মানুষ সে বুঝে নিতে চেষ্টা করল রায়ান। চাকুরীজীবী, নোংরা কাজে অভ্যস্ত কিন্তু ভীতু, খাঁচার সিংহকে খোঁচাতে পারে কিন্তু মুক্ত সিংহের সামনে পড়লে প্যান্ট ভিজিয়ে দেয়। রায়ান বেশ অবাক হল এতো কাঁচা কাজ দেখে, ওর পরিচয় জানা থাকলে এর বাপদাদার জানার কথা রায়ানের জন্য এ লোক শুধুই ছেলেখেলা! মুখ খুলল লোকটা,
-তাহলে, মিঃ রায়ান, কেমন বোধ করছেন?
-সামনের শুঁয়োপোকা আর পাশের নর্দমার কথা বাদ দিলে ভালই আছি।
ধরাম করে এক পাঞ্চ ঝাড়ল বডিবিল্ডার রায়ানের ডান গালে। আবার বলল শুঁয়োপোকা,
-বুঝতেই পেরেছেন আমাদের আপ্যায়নের ধরন। এবার মুখ খুললেই ভাল করবেন।
-যা বুঝতে পারছি নাকটা তোমাদের দুর্গন্ধে ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে।
আরেকটা পাঞ্চ পড়ল গালে। শুঁয়োপোকা বলল,
-দেখুন এভাবে নিজের স্কাল আর আমার সময় দুটোই বৃথা নষ্ট করছেন আপনি। ইজেরা আপনাকে মেরেই যাবে আপনি লাইনে না আসা পর্যন্ত।
-যত খুশি তাণ্ডব করতে পারে তোমার ঐ নর্দমা। আমার কোন আপত্তি নেই।
আবার পাঞ্চ। ইজেরাকে উদ্দেশ্য করে বলল রায়ান,
-আরেকটু ডানে, ওখানেই বেশী চুলকাচ্ছে।
আবার মারল। সশব্দে দরজা খুলে গেল এই সময়। গটগট করে আলোতে এসে যে দাঁড়াল তাকে দেখে মনে মনে চমকে গেল রায়ান। সিআইএ এর কারেন্ট ডিরেক্টর।
উঠে দাঁড়াল শুঁয়োপোকা। বেকায়দায় স্যালুট করল। পাত্তা না দিয়ে বলল ডিরেক্টর ল্যানহাম,
-তোমাকে বলা হয়েছিল ওঁর উপর নজর রাখতে, ওঁকে মারতে বলা হয়নি।
চিকন ঘাম দেখা গেল শুঁয়োপোকার মুখে। চিঁচিঁ করে বলল,
-না মানে স্যার, আসলে ভাবলাম...আমি...
-আসলে ভেবেছিলে এর মুখ থেকে কথা বের করে আমাকে তেল দিয়ে প্রমোশনটা বাগিয়ে নিবে, কিন্তু তোমার মতো মাথামোটার একে চেনা না থাকলেও আমার আছে।
ঘামের ধারা মোটা হল শুঁয়োপোকার। আবার বলল ল্যানহাম,
-আর যদি তোমার এই ছেলেখেলার কারনে ইনি মুখ খুলতে রাজি না হন তাহলে তোমার চোদ্দ গুষ্টিকে আমি গায়েব করে দেব। নাউ গেট লস্ট।
ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে গেল শুঁয়োপোকা। তার জানা আছে এই লোক যা বলে তার থেকেও বেশী সে করে। ওর চোদ্দ গুষ্টিকে গায়েব করা এনার কাছে হাতের ময়লা পরিষ্কার করার মতই তুচ্ছ কাজ।
খালি চেয়ারটায় বসল ল্যানহাম। রায়ান ভাবল, বিভিন্ন মিটিঙে আগেও ওদের দেখা হয়েছে। লোকটা খুব নিচু মনের অধিকারী। ল্যানহাম বলল,
-হ্যালো রায়ান! কতদিন পরে দেখা! নাইস টু মিট ইউ।
-তোমাকে দেখে আমি তেমন খুশি হতে পারছিনা ল্যানি।
-হাউ ক্যান আই ব্লেইম ইউ!
-কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি তোমার গিফটগুলো ফেরত চাইবে এখনই।
ঘর কাঁপিয়ে হাসল ল্যানহাম। উঠে এসে রায়ানের হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দিল। সাবধানে হাতটা সামনে এনে কবজি ডলতে ডলতে বলল রায়ান,
-রিয়েলি? তুমি আমার হাতকড়া খুলে কিন্তু তোমার পিস্তল হোলস্টারে রেখে নিরাপদ বোধ করছ?
-নট রিয়েলি। আসলে আমার কাছে কোন পিস্তলই নেই। ওটা তোমার সামনে নিজের হাতে রাখলেও বেঈমানি করতে পারে, আমি জানি। তবে খেলার টেক্কাটা আমার কাছে আছে।
চোখ সরু করে তাকাল রায়ান। দুবার চুটকি বাজাল ল্যানহাম। ঘরের আবছা অন্ধকার কোনের দরজা খুলে প্রায় বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত এক বন্দিকে নিয়ে ঢুকল একজন গার্ড। লোকটাকে পাহারা দেয়ার চেয়ে বয়ে আনার কাজেই বেশী প্রয়োজন হচ্ছে গার্ডকে। দরজার ভিতর পা রাখতেই ঝট করে পিছনে মাথা ছুঁড়ে দিয়ে গার্ডের নাক ভেঙ্গে দিল বন্দি। এরপর ল্যাং মেরে ফেলে দিল তাকে। হ্যান্ডকাফ কণ্ঠনালীতে চেপে ধরতেই লাফিয়ে পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকল এক এজেন্ট। গুলি করতে উদ্যত হতেই তাকে থামাল ল্যানহাম। বলল,
-ওকে এখনই মারার দরকার নেই। ওর প্রয়োজন আছে। নিয়ে এস।
নাকভাঙ্গা গার্ড উঠে দাঁড়িয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে বন্দিকে, পেছনে পিস্তল হাতে এজেন্ট। আলোতে আসতে বন্দির চেহারা দেখে চমকে উঠল রায়ান।
-জেসন!
মুখ তুলে অসহায় হাসি দিয়ে বলল জেসন,
-সরি স্যার! ওরা অনেকে ছিল। পারলাম না।
উঠে দাঁড়াতে গেল রায়ান। এজেন্টের পিস্তলের নল ঘুরে গেল ওর দিকে। ল্যানহাম বলল,
-তোমাদের রিইউনিয়ন চ্যাট পরে করতে পারবে রায়ান। তার আগে আমি যা চাইছি তা দিয়ে দাও।
থমথমে মুখে বসে রইল রায়ান। এজেন্টের পিস্তল আবার ঘুরে গেছে জেসনের দিকে। পাশে দাঁড়ান ইজেরকে একনজর দেখে ল্যানহামকে বলল রায়ান,
-এস’১৩? এস’১৩ কে ব্যবহার করছ তুমি?
মৃদু হেসে বলল ল্যানহাম,
-তোমার স্মৃতিশক্তি বরাবরই আমাকে অবাক করে রায়ান। ঠিকই ধরেছ। ইজরায়েল সরকারের পকেট থেকেও কমবেশি খসিয়েছি তো। তাই ওরা এদের ধার দিতে কার্পণ্য করেনি, তাছাড়া তারাও ব্যাক্তিগতভাবে তোমার পিছে লেগে আছে। আরও কত টীমকে যে তোমার পেছনে লাগানো হয়েছে কল্পনাও করতে পারবে না তুমি।
-একটা কথা বল ল্যানি, তোমার এই গোপন পরিকল্পনার ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও জানে প্রেসিডেন্ট? জানলে কি হবে ভেবে দেখেছ?
মুখের চেহারা পাল্টে গেল ল্যানহামের। রায়ান বুঝতে পারল ওর আন্দাজে ছোঁড়া ঢিলটা জায়গামত লেগেছে, এটা সম্পূর্ণ সিআইএ এর আরেকটা গোপন নীল নকশা। ল্যানহাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-সেটা জানার অনেক আগেই আমার প্ল্যান সফল হয়ে যাবে রায়ান। তুমি কিছুই করতে পারবে না। পুরো পৃথিবী দখল করে নেব আমি ঐ মিসাইলগুলো দিয়ে।
-তোমার মাথায় সমস্যা আছে জানতাম, তবে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছ সেটা আজ টের পেলাম।
গর্জে উঠে টেবিলে ঘুষি মারল ল্যানহাম। টেবিলের উপরে রাখা কাগজ-কলম লাফিয়ে উঠল। বলল ল্যানহাম,
-এনাফ বুলশিট রায়ান। তুমি এখন বলবে বলবে মিসাইলগুলোর লোকেশন। নাহলে তোমার প্রিয় সহচর মিঃ স্ট্যালিয়ন মরবে।
ঠাণ্ডা স্বরে ল্যানহামকে বলল রায়ান,
-দেখ ল্যানি, যেটা করছ সেটা পাগলামি। তুমি আশা করতে পারনা যে কোন মানুষ পৃথিবীর দখল নিতে পারবে এতো খুনোখুনি করে।
-আমি দশ পর্যন্ত গুনব। এজেন্ট হবস, এরমধ্যে মিঃ রায়ান মুখ না খুললে মিঃ স্ট্যালিয়নকে আর আমাদের প্রয়োজন হবে না।
মাথা ঝাঁকাল এজেন্ট। গুণতে শুরু করল ল্যানহাম,
-১...২...৩...৪...৫...
জেসন বলল রায়ানকে স্থবির কণ্ঠে,
-স্যার, ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেবেন।
চোখের কোনে পানি দেখা গেল জেসনের, কিন্তু সেটা কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ল না। একবার আড়চোখে এজেন্টের দিকে তাকাল। জেসন কি বলছে বুঝতে সময় লাগল না রায়ানের। বেচারা ওকে বাঁচাতে নিজের জীবনটা দেয়ার কথা বলছে। একবার জেসনের চোখে চোখ রাখল রায়ান। অনেক কথা হয়ে গেল ঐ এক দৃষ্টিতে। গুনে যাচ্ছে ল্যানহাম,
-৬...৭...৮...৯...
অমানুষিক রক্ত জমিয়ে দেয়া দৃষ্টিতে তাকাল রায়ান ল্যানহামের চোখে। ঠাণ্ডা স্বরে ঘরের সবার রক্তে কাঁপুনি তুলে দিয়ে বলল,
-জীবনের সবেচেয়ে বড় ভুলটা করতে যাচ্ছ তুমি ল্যানহাম এবং নিশ্চিত থাক এটাই তোমার শেষ ভুল।
-১০।
ট্রিগার চাপল এজেন্ট। বদ্ধঘরে বিকট আওয়াজ তুলল গুলি।

রায়ানের স্বরে এমন কিছু ছিল যে ঘরের সবার চোখ আর মনোযোগ নিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ওর দিকে, একমাত্র জেসন ছাড়া। ধীরে ধীরে সে পা দুটো গুটিয়ে টেবিলের কিনারে ঠেকিয়েছে। ল্যানহাম দশ গুনতেই এজেন্ট ট্রিগার চাপার ঠিক আগ মুহূর্তে ঝাড়া দিয়ে পা দুটো সোজা করে নিয়েছে। উড়ে গিয়ে ঘরের আরেক কোণে পড়ল ও। ভয়ংকর একটা বাজি খেলেছে জেসন। জীবনটা যেতে পারত। মাটিতে পরেই ছুট লাগাল সে। জেসনের পিছু নিল এজেন্ট। রায়ান এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে কনুই চালাল পাশে দাঁড়ান ইজরায়েলি এস’১৩ এর ইজেরের গলায়। প্রচণ্ড আঘাতে হাড় ভেঙে সাথে সাথে মারা গেল ইজের। লাফিয়ে উঠে পাশের দেয়াল থেকে একটা তলোয়ার নামিয়ে নিল ল্যানহাম। বাতাস কেটে রায়ানের ডানদিক দিয়ে সাঁই করে তলোয়ার চালাল। সতর্ক ছিল রায়ান। সরে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারল ওকে আহত করতে চাইছে ল্যানহাম। একের পর এক আঘাত এড়াতে লাগল রায়ান, সেই ফাঁকে খুঁজতে লাগল ল্যানহামের তলোয়ারের বিপরীতে ব্যবহার করা যায় এমন একটা অস্ত্র। কিন্তু কিছুই পাচ্ছে না। এক সুযোগ পেয়ে দেয়াল থেকে একটা ছুরি তুলে নিল। কিন্তু তলোয়ারের কাছে সেটা ছেলেখেলা। একের পর এক হামলা ঠেকাতে ঠেকাতে পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে না রায়ান। হঠাৎ ঘরের দূরপ্রান্তে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। জেসনকে পেয়ে গেছে এজেন্ট। ওর দিকে পিস্তল তাক করেছে সে। ছুরিটা ডান হাতে নিয়ে ঝাকি দিয়ে ছুঁড়ে দিল রায়ান। ফলাটা ঘ্যাঁচ করে এজেন্টের মাথায় ঢুকার আগেই একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। সিআইএ এজেন্ট পরে গেল। স্বস্তির শ্বাস ফেলল রায়ান, কিন্তু পরমুহূর্তে টলে উঠে পড়ে গেল জেসন।
রায়ানের বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল। জ্বলে উঠল প্রতিশোধের আগুন। রায়ানের চোখে সেই আগুন দেখে ভড়কে গেল ল্যানহামের মতো উন্মাদও। মিসাইলের ঠিকানার আশা বাদ দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে একের পর এক মরন আঘাত হানার চেষ্টা করতে লাগল সে। কিন্তু রায়ান যেন ঘূর্ণি বাতাস, টর্নেডোতে পরিনত হয়েছে। কোন আঘাতই স্পর্শ করতে পারছে না ওকে। হঠাৎ বিদ্যুতের গতিতে শেষ চেষ্টা হিসেবে নিরস্ত্র রায়ানের উপর ঝাপিয়ে পড়ে একের পর এক কোপ বসাতে গেল ল্যানহাম। আঘাতের প্রচণ্ডতায় পেছনে যেতে গিয়ে চেয়ারে পা বেঁধে হাত-পা ছড়িয়ে টেবিলের উপর পড়ল রায়ান। হাতে ঠেকল একটা কলম। ওদিকে রায়ানকে বাগে পেয়ে রায়ানের মাথা লক্ষ করে খোঁচা দেয়ার ভঙ্গিতে তলোয়ার সোজা করে ধরে রেখে লাফিয়ে পড়ল ল্যানহাম। শেষ মুহূর্তে একটু সরে যাওয়ায় রায়ানের কাঁধে গভীর গর্ত সৃষ্টি করে টেবিলের কাঠে গেঁথে গেল তলোয়ার। রায়ানের উপর পড়ল ল্যানহাম। সময় নষ্ট না করে চোখের পলকে হাতে ধরা কলমটা ল্যানহামের চোখের সামনে তুলল রায়ান। শিরশিরে কণ্ঠে বলল,
-ইগনেম ফেরাম।
পরমুহূর্তে রায়ান আমূল গেঁথে দিল কলমটা ল্যানহামের চোখে। মারা গেল সিআইএ ডিরেক্টর।

