somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার হজ্বের দিনগুলি- ০৮ (হজ্ব ২০০৭)

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৫:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আরাফাতের ময়দানে

হজ্ব হচ্ছে আরাফাহ্, আরাফাহ্ হচ্ছে হজ্ব---রাসূলুল্লাহ (সঃ)।
হজ্বের সবচেয়ে গুরু্ত্বপূর্ণ আহকাম হলো আরাফাতের ময়দানে সারাদিন অবস্থান। আর আমার কাছে সৌদি আরবে হজ্ব উপলক্ষ্যে যতদিন ছিলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল আরাফাতের দিন। লক্ষ লক্ষ মানুষ এদিন তাদের যাবতীয় অহংকার বিসর্জন দিয়ে কেবল দু টুকরো কাপড় পড়ে আল্লাহর সামনে হাজির হয় আর নিজেদের অপরাধের কথা স্মরণ করে কান্নাকাটি করতে থাকে। এ এক অবিস্মরণীয দিন, অবিস্মরণীয মুহুর্ত, শুধু টিভিতে দেখে এদিনের মাহাত্ন বোঝা যাবেনা। নিজে যেদিন যাবেন কেবল সেদিনই বুঝতে পারবেন, আর বুঝলে পরবর্তী জীবনে বারে বারে এই ময়দানে ফিরে যেতে ইচ্ছা করবে (হজ্বে)

আমরা মিনা থেকে রওনা দেই আগের দিন রাতে। যদিও সকাল বেলা যাওয়ার নিয়ম কিন্তু এখন ভীড়ের কারণে রাতেই রওনা দেন বেশীর ভাগ হাজ্বী। বাসে বেশ ভীড় ছিল, সবাই সীট পায়নি এদের মধ্যে আমিও ছিলাম। কিছু মহিলাও দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন, এ নিয়ে যাত্রীদের মাঝে কয়েক দফা বচসাও হয়ে গেল। প্রচন্ড যানজটের মধ্য দিয়ে বাস যাচ্ছিল এবং বেশ ঘোরা পথে যেতে হচ্ছিল। আধ ঘন্টার পথ যেতে প্রায় ৩ ঘন্টা লাগল। আরাফাতে পৌছে আরেক বিপত্তি, সঠিক তাঁবু খুজে বের করতে হবে। আমরা ৭৮ নং মুয়াল্লিমের হাজ্বী, কাজেই আমাদের ৭৮ নং সাইনবোর্ড ওয়ালা তাঁবু খুঁজে বের করতে হল। এই করতে করতে ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেল। আরাফাতের ময়দানের তাঁবু মিনার মত স্থায়ী নয়, তাই সুযোগ সুবিধাও একটু কম। বাথরুম টয়লেট মিনার চেয়ে একটু কমই বলা চলে।

শুনেছিলাম আরাফাতে অনেক খাবার জিনিস ফ্রী দেয়া হয়, বাসে থাকতেই তা টের পেলাম। আমাদের বাস থেকে একজন গিয়ে বেশ কয়েক বোতল লাবান (প‌্রক্রিয়াজাত মাঠা, সৌদিতে অত্যন্ত জনপ্রিয়) নিয়ে এল। ঝোঁকে পড়ে আমিও কয়েক বোতল নিয়ে এলাম, নিজে খেলাম কিছু, আশে পাশে বিলালাম।

তাঁবুতে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে আর শরীরে কুলালো না, ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাংলো ৯ টার দিকে। হাল্কা কিছু নাস্তা করে কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম আরাফাতের লক্ষ জনতার মাঝে। এখানে বলে রাখা ভাল, বাংগালী হাজীরা বেশীর ভাগই আরাফাতে তাঁবু থেকে বের হয়না- হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে। যার কারণে এই বিশাল জনসমুদ্রের সৌন্দর্য্য তারা কিছুই উপভোগ করতে পারেননা। কিন্তু আমার তো মিনার ময়দানে ব্রেক ছাড়া ঘোরাঘুরি করে আগেই সাহস বেড়ে গেছে। আমি নিশ্চিন্তে এগিয়ে চললাম।