আহত কাঁধ চেপে ধরে নিজের সবচেয়ে পুরনো সহকারীর লাশের কাছে ফিরল রায়ান। হাঁটু ভেঙে বসে মাথাটা কোলে তুলে নিল। চমকে উঠল ও। বেঁচে আছে জেসন! চোখ মেলল জেসন। বলল,
-ইগনেম ফেরাম মানে কি স্যার?
মৃদু হাসল রায়ান। বলল,
-আই ফর এন আই।
ধীরে ধীরে রায়ানের সাহায্যে উঠে দাঁড়াল জেসন। সিআইএ জেসনের শার্টের ভেতরের স্মার্টস্লিম বুলেটপ্রুফ ভেস্ট এর কথা জানত না। এই ভেস্টের আবিস্কারের পর পরীক্ষা করছিল ব্ল্যাক ফাইটারর্সের টেকনিশিয়ানরা। রায়ানও জানত না জিনিসটা জেসন ব্যবহার করে। তাই জেসন মারা গেছে ভেবেছে। ল্যানহামের লাশটা দেখল জেসন। বলল,
-আ পেন ইজ অলওয়েজ মাইটিয়ার দ্যান আ সোর্ড।
কিছু না বলে মুচকি হাসল রায়ান। ল্যানহামের ফোন ব্যবহার করে একটা কল করতেই বেশ কিছু এজেন্ট এসে সিআইএ এর ঐ সেফ হাউজে হামলা করে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে গেল।

পরদিন ভোর,
নিজের পেন্টহাউজের বিশাল ব্যালকনির এককোণে ইজি চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছে স্নো। হঠাৎ বেজে উঠল ওর ফোন। রিঙের কোন জবাব না পেয়ে ওপাশ থেকে আনসারিং মেশিনে মেসেজ দিল একজন,
-মিঃ স্নো, আপনার জন্য একটা টার্গেট আছে। যতদ্রুত সম্ভব আপনাকে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হল। ইটস আর্জেন্ট।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্নো। সব কথার শেষে ইটস আর্জেন্ট বলা স্বভাব হয়েছে ওর সেক্রেটারি তারিনের। হাজারবার বারণ করলেও শোনেনা। কফিটা শেষ করে উঠে পড়ল। অলস সময় কাটানোর পালা শেষ।

পেন্টহাউজ থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নামল স্নো। ইচ্ছে করেই গাড়ি না নিয়ে পায়ে হেঁটে চলেছে। ভোরের হাওয়া আর প্রথম সূর্যের আলো ওর খুব পছন্দ। পরনের পার্কার হুড তুলে দিয়ে কুয়াশার মাঝে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেল ওর অফিসে। একটা এভিয়েশন কোম্পানির মালিক ও। কোম্পানি দেখাশোনার কাজ ওর লোকেরাই করে। তবে তাদের কেউই জানেনা তাদের বসের আসল কাজ কি, কেন তিনি নিজে কোম্পানির দেখাশোনা করেন না। লিফটে উঠে সোজা নিজের অফিসে চলে এল স্নো। ওর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল তারিন। একটা ব্রিফকেস তুলে দিল স্নোর হাতে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল। ব্রিফকেসের কাগজগুলোয় নজর বুলাল। এরপর পিছনের বড় ভিডিও স্ক্রিন ওপেন করতেই ফুটে উঠল ভয়ানক প্রভাবশালী এক লোকের চেহারা। সংক্ষেপে কথা সারল সে,
-মিস্টার স্নো, আপনার কাজে প্রতিবার মুগ্ধ হয়েছি আমরা। তাই আবারও আরেকটি কাজে আপনার সাহায্য চাই। আপনার একাউন্টে পেমেন্ট আমরা করে দিয়েছি। টার্গেটের বিস্তারিত আপনার সেক্রেটারিকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এই টার্গেট খুবই ধূর্ত, বিপদজনক। আশা করব আপনি আমাদের ব্যর্থ করবেন না।
-আমার কাছে সব টার্গেটই সমান মিঃ হার্ড, গুডবাই।
মনিটর থেকে অদৃশ্য হল সিআইএ এর পূর্বের ভাইস ডিরেক্টর এবং বর্তমান ডিরেক্টর লরেন্স হার্ড। নিজের ব্যক্তিগত কম্পিউটার ওপেন করে টার্গেটের ডিটেইলে মনোযোগ দিল স্নো। আনমনেই বলল,
-নামটা ভালই। রায়ান, এজেন্ট সৌরভ রায়ান।
ঠোঁটে ফুটে উঠল ক্রুর হাসি। হঠাৎ স্ক্রিনে আবার উদয় হল লরেন্স হার্ড। স্নো জিগ্যেস করল,
-কিছু বলতে ভুলে গিয়েছিলেন মিঃ হার্ড?
খুক খুক করে কেশে নিয়ে বলল হার্ড,
-একটা শর্ত আছে এবার আমাদের।
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল স্নো,
-সেটা কি?


ফিনিক্স সিকিউরিটিজ এর হেড অফিস, সিটি সেন্টার, মতিঝিল, ঢাকা।
কনফারেন্স রুমে উপস্থিত রয়েছে ফেলিক্স হুয়েরা, আনিস আহমেদ, শায়খ রায়ান, জেসন স্ট্যালিয়ন এবং এজেন্ট সৌরভ রায়ান। ফেলিক্সই প্রথমে মুখ খুলল,
-যেটা ঘটেছে সেটা আবারও ঘটতে পারে কর্নেল, এরপরের বার যে প্রানে বেঁচে আসবে দুজনে সেটা নাও ঘটতে পারে।
শায়খ বলল,
-আমাদের ভাল একটা প্ল্যান এবং মুক্ত বাতাস দরকার। লেজে এস ১৩ নিয়ে ঘোরা তোমাদের কাছে কমফোর্টেবল লাগলেও আমার লাগছে না।
আনিস বলল,
-ওরা অনবরত আমাদের আন্ডারে থাকা বিভিন্ন ফ্যাসিলিটিতে হানা দিচ্ছে। এভাবে একটার পর একটা অ্যাটাক আমরা হজম করতে পারব না।
জেসন বলল,
-হয় আমাদের অল আউট অ্যাসল্ট এ যেতে হবে, নয়ত জাতিসংঘের হাতে তুলে দিতে হবে মিসাইলগুলো। তবে আমার মনে হয় না ইউএন কিংবা আমেরিকার হাতে মিসাইল তুলে দেয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে।
সবাই যার যার দৃষ্টিতে একের পর এক সমস্যা ও সমাধানের কথা বলছে, তবে সবার সমাধানই এসে আটকে যাচ্ছে যুদ্ধ অথবা মধ্যস্থতায়। রায়ান কিছুই বলছে না। ব্যাপারটা লক্ষ করে কিছুটা ঝাঁজের স্বরেই বলল শায়খ,
-ভাইয়া, কিছু বল। এভাবে স্ট্যাচু হয়ে বসে আছিস কেন?
-হুম?
এমনভাবে বলল রায়ান যেন মাত্র আকাশ থেকে পড়েছে। সবাই ওর ভাব দেখে রেগে যাচ্ছে দেখে হাসল। বলল,
-আমি আসলে অন্য একটা পথে ভাবছিলাম। প্রথম থেকে পরিস্থিতিটা দেখা যাক,
ইজরায়েল থেকে আমরা সিআইএ-র যে নিউক্লিয়ার মিসাইলগুলো দখল করেছি সেটা সিআইএ খুব ভালভাবে নেয়নি। ইজরায়েলি ইন্টেলিজেন্সও আমাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে ওদের সিক্রেট অপস টীম এস১৩। এখন তারা না পারছে আমাদের সরাসরি আক্রমন করতে না পারছে আমাদের খুঁজে বের করতে। পিছনে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দুটো টীম নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না, কথাটা ঠিক।
একটু থেমে আবার বলল রায়ান,
-পুরনো সিআইএ ডিরেক্টর ল্যানহামকে খালাস করে দেয়ার পর নতুন যেই চেয়ারে বসুক না কেন তার প্রথম কাজ আমাদের মাথাগুলো তার দেয়ালে ট্রফি হিসেবে ঝোলানো। তার আগে অবশ্য মিসাইলগুলোর ঠিকানা বের করে নেবে যেভাবেই হোক।
এখন আমার প্ল্যান শুনো। তারপর কোন সমস্যা থাকলে বল। ইজরায়েলে সিআইএ একটা ভুল করেছিল। ওরা সব মিসাইল এক জায়গায় রেখেছিল। তাই আমাদের একবারে আক্রমন করে দখল করা সমস্যা হয়নি। আমরা মিসাইলগুলো দুভাগ করে নিয়েছি। এর থেকে আমরা একটা প্লাস পয়েন্ট পাচ্ছি। আমরা আমাদের দু জায়গার লোকেশন ওদের হাতে তুলে দেব।
সবার চেহারা দেখে মনে হল ওরা রায়ানের মানসিক স্থিরতা নিয়ে চিন্তিত। আবার বলল রায়ান,
-আমরা ওদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে নামতে পারব না। ব্যাপারটা প্রেসিডেন্টের কাছে গোপন রাখার স্বার্থে ওরাও তা করতে পারছে না। তাই আমরা আমাদের মিসাইল ফ্যাসিলিটি দুটোর লোকেশন ওদের হাতে তুলে দেব। কারণ আমাদের সময় দরকার। আমি এর সমাধান ভেবে রেখেছি কিন্তু তার জন্য দরকার সময়। ওরা হামলা করতে আসতে বাধ্য, আর আমরাও প্রস্তুত থাকব। প্রয়োজনে এস১৩ এর নাম নিশান মুছে দেব পৃথিবী থেকে। প্ল্যান ঠিক আছে? এর বিকল্প কারও জানা থাকলে বল।
ফেলিক্স বলল,
-শুনতে তো ভালই লাগল, এর থেকে ভাল কিছু হতে পারে না বোধহয়। তোমার মেইন প্ল্যান সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছ না সেটাও বুঝলাম। কিন্তু ওরা কেন আমাদের কথা বিশ্বাস করবে? আমরা যদি গিয়ে ওদের হেডকে বলি, “হ্যালো স্যার, আমি পিংপং, কর্নেল রায়ানের অন্যতম সহচর। আমাদের মিসাইল ঘাঁটি এই এই জায়গায় আছে। কেউ নাই সেখানে, আপনি এসে চা খেয়ে যাবেন, কেমন?” ওরা বিশ্বাস করবে?
হাসল রায়ান। বলল,
-বিশ্বাস করবে যদি তুমি না বলে কথাটা ওদের ইনফরমার বলে।
-ওদের চর পাচ্ছ কোথায় তুমি?
ইন্টারকম তুলে কাকে যেন নিচু গলায় নির্দেশ দিল রায়ান। পাঁচ মিনিটের মাথায় দুজন এজেন্ট এজেন্সির এক ডেস্ক অফিসারকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বেচারা বেশ অবাক হয়েছে। এজেন্ট দুজন রায়ানের ইংগিতে বেড়িয়ে গেল। হোলস্টার থেকে নিজের এফএন৫৭ বের করে সেফটি ক্যাচ অফ করল রায়ান। ডেস্ক অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-এটার বেশ গ্লোরিয়াস একটা অতীত আছে শেলডন। বেঈমানদের আমার মতো এটাও দেখতে পারেনা।
ঘামতে শুরু করেছে অফিসার। আবার বলল রায়ান,
-একটা ভাল কারণ দেখাও যারজন্য আমি তোমাকে এখনই গুলি করব না।
-ইয়ে মানে...স্য-স্যার আ-অ্যাম-আমি...
তোতলাতে থাকল শেলডন। পিস্তলের বোল্ট টানল রায়ান। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। রায়ান বলল,
-তুমি ইজরায়েলি ইন্টেলিজেন্সের চর জেনেও আমি তোমার পরিবারের কথা ভেবে তোমাকে এখন একটা সুযোগ দিচ্ছি। তোমাকে আমার একটা ছোট্ট কাজ করতে হবে। তোমাকে আমাদের মিসাইল ফ্যাসিলিটির ঠিকানা দেব আমি। তুমি সেসব তুলে দেবে তোমার বসদের হাতে। এরপর লম্বা একটা ছুটিতে বউবাচ্চা নিয়ে চলে যাবে। তবে সেই ছুটি থেকে যেন আর কোনদিন তোমাকে ফিরতে দেখা না যায়।
-কিন্তু স্যার...
-কোন কিন্তু না। তোমাকে যা বলা হয়েছে তাই করবে। তোমাকে সঠিক ঠিকানাই দেয়া হচ্ছে সুতরাং তোমার বসদের তোমার বিশ্বাস করাতে সমস্যা হবে না। এই কাজ করার পর তোমার যেখানে খুশি যেতে পার। তবে এই রুমে এখন যে কথা হল তার বিন্দুমাত্রও যদি তাদের কানে যায় তাহলে জেনে রাখ, আমার হাত থেকে কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারে। তোমার ডেস্কে কি করতে হবে তা লিখিতভাবে এবং প্রমাণসহ একটা ফাইল রাখা আছে। নাউ গেট লস্ট...
ছুটে বেড়িয়ে গেল শেলডন। ফেলিক্সকে বলল রায়ান,
-খেলা শুরু। তোমার প্রশ্নের জবাব আশা করি পেয়েছ। আজ রাতের মধ্যেই আমাদের রায়ট টিমের সবাইকে নিয়ে তুমি আর শায়খ আমাদের এক নাম্বার মিসাইল ফ্যাসিলিটিতে চলে যাও। দু নম্বরে আমি আর জেসন যাব।
-তোমাদের টীম?
-ওটা আমার উপরই ছেড়ে দাও। পুরনো এক বন্ধুর সাহায্য নেয়া যাবে।
রহস্যময় হাসি হাসল রায়ান। সবাই বেড়িয়ে গেলেও আনিসকে থামাল রায়ান। বলল,
-তোমারও কিন্তু কাজ আছে আনিস। সত্যি বলতে তোমার কাজটাই প্রধান। বাকিরা, মানে আমরা কেবলই দাবার বোর্ডের সৈন্য।
অবাক স্বরে বলল আনিস,
-আমার কি কাজ সৌরভ ভাই? আমি তো আর এজেন্ট নই, সেরকম ট্রেনিংও আমার নেই।
-তা নেই, তবে লড়াইয়ের সবচেয়ে প্রাচীন জিনিসটা তোমার আছে, বুদ্ধি। আরও আছে আধুনিক যুগের অন্যতম হাতিয়ার, সাইন্স।
-কি করতে হবে আমাকে?
-তোমাকে একজন হাই সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের অধিকারী যুবতীকে জন্ম দিতে হবে সাতদিনের মধ্যে।
আনিসকে আঁতকে উঠতে দেখে হেসে বলল রায়ান,
-মানে একটা নতুন প্রোফাইল তৈরি করতে হবে, কার জন্য সেটা সেই তোমাকে জানাবে। তবে মাথায় রেখ তাকে এই যুগের সর্বচ্চ সিকিউরিটি সিস্টেম পাস করতে হবে প্রতিদিনে, কয়েকবার এই প্রোফাইলের সাহায্যে। কাজটা এতো সহজ হবে না, কিন্তু তোমার উপর আমার ভরসা আছে।
-আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আই নো মাই ওয়ার্ক।
-ওকে। তুমি তাহলে এই ঠিকানায় গিয়ে দেখা করো তার সাথে। আমি যাই। শীঘ্রই দেখা হবে আশা করি।


মিশরের মরুভূমির পরিত্যাক্ত এক এয়ারফিল্ড। ফিনিক্সের সেকেন্ড নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি। বন্ধুরাষ্ট্র মিশরে অনেক আগে থেকেই এ জায়গাটা ইমারজেন্সির জন্য রেডি করে রেখেছিল রায়ান। এখানে কেউ হামলা করলে প্রয়োজনে ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করে নিকটস্থ মিশরীয় সেনাবাহিনির সাহায্য পাওয়া যাবে। দুইদিন আগে রায়ট টীম নিয়ে ফ্যাসিলিটির মিশরীয় কমান্ডারের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে ফেলিক্স আর শায়খ। দুইদিন বিপদের টিকিটিও দেখা যায়নি। কিন্তু বিপদ যে আসছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সবাই। সবাই পোড় খাওয়া যোদ্ধা। এই অনুভূতি এদের চিরচেনা। এয়ারফিল্ডের গ্রাউন্ড লেভেলের অনেক নিচে নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি বানানো হয়েছে। অনেকটা এরিয়া ৫১ এর মতো করে। তাই সারফেসের ভয়াবহ যুদ্ধেও নিচে মিসাইলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নগণ্য। সাধারণ সতর্কতা আরও বাড়িয়ে রুটিনমাফিক কাজ করে গেছে ওরা। রায়ানের দেয়া চিঠি নিয়ে শহরের আর্মি চিফের সাথে কথা বলেছে ফেলিক্স। তিনি পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। রায়ানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই বৃদ্ধের। ফ্যাসিলিটিতে নিজেদের চারটা স্পেশাল টীম গঠন করা হয়েছে। নেহাদ-রিয়াদ ব্যকআপ টীম, রেমার-এন্ডারসন অ্যাসল্ট টীম, এনায়েদ-রিচার্ড ট্র্যাপ টীম, ফেলিক্স-শায়খ ফরওয়ার্ড টীম। পালা করে নিজেদের জায়গায় পাহারা দিচ্ছে ওরা। যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। অবশেষে তৃতীয়দিন সন্ধায় হাজির হল এস১৩। এক সাথে ৭টা সিগন্যাল বিপবিপ করতে লাগল রেইডারে। কিছু বোঝার আগেই কেঁপে উঠল এয়ারফিল্ড ভয়াবহ বিস্ফোরণে। প্রায় একই সাথে মিসাইলগুলো আঘাত করায় আলাদা করে বোঝা গেল না শব্দ শুনে। দশটা মেশিনগান পোস্টের মধ্যে সাতটাই উড়ে গেছে বিস্ফোরণে। গ্রাউন্ড টু গ্রাউন্ড মিসাইল ছিল। সেকেন্ড মিসাইল বৃষ্টি এয়ারফিল্ড ঘিরে রাখা দেয়ালের অনেকটাই উধাও করে দিল। নিজেদের পজিশনে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে ফরওয়ার্ড টীম। দেয়ালের ভাঙা ফোঁকর দিয়ে হাজির হল এস১৩ এর কমান্ডো টীম। একসাথে গর্জে উঠল দুই পক্ষের বন্দুক। খোলা জায়গায় থাকায় এস১৩ এর কমান্ডোদের অনেকেই গুলি খেয়ে পরে গেল। বাকিরা সুবিধেমত পজিশন নিয়ে ফেলেছে। তাদের কাভারিং ফায়ারে মাথা তোলাই কঠিন হয়ে গেল ওদের জন্য। সেই সুযোগে আরও ইজরায়েলি ঢুকে পড়ল ভেতরে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল ফরোয়ার্ড টীমের দিকে। ওদের গুলির তোড়ে মাথা নামিয়ে আড়াল নিয়েছে ফরোয়ার্ড টীম। ইতিমধ্যে বাকি তিনটে মেশিনগান পোস্টের দখল নিয়ে নিয়েছে এস১৩। শায়খের দিকে চাইল ফেলিক্স। শায়খ একবার মাথা উঠিয়ে পরিস্থিতি দেখে নিয়েই মাথা ঝাঁকাল। ওয়াকিটকি-তে চেঁচাল ফেলিক্স,
-অল টীম মুভ ইন, নাউ।
এয়ারফিল্ডের ফার্স্ট রানওয়ের অপর পাশের হ্যাঙ্গারগুলোর আড়ালে লুকিয়েছে ফরোয়ার্ড টীম। রানওয়ের মাঝামাঝি ওরা আসতেই লুকিয়ে থাকা বাকি তিন টীম তিনদিক থেকে আক্রমন করল ওদের। ফরোয়ার্ড টীমও আবার গুলি শুরু করল। পরিস্থিতি সামলাতে স্মোক গ্রেনেড ফাটাল ইজরায়েলি কমান্ডোরা। মরুভূমির উদ্যম হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল ধোঁয়া। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এল ইজরায়েলি টীম। বিপদ কেটে গেছে মনে করে বেড়িয়ে আসতে গেল গেল ওরা কিন্তু ওদের কানে ধরা পড়ল আরেক শব্দ। রোটরের আওয়াজ। দূরে দেখা গেল তিনটে ইজরায়েলি গানশিপ। সেখান থেকে সবার নজর সরাল ভয়াবহ শব্দ। বিকট শব্দ করে এয়ারফিল্ডের দেয়াল ভেঙে ঢুকল ট্যাঙ্ক। জিনিসটা যে ইজরায়েলি সেটা তাদের পিছুপিছু পিঁপড়ের পালের মতো ঢোকা আরও এস১৩ কমান্ডোদের দেখলেই বোঝা যায়। সবাই আবার দ্রুত কাভার নিল। তবে নতুন আক্রমনের বিরুদ্ধে যে নিজেদের চেষ্টায় টিকতে পারবে না সেটা ভাল করেই জানে সবাই। ফেলিক্স মোটামুটি ঘাবড়ে গেল। রেডিওম্যানের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বলল,
-আর্মি বেসের সাথে কন্টাক্ট করো, এখনই।
কিছুক্ষণ রেডিও নিয়ে বিফল চেষ্টা করে বলল রেডিওম্যান,
-যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সম্ভবত ইজ্রায়েলিরা নেটওয়ার্ক জ্যামার ইউজ করছে।
-শিট!
গাল দিয়ে উঠল ফেলিক্স। সামান্য দূরে দাঁড়ানো শায়খও ওদের কথা শুনতে পেল। বিরতিহীন গুলি ছুটে আসছে অপর পক্ষ থেকে। হঠাৎ এই গুলিবৃষ্টির মাঝে দিয়ে কভার ফেলে ছুট লাগাল ফ্যাসিলিটির মিশরীয় কমান্ডার আহসান। ওর পাগলামির কোন কারণ বুঝতে পারল না কেউ। বুলেট বৃষ্টি এড়িয়ে প্রায় ওদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা বুলেট ঘ্যাঁচ করে বিঁধল ওর বাম কাঁধে। পরে গেল সে খোলা জায়গায়। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে তাকে টেনে দেয়ালের আড়ালে নিয়ে এল শায়খ। জখম পরিক্ষা করে দেখা গেল একটুর জন্য হার্টে লাগেনি। বিড়বিড় করে কি যেন বলল সে। শোনার জন্য তার মুখের কাছে কান নিয়ে গেল শায়খ। আহসান বলছে,
-মিশরীয় পাইলট......পরশুদিন......ল্যান্ড করেছে...প্লেন রেখে গেছে...তেলের লাইনে সমস্যা...আজ ইঞ্জিনিয়ার এসে ঠিক করেছে...পাইলট কাল আসবে...এফ ৩৬...লোডেড...হ্যাঙ্গার ৫।
মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল শায়খের। রায়ান বারবার করে ওকে পাইলট কোর্স করতে বললেও আমলে নেয়নি শায়খ, কোন না কোন ছুতোয় ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করল এবার বেঁচে ফিরলেই কোর্স করবে আগে। তবে তার আগে বাঁচতে হবে। ফেলিক্স জানতে চাইল কি হয়েছে। শায়খ বলল,
-একটা মিশরীয় এয়ার ফোর্সের এফ৩৬ আছে হ্যাঙ্গার ৫ এ। কিন্তু আমি চালাতে জানিনা!
দপ করে আশার আলো জ্বলে উঠল ফেলিক্সের চোখে। বলল,
-মাই ডিয়ার রায়ান দ্যা জুনিয়র, ও জিনিস আমার দ্বারা চালানো সম্ভব।
-সিরিয়াসলি?
-অফকোর্স।
-আমরা কাভার দিচ্ছি। দৌড়াও।
সঙ্গীদের চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল শায়খ। সাথে সাথে কাভারিং ফায়ার শুরু করল ওরা। এঁকেবেঁকে দৌড়াল এবার ফেলিক্স। রানওয়ে পেরিয়ে এক সময় সেঁধিয়ে গেল হ্যাঙ্গার ফাইভের ভেতর। ফাইটার প্লেনটা দেখে শীষ দিল মনের অজান্তেই। বিমানটা এফ ৩৬ নয়, এটা এফ ৩৫। দুটোর অনেক তফাৎ আছে। বহু বছর এই জিনিসের ককপিটে বসা হয় না। আরেকটা ব্যাপারে অবাক হল ফেলিক্স, এফ ৩৫ ইউএস এখনও টেস্ট আর ট্রেনিং-এ ইউজ করছে। মিশর কিভাবে পেল এই জিনিস! তবে সেসব ভেবে এখন নষ্ট করার মতো সময় নেই। দ্রুত কিছু চেক সেরে উঠে পড়ল ককপিটে। একেএকে বিভিন্ন বাটন, লিভার টেনে পাঁচ মিনিটের মাথায় প্রস্তুত করে নিল বিমানটাকে। ভারটিক্যাল টেকঅফ করা যায় এ বিমানে। বাহিরে বের হয়ে সরাসরি মাথার উপর দুটো গানশিপ দেখে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে রানওয়ে ধরে ছুটল। মাটির মায়া ত্যাগ করতে না করতেই ওয়ার্নিং বাজতে শুরু করল। গানশিপ থেকে মিসাইল ফায়ার করা হয়েছে দুটো। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল বিমান নিয়ে ফেলিক্স। দেখতে দেখতে দুরের পাহাড়সারি পার হল। পেছনে লেগেই আছে মিসাইলদুটো। ক্রমেই দূরত্ব কমছে। হিটসিকার মিসাইল। ফ্লেয়ারস ছুঁড়ল ফেলিক্স বাটনটা খুঁজে পেতেই। মিসাইল আরও কাছিয়ে এসেছে।

মিসাইল দুটোকে লেজে নিয়ে প্লেনটাকে পাহারসারির ওপাশে অদৃশ্য হতে দেখল সবাই। তার কিছুক্ষণ পর দুটো বিস্ফোরনের শব্দ শুনতে পেল। ইজ্রায়েলিরা বিজয়ের হুল্লোড় করে উঠল।
আঁধারে তাকিয়ে বিড়বিড় করল শায়খ,
-রেস্ট ইন পিস কমরেড!
হঠাত্‍ আঁধারে আবার মাজল ফ্ল্যাশ দেখা গেল। প্লেনের উত্তেজনা যেতেই আবার আক্রমন শুরু করেছে ইজ্রায়েলিরা। তাদের গুলির পাল্টা জবাব দিতে দিতে ভাবল শায়খ, হাতে আর বড়জোর পাঁচ মিনিট সময় আছে। শত্রুপক্ষে কমপক্ষে আছে ৩০ জন। নিজের সোলজার বেঁচে আছে প্রায় ১৫ জন। এরমধ্যে আহত ৩ জন। এমুনিশনও প্রায় শেষ। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়তি সাহায্য না পেলে শায়খ রায়ান সহযোদ্ধাদের সাথে মারা যাবে আর এই নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি ইজ্রায়েলিদের হাতে চলে যাবে। অথবা তারচেয়েও ভয়ংকর পরিনতির স্বীকার হবে। সেটা কি হবে ভাবতে গিয়ে ইসরায়েলি আর্মি ইন্টেলিজেন্সের টর্চার ডানজনটার ছবিই ভেসে উঠল শায়খের চোখে।
হঠাৎ দূর থেকে সুপারসনিক কোন প্লেনের শব্দ ভেসে এল। পরমুহুরতে প্লেনটাকেও দেখতে পেল শায়খ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে সময় লাগল ওর। মিশর এয়ারফোর্সের পাইলটের রেখে যাওয়া সেই প্লেনটাই, ফেলিক্স! একদম নিচে দিয়ে উড়ে এল। এয়ার টু সারফেস মিসাইল লঞ্চ হল ওটার। এস১৩ এর ট্যাঙ্ক আগুনের গোলকে পরিনত হল। ট্যাঙ্কটা ধ্বংস হতে না হতেই আবার এক চক্কর দিয়ে ফিরে এল ফাইটার প্লেন। ককপিটে মাস্কের আড়ালে ফেলিক্সকে চেনা গেল না। নির্দিষ্ট লাইনে এসে ২০এমএম ক্যাননের ট্রিগারে চেপে বসল আঙুল। লাইন ধরে তিনটে ইজরায়েলি হেভি মেশিনগান পোস্টের সৈন্যদের ঝাঁজরা করে দিল। দূর থেকে গানশিপ কপটার হিট সিকার মিসাইল ছুঁড়ল প্লেন লক্ষ করে। ইচ্ছে করলেই মিসাইলকে ফাঁকি দিতে পারে ফেলিক্স। সেরকম সব টেকনোলোজিই আছে ওর প্লেনে, তবে মাছের তেলে মাছ ভাজার প্ল্যান করল ও। স্পীড মাঝামাঝি রেখে পেছনে মিসাইল নিয়ে ছুটল ও। চোখের আড়ালে চলে গেল। ওদিকে অন্যদুটো গানশিপ হেলিকপ্টার শায়খদের দিকে আগাল।
প্রমাদ গুনল শায়খ, এখন গানশিপ মানেই ওদের স্রেফ কচুকাটা করবে। আশেপাশে কোন আড়াল নেই, পেছনে পাহাড়। শেষ চেষ্টা হিসেবে গানশিপের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করল। কোন লাভই হলনা, কপটারের আরমার্ড বডিতে বুলেট দাগও কাটতে পারল না। ফেলিক্সের হঠাৎ পলায়নের কারণ বুঝতে পারেনি শায়খ। আজরাইলের দূত হয়ে যেন এগিয়ে আসছে গানশিপ। হঠাৎ আবার উদয় হল ফাইটার প্লেন। পেছনে এখনও মিসাইলটা লেগে আছে। সোজা গানশিপের দিকে আগাল। গানশিপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্টেলথ মোডে চলে গেল প্লেন। প্লেনের হিটসোর্স হারিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ল মিসাইল। গানশিপের হিটসোর্স পেয়ে ওটাকেই টার্গেট ধরে নিল। সরতে গিয়েও পারল না গানশিপের পাইলট, নিজেদের ছোড়া মিসাইলে নিজেরাই ধ্বংস হয়ে গেল। এফ৩৫ এর এয়ার টু এয়ার সাইডউইন্ডার মিসাইল দুটো ছুঁড়ল ফেলিক্স পলায়নপর গানশিপদুটোর উদ্দেশে। মুহূর্ত পরে গগনবিদারী আওয়াজ করে আগুনের গোলকে ছেয়ে বিস্ফোরিত হল সেগুলো। এরপর বাকি এস১৩ কমান্ডোদের শেষ করতে বেশী সমস্যা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে প্লেন নিয়ে রানওয়েতে নেমে এল ফেলিক্স। সংক্ষেপে রায়ানের জন্য মেসেজ পাঠিয়ে দিল শায়খ,
-ব্লুবার্ড গ্রিন, সিচুয়েশন ইজ আন্ডার কন্ট্রোল।