কিছুদূর এগিয়েই চোখে পড়ল 'জাবালে রহমত'- যে পাহাড়ের উপর আল্লাহর রাসুল বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়ে ছিলেন। পুরো পাহাড় মানুষে ছেয়ে গেছে এহরামের সাদা কাপড় পড়া লাখো মানুষে, যে কারণে সাদা দেখাচ্ছে দূর থেকে। মনে মনে ঠিক করলাম আগে ওখানেই যাব। কিন্তু তাঁবু থেকে বের হয়েছি, ঠিক ঠাক মত ফিরে তো আসতে হবে। মিনায় পথ হারানোর ঘটনা মনে ছিলো। তাই একটা পাহাড়কে ঠিকানা বানালাম যার গায়ে একটা সিঁড়ি ছিল। এই সিঁড়ি ওয়ালা পাহাড় হবে আমার পথ নির্দেশক (যদি পথ হারিয়ে যাই)।

পথে অনেককে দেখলাম ফ্রী খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত। আমি এগিয়ে চললাম জাবালে রহমতের দিকে। রাস্তা গুলো খুব সুন্দর, জায়গায় জায়গায় ইংরেজী এবং আরবীতে দিক নির্দেশক কথা বার্তা লেখা আছে। অনেক দূর হেঁটে একটা মোড়ের মত পেলাম। একদম পাহাড়ের ঢালে, সেখান থেকে রাস্তা গেছে আরাফাতের ময়দানের একেবারে ভেতরের দিকে। এই জায়গাটা ভাল করে চিনে রাখলাম। প্রায় ১ ঘন্টা হেঁটে জাবালে রহমতে পৌছলাম। লোকে লোকারণ্য, উপরে উঠার তেমন কোন রাস্তা দেখলাম না। সেই সাথে মনে পড়লো আরাফাতের ময়দানে আরেকটি জায়গা আছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ- মাসজিদে নামিরা। ঠিক করলাম এই মসজিদে যাব। হজ্বের দিন এই মসজিদে যোহর এবং আসরের নামাজ একসাথে জামাতে আদায় করা হয়, সকল হাজ্বী এই নামাজে শরীক হন।

যদিও খুব গরম ছিলনা কিন্তু একটানা হাঁটার কারণে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আধা কেজি আঙুর কিনলাম, তারপর সেই আঙুর খেতে খেতে এগিয়ে চললাম মাসজিদে নামিরার পানে। এখন ভাবলে খুব মজা লাগে, আরাফাহর ময়দান, আমি এক তরুণ বাংলাদেশী এক ঝোলা আঙুর নিয়ে পথ চলছি আর একটার পর একটা খেয়েই যাচ্ছি। আঙুরের পর স্ট্রবেরীর একটা প‌্যাকেট কিনেছিলাম ৫ রিয়াল দিয়ে।

আসলে মাসজিদে নামিরা ঠিক কোথায় এ ব্যাপারে আমার স্পষ্ট ধারণা ছিলনা কিন্তু ভীড়ের মাত্রা দেখে বুঝতে পারছিলাম সঠিক পথেই এগুচ্ছি। সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত সামনে এগুনোর চেস্টা করে ক্ষান্ত দিলাম। রাস্তার পাশে কিছু তাঁবু ছিল তার পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়লাম। পরে জেনেছি নামিরার খুব কাছেই এসেছিলাম।

আরাফাতের মাঠে প্রচুর নিম গাছ আছে, লোকে বলে এগুলো নাকি জিয়াউর রহমান পাঠিয়েছিলেন। আর রাস্তার পাশে ল্যাম্প পোষ্ট গুলো থেকে খুব সূক্ষ ধারায় পানি ছিটানো হয়। সব মিলিয়ে গরম লাগেনা বললেই চলে। খুতবা শুরূ হলো, আরবী ভাষায় যেহেতু তাই খুব একটা বুঝলামনা। আমার আশেপাশে যারা বসে ছিল জিজ্ঞেস করে জেনেছি তারা সবাই ভারতীয়। একসাথে যোহর আর আছর নামাজ পড়লাম প্রায় ৪০ লক্ষ মুসলমানের বিশাল জামাতে। নামাজের পর আশপাশের সবাই এসে হাত মেলালো। ইসলামের বিশ্বভাতৃত্বের রূপ নতুন করে উপলদ্ধি করলাম।

এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিল, নামাজের পর আর না উঠে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবল দোয়ায় মশগুল থাকতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হলোনা। যেহেতু রাস্তার পাশে বসেছিলাম, মানুষ যাওয়া আসা করছিলো। এবার রওনা দিলাম জাবালে রহমতের দিকে.....আবার। মাঝে একটা কথা বলে রাখি, আরাফাতের ময়দানে যত মানুষ দেখেছি, জীবনে এত মানুষ আর কখনো দেখিনি, আর সেই মানুষের কত রূপ, কত বর্ণ, কত বৈচিত্র্য- নিজের চোখে না দেখলে এ জিনিস কখনো বোঝানো যাবেনা।

জাবালে রহমত পাহাড়ে কিছুদূর উঠলাম, তারপর অনেক্ষণ দোয়া করলাম পরম করুণাময়ের কাছে। সামনে থেকে এত ভীড় দেখেছিলাম যে মনে হয়েছিল পাহাড়ে উঠা এক প্রকার অসম্ভব। কিন্তু আমি বুদ্ধি করে পাহাড়ের পেছন দিকে গিয়ে দেখি কিছুটা ফাঁকা আছে সেখানে। রহমতের পাহাড় থেকে নেমে মনে হলো এবার তাঁবুতে ফেরা দরকার। কারণ সূর্যাস্তের পর বাস ছেড়ে দেবে, আর আমি যে ঠিকঠাক মত পথ চিনে ফিরতে পারব তারও তো কোন নিশ্চয়তা নেই। কিছুটা সময় আমাকে হাতে রাখতেই হবে 'পথ হারানোর' জন্য। এই সময় বেশ ক্ষুধা লাগল, খাবারের দোকানপাট তেমন চোখে পড়লোনা। আপন মনে হেঁটে চলেছি, এমন সময় ছোট একটা ভ্যান থেকে কে যেন ডাকলো 'সাবিল...সাবিল'। মিনার অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই ডাক যেখানে শোনা যাবে সেখানে ফ্রী খাবার বিলানো হবে। যে খাবার পেলাম ওই ছোট্ট ভ্যান থেকে তা প্রত্যাশারও অতীত, 'আল বাইক' এর ফ্রাইড চিকেন আর ব্রেড। (সৌদির সবচেয়ে জনপ্রিয় ফাষ্ট ফুড শপ হলো আল বাইক) পথে এক তরুণ জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো এই খাবার কোথায় পেয়েছি। পুরো খাবার পথে খেয়ে শেষ করতে পারিনি, তাঁবুতে গিয়ে শেয়ার করতে হয়েছে।

ফেরার পথে যা ভেবেছিলাম....পথ হারিয়ে ফেলেছি। যে পাহাড়কে ঠিকানা বানিয়েছিলাম আশেপাশে এত পাহাড় যে সবই একই রকম লাগে। যাহোক, কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর মনে হল সেই সিঁড়ি ওয়ালা পাহাড় খুঁজে পেলাম। পাহাড়কে ঠিকানা ধরে এগুতে লাগলাম। যখন সেই মোড়ে পৌছলাম, খুশীতে একটা ছোট খাট লাফ দিয়ে বসলাম। কনুই বাঁকা করে বললাম ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস।

বাসের ছাদে চড়ে যখন ছেড়ে যাচ্ছিলাম আরাফাতের মাঠ, আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে শুধু একটা কথাই বলছিলাম, আবার যেন এই পবিত্র প্রান্তরে ফিরে আসতে পারি, আবার যেন হজ্বের এই কাফেলায় শরীক হতে পারি।


সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৫২
৮টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×