বহুদূরে রাশিয়ার অরেনবার্গের এক পাহাড়ের মাথায় বিশাল দুর্গে বসে আছে এজেন্ট রায়ান। একলা ঘরে চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে তাকিয়ে রয়েছে আশেপাশের পুরো এলাকা কাভারেজ করা ক্যামেরাগুলোর লাইভ ফিডের দিকে। দুদিন ধরে পালা করে এই কাজই করছে সে আর জেসন। জেসন ঘরে ঢুকে জানাল,
-শায়খ মেসেজ পাঠিয়েছে, ওদের মিশন সফল। এস১৩ এর আক্রমণ ওরা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
-হুম।
-নেক্সট অর্ডারস?
-ওদের পজিশন ধরে রাখতে বল।
-কিন্তু স্যার...
-ড্যামেজ যা হয়েছে সেগুলো নিজেদেরই সম্ভব হলে রিপেয়ার করে নিতে বল নাহলে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক।
-ইয়েস স্যার।
বেরিয়ে গেল জেসন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে রায়ানের পেছনে দাঁড়াল। শিফট চেঞ্জের সময়। চেয়ার থেকে উঠতে গিয়েও ধপ করে বসে পড়ল আবার রায়ান। কনসোলের উপর ওর হাত হামলে পড়ল। ভিডিও স্ক্রিনে দেখা গেল পাহারটাকে ঘিরে ফেলছে বেশকিছু সসস্ত্র লোক। পাহাড় বাইতে শুরু করেছে তাদের অনেকেই। পেছন থেকে কয়েকজন হেভি মেশিনগান দিয়ে ক্লাইম্বারদের কাভার করতে লাগল। নিজের ওয়াকিটকি তুলে নিল রায়ান। নির্দেশ দিল,
-অলরাইট, দিস ইজ ইট। সবাই ড্রিল মাথায় রাখ। বি অ্যালার্ট। স্নাইপারস, শুট টু কিল। আমাদের সংখ্যা একজনও যাতে না কমে। গো...
সসস্ত্র কিছু কমান্ডো আগে থেকে নির্ধারিত বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। স্নাইপারদের গুলির আওয়াজ ভেসে এল। হেভি মেশিনগানগুলো একটার পর একটা নিস্তব্ধ হতে লাগল।

ফোর্ট দজেরভস্কির পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে অ্যাটাকের লিড দিচ্ছে এস১৩ এর অন্যতম সার্জেন্ট কমান্ডার তানারা। পাহারটার নিচে দাঁড়িয়ে দুর্গের দিকে তাকিয়ে বহুবারের মতো আবারও প্রশ্নটা নিজেকে করল সে,
-একটা দুর্গ কিভাবে একটা নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি হতে পারে?
প্রশ্নটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে তার কর্তারা, মিশনের প্ল্যানাররা। তারা বলেছে এটা অসম্ভব কিছুই না। তবুও খচখচে অনুভূতিটা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি তানারা। মিশরে ওদের অন্য টীমটা গানশিপের বাড়তি সুবিধা পেলেও রাশিয়ায় ওদের কপালে তার কিছুই জোটেনি। নিজেদের সিটিং ডাক মনে হচ্ছে ওর। সেই দুর্গ দখল করার আমলের মতো। ওরা পাহাড় বেয়ে কোন কাভার ছাড়া যেন সিইজ ওয়েপন দিয়ে হামলা করছে দুর্গের দরজায়, আর দুর্গের ওরা পাথর, তেল, আগুন, গরম পানি ঢেলে ওদের রান্না করে দিচ্ছে। যুগের সাথে সাথে ওয়েপনস বদলে গেলেও দৃশ্যটা যেন সেই আগেরই আছে। এক সময় একের পর এক থেমে গেল স্নাইপারদের বন্দুক। ক্লাইম্বারদের যারা এখনও জীবিত মোটামুটি অক্ষতভাবে উপরে উঠতে পেরেছে তারা দুর্গ পাঁচিলে এক্সপ্লোসিভস ফিট করে দিল। ক্ষুদ্র সময়ের বিরতির পর পুরো পাহাড় কেঁপে উঠল বিস্ফোরণে। দুর্গে ঢোকার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল ইজ্রায়েলিদের। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ভেতরে ঢুকে পড়ল তানারার নেতৃত্বে একটা টীম। পিল পিল করে অবশিষ্ট সবাইও দুর্গে ঢুকতে লাগল অথবা দুর্গের বাহিরে পজিশন নিল। কিন্তু বিপক্ষ দলের কোন নামনিশানা নেই।

ঠোঁট কামড়ে ধরে দুর্গের প্রতিটা ইঞ্চি সার্চ করা দেখল তানারা, কিন্তু কাউকেই পাওয়া গেল না। কোন নিউক্লিয়ার ওয়েপন তো দূরের কথা, একটা লাশও নেই। সবাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পুরো দুর্গ গিজগিজ করছে এস১৩ কমান্ডোতে। এক কমান্ডোর ডাকে সারভেইলেন্স রুমে ঢুকল তানারা। মনিটরের দিকে নজর গেল। একটা কাউন্টডাউন ওয়াচ দেখা যাচ্ছে মনিটরে। ০০.০০ তে আসতেই একটা শব্দ ঝট করে ভেসে উঠল সেখানে,
-বুম!
গোপন শ্যাফট দিয়ে সবার শেষে নামছে জেসন আর রায়ান। নামতে নামতে বলল জেসন,
-আপনার প্ল্যানটা আসলেই ভাল ছিল স্যার। সব মিসাইল মিশরেই রেখে এদের শুধুশুধু একটা মূলা দেখিয়ে নিয়ে এলেন। এরপর বুম! ক্লাসিক।
-তোমার ফেলিক্সের কাছ থেকে একটু দূরত্ব দরকার। ওর মতো বিনাপ্রয়োজনে কথা বলছ।
-সরি, স্যার।
কিছু না বলে মুচকি হাসল রায়ান। হঠাৎ কেঁপে উঠল পাহাড় শক ওয়েভে। বালি আর পাথর খসে পড়ল ওদের গায়ে। এস১৩ যে দুর্গে ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারল ওরা। নামার গতি আরও বেড়ে গেল ওদের। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। দুর্গ বিস্ফোরণের আগে এই শ্যাফট থেকে বের হতে না পারলে এখানেই কবর হয়ে যাবে ওদের। বেয়ে নামার চিন্তা বাদ দিয়ে রিস্ক নিয়ে পিছলে নামতে লাগল ওরা। হঠাৎ ভীষণ ঝাঁকুনি আর আওয়াজের পর মাটিতে আছড়ে পড়ল ওরা। দ্রুত বের হওয়ার মুখটার দিকে ছুট লাগাল। পাহাড় এখনও কাঁপছে। ধস নেমেছে গোপন শ্যাফটে।
আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনটে রেঞ্জরোভার বেড়িয়ে এল অরেনবার্গের প্রধান সড়কে। রওনা হল বার্লিনের পথে। মাঝখানের গাড়ির ডানপাশে বসা মুখটা পরিষ্কার দেখা গেল রাইফেলের টেলিস্কোপে। নিজের হাতে কনফিগার করা স্নাইপার রাইফেলটা যত্নের সাথে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল স্নো। বাতাসের গতি চেক করে নিয়ে আবার মনোযোগ দিল টার্গেটে। পাশ থেকে শক্তিশালী দূরবীনে গাড়িগুলো দেখছে সিআইএ এর লোকাল অ্যাসেট। আপদটাকে অনেকটা জোর করেই গছিয়ে দিয়েছে ক্লায়েন্ট। হঠাৎ বলল,
-টার্গেট কনফার্মড। ইটস হিম!
-ইউ থিংক? সেটা আরও এক মিনিট আগেই বোঝা গেছে।
-আমি জাস্ট...
-শাট আপ।
টার্গেটে আবার মনোযোগ দিল স্নো। হাতে আর আধ সেকেন্ড সময় আছে। এরপর আর এই পাহাড়ের উপর থেকে রেঞ্জ পাওয়া যাবে না। নিয়ন্ত্রিত দম নিয়ে, স্নায়ু স্থির করে সমস্থ শরীর আর মনকে নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিল স্নো। ঝানু একজন স্নাইপার ও। সব নিয়ম ওর জানা। রাইফেলটাকে নিজের শরীরের একটা অংশ মনে হতে লাগল। টার্গেটে চোখ রেখে ট্রিগারে চেপে বসতে লাগল আঙ্গুল। ঠিক সেই মুহূর্তে ব্রেক করল সবগুলো গাড়ি। ট্রিগারে চাপ দিয়েছে স্নো। গুলি তার লক্ষভেদ করতে ছুটে গেল। এজেন্ট রায়ানের গলার চামড়ায় গভীর লম্বা এক ক্ষত তৈরি করে পাশে বসা জেসনের সিটের হেডরেস্টে গেঁথে গেল। কান থেকে ফোন সরিয়ে সবার দেখাদেখি মাথা নামিয়ে ফেলল জেসন। ড্রাইভার সাহস করে মাথা উঠিয়ে ডেঞ্জার জোন থেকে বের করে নিয়ে আসল গাড়ি। নিরাপদ জায়গায় এসে মাথা তুলল সবাই। জেসনের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইল রায়ান। জেসন বলল,
-স্নাইপার অ্যামবুশ করেছিল স্যার।
-আমি সেটা জানতে চাইনি। গাড়ি থামাতে বললে কেন?
-মিশর আমাদের নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি দখল করে নিয়েছে।
-হোয়াট?
-ইয়েস স্যার। শায়খ সিকিউর মেসেজ পাঠানোর কিছুক্ষণ পরেই মিশরীয় আর্মি হাজির হয়। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদেরকে এরেস্ট করে আর্মি। শায়খ ছদ্মবেশ নিয়ে বেঁচে গেছে।
-দ্যাটস অল?
-শায়খ এতটুকুই জানাতে পেরেছে। ও মিশরীয় আর্মির এর মেজর সেজে ফ্যাসিলিটিতে ঘোরাফেরা করছে ভেতরের ব্যাপার জানার জন্য। সুযোগ পেলেই আমাদের জানাবে যা জানতে পারবে। আর ফেলিক্স বন্দি হয়েছে। ওকে ইন্টারোগেশন করার প্ল্যান করছে আর্মি।
-ড্যাম ইট!
বার্লিনের অদূরে এক প্রাচীন প্রাসাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে রেঞ্জরোভারগুলো ঢুকে পড়ল এক সারিতে। একের পর এক গলিঘুপচি পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজার সামনে থেমে দাঁড়াল গাড়িগুলো। দরজায় কারবাইন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডেরা ওদের দেখে দরজা খুলে দিল। ফিনিক্সের প্রথম হেডকোয়ার্টার এটা। সম্প্রতি আবার খোলা হয়েছে। ফিনিক্স নয়, রাশিয়ার এক গডফাদারকে জায়গাটা ব্যবহার করতে দিয়েছে রায়ান। গডফাদার রায়ানের পুরনো বন্ধু। একসাথে বেশ কিছু যুদ্ধে যুদ্ধ করেছে ওরা অন্যায়ের বিপক্ষে। এখন অবসর নিয়ে সে হয়ে গেছে গডফাদার। দুর্গটা তারই ছিল। রায়ান চাইতেই দিয়ে দিয়েছে। সাথের লোকও দিয়েছ সে। রায়ানকে ফিরতে দেখে এগিয়ে এসে ওকে নিজের অফিসে নিয়ে এল। ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসেই ফোনটা কাছে টেনে নিল রায়ান। হাই কোয়ালিটির স্ক্র্যাম্বলার লাগানো ফোন। কিছুতেই এই ফোনকে ট্রেস করা সম্ভব না। ডায়াল করল মিশরিয় আর্মি চীফকে। বৃদ্ধের খানসামা ধরল ফোন। রায়ানের পরিচয় জানতে চাইল। মিশরীয় আর্মি হাসপাতালের এক ক্যাপ্টেনের পরিচয় দিয়ে বৃদ্ধকে চাইল রায়ান। কোন সন্দেহ না করে চীফকে লাইন দিল খানসামা।
-হ্যালো, আজমল?
-জি, স্যার। আপনার কানের ব্যাথাটা কমেছে?
-না আজমল। ডাক্তার আমার কোন কথাই শুনতে চাইল না। জোর করে মেশিন লাগিয়ে দিল।
-সে কি স্যার? আপনি আমার কথা বলেননি?
-বলেছিলাম। কিন্তু সে তোমার কোন সাজেশন মানতে রাজি নয়। আমিও কিছু করতে পারলাম না। বুড়ো মানুষ।
-হুম। দুঃখজনক।
-ভাবছি বাহিরের কোনখানে গিয়ে অপারেশন করাব। কিন্তু ঐ ডাক্তার রাজি হল না। বলল বাহির থেকেই বড়ডাক্তার আসছে দুয়েকদিনের মধ্যে। তুমি পারলে চলে আস, তোমার হাতের জাদু দেখা দরকার এদের।
-জি আচ্ছা, দুমাস পর ছুটি পাব। তখন চলে আসব স্যার। আপনি এরমধ্যে কিছু করতে যাবেননা যেন। রাখি স্যার। খোদা হাফেজ।
-খোদা হাফেজ। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক।
ফোন রাখতেই দেখল গডফাদার মাক্সিম সাবুরভ ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জানতে চাইল,
-কোডে কি বলল?
চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রায়ান,
-ওনার ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, খুব পাওয়ারফুল কেউ মিশরকে কোনভাবে বাধ্য করছে আমার বিপক্ষে খেলার জন্য। বৃদ্ধকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। দুএকদিনের মধ্যে সেই হাই পাওয়ারফুল কন্ট্রোলার যেই হোকনা কেন মিশরে আসছে।
-তোমার সহকর্মীদের কি খবর?
-ওদের কথা উনি কিছু জানে না। জানলে বলত। তবে আপাতত ওরা আমার চিন্তা না। শায়খ ওদের ব্যাপারে যা করার করবে। আমাকে সেই বিদেশি জোঁককে সামলাতে যেতে হবে।
-আমি তাহলে তোমাদের যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দেই?
-করো।
-আমার কিছু লোক সাথে দিয়ে...
-দরকার নেই। তুমি ইতিমধ্যেই অনেক উপকার করেছ। তাছাড়া মিশরে আমার নিজের লোক অনেক আছে। সমস্যা হবে না।
-ঠিক আছে। তুমি তাহলে রেস্ট নাও গিয়ে।
-ওকে।
অফিস থেকে বেরিয়ে এল রায়ান।
সাবুরভের প্রাইভেট জেটে করে কায়রো এয়ারপোর্টে নামল রায়ান। জেসন রাশিয়ার সেই দুর্গের ব্যাপার ধামাচাপা দিতে থেকে গেছে বার্লিনেই। রায়ানের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের কারনে প্রায় কোন ঝামেলা ছাড়াই এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আসতে পারল। রায়ানের ছদ্মবেশ আর নকল কাগজপত্র চিনতে পারার মতো অভিজ্ঞতা এয়ারপোর্ট পুলিশের নেই। এশিয়ান বিজনেস টাইকুনের পরিচয়ে এসেছে রায়ান। এয়ারপোর্টের বাহিরে এসে এদিকওদিক নজর বুলাতেই ওর নকল নামের প্ল্যাকার্ড হাতে একজনকে দেখতে পেল। রায়ানের অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারল যে লোকটা সাইডআর্মস ক্যারি করছে। ওর নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়েছে আর্মি চীফ। একটা রোলস রয়েস নিয়ে এসেছে। রায়ানের জন্য দরজা খুলে ধরল গানম্যান। রায়ান উঠে বসতেই সে উঠল ড্রাইভারের পাশে। কায়রোর ব্যস্ত রাস্তা ধরে ছুটে চলল রয়েস। একটু লক্ষ করতেই সামনে পিছনে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা দুটো গাড়ির এসকর্ট দেখতে পেল রায়ান। গৃহবন্দি অবস্থাতে থেকেও বেশ ভালই প্রভাব খাটাতে পারছেন বৃদ্ধ, ধারনা করল সে। অনেক দিন পর এসেছে কায়রোয়। তাই পথের দুপাশে নজর বুলিয়ে কি কি পরিবর্তন হয়েছে তা মাথায় গেঁথে নিতে লাগল। এক ঘণ্টার মাথায় এসে নীলনদের তীরে গার্ডেন সিটির ফোর সিজনস হোটেলে পৌঁছল রোলস রয়েস। এসকর্টের সামনের গাড়ি আরও আগেই ভিতরে ঢুকে চেক করে নিয়েছে সব। যদিও এখানে বিপদের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। গাড়ি থামতে গানম্যান নিরবে দরজা খুলে ধরল। রায়ান নামতেই নিঃশব্দে তার পিছু নিল। হাতের ছোট ব্রিফকেসটা ছাড়া আর কিছু আনেনি রায়ান। লাগেজ আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রিসেপশন থেকে কি কার্ড নিয়ে এলিভেটরে ঢুকে পড়ল ও। গানম্যান ওর সাথেই উঠল। লিফট থেকে বের হয়ে সোজা নিজের স্যুইটে এসে ঢুকল। বাহিরে দাঁড়িয়ে গেল গানম্যান। টানা পাঁচঘণ্টার ফ্লাইট পেরিয়ে কিছুটা ক্লান্ত রায়ান। গতকালকের একশনের পর থেকে বিশ্রাম নেবার সুযোগ পায়নি বললেই চলে। স্যুইটের সাধারন রুটিন চেক সেরে বিছানায় এলিয়ে দিল শরীর। ঘুম ভাঙল রাত নয়টায়। শাওয়ার সেরে কাপড় পাল্টে ঝরঝরে শরীরে বেরিয়ে এল। দরজার পাশে গানম্যান ঠায় দাঁড়িয়ে। রায়ানকে দেখে একটা কাগজ বের করে দিল সে। কাগজটাতে রায়ানের প্রিয় একটা হোটেলের নাম আর টেবিল নাম্বার লেখা। একবার দেখে লাইটার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলল কাগজ। গানম্যানকে বলল রায়ান,
-আমি বারটার পরে ফিরে আসব। তুমি এরমাঝে খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার লোকেদেরও তাই করতে বল।
মাথা ঝাঁকাল গানম্যান। নিচে নেমে রিসেপশনে যোগাযোগ করে একটা লিমুজিন নিল রায়ান শোফার ছাড়া। গাড়িটা নিয়ে ৭ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল কায়রো টাওয়ারে। ৫৫তলার রেস্টুরেন্টে উঠে এসে নির্দিষ্ট টেবিলে এসে বসল।
ওয়েটার খাবারের অর্ডার নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মার্জিত চেহারার এক মিশরীয় যুবক এসে দাঁড়াল ওর সামনে। জানতে চাইল,
-আমি কি এখানে বসতে পারি?
-টেবিলটা আমার নামে বুক করা হলেও করেছেন আপনি, সুতরাং অবশ্যই আপনি বসতে পারেন।
নিঃশব্দে মুখোমুখি বসে বলল যুবক,
-আমি ক্যাপ্টেন আহমেদ।
-জানি। জেনারেল আহমেদ আপনার বাবা।
-এটা যেহেতু জানেন তাহলে আমি ধারনা করতে পারি যে আমার সম্পর্কে কিছুই আপনার অজানা নেই?
-নিঃসন্দেহে। কাজের কথায় আসা যাক।
-আপনার টার্গেট দুজন। একজন ইজরায়েলি এবং একজন আমেরিকান। আগামীকাল আমাদের দেশে পা রাখবে। রাত ঠিক এগারটায় প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইটে আমাদের প্রেসিডেন্টের সাথে অথবা তার কোন প্রতিনিধির সাথে তাদের সরাসরি মিটিং হবে। ভিআইপি পারসনদের উপস্থিতির কারনে হোটেল সিকিউরিটি অনেক কড়া করা হয়েছে। একদম ফুলপ্রুফ। এটা ভাঙ্গার কোনও পথ আমি পাইনি। তবে বাবার মতে আপনি অসম্ভবকেও নাকি সম্ভব করতে পারেন। সেজন্যই আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি আমি। আমি আপনার সাথেই কাজ করতে চাই এই ব্যাপারে।
-ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। তবে আমি আমার নিজস্ব লোক ছাড়া কাজ করি না। সে যত বড় অথরিটিই নিয়ে আসুক না কেন আমি একাই কাজ করি।
-আপনার ইচ্ছা।
-তবে আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি যে আপনাদের সরকারকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে তা আমি থামাব।
-ধন্যবাদ।
ভ্রু কুঁচকে রায়ানের দিকে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেন আহমেদ। রায়ান নিঃশব্দে, একমনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। ওকে বিশ্বাস করা যায় কি যায় না ভাবতে ভাবতে এক সময় বিশ্বাস করারই সিদ্ধান্ত নিল ক্যাপ্টেন। পকেট থেকে ছোট একটা পেনড্রাইভ বের করে টেবিলের উপরে রেখে ঠেলে দিল। বলল,
-এখানে সিকিউরিটি সম্পর্কে সব ডিটেইল আছে।
এক মুহূর্তের জন্য খাওয়া থামিয়ে বলল রায়ান,
-আপনি আমাকে অকারনে কথা বলতে বাধ্য করছেন ক্যাপ্টেন। কাজটা আমার পছন্দ না। আমি হোটেল সিকিউরিটি অথবা প্রেসিডেন্টের প্রোটেকশন ডিটেইল জানতে চাইনি। আমি জেনারেলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমার যে এজেন্টরা বন্দি হয়েছে তাদের খবর। তাদের নিয়ে কার কি প্ল্যান, ওরা কোথায় এসব আমি জানতে চেয়েছি।
ইতস্তত করে বলল ক্যাপ্টেন,
-ওদেরকে কায়রোর আর্মি প্রিজনে রাখা হয়েছে। আজ রাতের ফ্লাইটে ওদেরকে নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। বাবা তার সাধ্যের মধ্যে আপাতত এততুকুই করতে পেরেছেন। তবে কন্ট্রোলাররা ফেলিক্স সাহেবকে দাবী করেছেন। মিশর তা মানতে বাধ্য হয়েছে।
-ফেলিক্স কি একই জায়গায়?
-না, তাকে বর্গ-এল-আরবের ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজনে রাখা হয়েছে।
-হুম। এ ব্যাপারে জেনারেলের সাহায্য আমার কাজে আসতে পারে।
-কিভাবে?
একটা টিস্যুপেপারে কলম দিয়ে একটা নাম লিখে ক্যাপ্টেনের দিকে বাড়িয়ে ধরল রায়ান। বলল,
-একে চাকরি থেকে সসম্মানে ডিসচার্জ করুন। কারণ হিসেবে মেডিক্যাল রিজন দেখাতে পারেন।
-কিন্তু, ইনি কে? কোন কারণ ছাড়া একজন মেজরকে ডিসচার্জ! কিভাবে ইনি আপনার সোলজারদের...?
-জাস্ট ট্রাস্ট মি অন দিস। আরেকটা ছোট কাজ করতে হবে ক্যাপ্টেন, ফেলিক্সের উপর কোন টর্চার যদি না করা হয়ে থাকে তাহলে যেন করা শুরু হয়। কমপক্ষে দুয়েকটা হাড্ডি ভাঙ্গার ব্যবস্থা করবেন।
বিমুঢ়ের মতো মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন,
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সে আপনার নিজের লোক না?
-আর কিছু বলার নেই আমার, ক্যাপ্টেন।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল ক্যাপ্টেন আহমেদ। ডিনারের শেষ কোর্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রায়ান।
পরদিন কায়রোর এখানে ওখানে ঘুরে সময়টা পার করল। দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। সময় যেন উড়ে বেড়িয়ে গেল। হোটেলে রাত নয়টায় ফিরল ও। সিকিউরিটির হঠাৎ কড়াকড়ি দেখে বুঝতে পারল খেলা শুরু হয়েছে। ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে রুম সার্ভিসকে দিয়ে ডিনার আনিয়ে খেল। সেইসাথে ক্যাপ্টেনের দেয়া তথ্যগুলো পড়ে মাথায় ভাল করে গেঁথে নিল। এরপর গাঢ় রঙের স্যুট পড়ে তৈরি হয়ে নিল। রুমের দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখল এলিভেটরের সামনে সশস্ত্র গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। কেউ লিফটে উঠতে গেলে সার্চ করে নিচ্ছে। দরজায় তালা লাগিয়ে সেদিকে এগোল রায়ান। ওকে দক্ষ হাতে সার্চ করল এক গার্ড, অপরজন নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কাভার দিল। সার্চ করে কিছু না পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে ক্ষমা চেয়ে পথ ছেড়ে দিল গার্ড। এই এলিভেটর দিয়ে হোটেলের পূর্ব পাশের সব ফ্লোরে যাওয়া যায়। এই হোটেলে মোট এলিভেটর নয়টা। আটটা এলিভেটর সাধারন গেস্টদের ব্যাবহারের জন্য। শেষ এলিভেটরটা কেবল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটের ভিয়াইপি পারসনদের জন্য। গেস্টদের ঐ এলিভেটরের ধারেকাছে যাওয়ারও সুযোগ নেই। এলিভেটরে করে ৩৫তলায় উঠে এল রায়ান। সোজা হেঁটে ৩৫০৭ রুমে ঢুকে পড়ল চাবি দিয়ে খুলে। এই রুমটা বুক করেছে ও অন্য নামে। আলমারি থেকে নাইলন কর্ডের সরু দড়ি বের করে নিল হুকসহ। এফএন ৫৭-ও হোলস্টারসহ যথাস্থানে ফিরে গেল। বাহিরে একবার নজর বুলিয়ে জানালায় দড়ির এক মাথা বেঁধে ঝুলে পড়ল। স্লাইড করে ২০তলায় মেইন্টেন্যান্স রুমের কাঁচের দেয়ালের বাহিরে এসে থামল। গ্লাস কাটার দিয়ে গ্লাস কেটে ঘরের ভিতর ঢুকতে তিন মিনিট লাগল। দেয়ালের নির্দিষ্ট একটা বোর্ড সরাতেই একটা ফোঁকর দেখা গেল। ঘড়িতে সময় দেখল। দশটা পঞ্চান্ন। জানালার বাহিরে উঁকি দিতেই হোটেলের সামনে এসকর্টসহ একটা মার্সিডিজ এসে ঢুকতে দেখল। প্রেসিডেন্ট আগেই এসে বসে আছে। অন্যরাও তাহলে এসে পড়েছে। দুর থেকে দেখে ঠিকমত চিনতে পারল না রায়ান ওদের। হোটেলে ঢুকে পড়ল ওরা। রায়ানের হাতঘড়িটা ওর ঘরে রেখে আসা শক্তিশালী ল্যাপটপের একটা কন্ট্রোল ডিভাইস। ওটা ব্যবহার করে হোটেলের মেইন্টেন্যান্স মনিটরিং সিস্টেমকে ঠিক দশ মিনিটের জন্য ফ্রিজ করে দিল। চোখ বন্ধ করে কাউন্টডাউন শুরু করল। তিন মিনিটের মধ্যে রুমে ঢুকবে আগন্তুকরা। এরপরের পাঁচমিনিটে তাদের সাথের টীম তল্লাশি করা শেষ করবে পুরো জায়গা। রায়ান হাতে সময় পাবে দুই মিনিট। দুই মিনিটে নিঃশব্দে সাততলায় নামতে হবে ওকে, এয়ার শ্যাফট ব্যবহার করে। চোখ বন্ধ করে গুনে যাচ্ছে রায়ান। আট মিনিট যেতেই ঢুকে পড়ল এয়ার শ্যাফটের ফোঁকর দিয়ে। বেশ কিছু পথ ঘুরে নির্দিষ্ট শ্যাফট বের করল। এবার সোজা নামতে শুরু করল নিচের দিকে। হাতে আছে এক মিনিট। তার এক সেকেন্ড পরেই মেইন্টেন্যান্স মনিটরিং সিস্টেম শ্যাফটের ভেতরের বাঁধা ডিটেক্ট করতে পারবে। এরপর গার্ডদের ছুটে আশা কেবল সময়ের ব্যাপার। নেমে চলেছে রায়ান এসব চিন্তা মাথা থেকে দূরে রেখে।

ফোনটা নামিয়ে রাখতেই সিও এর ঘরে ঢুকল মেজর আশফাক আলী। ভ্রু কুঁচকে দুমিনিট তাকিয়ে থেকে বললেন সিও কর্নেল মাহমুদ,
-কোন ইউনিটের যেন তুমি বলেছিলে?
-সেভেন্থ কায়রো রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ন স্যার।
আনমনেই মাথা ঝাঁকাল কর্নেল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-তোমার ডিসচার্জ অর্ডার এসেছে।
-কারণটা জানতে পারি, স্যার?
মেইলে আসা ডকুমেন্টস এ আরেকবার চোখ বুলিয়ে বলল কর্নেল,
-তোমার মেডিকেল রিপোর্টে কি যেন একটা এসেছে। তোমার হেডঅফিসে যোগাযোগ করা উচিত। তবে আপাতত তোমাকে আমার ডিসচার্জ করতে হচ্ছে।
-অলরাইট স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ। আমি যেতে পারি?
-ইয়েস মেজর।
স্যালুট করে বেড়িয়ে এল মেজর আলী। নিজের কেবিনে ফিরে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ইউনিফর্ম খুলে বেড়িয়ে পড়ল। নিজের জীপ নিয়ে আর্মি বেস থেকে বেড়িয়ে এল। মরুভূমি পেরিয়ে শহরে ঢুকে এক হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে জীপ ঢুকল। দশ মিনিট পর যখন জীপটা বেড়িয়ে এল তখন তার লাইসেন্স প্লেটের সাথে সাথে মালিকের পরিচয়ও পাল্টে গেছে। মালিক এখন মিশরীয় এক আর্মি ডাক্তার। ক্যাপ্টেন আজমল মাহমুদ। গাড়ি ছুটে চলল বর্গ-এল-আরব প্রিজন, আলেক্সান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে।

বর্গ-এল-আরব প্রিজন। সেল নাম্বার ৪১১। সেল না বলে টর্চার চেম্বার বললেই ভাল মানায়। এই মুহূর্তে সিলিং থেকে নেমে আসা লোহার শিকলের সাহায্যে বন্দি করে রাখা হয়েছে ফেলিক্স হুয়েরাকে। দুই প্রিজন গার্ড মনের সুখে পিটিয়ে চলেছে ওকে। মাঝে মাঝে কেবল গুঙিয়ে উঠছে ও, আর গার্ডদের হাঁপানোর শব্দ। এছাড়া পুরো প্রিজন নিঃশব্দ। অস্বাভাবিক রকম নিঃশব্দ। সেলের বাহিরে চেয়ারে বসে এই দৃশ্য উপভোগ করছে ওয়ার্ডেন। হঠাৎ এক গার্ড এসে তার কানে কানে কিছু বলতেই উঠে নিজের অফিসে রওনা দিল সে।
পায়ের উপর পা তুলে ডেস্কের এপাশে বসে আছে ক্যাপ্টেন আজমল মাহমুদ। ওয়ার্ডেন ঢুকতেও পা নামানর কোন লক্ষণ দেখাল না। ভ্রু কুঁচকে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল ওয়ার্ডেন। গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল,
-আপনাকে কে পাঠিয়েছে?
-যে আপনাকে অর্ডার দিয়েছে স্পেশাল প্রিজনার মশাইকে টর্চার করতে, তার বাপ।
কুঁচকান ভ্রু আরও কুঁচকে গেল ওয়ার্ডেনের। ব্যাপারটা লক্ষ করে কোটের পকেট থেকে পরিপাটি করে ভাজ করা একটা কাগজ বের করে তাচ্ছিল্যের সাথে ছুঁড়ে দিল ওয়ার্ডেনের দিকে। কাগজের ভাজ খুলে প্রথমে নিচের সইটা দেখল ওয়ার্ডেন। সইটা চিনতে পেরে চোখের বিরক্তি আর সন্দেহ দূর হয়ে সেখানে ঠাই পেল আশংকা, তারপর পুরো চিঠি পড়ে সেই আশংকা পরিণত হল আতংকে। কাঁপা কণ্ঠে কৈফিয়ত দিতে গেল সে,
-কিন্তু জেনারেল আমাদের টর্চারের অর্ডার দিয়েছিল। আমরা ইচ্ছে করে...
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল মাহমুদ। বলল,
-আপনি কি করেছেন সেটা আমার দেখার ব্যাপার না ওয়ার্ডেন। আমার দেখার বিষয় আমার কাজ আপনারা কতটুকু বাড়িয়েছেন।
-জি, তেমন কিছু না।
-আমাকে নিয়ে চলুন।
উঠে দাঁড়াল মাহমুদ। ছুটে এসে দরজা খুলে পথ দেখিয়ে সেল নাম্বার ৪১১ তে নিয়ে এল ওকে ওয়ার্ডেন। ডাক্তারের নির্দেশে ঘরের একমাত্র বাঙ্কে শোয়ানো হল ফেলিক্সকে বাঁধন খুলে। বেশ সময় নিয়ে দক্ষ হাতে ওকে পরিক্ষা করল ক্যাপ্টেন মাহমুদ। পরিক্ষা শেষ করে বলল,
-একে এখনই ভাল কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অবস্থা ভাল না। আপনি চাইলে আপনার প্রিজন ডাক্তারকে দিয়ে চেক করাতে পারেন।
-না না স্যার। তার কোন দরকার নেই। আমাদের প্রিজন হাসপাতালে...
-...কোন কিছুই নেই। ওসব নামেই কেবল হাসপাতাল, কাজে না। কাছাকাছি হাসপাতাল কোনটা আছে?
-কয়েক মাইল দুরেই রিসোর্ট এরিয়ায় আছে ভাল হাসপাতাল। কিন্তু...
-গুড। আপনার চারজন গার্ড দিন আমার সাথে। আর প্রিজন হাসপাতালের কোন অ্যাম্বুলেন্স থাকলে সেটা রেডি করতে বলুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হতে চাই।
সাথে গার্ড নেবে শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ছুটল ওয়ার্ডেন। পাঁচ মিনিটের মাথায় অ্যাম্বুলেন্সের পিছনে দুই গার্ড আর অজ্ঞান ফেলিক্সসহ চরে বসল আজমল। সামনের সিটে আরেক গার্ড আর গার্ড ড্রাইভার। গাড়ি বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ ককিয়ে উঠল ফেলিক্স। দ্রুত নিজের পকেট থেকে একটা আম্পুল বের করে সিরিঞ্জে তরল ঢুকাল মাহমুদ। ফেলিক্সের হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করতেই লাফিয়ে উঠল ও। তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেন সরে যেতেই দুই গার্ড চেপে ধরল ওকে। ধস্তাধস্তি শুরু করল ফেলিক্স ওদের সাথে। এদিকে ডাক্তার নিজের কোটের ভিতরের গোপনপকেট থেকে দুটো তরল ভর্তি সিরিঞ্জ বের করল। পিছন থেকে দুই সিরিঞ্জ দুই গার্ডের শরীরে ইঞ্জেক্ট করতে মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারাল ওরা। ওদিকে পেছনে হুটোপুটির আওয়াজ পেয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছে গার্ড আর ড্রাইভার। দুজনে দুদিক থেকে পেছনে আগাল। অজ্ঞান এক গার্ডকে ব্যবহার করে আড়াল নিল ফেলিক্স। গার্ডদের পায়ের শব্দ দরজার কাছে এসে থেমে যেতেই দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্যাপ্টেন মাহমুদ। রাস্তায় পড়ে যেতেই ওর দিকে আগাল গার্ড। আরেকজন শটগান দিয়ে কাভার করল ফেলিক্সকে। শেষ সিরিঞ্জটা খালি করল ক্যাপ্টেন তাকে সাহায্য করতে আসা গার্ডের শরীরে। নিঃশব্দে অজ্ঞান গার্ডকে রাস্তায় শুইয়ে দিয়ে পেছন থেকে শটগানধারী গার্ডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক মিনিট লাগল তাকে নিরস্ত্র করে অজ্ঞান করতে। গার্ডদের বেঁধে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে ফেলে রাখল ওরা। গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসল ক্যাপ্টেন। মুখ খুলল ফেলিক্স,
-সো রায়ান দ্যা জুনিয়র, আমি বন্দী হওয়ার পর পৃথিবীর বর্তমান খবরাখবর সম্পর্কে কিছু জানাবেন কি?
কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করল শায়খ,
-আমাকে চিনলে কিভাবে?
-জুনিয়র সাহেব, আমি সিনিয়র রায়ানের সাথে এতো সময় কাজ করেছি যে যখন আশেপাশে কোন রায়ান থাকে তখন আমার অ্যালার্জি হয়। একই কারনে তোমার ডিয়ার বিগ ব্রাদারও কখনও আমাকে চমকে দিতে পারেনি।
হাহা করে হাসল শায়খ। হাসি থামিয়ে বলল,
-আমার স্পেশালিটি তো জানই। ইনফিলট্রেশন। সুতরাং আমাদের বেসে হামলা হতেই মিশরীয় আর্মির ছদ্মবেশে ওদের মধ্যে মিশে গেলাম। তোমরা সবাই বন্দী হওয়ার পর আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়। আমি চলে আসি সিনাইয়ের সেই আর্মি বেসে। এরপর তোমাদের খোঁজ বের করলাম। জানলাম অন্যদের আজ রাতের প্লেনে সোজা দেশে পাঠিয়ে দিলেও তোমাকে ছাড়ছে না। এরই মাঝে মেসেজ পেলাম আমাকে মেডিক্যাল রিজনের কারনে ডিসচার্জ করা হয়েছে।আমার ছদ্মবেশের পরিচয় কেবল ভাইয়াই জানে। আসলে আমরা দুজনেই একই ছদ্মবেশ ব্যাবহার করি মাঝেমাঝে। তাই সমস্যা হয় না। এখন যার কোন অস্তিত্বই নেই তাকে মেডিক্যাল রিজনের কারনে ডিসচার্জ করার প্রশ্নই আসে না। বুঝতে পারলাম ভাইয়া আমাদের আরেকটা ছদ্মপরিচয় ইউজ করতে বলেছে। তখনই আর্মি ডাক্তার ক্যাপ্টেন আজমল মাহমুদ হয়ে গেলাম আর্মি বেস থেকে বের হয়ে। জাল কাগজপত্র নিয়ে তোমার ওয়ার্ডেনকে পটিয়ে বের করে আনলাম তোমাকে।
-উফ! তোমাদের এই ছদ্মবেশ ছদ্মবেশ খেলায় কবে যে তোমাদের আসল পরিচয়ই গায়েব হয়ে যায় কে জানে!
একটু থেমে আবার বলল ফেলিক্স,
-ভাল কথা, প্রথমে তো ওরা ভালই ব্যবহার করছিল আমার সাথে। হঠাৎ টর্চার শুরু করল কেন বলতে পার?
জিভ কামড়াল শায়খ। সেটা দেখে ফেলে পুরো ব্যপারটা মুহূর্তেই বুঝে ফেলল ফেলিক্স,
-তারমানে তোমরাই আমাকে মার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছ?
-আমার প্ল্যান না, ভাইয়ার প্ল্যান। তবে এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। তোমাকে বের করে আনার জন্য ভাল কোন কারণ দরকার ছিল।
-আমি নিজ চেষ্টায় এরপরে কোন সময় জেলে গেলে বের হব, মাফ চাই! তোমাদের হেল্প আর লাগবে না! হায় খোদা! এ কেমন বন্ধু, যে সেধে বন্ধুকে মার খাওয়ায়!
কিছুক্ষণ পর শহরে ঢোকার একটু আগে এ্যাম্বুলেন্স এক পরিত্যাক্ত বাড়ির গ্যারেজে ঢুকল। সেখান থেকে নিজের জীপ নিয়ে আর ফেলিক্সের চেহারা পাল্টে রওনা হয়ে গেল বর্গ-এল-আরব এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি পার হয়ে একটা প্রাইভেট জেটে উঠে পড়ল কোন ঝামেলা ছাড়াই। প্লেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে সময় দেখল শায়খ, রাত ঠিক এগারটা।

বেডরুমের এয়ার শ্যাফটের ঢাকনা খুলে নিঃশব্দে নেমে এল রায়ান। পিস্তলে সাইলেন্সার লাগিয়ে নিল। রুমের সেন্সরগুলো খুঁজে বের করে দ্রুত অকেজো করল। সাবধানে দরজার ফুটো দিয়ে বাহিরের করিডরে তাকাল। এই করিডর পেরিয়েই ড্রইংরুমে যেতে হবে। করিডরে পাহারায় আছে দুজন অ্যামেরিকান, দুজন ইজ্রায়েলি আর দুজন মিশরীয় গার্ড। মনে মনে হাসল রায়ান। তিন পরস্পরের শত্রু দেশ এক জায়গায় বসে মিটিং করছে। কিন্তু কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। এটাই খেলার নিয়ম। তারা সবাই খেলতে জানে। রায়ান জানে এই স্যুইটে প্রাইভেসি রক্ষা করার স্বার্থে কোনও সিসি ক্যামেরা ফিট করা নেই। তাই নির্ভয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করে নার্ভ গ্যাসের তিনটে ক্যাপস্যুল ছুঁড়ে দিল। কিছু বুঝতে পারার আগেই জ্ঞান হাড়িয়ে পুরু কার্পেটের মেঝেতে পড়ল করিডরের সব গার্ডেরা। তবে কার্পেটে পড়ে যাওয়ার মৃদু শব্দ ভেতরের লোকদের কানে গেছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। দুমিনিট সময় দিয়ে বেরিয়ে এল রায়ান। নার্ভ গ্যাস গায়েব হয়ে গেছে ততক্ষণে বাতাসে। ইজ্রায়েলি এক গার্ডকে দুহাতে সামনে তুলে নিয়ে দরজার দিকে ছুটল। দরজার কাছাকাছি পৌঁছতেই ভেতর থেকে এক সাথে একের পর এক গুলি আসা শুরু করল। শব্দ শুনে বুঝতে পারল কমপক্ষে ছয়টা পিস্তল থেকে গুলি করা হচ্ছে। গুলি থামতেই সর্ব শক্তি ব্যবহার করে লাশটাকে ছুঁড়ে দিল রায়ান দরজা দিয়ে। দরজা ভেঙে উড়ে গিয়ে ভেতরে পড়ল লাশ। পদ্ধতিটা রায়ান আগেও ব্যবহার করেছে। ট্রেইন্ড কমান্ডোরাও অনেকে এতে ধোঁকা খেয়ে যায়। লাশের দিকে সবাই গুলি করতে শুরু করতেই ঝড়ের গতিতে উদ্যত পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকে পড়ল রায়ান। ঢুকেই পিস্তলধারী গার্ডদের প্রথমে যাকে সামনে দেখল তাকে গুলি করে ফেলে দিল। সিটিং ডাকের মতো দরজার আড়ালে বসে লাশে গুলি করছিল সে। অন্যরা মুহূর্তে ধোঁকা বুঝতে পেরে টার্গেট পরিবর্তন করল। ততক্ষণে রায়ান এক সাইডের সোফার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। গুলি চালিয়ে লাভ হবে না বুঝতে পেরে মুখ খুলল ইজ্রায়েলি এস১৩ ডিরেক্টর কর্নেল অরওয়েল হেজাজ,
-কর্নেল রায়ান, আবার দেখা হল। পরিস্থিতি সেই আগের মতই, কি বলেন?
-এবারেও আমার কাছে হেরে বসে আছ তুমি, তা বোঝাতে চাইলে আমি একমত।
-কে কার কাছে হারে সেটা পরের ব্যাপার কর্নেল। আমরা এখানে পাঁচজন অস্ত্রধারী আছি, আর তুমি একা।
-আমার হিসেবে তিনজন তোমরা।
ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল সিআইএ ডিরেক্টর,
-কিভাবে?
-আরেহ! হার্ড নাকি? তোমার বসের ফিউনেরালে যাইনি বলে মাইন্ড করেছ নাকি হে?
-তোমারটার ব্যবস্থা করার পর সেই দুঃখ আমি ভুলে যাব।
-সে কি! তোমাকে আমি সিআইএ ডিরেক্টর বানিয়ে দিলাম, আর তার প্রতিদান এই?
রায়ানের মাথার উপর দিয়ে একটা গুলি করল হার্ড। বলল,
-জবাবটা মিষ্টি ভাষাতেই দিলাম।
রায়ান বলল আবার,
-তিনজন গুনেছিলাম কারণ মিশরীয় ডিফেন্স মিনিস্টার সাহেব অথবা তার গার্ড কোনমতেই আমাকে গুলি করবেননা। তাই না রুশদি সাহেব?
-বন্ধুকে খুন করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই রায়ান সাহেব। কিন্তু এখানে আমার হাতপা একরকম বাঁধাই। আপনাকে না মারলেও বাঁচাতেও পারব না। প্রেসিডেন্টের অর্ডার।
-কি আর করা! নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।
অধৈর্য হয়ে বলল হার্ড,
-কথা অনেক হয়েছে রায়ান, জীবিত অস্ত্র ফেলে বেরিয়ে আসতে চাও, নাকি লাশ হয়ে বের হতে চাও?
-লাশ করবে কিভাবে সেটা ঠিক...
কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বুলেটটা এসে লাগল রায়ানের কানের নিচে সোফার পিঠে। হেসে বলল হার্ড,
-আশেপাশে যে দূরত্বে বিল্ডিং আছে সেখান থেকে গুলি ছোড়ার সাহস আছে এমন স্নাইপার তোমাদের টীমে একজনই আছে, তা হল তুমি। আর তুমি যেহেতু এখানে তাহলে নিশ্চিন্তে ধরে নিতে পার বাহিরের ঐ স্নাইপার তোমার টীমের কেউ না। এখন পিস্তলটা ফেলে মাথার উপর হাত তুলে বেরিয়ে আসতে পার।
কথামত কাজ করল রায়ান। পিস্তলটা ছুঁড়ে দিয়ে ধীরেধীরে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। আমেরিকান বডিগার্ড এসে সার্চ করল ওকে। কব্জির স্টিলেটো খুলে নিয়ে পিছিয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল রায়ান। হার্ড বলল,
-আমাদের সাথে খেলার যোগ্যতা এখনও হয়নি তোমার রায়ান। খেলতে পার তুমি, তবে আমাদের মতো অত ভাল না।
-তুমি সিওর?
-মানে?
-তোমার ধারনা এই রুমে যারা আছে তারা সবাই তোমার টীমে? সবাই তোমার লোক? এই সিলকমান্ডো বডিগার্ড, কর্নেল হেজাজ, ইজ্রায়েলি এস১৩ গার্ড, মিশরীয় আর্মি অফিসার, বাহিরের স্নাইপার সবাই তোমার টীমের খেলোয়াড়?
-কি বলতে চাইছ তুমি?
-আমি বলেছিলাম আমি কেবল তিনজন হিসেবে গুনছি তোমাদের। খেলার ঘর কিভাবে হঠাৎ পাল্টে দিতে হয় এবার দেখ।
ডান হাতে তুড়ি বাজাল রায়ান। সাথে সাথে সিলটীম কমান্ডো বডিগার্ডের হার্ট ফুটো করে দিল স্নাইপার বুলেট। পরমুহূর্তে ফুটো হল এস১৩ গার্ডের খুলি। জায়গায় জমে গেল বাকিরা। অস্ফুস্টে বলল লরেন্স হার্ড,
-কিভাবে?!
-তুমি ভেবেছিলে স্নো তোমার টীমের খেলোয়াড়? ওর আসল পরিচয় পর্যন্ত জানা নেই তোমার। একটা গুটি, একটা চাল জীবনের খেলাকে বদলে দিতে পারে, আর এটা হচ্ছে দ্যা এন্ড গেম।
অট্টহাসি হেসে বলল হেজাজ,
-একটা চাল এখনও বাকি আছে আমার কর্নেল।
-তুমি কি আমার সহযোদ্ধা ফেলিক্সের কথা বলছ? ও ইতিমধ্যে এদেশের সিমানা পেরিয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে দেখতে পার।
হাসি মুছে গেল হেজাজের মুখ থেকে। বলল,
-তাহলে পুরনো পদ্ধতিতেই দেখা যাক কে জেতে...
পিস্তলের ট্রিগার টানতে গেল কর্নেল হেজাজ। রায়ান কেবল নিজের হাতটা একটু ঝাঁকি দিল। স্যুটের হাতায় কায়দা করে লুকানো একটা চিকন পাইপের মতো ডার্টগান থেকে ডার্ট বেরিয়ে হেজাজের হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিল।
রায়ান বলল,
-খেলতে গিয়ে তোমরা বারবার ভুলে যাও যে এ খেলার সবচেয়ে পুরনো খেলোয়াড় আমি।
হেজাজের লাশটা তার পেছনের সোফায় ঢলে পড়ল। হাত থেকে পিস্তল খসে পড়ল সিআইএ ডিরেক্টর লরেন্স হার্ডের। মিশরীয় আর্মি অফিসারের দিকে ফিরল রায়ান,
-ক্যাপ্টেন, ঝামেলা যেহেতু শেষ তাহলে আমার একটা ছোট উপকার করুন।
হেসে বলল ক্যাপ্টেন আহমেদ,
-নিশ্চয়ই স্যার।
-বেডরুমের আলমারিতে যে ডকুমেন্টসগুলো রাখতে বলেছিলাম তা নিয়ে আসুন।
বেরিয়ে গেল ক্যাপ্টেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা চিকন ফাইল নিয়ে হাজির হয়ে গেল। ফাইলটা হার্ডের সামনে টেবিলে রাখল রায়ান। হার্ড বসতে যেতেই হাঁহাঁ করে ছুটে এল ক্যাপ্টেন। হার্ডকে সার্চ করে কয়েকটা ইমারজেন্সি ট্রান্সমিটার বাটন বের করে নিল। এরপর বসতে দিল। নীরস মুখে বসল হার্ড। জানতে চাইল,
-এতে কি লেখা আছে?
-লেখা আছে তুমি, মানে সিআইএ মিশরকে যেভাবে যেভাবে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করেছ তা তুমি ক্ষমাপার্থনাপূর্বক ফিরিয়ে নিচ্ছ।
-তা করার ক্ষমতা আমার নেই।
-তোমাকে আমি কিছু বলতে বলিনি। কার ক্ষমতা আছে এবং কি করতে হবে তা আমার জানা আছে। নিজের কাজ করো।
-করব না সাইন।
-বাচ্চাদের মতো জেদ করোনা হার্ড। তোমাকে বাচিয়ে রাখার কোনও কারণ নেই আমার, নিতান্তই দয়া করে তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তুমি সাইন করো, আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
দু চোখ চকচক করে উঠল হার্ডের। বলল,
-তুমি তার ত্রিসীমানায়ও যেতে পারবে না।
-আই নো মাই গেম। লাস্ট চান্স, সাইন অর ডাই।
-ইটস আ চ্যালেঞ্জ।
খসখস করে সাইন করে দিল হার্ড। ক্যাপ্টেনের কানে কানে বলল রায়ান,
-ঠিক সময়ে কলটা যেন করে, খেয়াল রেখ।
-আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
ফাইলটা ডিফেন্স মিনিস্টারের কাছে দিয়ে বেরিয়ে গেল রায়ান। ওর এখানকার কাজ আপাতত শেষ। সোজা পথেই বেরিয়ে এল। ডিফেন্স মিনিস্টার সিকিউরিটির কাছে মেসেজ পাঠিয়ে দেয়ায় কোনও বাঁধা আসল না। বাহিরে বের হয়ে একটা নির্দিষ্ট নাম্বারে কল করল রায়ান,
-তুষার, কাজ হয়ে গেছে। কেটে পরো।
-ওকে। বাই দ্যা ওয়ে, খেলাটা দারুণ ছিল।
ঢাকার মিটিঙের দিনের কথা মনে পড়ল রায়ানের। সেদিন মিটিং শেষ করে স্টেডিয়ামে চলে এসেছিল ও। সেখানে সাধারন দর্শকদের গ্যালারিতে অপেক্ষা করছিল তুষার। রায়ান পৌছতে কিছুটা অবাক হয়েই জিগ্যেস করেছিল ওখানে দেখা করার কারণ। রায়ান জবাব দিয়েছিল,
-সবচেয়ে গোপনীয় জায়গা হল মানুষের ভিড়ে। তুমি গায়েব হয়ে যেতে চাও? স্রেফ মানুষের ভিড়ে মিশে যাও।
-ও।
-তোমার পরিচয় ওরা কেউ জানেনা। সুতরাং ওরা তোমাকেই হায়ার করবে আমাকে শেষ করার জন্য। সো গুড লাক।
-সেইম টু ইউ।
উঠে আসার আগে বলেছিল তুষার,
-মানুষগুলোকে দেখ, এরা সবাই ভাবছে আধুনিক যুগে দেশেদেশে যুদ্ধ চলছে এই খেলার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু আসলে আড়ালে কি হচ্ছে তার সম্পর্কে এদের কোনও ধারনাই নেই।
হেসে জবাব দিয়েছিল রায়ান,
-তাতে কি? এরা কেউ জানেনা চারপাশে কত রকমের বিপদ আছে যা তাদের অজানা, কত কিছু ঘটছে, প্রতিদিন কতবার তাদের জীবন বাঁচছে, কতবার জীবন হুমকির মুখে পড়ছে তা এরা কেউ জানেনা। এজন্য তারা আমাদের মতো মানুষদের চেয়ে অনেক ভাল আছে। এখন তুমি বল না জেনে তারা যদি ভাল থাকে তাতে ক্ষতি কি?
মতভেদ হয়নি ওদের। কিছুক্ষণ পর অন্যদের সাথে ওরাও খেলায় মগ্ন হয়ে গেল। খেলা পুরোটা না দেখে চলে এসেছিল রায়ান। তুষার নিশ্চয়ই সেটার কথাই বলছে। কিছু না বলে হাসল রায়ান। কল কেটে দিল।








সিচুয়েশন রুম, হোয়াইট হাউজ।
ডিফেন্স সেক্রেটারি, ভাইস প্রেসিডেন্টসহ বেশ কিছু মানুষ উপস্থিত। এদের গুরুত্ব বুঝাতে হলে বলতে হয় এরা একসাথে মানুষের মধ্যে পুরো দুনিয়ায় ছড়ি ঘোরাতেন এতদিন। ঠিকই বলা হল “এতদিন”, আর নয়। যদিও তারা এ সম্পর্কে এখনও কিছুই জানেন না। বর্তমানে তারা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একটি নির্দিষ্ট জবাবের জন্য। অনেকের চেহারাতেই অধৈর্য ভাব ফুটে উঠেছে। হঠাৎ পরিস্কার শোনা গেল সিআইএ ডিরেক্টরের গলা। অপারেশন সাকসেসফুল, প্যাকেজ উদ্ধার করা হয়েছে, এজেন্ট রায়ান কনফার্মড ডেড।
সবার চোখেমুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ একে অপরের পিঠ চাপড়ে বাহবা প্রদান করল। নিজেদের দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন টীমকে ফিরে আসার নির্দেশ প্রদান করা হল। সবাইকে বিদেয় জানিয়ে নিজের পার্সোনাল অফিসে রওনা হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। এতো রাতে চারিদিক শান্ত, প্রেসিডেন্ট এখনও তার অফিসে আছেন। তাকে রিপোর্ট করে তিনি বাড়ি যাবেন। অফিসে ঢুকে বললেন,
-আমাদের কাজ শেষ হয়েছে স্যার।
-রেজাল্ট?
-সিআইএ এর উপর হামলা করা এজেন্সির হেড রায়ান মারা গেছে। আমাকের চুরি যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলোও পাওয়া গেছে।
-দ্যাটস গুড। আর কিছু?
-না স্যার, দ্যাটস অল।
-ওঁকে। গুড নাইট।
ভাইস প্রেসিডেন্ট চলে যেতেই আবার ফাইলে মনোনিবেশ করলেন প্রেসিডেন্ট। হঠাৎ বাহিরে কিসের যেন শব্দ হল। উঠে করিডরে ঘুরে দেখে এলেন, কেউ নেই। ফিরে এসে ভেতরে ঢুকে দরজা লক করে দিলেন। পিছনে ফিরে ডেস্কের দিকে চেয়েই জমে গেলেন তিনি। মুখ থেকে একটা শব্দই বের হল প্রেসিডেন্টের,
-ফিনিক্স!
এক পলকে অতীতে ফিরে গেলেন প্রেসিডেন্ট।

সময়টা ১৯৫৭ এর সেপ্টেম্বর,
প্রাক্তন এক এসএএস কর্নেল এবং ব্রিটিশ আর্মির একজন এক্স মেজর বসে আছে বারান্দায়। ঘরের ভেতরের রেডিও থেকে ভেসে আসছে নিত্যনতুন খবর। বলা বাহুল্য সেখানে অরাজকতার খবরই বেশী। কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল মেজর জেসন স্ট্যালিয়ন। হঠাৎ বললেন কর্নেল,
-তোমার কি মনে হয়, এসবের পেছনে কাদের হাত আছে?
-স্যার, আমি যেসব রিপোর্ট পেয়েছি তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যুদ্ধের প্রাক্তন যোদ্ধাদের কেউ কেউ বিপথে চলে গেছে। তারাই সংঘবদ্ধ অথবা আলাদাভাবে বিভিন্ন জায়গায় এসব খুন, বোমাবাজি করে ফিরছে।
-আমার কিন্তু অন্যরকম রিপোর্ট আছে। ভেতরে এস।
কর্নেলের পিছুপিছু তার কাজের ঘরে এসে ঢুকল জেসন। পুরো ঘর বিভিন্ন ডোশিয়ে, ছবি, পেপার কাটিং দিয়ে ভরা। তাদেরকে একটা আরেকটার সাথে কানেক্ট করে দিয়েছে বিভিন্ন ফিতে। কর্নেল বললেন,
-যাদের ছবি দেখছ তারা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় হামলাকারী দলের লিডার। তাদের যে কোনও একজনের সাথে লাগানো ফিতে অনুসরণ করো।
একজনের ফিতে ধরল জেসন, অনুসরণ করে একটা পেপার কাটিঙয়ে এসে থামল। কর্নেল বলল,
-জুরিখের ব্যাংকে হামলা, অগনিত টাকা লুটপাট, ব্যাংক কর্মকর্তা সবাইকে প্রকাশ্যে খুন, কাগজ ও দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে। এরপরের পয়েন্টে যাও।
জেসন সুতো ধরে আবার আরেক কাটিঙে এসে থামল। তবে এটা কোনও পেপার কাটিং নয়, এটা কোনও সরকারি ডকুমেন্ট। কর্নেল আবার বললেন,
-নব্য সিআইএ-র জুরিখ শাখায় হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে ফান্ড বৃদ্ধি। তারিখ আগের ঘটনার এক সপ্তাহ পর।
কর্নেল কি বুঝাচ্ছেন বুঝতে পেরে হা হয়ে গেল জেসন। আরেকটা ফিতে ইংগিত করল কর্নেল। জেসন ওটাকে অনুসরণ করতে বললেন,
-সিআইএ ইনভেস্টিগেশনের জন্য প্রাক্তন জার্মান তেল ও খনিজ মন্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিল। বিধ্বস্ত অবস্থায় সেই মন্ত্রীকে বের হয়ে আসতে দেখা যায় ওদের অফিস থেকে।
জেসন ফিতের নেক্সট পয়েন্টে গেল। কর্নেল বললেন,
-বাসে বোমা হামলা সন্ত্রাসীদের, দশজন মৃতের মধ্যে একজন সেই মন্ত্রী। এসবই শেষ নয়। নব্য নাৎসি বল আর পুরাতন নাৎসি বল, তাদের পেছনে আছে নবজাত কেজিবি। দুই সুপারপাওয়ারের মাঝে পড়ে বাকি দুনিয়া অতিষ্ঠ।
-এখানে আমাদের কি করার আছে, স্যার?
-হোয়াট উই ডু বেস্ট। উই প্লে।
রক্ত ঠাণ্ডা করে দেয়া হাসি দেখা গেল কর্নেলের মুখে। কিছুদিন এদিক-ওদিক ঘুরে কর্নেল তার সঙ্গিসাথি যোগাড় করলেন। তাদের মধ্যে একজনের নাম জানা যায়, ফেলিক্স হুয়েরা। তারপর একের পর এক খুন হতে লাগল করাপ্টেড সিআইএ অফিশিয়ালস, কেজিবি অফিসারস। একটা মার্ক ছিল এই কর্নেলের কাজের, কাজ সারার পর প্রমান সহজে নষ্ট করতে সব জ্বালিয়ে দিত। তাই অনেকে তাকে প্রাচিন মিথ এর ফিনিক্স পাখির নামে ডাকত। ফিনিক্সের ছোঁয়ায় যেমন সব পুরে ছারখার হয়ে যায় তেমনি তিনি পুড়িয়ে শেষ করতেন সব ভয়াবহ অপরাধীদের। কোনও নাম ছিল না এই টিমের, ছিলনা কোনও নির্দিষ্ট সদস্য সংখ্যা। এরা ছিল গোস্ট অপারেটর, কিলার, ডেস্ট্রয়ার, অ্যাসাসিন। শুধু সিআইএ কেজিবি নয়, অনেক দেশই অরাজকতার সুবিধা নিচ্ছিল। তাদেরও ছেড়ে কথা বললেন না কর্নেল। বিপক্ষ দলেরা তাদের কোনও হদিসই বের করতে পারছিল না। ফিনিক্স এবং তার দল কাজ করে যেতে লাগল নিভৃতে। দেখতে দেখতে করাপ্টেড সংস্থাগুলোর বেশির ভাগ ধ্বংস হয়ে যাবার পর তারা বাধ্য হয়ে পুরো ঘটনা জাতিসংঘের কাছে স্বীকার করে সাহায্য চাইল। প্রধান সদস্য দেশগুলোর এ অবস্থা হওয়ায় জাতিসংঘও অনুরোধ ফেলতে পারল না। তারা গোপন বৈঠকে বসতে চাইল ফিনিক্সের সাথে। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে হাজির হল সিআইএ প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিজে, কেজিবি প্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব সহ আরও দুয়েকজন হর্তাকর্তা। সবশেষে প্রবেশ করল নতুন কিংবদন্তী সৃষ্টি করা ফিনিক্স! তার ব্যক্তিত্ব এতো ধারালো যে ঘরের এতো এত হোমরাচোমরা লোকেরাও দাঁড়িয়ে গেল। সেই বৈঠকে ফিনিক্স চুপচাপ বসেছিলেন। জাতিসংঘের মহাসচিবের অনুরোধে সংশ্লিষ্ট করাপ্টেড বাহিনীর প্রধানেরা নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন চতুরভাবে, কারণ তারা জানেন এ ঘরের কথা বাহিরে কখনই যাবে না। এখান থেকে বের হবার পর জীবিত থাকবে না ঐ ফিনিক্স। নব্য সিআইএ ডিরেক্টর সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম। তিনি জানালেন তাঁর অজ্ঞাতে এসব ঘৃণ্য কাজ করা হয়েছে। সেজন্য তিনি লজ্জিত এবং করাপ্টেড সব অফিশিয়ালদের শেষ করায় তিনি ফিনিক্সকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন। ফিনিক্স কেবল একবার তার মুখের দিকেই একবার চাইলেন। সবার কথা শেষে ফিনিক্স মুখ খুললেন। তিনি শুধু তাঁর দাবিগুলো বলে গেলেন, সবাই শুনল। সবাই সুস্থ এসপিওনাজ জগত পরিচালনা করবেন এই ছিল তার অন্যতম দাবী। সবাই এতো সহজে সমস্যা সমাধান হচ্ছে দেখে খুশিই হল। চুক্তিতে সই করলেন সবাই। মিটিং শেষে বের হয়ে গেল সবাই। সেদিনই এক গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেল কিংবদন্তির শেষ ফিনিক্স।
গম্ভীর স্বরটা বাস্তবে ফিরিয়ে আনল প্রেসিডেন্টকে,
-আহ! মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমাকে চিনেছ দেখছি! প্লিজ সিট।
প্রেসিডেন্ট বসতে বসতে একটা হাত চেয়ারের হাতলের কাছে নিয়ে গেলেন, একটা গোপন সুইচে চাপ দিলেন। আগন্তুক আবার বলল,
-তোমার লোকেরা আমাকে কিছুতেই দেখা করতে দিচ্ছিল না তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই চলে এসেছি, অনুগ্রহ করে ক্ষমা করবে। তোমার অবগতির জন্য জানান যাচ্ছে যে এই রুমের সমস্ত অ্যালার্ম, ক্যামেরা, সেন্সর সবগুলোরই ব্যবস্থা করা হয়েছে, এমনকি তুমি যে সুইচটায় চাপ দিলে সেটারও।
মৃদু হাসি দেখা গেল প্রেসিডেন্টের মুখে। বললেন,
-দেখা যাচ্ছে তুমি একটুও বদলাওনি।
-ভুল, আমি বদলেছি, অনেক বদলেছি সময়ের প্রয়োজনে।
-কি চাও তুমি?
-কাজের কথায় আসা যাক, আমি যা বলছি তা মন দিয়ে শোন।
এই বলে চুপচাপ নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বলল রায়ান। চুপচাপ শুনল প্রেসিডেন্ট। রায়ানের কথা শেষ হতে চিন্তায় দুবে গেলেন বেশ কিছুক্ষনের জন্য। তারপর বললেন,
-তুমিই এজেন্ট রায়ান?
মনে হল প্রেসিডেন্টের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। তা দেখে বলল রায়ান,
-এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাস আরেকবার খেলা দেখাল। সিআইএ তোমার চেয়ে ভাল ডিরেক্টর এবং আমেরিকা তোমার চেয়ে ভাল প্রেসিডেন্ট আর পায়নি, পাবেও না। আবারও তোমার অধিনস্তরা গোপনে কি করেছে তা তুমি জানতেও পারনি। তোমার ব্যর্থটা। এখন বল তুমি কি করতে পার?
-আমাকে দুমাস সময় দাও।
-দুমাস তোমাকে দেয়া হল। আশা করব তুমি তোমার ভালর জন্যই আমাকে দেয়া কথা রাখবে।
প্রেসিডেন্টকে ঐ অবস্থায় রেখেই বেরিয়ে এল রায়ান। হোয়াইট হাউজ থেকে বেরিয়ে এল রিনিসের দেয়া আইডি ডিটেইল ইউজ করে। আনিস সফলভাবে রিনিসের ফলস আইডেন্টিটি বানাতে পেরেছিল। এরপর রিনিস হোয়াইট হাউজে কাজ করা শুরু করে আর রায়ানের ভেতরে ঢোকার পথ তৈরি করে। কিছুদূর হেঁটে আগাতেই একটা গাড়ি এসে থামল পাশে। রায়ান উঠে বসতেই ছুটে চলল হাইওয়ে ধরে। ড্রাইভিং সিটে শায়খ, পাশে তুষার, পেছনে রায়ান আর রিনিস। রিনিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তুষারের,
-এই হল আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাই। তুষার। অবশ্য স্নো নামে ওকে তোমার চেনার কথা।
অবাক হয়ে বলল রিনিস,
-স্নো মানে, দ্যা হিটম্যান?
-ইয়েস, হি ইজ দ্যা হিটম্যান। আসলে অনেকেই যেটা জানেনা সেটা হল ও কখনও নিরপরাধ কাউকে মারেনা। যাদের মারা দরকার, বেঁচে থাকার যোগ্যতা যারা হারিয়েছে তাদেরকেই কেবল ও খুন করে। আর আমি ওর জন্যে গর্বিত।
হাসল রিনিস। এতক্ষনে হাত বাড়িয়ে দিল তুষারের দিকে,
-নাইস টু মিট ইউ।
পেছনে ঘুরে হাত বাড়াতে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল তুষার,
-ওয়াচ আউট!
হঠাৎ উদয় হল এক লরি। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই রিনিস যে পাশে ছিল সেই পাশেই প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মেরে রাস্তার পাশের খাদে ফেলে দিল সেডানকে। ড্রাইভার নেমে এসে একবার উল্টে পড়া সেডানকে দেখে নিয়ে, এক পশলা গুলি ছুঁড়ল সেডানের গায়ে। এরপর লরিতে চরে রওনা হয়ে গেল স্বাভাবিকভাবে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রক্তাক্ত শায়খ আর তুষার। অচেতন রায়ান আর রিনিসকে টেনে বের করে হাইওয়েতে এসে একটা গাড়ি ছিনতাই করে কাছাকাছি হাসপাতালের দিকে ঝড়ের গতিতে রওনা হল।

হাসপাতালের করিডরে অসহায়ের মতো পায়চারী করছে শায়খ। তুষার চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ডাক্তার বেড়িয়ে এলেন। ওদের প্রশ্নের জবাবে জানালেন অপারেশন চলছে, ওদের আল্লাহ-কে ডাকতে বলে গেলেন। শায়খ আরও অস্থির হয়ে পড়ল। তুষার ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরই মাঝে তুষার ঘণ্টা খানেকের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর ফিরে এসেছে। কিছু জিগ্যেস করেনি শায়খ, অনুমান করতে পারছে কোথায় গিয়েছিল। অপারেশন শেষ হল। ডাক্তার জানালেন অপারেশন সাকসেসফুল। এখন রায়ানের জ্ঞান ফিরবে কিনা তার উপর বাকিটা নির্ভরশীল। এদিকে সকাল হয়ে গেল। রায়ানের জ্ঞান ফেরার নাম নেই। হাসপাতালের প্রবেশমুখের দিকে তাকাল শায়খ। এই মাত্র ভেতরে ঢোকা এক বৃদ্ধের উপর চোখ আটকে গেল ওর। তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, কাঁচাপাকা ভুরু, ঋজু হাঁটার ভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব যেন তার চারিদিকে পাহাড়ের মতো গড়ে উঠেছে। উনি রিসেপশন থেকে রুমনাম্বার জেনে রায়ানের কেবিনে ঢুকে গেলেন। শায়খ কেবিনে ঢুকতে চাইলে বাঁধা দিল তুষার। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল শায়খ। তবে তুষার কিছু বলল না। ওরা নিঃশব্দে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। রায়ানের পাশে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে পড়লেন ভদ্রলোক। শায়খরা সরে দাঁড়াল। ওদের দিকে তাকিয়ে মাথাটা মৃদু ঝাঁকিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।

বিশমিনিটের মাথায় জ্ঞান ফিরল রায়ানের। মনের ভিতর যেন সেই চেনা বজ্রকন্ঠ শুনতে পেয়েছিল সে। জ্ঞান ফিরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ছোট দুই ভাইকে। তবে দামী ইউরোপিয়ান চুরুটের মিষ্টি গন্ধ ওর নাককে এড়াতে পারল না। জ্ঞান ফিরেও উঠতে পারল না রায়ান। ওর শরীরের রিকভার করা এখনও অনেক বাকি। ওদেরকে জিগ্যেস করল রায়ান,
-রিনিস?
চেহারায় মেঘ জমল ওদের দুজনের। শেষে শায়খই মুখ খুলল,
-ডাক্তাররা কিছু করতে পারেনি, সরি।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে চোখে আগুন নিয়ে তুষারের দিকে চাইল রায়ান। ছোট করে মাথা ঝাঁকাল তুষার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে ফিরল রায়ান। চোখের কোনে পানি এসে গেলেও ওদের দেখতে দিতে চায় না। কেবিন থেকে বেরিয়ে এল শায়খ আর তুষার। অচেনা বৃদ্ধের পরিচয় অজানাই রইল শায়খের কাছে।

নির্ঘুম রাত পার করল প্রেসিডেন্ট। সকালে জরুরি মিটিং কল করল। প্রথমেই ডিফেন্স মিনিস্টার জানালেন নতুন সিআইএ ডিরেক্টরের মৃত্যুর খবর। লাশের ছবি দেখে অনেকেই শিউরে উঠলেন। মৃত্যুর কারণ কেউ উল্লেখ করল না। এরপর প্রেসিডেন্ট তার ডিসিশন জানালেন। সাথে সাথে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। তবে সেদিন থেকে দুমাসের মধ্যে ঐ কন্ট্রোলারদের সবাই একমত হলেন যে ঐ মিসাইলগুলোর কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা ছিল তাদের করুন পরিণতিও মত বদলানোর প্রধান একটি কারণ। তারা খুব ভালভাবেই গত দুমাসে বুঝতে পেরেছে, নোবডি ইজ সেফ। তাদের মত হল, খেলা যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক, বাড়তি কিছুর দরকার নেই।

পড়ন্ত বিকেল। মালিবুতে এক প্রাসাদসম বাড়ির বাগানে একটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুদর্শন এক যুবক। যুবককে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। যেন কেউ তার কাছ থেকে খুব আপন কিছু কেড়ে নিয়েছে। সূর্য ধীরেধীরে ডুবে গেল। হাতের কাল গোলাপগুলো নামিয়ে রাখল সে কবরের হেডস্টোনের কাছে। এরপর ঘুরে বাড়ির দিকে রওনা হল। বিষণ্ণ ভাবটা এখন আর বোঝা যাচ্ছে না। যুবকের পেশায় এসব অনুভুতির কোনও স্থান নেই। টানা, দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে সে বাড়ির দিকে। সাঁঝের আলোয় কেবল তার পাথরের মতো অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে।
সে রায়ান, এজেন্ট সৌরভ রায়ান।
তেমন কেউ না, অতি সাধারণদের মাঝে শুধুই একজন অসাধারণ...।।

রাইটার্স কনফেশনঃ রায়ান সাহেবের সাথে একদিন আড্ডা দেয়ার সময় হঠাৎই মাথায় আসে এজেন্ট রায়ান লেখার আইডিয়া। নামটা তখনও জানা ছিল না। এরপর দুজনে মিলে প্ল্যান করলাম এজেন্ট রায়ানের। ব্যাকগ্রাউন্ড, বেসিক, পাওয়ার ইত্যাদি, ইত্যাদি। যাই হক। প্রায় এক বছর হয়ে গেল বোধহয় এজেন্ট রায়ানের। আজ শেষ গল্প পোস্ট করে দিলাম। আর এই পুরো সিরিজটা উৎসর্গ করলাম ওয়ান এন্ড অনলি সৌরভ ভাইজান -কে।

***এই গল্পটা লিখতে এবং লিখার পরে ডেভেলপ করতে ব্লগার চশমখোর ভাই অনেক হেল্প করেছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। :)

আদিওস এজেন্ট রায়ান।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×